মনিজা রহমান, নিউইয়র্ক : দুটো কিডনি নষ্ট ছিল। তবু হাসিমুখে সবার সঙ্গে মিশতেন তিনি। আগামী ৩১ জুলাই ৫৭ বছর পূর্ণ হতো। এমন কী বয়স হয়েছিল! কিসের এত তাড়া ছিল চলে যাওয়ার। নিঃসঙ্গ একাকী জীবনে নীরবেই চলে গেলেন তিনি। তিনি কিংবদন্তিতুল্য নৃত্যশিল্পী অনুপ কুমার দাস। নিউইয়র্ক নগরের ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টারশায়ারের শেষ মাথায় এক ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন। অসুস্থ বাবা-মা দীর্ঘদিন ধরে নার্সিংহোমে। তাদের নিয়মিত দেখতে যেতেন অনুপ কুমার। ছিলেন চিরকুমার। নূপুরের নিক্বণের সঙ্গেই যেন আজীবনের প্রেম। যে কারণে হয়তো আর কারও সঙ্গে মিতালি হয়নি।

২০ জুলাই সকালে অনুপ কুমারকে তাঁর ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায় দেখেন বন্ধু ব্রুস। মৃত্যুর কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, এটা জানা গেছে। ময়নাতদন্তের পরে জানা যাবে, কীভাবে ও কখন মৃত্যু হয়েছে তাঁর। নিউইয়র্ক শহরে তাঁর খুব কাছের একজন মানুষ ছিলেন বাফা সভাপতি ফরিদা ইয়াসমীন। দুজনে মিলেই ব্রঙ্কসে বাফা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফরিদা ফোনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘নয় বছর ধরে উনি আর আমি এক সঙ্গে বাফায় কাজ করছি। আমার পরিবারের সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে যেন নিজের ভাইকে হারালাম।’ তিনি বলেন, ‘অনুপ দাদা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। তাঁকে বহুবার বলেছি, আপনি যেহেতু একা থাকেন, আমাদের কাছাকাছি কোথাও বাসা ভাড়া নেন। তিনি আমাদের কথা শোনেননি।’

ফরিদা ইয়াসমীন বলেন, মঙ্গলবার (২১ জুলাই) অনুপ কুমারের ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল হাসপাতালে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন। নিজেই বাসায় ডায়ালাইসিস করতেন। ব্রুস নামে তাঁর বন্ধু ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে এসে নিয়ে যেতেন। ব্রুসের কাছে বাসার চাবি ছিল। তিনি সোমবার (২০ জুলাই) বন্ধুকে দেখতে দুপুর দুইটার দিকে গিয়ে ঘরে তাঁকে মৃত পড়ে থাকতে দেখেন। অনুপের মোবাইলের কললিস্ট দেখে ব্রুস তাঁকে ফোন করেন।

আপাতত অনুপ কুমারের মৃতদেহ মর্গে রাখা হয়েছে। কুইন্স বোরোর করোনাতে এক ফিউরানেলের সঙ্গে মরদেহ সৎকারের কথা হয়েছে। শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সেখানে কিছুক্ষণ মরদেহ বাইরে রাখা হবে।

অনুপ দাসের হঠাৎ মৃত্যুতে নিউইয়র্কে বাঙালি কমিউনিটিতে শোকের আবহ। তিনি নাচের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। তিনি যেভাবে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে শেখাতেন, সেটা ছিল অত্যন্ত বিরল। বাফার হয়ে চণ্ডালিকা-মায়ার খেলাসহ বহু নৃত্যনাট্যের নির্দেশনা দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রোগ্রাম শেষে দেখা যেত, তাঁর ছাত্রীরা অনুষ্ঠান শেষে নৃত্যগুরুর পায়ের ধুলো নিত।

অনুপ দাসের বোন আলপনা গুহ নিউইয়র্কে বাঙালি কমিউনিটিতে সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে পরিচিত। তাঁর স্বামী নিউইয়র্কের কমিউনিটি নেতা শিতাংশু গুহের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, অনুপ দাস ১৮ জুলাই জুমে ছাত্রীদের ক্লাস নিয়েছেন। আগের দিন ১৭ জুলাই ফোনে বাবা–মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। ১৯ জুলাই কারও সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর দুটি কিডনিই নষ্ট। সেই নিয়েই সব জায়গায় হাসি মুখে যেতেন। প্রতিদিন রাতে নিজের ডায়ালাইসিস নিজেই করতেন। ১৯ জুলাই গভীর রাতে ডায়ালাইসিস করার সময় সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয়। কারণ, সোমবার (২০ জুলাই) দুপুরে যখন আমরা ম্যানহাটনের হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাই, তখন ডাক্তার জানান, প্রায় ‘১০ ঘণ্টা আগে মৃত্যু হয়েছে অনুপের।

অনুপ কুমার একবার প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আসলে জীবনে আর কিছু হবেন, ভাবতে পারেননি। বয়স যখন ৩/৪ বছর, টিভিতে লায়লা হাসানের নাচের অনুষ্ঠান দেখে নিজেও নাচতেন। বড় হয়ে সেই লায়লা হাসানের সঙ্গেই কাজ করেছেন। তবে দিল্লিতে পাওয়া স্কলারশিপটাই অনুপ কুমারের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তার পায়ের তলার মাটি শক্ত করে। নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। বাংলায় অনার্স শেষ করার পরে স্কলারশিপটি পান। তারপর মাস্টার্স শেষ না করেই চলে যান ভারতে। প্রথম এক বছর ছিলেন শান্তিনিকেতনে। ওখানে কথাকলি ও মণিপুরী শিখলেও অনুপ কুমারের মন ভরছিল না। কারণ তাঁর শেখার আগ্রহ ভরত নাট্যম ও কত্থক নৃত্য। যে দুটি শাখা বিশ্বভারতীতে ছিল না। তাই চলে যান দিল্লি। সেখানে শ্রীরাম ভারতীয় কলা কেন্দ্রে লীলা স্যামসনের কাছে ভরত নাট্যম ও মুন্নালাল শুক্লার কাছে কত্থক শেখেন অনুপ কুমার। কত্থক নাচের জন্য আরেক গুরু রেবা বিদ্যার্থীর কাছেও কৃতজ্ঞ ছিলেন তিনি।

নৃত্যশিল্পী হিসেবে অনুপ কুমারের শ্রেষ্ঠ অর্জন ছিল বিরজু মহারাজ নির্দেশিত নৃত্যনাট্য ‘রঘুনাথ’ অংশ নেওয়া আর নির্দেশক হিসেবে ২০১৮ সালে কুইন্স থিয়েটারে ‘মায়ার খেলা’। নিউইয়র্কর মারজিয়া স্মৃতি আর অন্তরা সাহাই শুধু নয়, অনুপ কুমার দাস উপহার দিয়েছেন আরও অনেক নামকরা নৃত্যশিল্পী। বাংলাদেশের রিচি, চাঁদনী, রিয়া সবাই তাঁর হাতে গড়া। রিয়ার প্রথম কমার্শিয়ালের কোরিওগ্রাফি করেছেন তিনি। বাফার নৃত্যশিক্ষক থাকাকালে তাঁর কাছে কত্থক নাচ শিখেছেন মৌ, রতন, স্বপন, বেবী, তান্নার মতো দেশসেরা নৃত্যশিল্পীরা। শিবলী মোহাম্মদ, সোহেল রহমান, আনিসুল ইসলাম (হিরু), কবিরুল ইসলাম (রতন)—সবাই অনুপ কুমার দাসের সমসাময়িক নৃত্যশিল্পী ও বন্ধু। তাদের ছেড়ে নিউইয়র্কে চলে এলেও নাচ ছাড়েননি তিনি।

অথচ অনুপের পরিবারের কেউ নাচের মানুষ ছিলেন না। বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশের নায়িকা পূর্ণিমা সেন গুপ্তা তাঁর দূর সম্পর্কের পিসি। তিন ভাই ও এক বোনের সংসারে আর কেউ নাচ শেখেনি। চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে অমূল্য দাস আর সুপ্রিয়া দাসের কোল আলো করে জন্ম নেওয়া শিশুটি নিউইয়র্ক শহরে ব্রডওয়ে শো থেকে শুরু করে বহু জায়গায় কাজ করেছেন।

পিএস টু হান্ড্রেড স্কুলের শিক্ষক অ্যানি কাপুয়া ফেসবুকে ২০ জুলাই জানালেন, ‘আমি ওনার সঙ্গে স্কুলে কাজ করেছি। ওনার মতো চমৎকার মানুষ খুব কম দেখেছি। ছাত্র–ছাত্রীদের এত দরদ দিয়ে নাচ শেখাতেন যে, বলার নয়। ভারতীয় নাচ ও কোরিওগ্রাফি নিয়ে বহুবার কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। উনি নিউইয়র্ক বাঙালি কমিউনিটি নিয়ে খুব গর্বিত ছিলেন। খুব গর্ব ও ভালোবাসা নিয়ে তিনি সবার কথা বলতেন। ওনার আত্মার শান্তি কামনা করছি। আমাদের স্কুলের প্রত্যেকে তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত। তার খুব সুন্দর একটা মন ছিল।’

অ্যানা বাপুয়ার মতো পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বহু মানুষ শোক জানিয়েছে অনুপ কুমার দাসের মৃত্যুতে। উদীচী যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা সংগঠন তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।