কামাল কাদের : দিনটি আগুন ঝরা গ্রীষ্মের দুপুর। রাস্তার দু’পাশে লোকের চলাচলের ভীড় দৃশ্যমান, একজন আরেকজনকে ঠেলাঠেলি করে হাঁটছে। এরই মাঝে ট্রাফিক আলোর সামনে ছোট্ট মেয়েটি হাতে কয়েক গোছা বেলী ফুলের মালা নিয়ে চলন্ত গাড়ীর আরোহীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে, উদ্দেশ্য মালাগুলি বিক্রী করা। মেয়েটির বয়স বড়োজোর আট / নয় বছর হবে। শুস্ক চেহারা, শীর্ণকায় শরীর, কতদিনের পুরানো জামা গায়ে জড়ানো তা বোঝা কঠিন। উত্তপ্ত পিচ ঢালা পথে খালি পায়ে হেঁটে ক্রেতাদের পেছনে পেছনে ঘুরছে যদি কোনো হৃদয়বান ক্রেতা তার কাছ থেকে একটি মালা কিনে!!

নাসিমা আখতার সুগন্ধা, বাবার মালিকাধীন “আইডিয়াল ফুড ম্যানুফ্যাকচারিং” অফিসের চীফ এক্সজিকিউটিভ অফিসার। বয়স সাতাশ, সফল ব্যাবসায়ী। মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকে এসেছে তার এক বান্ধবীর সাথে দেখা করতে। বান্ধবীটিও ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা। ব্যাংকে ভিতরে ঢোকার মুহূর্তে সুগন্ধা এই করুণ দৃশ্যটি দেখতে পেলো। মেয়েটির এই অবস্থা দেখে সুগন্ধার মায়া জন্মালো। মেয়েটির সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলো, “এ বয়সে তুমি খেলাধুলা, লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কি কারণে এই ভরা দুপুরে ফুলের মালা বিক্রী করছো?” মেয়েটি বিনীত এবং শিষ্টাচারের সাথে জানালো, “একান্ত দায়ে পরে এই কাজটি করতে হচ্ছে ম্যাডাম। এখান থেকে কিছু দূরে এক বস্তিতে আমি, এক ছোট বোন এবং মাকে নিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকি। বাবা যখন ছিল, তখন কোনো মতে আমাদের জীবন, সংসার চলছিল। কিছুদিন আগে আমার বাবা আমাদেরকে না জানিয়ে হঠাৎ করে এক মহিলাকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ফলে মা মানুষের বাসায় ঝিয়ের কাজ এবং আমি এই ফুলের মালা বেচাকেনা শুরু করে দিই। মার একার আয়ে সংসার চলছে না, তাই মাকে সংসার খরচের জন্য কিছুটা হলেও সাহায্য করার চেষ্টা করছি। সুগন্ধা মেয়েটিকে আবার জিজ্ঞাসা করলো, “এই প্রখর সূর্যের তাপে নিশ্চয় তোমার তেষ্টা বা ক্ষিধে পেয়ে থাকবে। তোমার জন্য কিছু পানীয় বা খাবারের ব্যবস্থা করে দেব?” মেয়েটি আবেগের সাথে বললো, “ম্যাডাম, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, কিন্তু আমি তো কারো দান নেই না। যদি আমাকে সত্যি উপকার করতে চান, তাহলে আমার কাছ থেকে এই ফুলের মালাটি কিনে নিতে পারেন। তাহলেই আমি খুশি। এখন পর্যন্ত আজ একটি মালাও বিক্রী হয়নি, কি যে করি”! “ঠিক আছে”, এই বলে সুগন্ধা মেয়েটির কাছ থেকে সবগুলি মালা কিনে নিলো।

এরই মধ্যে মেয়েটির মা তার ছোট বোনটিকে সাথে নিয়ে সেখানে হাজির। সাথে খাবারের পুটলি। মেয়েটি মাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। ছোট বোনটিকে চুমো খেলো। তারপর রাস্তার এক কোণে ছায়ার কাছে গিয়ে সবাই বসলো। সুগন্ধা দেখলো মা মেয়েটি এবং বোনটিকে কত যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে। এই দৃশ্যখানা দেখে সুগন্ধা তার চোখে জল আটকাতে পারলো না। হাতের রুমালটা দিয়ে চোখের জল সংবরণ করতে চেষ্টা করলো। অফিসের ভিতরে ঢুকার সাথে সাথে সুগন্ধার বান্ধবী সুগন্ধার চোখের জল আঁচ করতে পারলো, জিজ্ঞাসা করলো, “তোর চোখে জল কেন?” মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসার যে ছবিটি এই মাত্র দেখলো সেটার বর্ণনা করে চোখের জলের কারণটা জানালো। বান্ধবীটি শুধু বললো, “পৃথিবীতে এমন কোনো ভালোবাসা নেই যা মায়ের স্নেহ-ভালবাসার সাথে প্রতিদ্ব›দ্বীতা করে জয়ী হতে পারে।”

সেদিন রাত্রে সুগন্ধা ডিনার শেষ করে নিজের বিছানায় এসে বসলো। অসহ্য গরম। সিলিং ফেনটা পুরো দমে চালিয়ে দিলো। শরীর এবং মন দুটিই শীতল হতে শুরু করলো। মন্থর গতিতে আজকের দেখা মেয়েটির কথা মনে পরে গেলো। মেয়েটির কিছু না থাকলেও ওর মা তো রয়েছে, এতো জীবনের সবচেয়ে পরম পাওয়া। সারাদিন হাড় ভাঙা খাটুনির পর যখন সে দিন শেষে মার বুকে মিশে যায়, তখন নিশ্চয় সেই খাটুনি আর খাটুনি থাকে না। সুগন্ধা নিজের কথা ভাবে। যখন তার বয়স তিন এবং ছোট ভাইটির বয়স নয় মাস, তখন তার প্রাণবন্ত মা হঠাৎ করে হার্ট ফেল করে মারা যান। মনে মনে কত প্রশ্নই রয়ে যায়, কিন্তু উত্তর মেলে না। এই দুঃখ তাকে আঘাত করে, সে কিছুতেই তা সামলাতে পারে না। যখন তার উনিশ বছর বয়স তখন থেকে তার মায়ের শুন্যতার উপলব্ধি বেড়ে যায়। মার বয়স যখন সাইত্রিশ তখন তিনি এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। মার এমন করে চলে যাবার ফলে পরিবারে সবাইকে গভীর ভাবে ধ্বংস করে দেয়, বিশেষ করে বাবাকে। কে এই অবুঝ দুটি সন্তানকে সামলাবে?

তিন বছরের মেয়ে সুগন্ধা কোনো অবস্থাতেই তার মাকে স্মরণ করতে পারছে না অর্থাৎ তার স্মৃতি কিছুই ধরে রাখতে পারে নাই। ছোট ভাই এবং বাবাকে নিয়ে সে ভাবতো এটাই বুঝি স্বাভাবিক জীবন। বাবা তাকে সন্তান হিসাবে সব কিছু উজাড় করে দিয়েছে, কোনো কিছুর কমতি রাখেনি, সেটা খেলার পুতুল অথবা ফুটবল সে যাই হোক। সুগন্ধা তার “টিনএজ” বয়সে অনুধাবন করতে শুরু করলো, একজন নারী হিসেবে তার একজন মহিলা অভিভাবকের দরকার, যে কি না এই পরিবর্তনশীল জীবনের তাকে পথ দেখাবে। ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে। যদিও সে এ জীবনে স্বাভাবিকভাবে চলার চেষ্টা করছে তবুও তার মনে হয় সে না পাওয়ার শুন্যতায় ভুগছে এবং নিজেকে রীতিমতো ধিক্কার দিচ্ছে মা হারানো বেদনায়।

সুগন্ধার কখনো মনে হয় মাকে পেলে জিজ্ঞাসা করতাম, “মা তোমার পছন্দের রং কোনটি, অথবা তোমার কোন খাবারটি ভালো লাগে, খুব বেশি হলে জিজ্ঞাসা করতাম, দেশের সিনেমার কোন নায়ককে তোমার পছন্দ হয়? আবার কখনো অনুশোচনা হয়, মনে হয় জীবনে এমন একটা জিনিস হারিয়েছি অথচ তাকে কখনো পাইনি। যে জিনিস পাইনি তা হারায় কিভাবে? আবার শোকার্ত হই, আবার ভাবি আমার মা তো আমার সাথেই রয়েছে। প্রকাশ্যে রাস্তায় জনতার ভীড়ে যখন দেখি একটা মা কি হৃদয়তার সাথে তার ছোট্ট মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে, তখন সে দৃশ্যটা দেখে মনে হয় কে যেন আমাকে বন্দুকের গুলির মতো আঘাত করলো, তখন মা হারানোর বেদনা দারুন কষ্টদায়ক হয়ে উঠে”। যখন সেই দুঃখী মুহূর্তটি কোনো সময়ে সুগন্ধার মাঝে এসে যায়, তখন নিজেকে সে আর সামাল দিতে বা কান্না চাপা দিতে পারে না, শুধু জলে তার চোখ দুটি ছল ছল করে কেঁপে উঠে। সুগন্ধার মার সংস্পর্শে যারা এসেছেন তাদের সাথে সে তার মার স্মরণীয় ঘটনাগুলি বেশ আগগ্রহের সাথে জানতে চায়। সে জানতে চায় তার বাবার সাথে মার কিভাবে পরিচয় হয়েছিল, মার শেষকৃত্যের সময় কত লোক মাকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলো, এতে হয়তো সে অনুমান করতে পারে মা সমাজে কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তার মা তাকে কত ভালোবাসতো সেটা শুধু জানতে পারে মার আত্মীয় এবং বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে, কিন্তু মার মুখ থেকে সে শুনতে পায়নি। হয়তো মা কানের কাছে এসে বলতো, “আমার সোনামনি আমি আমার জীবনের চাইতে তোমাকে ভালোবাসি”, তার দুর্ভাগ্য, এই কথাগুলো শুনার সুযোগ হয়নি।

অনেকে বলে সুগন্ধা তুমি দেখতে অবিকল তোমার মার মতো হয়েছো, এরকম প্রশংসা শুনলে তাকে মোহিত করে তোলে। কিন্তু তার মায়ের ব্যক্তিত্বের কথা কেউ উল্লেখ করে না। তার বাবাও তাই বলে, “সুগন্ধা, তোমার চেহারাটি দেখলে মনে হয় তুমি তোমার মায়ের ছায়া হয়ে আমার কাছে এসেছ। গাড়িতে অথবা যেকোনো অবস্থাতেই তুমি খুব সহজেই ঘুমিয়ে পড়তে পারো, যে স্বভাব তোমার মারও ছিল। তোমার মা তোমার জন্য একজোড়া সোনার চুরি বানিয়ে রেখেছে। তুমি যখন সেটা পর তখন মনে হয় তোমার মাকে আমি দেখছি”। এ সমস্ত কথা শুনলে তখন তার উদ্যমহীন মনটা কি যে ভালো লাগে। সে জানতে পারে তার মা খুব বুদ্ধিমতী এবং জ্ঞানী মহিলা ছিলেন। জীবনের চিন্তা ধারাটাকে উদ্বেগহীনভাবে গ্রহণ করেছিলেন, সুগন্ধা বরং তার উল্টোটা। সে সব সময়ে দুশ্চিন্তায় থাকে, কারো সাথে তার ব্যবহারে কোথায়ও ভুল হলো কিনা, সেই চিন্তা সপ্তাহ অথবা মাস অবধি থাকে। অনেক সময়ে তার দুঃখ হয়, কেন সে তার মার ব্যক্তিত্ব পায়নি, তাহলে সে খুব সুখীভাবে জীবন যাপন করতে পারতো, জীবনটা ভালোর দিকে চালাতে পারতো। সে মনে মনে মার কথা ভাবে, “যখন তুমি কারো দুঃখে নিজেকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দাও, যাকে কোনোদিন জানার সুযোগ ছিলো না, যাকে তুমি কোনোদিন জড়িয়ে ধরেছো, চুমু খেয়েছো, মনে করতে পারছো না, তবুও তার ছায়া কোলে নিয়ে দিন কাটাচ্ছ! তবুও তাকে ভুলতে পারছো না, একে কি বলা যায়? এরই নাম কি মাতৃত্বের ভালোবাসা?”

অবশ্য সুগন্ধা তার মাকে সব সময়ে স্মরণ করে না। যখন স্মরণে আসে তখন চারিদিক থেকে নানা জল্পনা কল্পনা জড়িয়ে ধরে। মন, মানসিকতা মাথার ভিতরে চাপের সৃষ্টি করে, এর ফলে নিজেকে তখন অসহায় মনে করে। পরিশেষে মনকে সান্ত¡না দেয়, “এই দুঃখের যন্ত্রণা আমাকে সারা জীবন জ্বালিয়ে যাবে”। কেউ যখন মারা যায়, তৎক্ষণাৎ সে দুঃখটা আমরা বুজতে পারি না, সময়ের সাথে সাথে সেই অভাবটা যখন বোধগম্য হয়, তখনই তো আমরা কান্নায় ফেটে পড়ি। সে তার মাকে ভালোভাবে জানে না, তবু কেন সমস্ত আবেগ এবং অনুভ‚তি তার মার প্রতি প্রকট হয়ে উঠে! সে নিজেকে প্রশ্ন করে “আমার জীবনটা কেন এমন হলো?”। কখনও অসংগত এবং অযৌক্তিক বিচারশুন্য ক্রোধ মনের ভিতর চাড়া দিয়ে উঠে, জানা শুনা অন্য কারো জীবনে এরকম ঘটনা তো ঘটেনি, তবে আমার বেলায় কেন? আমার কি অপরাধ ছিল? সে কোনো সদ উত্তর পায় না। একজন মানুষের প্রতিমূর্তির উপর তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, যার স্মৃতি তার জীবনে নেই, কেন তবে তার সানিধ্য পেতে, ছোয়া পেতে মন আনচান করে। যখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়, কোন কারণ ছাড়াই সে কন্নায় ভেঙে পরে, কারো স্নেহের ছোঁয়ার জন্য মন আকুল হয়ে উঠে। পরে অনুভব করে এরকম কান্নার কোনো মানে হয় না, সেটা কান্না হতে পারে না, সেটা মা হারা কোনো এক দুঃখীর বিলাপ এবং শোক ছাড়া আর কিছুই না। আবার ভাবে হয়তো” এটা আমার মাকে হারানোর প্রতিধ্বনি, অথবা একটা ছায়ার মতো আমার মা, আমার জীবনে জড়িয়ে আছে আমার প্রতিটি ধমনীতে, যে আমাকে এই পৃথিবীতে এনে এই নুতন দিগন্তে অভিজ্ঞতার দ্বার খুলে দিয়েছে, তিনিই যে আমার মা। শুধু এটুকু বুঝতে পারি আকাশের উপর থেকে আমার মা আমাকে আশীর্বাদ করে যাবে, আমি যেন আমিতেই থাকি, প্রকৃত ঘটনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমি আমার জীবনকে চালিয়ে নিতে পারি। এখন যে ভাবে জীবন চলছে শোক বা বিলাপ না করে, এগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখে মা হারানো, মাকে কাছে না পাওয়ার বেদনা থেকে যতদূর সম্ভব ভুলে থাকতে পারি!!!”।

কথায় আছে পেয়ে হারানোর চাইতে, না পাওয়া শ্রেয়। তবে কেন না পেয়েও মা কে হারানো এতো কষ্টকর এবং বেদনাদায়ক হয়? শেষ
email :— quadersheikh@gmail.com