শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : আমি শোকে বিহ্বল, জাঁহাপনা আপনার বয়স কম, তারুণ্যের প্রথম ভাগে থাকা এক জন মানুষের পক্ষে জগত সংসারের কিছুই উপলব্ধিতে আনা সম্ভব নয়। তাঁর পক্ষে নিজের হাতের তলোয়ারকে সংযত রাখা কঠিন, তাঁর পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন কোন দিকটা পূর্ব, কোন দিকটা পশ্চিম, কোন দিকটা উত্তর কিংবা কোন দিকটা দক্ষিণ!
যদি বিষ প্রয়োগ করার নির্দেশ আমি দিতাম, যদি আমার অন্তরে সম্রাটকে হত্যা করার ইচ্ছা সত্যি সত্যিই থাকতো, তা হলে আমার কি দরকার পরেছে, এই অঘটনটা আমার নিজের সরকারি বাস ভবনের ভিতরে ঘটানোর? আরও বলা যায় কি দরকার ছিলো রাজ বৈদ্যকে ডেকে নিয়ে এসে ওর হাত দিয়ে এই কর্ম করানোর! ‘লা পা’ উৎসবের সময় জাঁহাপনা যখন ছদ্মবেশ ধারণ করে বাইরে বেড়াতে বেরিয়ে ছিলেন, তখন তো ছিলো এর চেয়ে অনেক ভালো সুযোগ, তাই নয় কি?”

খানিকটা সময় আমি একেবারেই বাক্য হারা হয়ে গেলাম। আমি বুঝতে পারছি, ঐ বারের ফিন চৌ শহরের ভ্রমণের গোপন পদ চিহ্ন এবং পায়ের আওয়াজ, পশ্চিম সুবাদার চাও ইয়াং-এর শ্রবণ ও দর্শন ইন্দ্রিয়ের আয়ত্তের মধ্যেই ছিলো। আমি আমার রাজকীয় বিছানার নীচে বসে থাকা কর্মকর্তাদের দিকে ভালো করে তাকালাম। অল্প সময়ের জন্য হলেও তাদের মুখগুলো কালো হয়ে গেছে, তারা নীরব নিঃস্তব্ধ হয়ে গেছেন! তাদের মধ্যে মোটামুটি সবাই ভয় পাচ্ছেন, যদি না আবার সম্মানিত, সম্ভ্রান্ত আর ঐশ্বর্যশালী পশ্চিম সুবাদার চাও ইয়াং অপমানিত বোধ করেন তাদের ঐ কাজের জন্য!

“রাজ বৈদ্য ইয়াং তোং কি কারণে বিষ প্রয়োগ করে আমাকে খুন করতে চেয়েছিলো?”, খুব শান্ত আর ধীর স্থিরভাবে আমি এই প্রশ্নটা করলাম।
“আঘাতকারীকে আঘাতই পেতে হয়, জাঁহাপনা! রাজ বৈদ্য ইয়াং তোং ছিলো, প্রশিক্ষণার্থী সেনা কর্মকর্তা ইয়াং সোং-এর আপন বড় ভাই! তাদের দুই ভাই এর মধ্যে ছিলো প্রগাঢ় ভ্রাতৃত্ব বোধ। ইয়াং তোং জানতো চিয়াও চৌ এলাকায় জাঁহাপনা নিজ হাতে তীর ছুঁড়ে খুন করেছেন ইয়াং সোং-কে, দেশের প্রতি যে ছেলেটির ছিলো অসামান্য অবদান!”, পশ্চিমের সুবাদার চাও ইয়াং-এর মুখ অবয়বের বর্ণ বদলে গেলো আরেক বার, ফুটে উঠলো শোকের ছায়া! ওর চোখের উজ্জ্বল দৃষ্টি যেন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আমাকে!

“ইয়াং সোং অনুমোদন ছাড়াই সেনা দল নিয়ে ছুটে গিয়েছিলো ফং হুয়াং গিরিপথের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে যুদ্ধ রত সেনাদের সাহায্যার্থে! যদিও সে জাঁহাপনার কাছ থেকে তাঁর সদয় অনুমোদন নেয়নি! কিন্তু বীরেরা যে সব সময়ই দেশের সেবায় নিয়োজিত থাকে! সে করতে গিয়েছিলো অত্যন্ত সন্মানজনক কাজ!
এই অধম চাও ইয়াং জানে না, জাঁহাপনা যব ক্ষেতের মধ্যে ওকে তীর ছুঁড়ে কি কারণে হত্যা করেছেন?”
অবশেষে একটা বিষয় আমার কাছে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে, রাজ বৈদ্য ইয়াং তোং এর বংশ পরিচয়! পশ্চিম সুবাদার চাও ইয়াং এর তীক্ষ্ণ ধারালো প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কোন উপায় আমার নাই। বিশেষত তার হুমকি সুলভ চোখের দৃষ্টি আমাকে বিব্রতকর অবস্থা থেকে রাগান্বিত করে তুলছে। আমি আমার হাতে থাকা রতœ খোচিত হাতল ওয়ালা তরবারিটা ওর দিকে ছুঁড়ে মারলাম। আমি তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “তুমি দূর হও এখান থেকে! আমার যা ইচ্ছা, তা-ই করবো, যাকে হত্যা করার ইচ্ছা হয় তাকেই আমি মারবো! তুমি প্রশ্ন করার কে?”

আমি শুনতে পেলাম, পশ্চিমের সুবাদার চাও ইয়াং আকাশের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। নিজে নিজে বিড় বিড় করে বললেন, “সিয়ে দেশের সম্রাটের অপরিণত বয়স আর সেই সাথের দয়াহীন নিষ্ঠুরতা, অচিরেই ডেকে আনবে সিয়ে রাজ্যের আসন্ন বিপর্যয়!”
কথাগুলো বলেই ইয়াং তোং-এর কর্তিত শির সাথে নিয়ে রাজ দরবারী শিষ্ঠাচার মেনে আমার দিকে মুখ করে ধীরে ধীরে পিছু হটে বাইরে চলে গেলো সে। আমার মনে হচ্ছে, পশ্চিমের সুবাদার চাও ইয়াং-এর কথাগুলো শুনতে আমার কান দু’টো যেন আগে থেকেই অভ্যস্থ হয়ে আছে! ওর সহানুভূতি সূচক কথাগুলো নিয়ে একটু খানি গভীরভাবে ভাবতেই অপ্রত্যাশিতভাবেই মানস পটে বৃদ্ধ পাগল সুন সিন-এর মুখটা ভেসে উঠলো, এদের দু’জনের কথা যে হুবহু একই!

এ দেশে শীতকালে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। কিন্তু যে দিন আমরা ফিন চৌ শহর ছেড়ে আসলাম, সে দিন পরলাম বৃষ্টিতে। বিরল শীতকালীন বৃষ্টি! রাজকীয় শকট বহর অতিক্রম করছিলো ‘ফা ছাং’!

ফা ছাং হচ্ছে দন্ড বা শাস্তি ক্ষেত্র কিংবা বলা যায় শাস্তির মাঠ! এ মাঠে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীদের মৃতদেহ কিংবা মৃত দেহের অংশ বিশেষ টাঙ্গিয়ে রাখা হয়! সোঁ সোঁ বাতাস আর বৃষ্টির মধ্যে দন্ড ক্ষেত্রের মাঠে দেখা যাচ্ছে অল্প কিছু মানুষের পায়ে ছাপ! কাঠের থামের উপর ঝুলানো কর্তন করা মানুষের মাথাগুলো বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। এরা তো ছিলো অপরাধী, তাই পেয়েছে সাজা। মনে হচ্ছে বৃষ্টির পানি ওদের মুখ অবয়ব থেকে ওদের করা সমস্ত অপরাধ আর পাপ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে নিয়ে গেছে! প্রতিটা মুখমণ্ডলে ফুটে উঠেছে একটা উজ্জ্বলতার আভা! মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পাঁচজন মানুষের কর্তিত মস্তকের মাঝে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে একটা বাদামী হলুদ রঙের মানব দেহের চামড়া, যা বাতাসে পত পত করে উড়ছে! লোকজন বললো, ওটা হচ্ছে রাজ বৈদ্য ইয়াং তোং-এর দেহের ত্বক! পশ্চিম সুবাদার চাও ইয়াং রাজ বৈদ্য ইয়াং তোং-এর কর্তিত শির আমার কাছে পেশ করার পর, ইয়াং তোং-এর ত্বক দেহ থেকে ছিলে ফেলে আলাদা করা হয়েছে। তারপর সেই চামড়াটি সর্ব সাধারণকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ দেখাবার জন্য দন্ড ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর সেই ত্বকবিহীন দেহটি পশ্চিম অঞ্চলের সুবাদার চাও ইয়াং-এর বদন্যতায় এবং নির্দেশে মর্যাদার সাথে শবাধারের ভেতর স্থাপন করে রাষ্ট্রীয় সমাধি ক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়েছে!

খুবই অপ্রত্যাশিত একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো! ইয়াং তোং-এর দেহের ত্বক যেটা একটা কাঠের থামের উপর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো, হঠাৎ করে বয়ে যাওয়া এক প্রবল দমকা বাতাসের ঝাপটায় সেটা উড়ে এসে ঠিক আমার রাজকীয় রথটার ছাদ বরাবর এসে পরলো! এ ধরনের একটা কাকতালীয় ঘটনার সংঘটন আমিসহ প্রত্যক্ষদর্শী সবার জন্যই ছিলো একটা অভিঘাত, চরম বিস্ময়কর বিষয়! চামড়াটা প্রবল বেগে গাড়ির ছাদে সশব্দে আছড়ে পরলো, সেই সাথে তৈরী করলো একটা প্রতিধ্বনি! মনে হচ্ছিল ওটা যেন ক্রোধে গর্জন করছে! আর এই গম্ভীর শব্দ আমার স্মৃতি পটে রেখে গিয়েছিলো একটা প্রগাঢ় ছাপ!
ঘুম ঘুম ঝিমানি আর অবসন্নতার মাঝে রাজধানীতে ফিরে আসার পথে, আমি বহু বার মগ্ন হোলাম দিবা স্বপ্নের ঘোরে! আমি যেন দেখতে পাচ্ছি ‘ইয়াং’ পদবীর দুই সহোদর ভাই গোটা পথ জুড়ে আমার অবস্থান অনুসরণ করে আসছে ধেয়ে! আমি যেন দেখতে পাচ্ছি ইয়াং সোং নীচু হয়ে ধরে রেখেছে ওর পেট থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত মাখা ক্ষুদ্রান্তের অংশ বিশেষ! আর রাজ বৈদ্য ইয়াং তোং ওর আপন ভাই এর পিছনে দেহ থেকে ছিলে নেয়া একটা মানুষের ছাল দুলাতে দুলাতে খুব জোরে দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে আসছে!

ঘাতক, গুপ্ত ঘাতক! আমি ঘুমের ঘোরে এই কথাগুলো কয়েক বার চিৎকার করে বলে উঠেছি! আমি হুকুম দিলাম পথের মধ্যে আর কোথাও গাড়ি যেন না থামে! এর পরে আমি যেন ঘোরের মধ্যে খানিকটা অস্পষ্টভাবে দেখলাম ইয়াং পদবীর দুই সহোদরের সাথে যুক্ত হয়েছে এক দল নারী!

এদের মধ্যে যাদের মুখ গহ্বরে জিহ্বা নাই, তাদের মুখ অবয়ব বেশ ফুলে উঠেছে, আরও দেখতে পাচ্ছি হালকা গোলাপি রঙের কাটা হাতের আঙ্গুলগুলো রাস্তায় ফেলে দিতে দিতে ছুটছেন একজন, তার অবিন্যাস্ত চুল বাতাসে উড়ছে, তার পরনের জামা ও পোশাক ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে পাগলের মতো দৌড়ে ছুটে আসছে একটা ছোট সাদা ভুতের দল! আমি দেখতে পাচ্ছি ইয়াং ফুরেন, আর রাজ রক্ষিতা তাই নিয়াং-কে, যাদের স্মৃতি মানস পট থেকে প্রায় বিলীন হয়ে এসেছে। তারা আমাকে উদ্দেশ্য করে তীক্ষ্ণ স্বরে কিছু একটা বলছেন! আমার মনে হচ্ছে, ইয়াং ফু রেন দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার করে বলছেন, তুমি সিয়ে দেশের সম্রাট নও! সিয়ে দেশের রাজাধিরাজ হচ্ছে আমার ছেলে তুয়ান ওয়েন!
তাই নিয়াং অনুসরণ করছেন আমাকে আমার কল্পনার জগতে! তার দেহ সৌষ্ঠব আর অঙ্গ ভঙ্গিতে পরিপূর্ণ হয়ে আছে কামদ যৌন আবেদন। আমার মনে হচ্ছে তার পোশাক আশাক সবই জালের তৈরী! জালের ছিদ্রগুলো দিয়ে আমার নজর সরাসরি চলে যাচ্ছে বাতাসের দোলায় দুলতে থাকা তার ঢেউ খেলানো দেহের আবেদনময়ী ভাঁজগুলোর দিকে। তাই নিয়াং তার বুকের কাপড় আলগা করে দেখাতে চাচ্ছেন তার নরম বুকগুলো, আমাকে উদ্দেশ্য করে যেন জোরে জোরে বলছেন, জাঁহাপনা, আসো না কাছে, আমার পাশে!

আমি শুনতে পাচ্ছি আমার দুর্বল শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে যৌনতা মাখা উত্তেজনার গোঙানির দীর্ঘশ্বাস! আমার খুব ইচ্ছা করছে ওদেরকে উদ্দেশ্য করে বলতে, তোমরা আমার কাছে এসো না! আর একটু যদি আগাও তবে আমি তোমাদের খুন করে ফেলবো! কিন্তু লক্ষ্য করলাম, আমার কন্ঠ নালী দিয়ে কোন আওয়াজই বের করতে পারছি না! পা উষ্ণ রাখার কাজে ব্যবহৃত লাল তামার তৈরী বিশেষ চুলাটার উপর আমি সজোরে লাথি মারলাম! হাতের নখ দিয়ে কেতাদুরস্ত পোশাক পরিহিত দেহরক্ষীর গাল আঁচড়ে দিলাম, নখের আঁচড়ের দাগ বরাবর ফুটে উঠলো বেরিয়ে আসা রক্তের রেখা। আমার সেবায় নিয়োজিত রাজকীয় শকট বহরে থাকা চাকরবৃন্দ বুঝতে পারছিলো না এমন পরিস্থিতি তারা কিভাবে সমাল দিবে! ওরা পরে আমাকে বলেছে, ঘোরের মধ্যে প্রায় অচেতন থাকা আমি এক কথাই বার বার বলেছি, চিৎকার করে বলেছি: খুন! খুন করে ফেলবো!


শুদ্ধাচার অনুশীলন গৃহে রোগ শয্যায় কাটানো দিনগুলো ছিলো নির্জন নিঃসঙ্গতায় ভরা, আর এর কোন বিকল্পও ছিলো না। প্রতিদিন বাইত কান বন্ধ হয়ে আসা উত্তরের বাতাস, মরে যাওয়া শীর্ণকায় গাছগাছালির ডাল পালা নড়াচড়ার খস খস শব্দ মনটাকে করে তুলতো আরও ভারাক্রান্ত! আমার মাতা মং ফু রেন সব সময়ই ছুটে আসতেন আমার শয্যার পাশে, জিজ্ঞেস করতেন, আমি একটু ভালো বোধ করছি কি না, আর সংগোপনে ফেলতেন চোখের জল। তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন, এই সুযোগে প্রাসাদের ভেতর কেউ বুঝি আবার ক্ষমতা পালাবদল করার চেষ্টা করে! তিনি সন্দিহান ছিলেন, আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেন-কে নিয়ে! দাদী না আবার এই সময়টাতে কোন ফাঁদ পেতে বসেন কিংবা কোন ক্ষতিকর পরিকল্পনা করা শুরু করেন! আমার মাতা মং ফু রেন-এর অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে অবিরাম বক বক করা আমার এক দম ভালো লাগে না!

মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি যেন হয়ে গেছেন কথা বলতে পারে, এমন একটা খাঁচায় আবদ্ধ তোতা পাখী! একই কথা বার বার বলেই যাচ্ছেন, বলেই যাচ্ছেন! আমার মন ভালো করার জন্য নৃত্য শিল্পীরা এসেছে। ঘর গরম করার জন্য যে কাঠ কয়লার আগুনের চুল্লীটা আছে, সেটার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে নাচের মেয়েরা নাচছে বাজনার তালে তালে। যন্ত্র শিল্পীরা বসেছেন কক্ষের বাইরে, সেখানে তারা বাজাচ্ছেন তারের বাদ্য যন্ত্র। কিন্তু ওদের এত চেষ্টাও যেন বিফল হচ্ছে। আমি এখনও রয়েছি উদ্বিগ্নতার আর আতঙ্কের ঘোরের মধ্যে! নাচের মেয়েরা পরিধান করেছে লম্বা হাতার জামা, ওদের চুলের খোঁপা আর বেণীতে গোঁজা আছে সোনার তৈরী চুলের কাঁটা। আমি ঐ মেয়েদের লম্বা হাতা আর উজ্জ্বল চুলের কাঁটার মধ্য দিয়ে দেখতে পাচ্ছি রক্ত স্নাত মানুষের নাড়ি ভুড়ি, ওগুলো যেন ঢুকে পরেছে শুদ্ধাচার অনুশীলন গৃহে, ওরা যেন এখানে নৃত্য অনুশীলনে রত হয়েছে! অনেকগুলো মানুষের শরীর থেকে ছিলে ফেলা চামড়া যন্ত্র সঙ্গীতের মধ্যে মৃদু শব্দ করে উড়ে বেড়াচ্ছে! খুন, খুন, খুন! আমি হঠাৎ করেই তলোয়ার বের করে লাফ দিয়ে নৃত্য রত মেয়েদের মাঝে গিয়ে দাঁড়ালাম। তলোয়ার নাচিয়ে মেরে টুকরা টুকরা করার ভঙ্গি করলাম। মেয়েগুলো ভয় পেয়ে তাদের দু’ হাত উপরে তুলে মাথা বাঁচাবার ভঙ্গি করে আতঙ্কিত ইঁদুরের মতো দৌড়ে পালালো। রাজ বৈদ্য বললেন, আমার ভিতরে নাকি খুব শক্তিশালী বিষ ক্রিয়া করছে। খুব সহজে অল্প সময়ের মধ্যে এই অবস্থার উন্নতি হওয়ার নয়! প্রয়োজন খানিকটা সময়ের, শীত শেষে বসন্তের উষ্ণ আবহাওয়ায় গাছে গাছে ফুল ফোটা শুরু হলে আশা করা যায় শরীর আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে!

এক সপ্তাহ হয়ে গেলো, রাজ দরবার ঠিক মতো বসছে না! আমর দাদী হুয়াং ফু ফুরেন আমার সাথে বসে আলোচনা করার চেষ্টা করলেন। আমি আছি আগের মতোই, শুধু চিৎকার করে বলতে পারি একটা শব্দ : খুন!

আমার দাদী নিরাশ হলেন। যাত্রা পথে আমি অসুস্থ হওয়ার সময় যে সব কর্মকর্তাবৃন্দ আমার সফরসঙ্গী হিসাবে ছিলেন, তিনি তাদেরকে কর্তব্যে অবহেলা করার জন্য দায়ী করলেন, তাদেরকে একজন একজন করে দিলেন শাস্তি! এই সফরের মূল ব্যবস্থাপক রাজ দরবারের প্রধান নজরদার লিয়াং ইউ শ্র শাস্তি পাওয়ার ব্যাপারটা শুনে খুব অপমানিত বোধ করলেন। ক্ষোভ আর গøানিতে জর্জরিত হয়ে ঐ দিন বাড়ি ফিরে তিনি খানিকটা ধাতব বিষ খেয়ে নিজের প্রাণ নিজেই নাশ করলেন! এক সপ্তাহ-র সাতটা দিন শেষ হওয়ার পর অষ্টম দিনে হুয়াং ফু ফুরেন আর প্রধানমন্ত্রী ফং আও এক সাথে পরামর্শ করতে বসলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, শরীর অসুস্থ থাকা সত্বেও আমাকে রাজ দরবারে বসতে হবে। রাজ দরবারে আসিন অবস্থায় আমি যাতে অসংলগ্ন কথাবার্তা না বলতে পারি সে জন্য তাঁরা একটা ভয়াবহ পদ্ধতি প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন! আমার মুখের মধ্যে ঢিপে দেয়া হবে এক দলা রেশম। তারপর আমার হাত দু’টো পিছনের দিকে নিয়ে জড়ো করে সিংহাসনের সাথে বেঁধে রাখা হবে। এই ভাবে রাজ দরবারে আগত সামনের সারির মানুষ জন দেখতে পাবে আমার মুখ অবয়ব, কিন্তু ওরা শুনতে পাবে না আমার কন্ঠ থেকে বেরিয়ে আসা কোন শব্দ!
কি ভয়ঙ্কর এই বৃদ্ধার চিন্তা ভাবনা, কি ভয়ঙ্কর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের কার্যকলাপ! একজন দন্ডিত আসামীর সাথে যে রকম ব্যবহার করা হয়, বাস্তবে ঠিক যেন সেই রকম আচরণ তাঁরা আমার সাথেই করেছেন।
আহা, কেমন সুউচ্চ মর্যাদায় মর্যাদাবান বিশাল সিয়ে দেশের মহান সম্রাট!

এ বছরের শীতকালে জীবনে প্রথম বারের মতো খুব বড় ধরনের দুঃখজনক বিব্রতকর অবমাননা আমাকে সইতে হচ্ছে। একটা রেশমের দলা মুখের মধ্যে পুরে রেখে সিংহাসনে বসে বহু সংখ্যক সামরিক আর বেসামরিক আমলা কর্মকর্তাদের রাজদর্শন দেয়ার সময়, রাগে আর অপমানে আমার চোখ দুটি বেয়ে নেমে আসে দুঃখের অশ্রু ধারা!
সিয়ে দেশের সীমানার মানচিত্র, মানচিত্র অংকনকারী এরই মধ্যে আরেক বার সংশোধন করে এঁকেছেন! চিয়াও চৌ ফং হুয়াং গিরিপথ অঞ্চল, প্রায় একশত লি আয়তনের এলাকা নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে ফং কুয়ো দেশের সাথে। মানচিত্র করের বংশ পদবী হচ্ছে চাং, সে সিয়ে দেশের নতুন মানচিত্র অংকন করার পর, কাগজ কাটার ছুরি দিয়ে নিজের একটা আঙ্গুল কেটে মানচিত্রের কাগজে পেঁচিয়ে সদ্য আঁকা মানচিত্রের সাথে রাজ প্রাসাদে পাঠিয়ে দিয়েছে! এ ব্যাপারটা নিয়ে প্রাসাদের ভেতর খানিকটা সময় ধরে চললো গুঞ্জন, একেক জন, একের পর এক মন্তব্য করে চললেন!

আমি ঐ মানচিত্রটা দেখেছি। ওটাতে রক্তের দাগ তখনও শুকায় নাই। অনেক আগে সব অঞ্চলসহ সিয়ে দেশের মানচিত্রটাকে দেখতে একটা বড় পাখির মতো দেখাতো। আমার পিতা প্রয়াত সম্রাটের সময় ঐ পাখি সদৃশ মানচিত্রের ডান পাশের ডানাটা পূর্ব দিকের প্রতিবেশী সু কুয়ো দেশ কেটে নিয়ে গেছে! আর এখন বড় পাখির বাম ডানাটা ধ্বংস হলো আমার হাতে! এখন আমার সিয়ে কুয়ো দেশ দেখতে হয়েছে একটা মরা পাখির মতো, যা কি না আর কখনোই উড়তে পারবে না!

আমার মনে আছে দীর্ঘ দিন রোগ ভোগের পর অসুস্থতা থেকে যে দিন আরোগ্য লাভ করলাম সে দিনটা ছিলো রোদ ঝলমলে, আবহাওয়া উষ্ণ হয়ে উঠেছে। রাজ বৈদ্যের পরামর্শ ক্রমে আমি এসেছি প্রাসাদের পিছনে গাছগাছালির নীচে পাখীদের কলকাকলি আর কিট পতঙ্গের গুঞ্জন শোনার জন্য। রাজ বৈদ্যের মতে, আমার মুখে স্বাভাবিক কথা বার্তার ধারা ফিরিয়ে আনতে পশুর ডাক, পাখীর ক‚জন আর পতঙ্গের গুঞ্জন একটা বড় উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। আমি গাছ পালার মধ্যে থামের সাথে ঝুলানো শিশুদের খেলার কয়েকটা দোল খাওয়ার দোলনা দেখতে পাচ্ছি। কয়েকটা উজ্জ্বল সোনালী রঙের মোরগ আর একটা লম্বা লেজ ওয়ালা রঙিন পাখি, অনেকটা মানুষের মতো দোলনার উপরে এসে দাঁড়িয়ে খুব সতর্কতার সাথে ডান বামে তাকাচ্ছে। ঐ পাখিটা ওর শরীরটাকে ঝাঁকুনি দিয়ে ডেকে উঠলো। আমিও পাখিটার ডাক অনুকরণ করে ডেকে উঠলাম কয়েক বার। যেমনটা আশা করা গেছে, ঠিক তা-ই হয়েছে, আমার কন্ঠনালী খুলে গেছে, দূর হয়ে গেছে স্বর নালীর জড়তা!
আজকের ভোর বেলাটা তো ভারী চমৎকার!
পরবর্তীতে পাখীদের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ আর ওদের প্রতি শতগুণ গভীর ভালোবাসার সূত্রপাত হয়েছিল ঐ ভোর বেলায়!

সজীব আর সতেজ, গভীর আর ঘন বেশ কিছু ঝাউ গাছের বেষ্টনী, এ জায়গাটাকে হীম প্রাসাদের চত্বর থেকে আলাদা করেছে। পাখীর ডাকের পাশাপাশি আমি আরও শুনতে পাচ্ছি হীম প্রাসাদ থেকে আসা বাঁশির সুর! নল খাগড়া আর বাঁশের বাঁশিতে কারা যেন সুর তুলেছে, একটা বেদনা বিধুর সুর, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে একটা জন মানব শূন্য প্রাসাদের দেয়াল বেয়ে নেমে আসছে উপচে পরা পানির ধারা! আমি একটা দোলনার উপর গিয়ে বসলাম। আমার শরীরটা যেন ছেড়ে দিয়েছে নিজেকে, আমি দোল খেয়ে উপরে উঠছি আর নীচে নেমে আসছি। এই বনের মধ্যে আমার মনে হচ্ছে আমি যেন হয়ে গেছি একটা শিকারের পাখী, আমার উপর আছে শিকারীর তীক্ষ্ণ নজর। আমার ভেতর একটা চিন্তার উদয় হচ্ছে, আমার উড়ে চলে যাওয়ার আকাঙ্খা হচ্ছে!

আমি হঠাৎ করেই উচ্চ স্বরে বলে উঠলাম : ফেই! এতগুলো দিনের মধ্যে আমার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পথে এটা হচ্ছে আমার কন্ঠনালী দিয়ে বেড়িয়ে আসা দ্বিতীয় শব্দ ‘ফেই’! যার অর্থ হচ্ছে উড়ে যাওয়া! আনন্দে উল্লোসিত হয়ে আমি পর পর কয়েক বার চেঁচিয়ে উচ্চারণ করলাম এই শব্দটা! বনের মধ্যে নানান কাজে ব্যস্ত প্রাসাদ ভৃত্যরাও আমার সাথে তাল মিলিয়ে উচ্চ স্বরে বলে উঠলো ‘ফেই’! তাদের মুখ অবয়বে ফুটে উঠেছে বিস্ময় আর আনন্দের চিহ্ন! (চলবে)