শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : আমি বললাম, “দাদী, ঐ মেয়েলোকগুলোর কান্না কি আপনি পছন্দ করতেন?”
আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেন সরাসরি কোন জবাব না দিয়ে মৃদু হাসলেন। এরপর বললেন, “জিহ্বা কেটে ফেলেছো, তো কি হয়েছে? ভালো করেছো!
কিন্তু খবরদার; এ কথা যেন প্রাসাদের বাইরে না যায়!
প্রাসাদ থেকে বয়ে যাওয়া বাতাস যেন প্রাসাদের কোন গোপন খবর বাইরের জগতে উড়িয়ে নিয়ে না যায়!
আমি প্রাসাদ দাসীদের কড়া নির্দেশ দিয়েছি, যদি এই খবর বাইরে যায়, তবে যে বা যারা এই গোপনীয়তা ফাঁস করবে, তার বা তাদের জিহ্বা আমি কেটে দেবো!”
আমার বুকের উপর চেপে বসা একটা বড় পাথর যেন মুহূর্তের মধ্যেই নীচে নেমে গেলো! আমার দাদীর শাস্তি দেয়ার পদ্ধতি তো আমার মতোই! এটা আমার জন্য একটা বড় স্বস্তি দায়ক ব্যাপার!
আমার এখন, কেন জানি নিজেকে খানিকটা বোকা বোকা লাগছে! দেখা যাচ্ছে, আমিও কোন ভুল করি নাই!
আমি হীম প্রাসাদের তেরো জন মহিলার জিহ্বা কেটে ফেলার ব্যবস্থা করেছি; কিন্তু আমার দাদীর কাছে মনে হয়েছে ঐ কাজটা তো নিতান্তই একটা তুচ্ছ ঘটনা!
উনি যেন বলছেন, “ও কিছু নয়! জিহ্বা কেটেছে, তো কি হয়েছে তাতে!”
বুঝাই যাচ্ছে, ওনার বিবেচনায় আমি কোন অপরাধ করি নাই!

অমরত্বের যাদুর ঔষধের নির্জাস তৈরীর কাঁসার বড় পাত্রটা আগের মতোই খুব উঁচু করে দেয়ালের এক পিঠের সাথে গেঁথে রাখা আছে। পাত্রের নীচের ছাই এর ভিতরের আগুন ইতিমধ্যেই নিভে গেছে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ব্যাপার হচ্ছে, ধাতব পাত্রটার গায়ের রঙ দেখে এবং ওটার গায়ে আঙ্গুল স্পর্শ করলে বুঝা যায় পাত্রটা এখনও বেশ গরম, হাত পুড়িয়ে দেয়ার মতো গরম! প্রয়াত প্রাক্তন সম্রাট সারা বছর ধরেই অমরত্বের ঔষধ সেবন করতেন!
এই যাদুর ঔষধ তৈরী করার কাজে তিনি আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন ফং লাই দেশের এক কবিরাজকে। এই দেশটা আমাদের এখান থেকে বহু দূরে। কবিরাজকে পারিশ্রমিক স্বরূপ দেয়া হতো বহু স্বর্ণ মুদ্রা। ফং লাই নামের ‘রূপকথার যাদুর দেশ’ থেকে আসা কবিরাজের যাদুর ঔষধ মহামান্য সম্রাটের দুর্বল স্বাস্থ্যকে সবল করতে পারেনি, বৃদ্ধিও করতে পারে নাই তাঁর যৌন ক্ষমতা! সম্রাট যে রাতে মারা যান, তার আগের দিন ঐ কবিরাজ প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যায়! তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনাটা প্রমাণ করে যে, ঐ সর্বোরোগ নাশী, দীর্ঘ যৌবন প্রদানকারী যাদুকরী ঔষধের ব্যাপারটা একটা প্রতারণা বৈ অন্য কিছু ছিলো না!
আগুন জ্বালাবার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রাসাদ ভৃত্য হচ্ছে সুন সিন। ওর মাথার চুল ছাই এর মতো ধূসর সাদা হয়ে গেছে। আমি খেয়াল করেছি, সে হেমন্তের ঠান্ডা বাতাসের মধ্যেই ঔষধ তৈরীর চুল্লীর আসে পাশে ছুটাছুটি করে, শরীরটাকে বাঁকা করে চুল্লীর নীচে ছাই এর মধ্যে জ্বালানি কাঠের টুকরাগুলো গুঁজে দেয়।
আমি প্রতি বার চুল্লীটার সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করার সময় দেখি, সুন সিন চুল্লীর নীচ থেকে নীচু হয়ে দুই হাত দিয়ে ছাই টেনে বাইরে বের করতে করতে চেঁচিয়ে বলে, “আগুন নিভে গেছে, সিয়ে রাজ্যের বিপর্যয়ও খুব তাড়াতাড়ি ঘনিয়ে আসছে!”
আমি জানি পুরনো প্রাসাদ ভৃত্য সুন সিন হচ্ছে একটা পাগল! কেউ কেউ ওকে প্রাসাদ থেকে বের করে দিতে চেয়ে ছিলো, আমি ব্যাপারটা ঘটতে দেইনি। সুন সিনকে আমি শুধুমাত্র পছন্দই করি না, এর বাইরেও ওর বার বার আওরানো মন্ত্রের মতো কথাগুলো আমার শুনতে খুবই ভালো লাগে। ওর হাতের মধ্যে থাকা চুলার তলা থেকে বের করে আনা ছাইগুলো আমি বেশ খানিক ক্ষণ মনযোগ দিয়ে দেখলাম। আমি বলে উঠলাম, “আগুন এরই মধ্যে নিভে গেছে, সিয়ে দেশের বিপর্যয়ও খুব দ্রæত ঘনিয়ে আসছে!”
আপরাধীর হাসি মুখে নিয়ে তোষামোদকারী কিছু নপুংসক সরকারি কর্মকর্তা যখন আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন আমার প্রায়ই কান্না ভেঁজা করুণ নয়নে তাকিয়ে থাকা বুড়ো প্রাসাদ ভৃত্য সুন সিনের চেহারাটা খুব মনে পড়ে। আমি ঐ লোকগুলোর উদ্দেশ্যে বলে উঠি, “তোমরা বোকার মতো হাসছো কেনো? আগুন ইতিমধ্যেই নিভে গেছে , সিয়ে দেশের বিপর্যয়ও ঘনিয়ে আসছে!”

রাজকীয় শিকার ক্ষেত্রটার অবস্থান রাজ প্রাসাদ থেকে খানিকটা দূরে তাম্র কাঠি পাহাড়ে।
শরত কালে এই শিকার ক্ষেত্রটা ভরে গেছে আগাছায়। ঝোপঝাড় আর জংলা ঘাস বেড়ে উঠেছে, ছাড়িয়ে গেছে আমার হাঁটু, প্রায় ছুঁয়েছে আমার কোমর।
পাহাড়ের গায়ে আগুন লাগানো হয়েছে। আগুনের আঁচ পেয়ে বন্য জন্তু-জানোয়ারগুলো ওদের আবাসস্থল থেকে ভয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
স্তূপাকৃতির আগুন মিট মিট করে জ্বলছে পাহাড়ের ঢালের বিভিন্ন জায়গায়। তাম্র কাঠি পাহাড়ের উপত্যকার সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, পোড়া ঘাস আর কাঠের গন্ধ।
বন্য খরগোশ, ক্ষুদ্রাকৃতির রো হরিণ, পাহাড়ি হরিণ আরো অনেক বন্য প্রাণী ধোঁয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে জোরে দৌড়ে খোলা জায়গার দিকে ছুটছে।
আমি শিকারীদের নিক্ষিপ্ত তীরের ছুটে যাওয়ার শব্দ এবং তাদের উল্লাসের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি, যা কি না তাম্র কাঠি পাহাড়ের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে তৈরী করছে প্রতিধ্বনি।
প্রতি বছর রাজকীয় শিকার ক্ষেত্রে শিকারের অনুষ্ঠান হয় একবার। এই অনুষ্ঠানটা আমার খুবই পছন্দের।
রাজ পরিবারের প্রায় সব পুরুষ সদস্যই এবারের শিকার উত্সবে অংশ নিচ্ছে। সাথে আছে তীর ধনুকে সুসজ্জিত প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর এক দল অশ্বারোহী সৈনিক।
আমার ঘোড়াটা লাল কেশরের, আকৃতিতে একটু বেঁটে। পিছনে খুব কাছাকাছি থেকে ওটাকে অনুসরণ করছে আমার বৈমাত্রেয় ভাইদের ঘোড়াগুলো।
আমি দেখতে পাচ্ছি তুয়ান উ এবং তার সহোদর ভাই তুয়ান ওয়েনকে। ওদের দু’জনের অভিব্যক্তি খানিকটা বিষন্ন, নিষ্ঠুর কিংবা দম্ভ-আত্ম অহংকারে কলুষিত। আমি আরও দেখতে পাচ্ছি দ্বিতীয় রাজ কুমার তুয়ান সুয়েনের প্রশান্ত অবয়ব। আরও নজরে আসছে চতুর্থ রাজ কুমার তুয়ান মিং এর বোকা বোকা চেহারাটা। পাকা ফলের গন্ধ অনুসরণকারী মাছির মতোই ওরা সবাই আমাকে অনুসরণ করছে।
এ ছাড়াও এখানে এসেছেন আমার গুরু চুয়ে খোং, আরও আছে এক দল অস্ত্র সজ্জিত নিরাপত্তা রক্ষী, যারা পরিধান করেছে বেগুনী রঙের পোশাক এবং আরোহন করেছে দ্রæত গতির অশ্বে।
আমার রাজকীয় কর্ম জীবনে, প্রথম বারের মতো গুপ্ত ষড়যন্ত্রের আঘাত আসে এবারের শিকার অনুষ্ঠানে, রাজকীয় শিকার ক্ষেত্রে!
আমার মনে আছে, একটা হলুদাভ বাদামি রঙের পাহাড়ি হরিণ আমার ঘোড়ার সামনে দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল। অপরূপ সুন্দর হরিণটার পশম ও ত্বক ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে কখনো কখনো আমার দৃষ্টি সীমায় আসছিলো আবার মিলিয়ে যাচ্ছিলো।
আমি ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে দিক পরিবর্তন করে হরিণটাকে অনুসরণ করা শুরু করেছি, ঠিক এমন সময় পিছনের দিক থেকে শুনতে পেলাম চুয়ে খোং এর কন্ঠস্বর, “হুঁশিয়ার, সাবধান! ছুটে আসছে গুপ্ত ঘাতকের তীর!”
আমি ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়েছি মাত্র, সাথে সাথে আমার সাদা রঙের পালকে মোড়া শিরস্ত্রান ছুঁয়ে বিষ মাখা তীরটা সাঁই করে ছুটে গেল সামনের দিকে!
এই ঘটনাটা তাত্ক্ষণিকভাবে আমার সঙ্গীদের করলো হতবিহ্বল, ভীত সন্ত্রস্ত! যেন ঠান্ডা শীতল ঘামের ধারা বয়ে যাচ্ছে সবার শরীরে।
আমিও সাংঘাতিক আতংকিত হয়েছি। চুয়ে খোং ঘোড়া ছুটিয়ে চলে আসলেন আমার কাছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে আসলেন তাঁর ঘোড়ার পিঠে। আমার মাথা থেকে খুলে পরে গেলো শিরস্ত্রানটা। প্রলম্বিত আতংকের মধ্যে আমি মাটি থেকে উঠিয়ে নিলাম শিরস্ত্রানটাকে। বালি হাঁসের পালকে মোড়া শিরস্ত্রানের বহিরাবরণ থেকে একটা পালক তীরের ঘষায় ভেঙ্গে পরে গেছে।

“কে ছুঁড়েছে এই গুপ্ত তীর?”, আমি প্রশ্ন করলাম আমার গুরু চুয়ে খোং-কে, “কে আমার অনিষ্ট করতে চায়?”
চুয়ে খোং পাহাড়ের ঢালের চার পাশে তাকালেন। তারপর একটু উঁচু জায়গায় উঠে নীচের দিকের গাছ পালা ঝোপঝাড়গুলো ভালো করে লক্ষ্য করলেন। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলে উঠলেন, “তোমার ব্যক্তিগত শত্রু!”
আমি বললাম, “কে আমার শত্রু?”
চুয়ে খোং হেসে হেসে উত্তর দিলেন, “তুমি নিজে চিন্তা করে দেখ, যে তোমার কাছ থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থান করছে, সে-ই তোমার শত্রু!”
আমি খেয়াল করলাম, আমার চার বৈমাত্রেয় ভাই হঠাত করেই আমার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলো! এটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, তারা গাছ পালার পিছনে গিয়ে নিজেদেরকে আড়াল করছে।
আমি সন্দেহ করছি, ঐ গুপ্ত তীরটা বড় রাজ কুমার তুয়ান ওয়েন নিক্ষেপ করেছে। আমাদের পাঁচ ভাই এর মধ্যে তুয়ান ওয়েনের তীরের নিশানা সব চেয়ে ভালো। শুধু মাত্র ধূরন্ধর তুয়ান ওয়েন এর পক্ষেই এমন নিখূঁত গুপ্ত হত্যার পূর্ণ পরিকল্পনা করা সম্ভব!
সিঙ্গা বাদক সিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে সংকেত দিলো, সকলকে একত্রিত হয়ে প্রাসাদে ফেরার জন্য।
সর্বাগ্রে ঘোড়া ছুটিয়ে প্রাসাদে পৌঁছালো তুয়ান ওয়েন। ওর পিঠের সাথে ঝুলানো আছে একটা চিত্রা হরিণ, ঘোড়ার পিঠের সাথে বাঁধা আছে পাঁচ ছয়টা বুনো খরগোশ এবং বন মোরগ। তুয়ান ওয়েনের তীর রাখার তূণে লেগে আছে জীবন্ত প্রাণীর কালচে রক্ত, ওর সাদা আলখেল্লায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেগে আছে রক্তের দাগ। আমি দেখতে পাচ্ছি, ওর চেহারায় ফুটে ওঠা দম্ভের অভিব্যক্তি! বীর দর্পে সে দ্রæত ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে।
হঠাত করেই একটা অদ্ভুত অনুভূতির উদয় হলো আমার ভেতরে! আমার মনে পড়ছে, ইয়াং ফুরেন-এর কথাগুলো, যে মানুষটাকে জীবন্ত অবস্থায়ই প্রয়াত সম্রাটের সমাধীতে সমাহিত করা হয়েছে। এমনও তো হতে পারে, ওনার কথাগুলোই সত্য! তুয়ান ওয়েনের চেহারা ও শরীরের গঠন দেখতে অনেকটাই আমাদের পিতা প্রয়াত সম্রাটের মতো। ওর চালচলন, ভাব-ভঙ্গির মধ্যে একটা রাজকীয় আভিজাত্যের ছাপ আছে।
আসলে সিয়ে রাজ্যের রাজা হিসেবে ও-ই বেশি মানানসই; সেই তুলনায় আমাকে মোটেও রাজার মতো দেখায় না!
“জাঁহাপনা, কি কোন কিছু শিকার করেছেন?”
তুয়ান ওয়েন ঘোড়ার পিঠে বসেই খুব অবজ্ঞার সুরে আমাকে বললো, “জাঁহাপনার ঘোড়ার পিঠ তো একে বারেই খালি! শিকার করা কোন কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না!”
আমি বললাম, “আরেকটু হলে, গুপ্ত তীরের আঘাতে আমি মারা যেতাম! তুমি কি জানো, কে ছুঁড়েছে ঐ তীর?”
“আমি জানি না!
জাঁহাপনার তো একটা পশমেরও কোন ক্ষতি হয়নি!
ঐ তীর অবশ্যই আমার ধনুক থেকে ছুটে আসে নাই। তীরন্দাজ হিসাবে, আমি খুবই দক্ষ, আমার তীর শত ভাগ লক্ষ্য ভেদি!” তুয়ান ওয়েন একটু কোমর বাঁকা করে সোজা হয়ে বসলো। ওর চেহারায় ফুটে উঠেছে দম্ভ আর প্রচ্ছন্ন হুমকির ছাপ।

“যদি তুমি না হও, তবে নিক্ষেপ করেছে তুয়ান উ।
যে ই হোক, গুপ্ত তীর যে ছুঁড়েছে, তার কোন ক্ষমা নেই! আমি তাকে দেখে নেবো!” আমি দাঁতে দাঁত লাগিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বললাম। ক্রোধে আমার শরীর কাঁপছিলো। রাগের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ ঘোড়ার চাবুকটাকে উপরে তুলে কয়েক বার নাচালাম। জোরে মারলাম ঘোড়ার পিঠে চাবুকের কয়েক ঘা। লাল কেশরের ঘোড়টা সোজা ছুটে বেরিয়ে গেলো প্রাসাদের আঙ্গিনা ছেড়ে।
আমার মন ভারাক্রান্ত, শরতের বহমান বাতাস আমার কানে যেন কান্নার শব্দ বয়ে নিয়ে আসছে। আমি শুনতে পাচ্ছি ঘোড়ার খুড়ের চাপে ছোট ছোট ঝোপঝাড়ের ডাল পালা ভেঙ্গে যাওয়ার মট মট আওয়াজ। তাম্র কাঠি পাহাড়ের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শরতের বিষন্ন বাতাসের মতো আমার মনটাও বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে। ঐ নিক্ষিপ্ত গুপ্ত তীরটার কথা আমি ভুলতে পারছি না! ঐ গুপ্ত তীরের ঘটনা বাড়িয়ে দিয়েছে, আমার হৃদ স্পন্দনের গতি, আমার মধ্যে সঞ্চার করেছে এক বিশাল ক্রোধ।
আমার মাতা মং ফুরেন যে শাস্তি তাই নিয়াং-কে দিয়েছেন, আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, ঠিক সেই শাস্তি আমি তুয়ান ওয়েন এবং তুয়ান উ-কে দিবো, দণ্ড বিধায়ককে নির্দেশ দেবো, ঐ দুই সহোদর ভাই এর হাতের আঙ্গুলগুলো কেটে ফেলার!
আমি আর কখনোই ওদেরকে দম্ভ ভরে টান টান করে ধনুক টান দিয়ে আমার চোখের সামনে তীর নিক্ষেপের দক্ষতা প্রদর্শন করতে দেবো না!
শিকার ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া ঐ ঘটনাটা রাজ প্রাসাদে তুলেছে এক ব্যাপক আলোড়ন! পর দিন রাজ দরবার শুরু হওয়ার পর, আমার মাতা মং ফুরেন সবার সামনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না কাটি করা শুরু করলেন। তাঁর দাবী হলো হুয়াং ফু ফুরেন এবং উপস্থিত মন্ত্রী পরিষদ যেন ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা করেন। তুয়ান ওয়েন এবং তুয়ান উ, এই দুই ভাইকে যেন কঠোর শাস্তি দেন।
অন্য দিকে হুয়াং ফু ফুরেন, যেহেতু বয়োজ্যেষ্ঠ আর অভিজ্ঞ মানুষ, তিনি ঘটনাটা দেখছেন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে, তিনি মং ফুরেনকে শান্তনা দিয়ে বললেন, “এ রকম ঘটনা আমি আমার জীবনে বহু বার ঘটতে দেখেছি। তোমার এত বেশি আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নাই। শুধুমাত্র অনুমানের উপর ভিত্তি করে তুয়ান ওয়েন এবং তুয়ান উ-র প্রতি কোন অবিচার করতে যেও না। আমার একটা স্বাভাবিক পদ্ধতি আছে, কে প্রকৃত খুনি বা কে খুন করার চেষ্টা করেছে, সব কিছু সুস্পষ্ট হওয়ার পর প্রকৃত অপরাধীকে কঠোর সাজা দেয়া যাবে, সময় আছে, তাড়াহুড়া করার একে বারেই দরকার নাই।”
মং ফুরেন, হুয়াং ফু ফুরেনের কথা একেবারেই আমলে নিলেন না, ওনার বিবেচনায় হুয়াং ফু ফুরেন পক্ষপাত মূলক আচরণ করছেন, তিনি তুয়ান ওয়েন এবং তুয়ান উ, এই দুই ভাইকে রক্ষা করতে সচেষ্ট।
মং ফুরেন তাঁর নিজ সিদ্ধান্তে রইলেন অটল। তিনি দাবী জানালেন, বিলাস কেন্দ্র প্রাসাদের সামনে তুয়ান ওয়েন ও তুয়ান উ কে ডেকে নিয়ে এসে যেন সবার সামনে প্রকাশ্যে জেড়া করা হয়।
অন্য দিকে, হুয়াং ফু ফুরেন চাচ্ছেন না, সরকারী দাপ্তরিক কাজের সাথে প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারকে জড়াতে।
আমি লক্ষ্য করছি, সিংহাসনের সামনে দাঁড়ানো খোজা ভৃত্যটি পরেছে এক কঠিন অবস্থার মধ্যে, সে যেন এগুতেও পারছে না, পিছাতেও পারছে না! ওর চেহারায় ফুটে উঠেছে এক হতবুদ্ধি আর বিভ্রান্তির ছাপ।
গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই কৌতুকপূর্ণ মনে হচ্ছে। আমার খুব হাসি পাচ্ছে, কিন্তু এখানে তো হাসতে বারণ!

দুই পক্ষের মধ্যে বিতণ্ডা হচ্ছে লম্বা সময় ধরে, কেউ কারো কথা মনে না, নিজের সিদ্ধান্ত বদলাতে দু’জনের কেউ ই রাজী নয় ! হুয়াং ফু ফুরেন দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর মুখে একটা স্নেহ পূর্ণ হাসি ধরে কথা বলছিলেন, কিন্তু এক পর্যায়ে তিনি আর পারলেন না। প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে গেলেন, তাঁর হাতে ধরে থাকা বেগুনী রঙের গোলাপ কাঠের লাঠিটা দিয়ে ইঙ্গিত করলেন সামনে উপবিষ্ট মন্ত্রী ও সরকারী কর্মকর্তাদের দরবার ত্যাগ করার জন্য। রাজ দরবারের রাজকীয় আচার অনুযায়ী তারা সবাই রাজ সিংহাসনের দিকে মুখ করে ধীরে ধীরে পিছিয়ে সরে যেতে লাগলেন।
এর পর পরই ঘটলো এক অঘটন!
আমার দাদীর গোলাপ কাঠের তৈরী লাঠিটার এক প্রান্ত ধরা আছে তাঁর হাতের মুঠায়; আরেক প্রান্তের শীর্ষ বিন্দু, জ্যামিতির ভাষায় বলতে গেলে বলা যায়, একটা বৃত্ত চাপের মতো বক্র রেখায় শূন্যে উঠে গিয়ে সজোড়ে আঘাত করলো আমার মাতা মং ফুরেনের চুলের খোঁপার উপর!
তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন তীক্ষ্ণ স্বরে। একটা নোংরা গালি তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো।
আমি তো একেবারেই বোকা বনে গেছি। বিলাস কেন্দ্র প্রাসাদের দরবার কক্ষ থেকে সামনের দিকে মুখ করে পিছনে হটে বেরিয়ে যাওয়া মন্ত্রী ও আমলারা বার বার দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে চাইলেন ভেতরে কি ঘটছে! আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেন রাগে কাঁপছেন!
তিনি মং ফুরেনের নিকটে এগিয়ে এসে, গোলাপ কাঠের লাঠির সরু অগ্রাভাগ চেপে ধরলেন মং ফুরেনের ঠোঁট বরাবর।
“তুমি মুখ দিয়ে কি গালি দিচ্ছো?”, হুয়াং ফু ফুরেন লাঠিটা চেপে ধরেই বললেন , “আসলে আমি তখন খেয়াল করি নাই; তা না হলে কি তোমার মতো সস্তা মেয়েলোক, আর খেসারির ডাল দোকানদারের মেয়েকে দেশের রাণী হতে দেই! (চলবে)