আবুল খায়ের : নিম্নমাধ্যমিক শেষ করে নবম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পায় রফিক। আর তার পিছনে যে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায়। রফিক কি করে, কোথায় যায়। কি তার পছন্দ। শুধু কি রফিক? তার পরিবারের সব খোঁজ খবর যার মাথায় কিড়বিড় করে সারাক্ষণ। একটু ভালো কিছু রান্না হলেই রফিকের বাড়িতে দৌড়ে নিয়ে আসে। অবশ্য এজন্য ওর মা কিছুটা হলেও সুযোগ দিতো। রফিক জানতো না তাদের কোনো মহান উদ্দেশ্য ছিল কি না। নানা কারণে দরকারে বেদরকারে ‘চুমকি’ রফিকদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতো। রফিককে তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা থাকতো নানা বাহানায়। এসব যে শুধু অকারণে নয় তা রফিকের জানা ছিল না। কল্পনায়ও না। কারণ রফিকের যে বয়স, তাতে সে শুধু লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুই বুঝে না। খেলাধুলা দেখতে ভালো লাগতো তার, খেলতে নয়। মাঠের পাশে অথবা ক্ষেতের আইলে দর্শক সারিতে থাকার মজাই আলাদা। জামেলা কম। স্বাস্থ্য যা ছিল খারাপ না। কিন্তু ভয় পেতো যদি হাত পা ভেঙে যায়। তাই একটু দূরে থাকতো রফিক।

প্রথম বেঞ্চে বসার চেষ্টা করত। স্কুলে যেতে একটু দেরি হলেও সহপাঠিরা সিট রেখে দিতো। পড়া প্রতিদিনই পারতো। তবে কোনো প্রশ্নই পুরোপুরি মুখে মুখে বলতে পারতো না। কিন্তু খাতায় লিখতে বললে সমস্যা হতো না। তবে পরীক্ষায় কখনো সেভাবে ফলাফল পেতো না। কারণ কোনো প্রশ্নেরই পুরো উত্তর লিখতে পারতো না সে। হয়তো লেখার মান ভালো হতো না। মাথায় ধারন করা উত্তর যা মাথায় আসতো লিখত। যেটাকে বলা হয় বানিয়ে বানিয়ে লেখা। ফলে গড়পড়তায় নম্বর আসতো তার। হাতের লেখা যদি আর একটু সুন্দর হতো তবে নম্বর কিছুটা হলেও বেশি পেতে পারতো। প্রতিবারই পাঁচ-সাত জনের পরে মানে প্রথম দশজনের মধ্যেই থাকতো ক্রম সংখ্যা।

রফিক কখনো কোনো কথা গুছিয়ে বলতে পারতো না। বিশেষ করে মেয়েদের সাথে। তবে বন্ধু মহলে খুবই আড্ডায় জমাতে সিদ্ধহস্ত ছিল। উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তাক লাগানো এবং হাসানোর জন্য সবাই রফিকের উপস্থিতি কামনা করতো। সিনেমা দেখে কাহিনি মনে রাখার চেষ্টা করতো। কিছুদিন যাবৎ সিনেমার পুরো ঘটনা মনে থাকতো।

রফিক মাঝে মাঝে তার বাবার সাথে মাঠে কাজ করতে যেত। কৃষাণ-মজুরদের নাস্তা-পানি, খাবার নিয়ে যাওয়ার কাজ বেশ উপভোগ্যও ছিল।

চুমকিদের বাড়ির পাশে জমি ছিল রফিকদের। ফলে দেখলেই নাস্তা-পানি খাওয়ার জন্য ডাকতো। বলতো, ভাইয়া-মা ডাকছেন, বাসায় আসেন। বাসায় বিভিন্ন রকমের হাতের তৈরী পিঠা-পায়েস থাকতো। ওর বড় ভাই রফিকের চেয়ে এক-দুই বছরের বড় হলেও খুবই সামাজিক ও ধার্মিক ছিল। রাফিককেও আদর করতো ছোট ভাইয়ের মতো। হয়তো তার ভালো পড়ালেখার জন্য হতে পারে। রফিকের ভাবনাটা ঠিক এমনি ছিল। দেখা হলেই খালাম্মা কেমন আছেন, খবর নিতো। রফিকও খালাম্মা বলতো চুমকির মা’কে। তবে রফিক জানে না, কেনো তার সাথে এমন ভালো ব্যবহার করছে তারা।

ঈদ কার্ড দিয়ে দাওয়াত দেয়ার রেওয়াজ বেশ পুরোনো। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব পরস্পরকে ঈদকার্ড দিয়ে দাওয়াত দিতো। কে কয়টা কার্ড পেয়েছে, এ নিয়ে আলোচনাও হতো। দুই টাকা দামের ঈদকার্ড। সুন্দর ছন্দ ও ফুল আঁকা কার্ড। কলমে লেখা ছন্দ/ছড়া ছিল। রফিক তখনও জানতো না ছড়া কী জিনিস। এখন যেমনটি দু’কলম লিখতে পারার কারণে কিছুটা বোঝে। রফিকের জীবনের প্রথম ঈদ কার্ড পায় চুমকির কাছ থেকেই।
কার্ডটি ছিলো বিউকার্ড সাইজের। কার্ডে তার হাতের লেখা ছন্দে ভরা একটি ছড়াও ছিল। যার মানে ছিলো ঈদে যেনো তাদের বাড়িতে যায় রফিক।

এক সময় চুমকির বিয়ে হয়ে যায়। রফিকের এক ক্লাশমেটের সাথে। তার নাম দামাল। একসাথে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল দুইজন। যদিও দুইজন দুই স্কুল থেকে। পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল একই। চূড়ান্ত পরীক্ষার সময়ে দু’একদিন একসাথে আসা-যাওয়া করার সুযোগ হয়েছে রফিক-দামালের। তবে রফিকের স্কুলটি ছিল বড় নাম করা প্রতিষ্ঠান ওদের তুলনায়। যা হোক। একদিন জানা গেলো ‘দামাল’ নকল করার দায়ে বরখাস্ত হয়েছে।

আর্থিক অবস্থা রফিকের চেয়ে ওদের কিছুটা ভালো ছিল। যদিও বাপ ছিল না দামালের। তবে তার বড় ভাইয়েরা মধ্যপ্রাচ্যে থাকতো বলে পরিবার ছিল কিছুটা স্বচ্ছল।

এসএসসি পরীক্ষায় বরখাস্ত হয়ে পড়ালেখা বন্ধ করে দেয় সে। যাদের পড়ালেখার সুযোগ কম, তাদের বিদেশ চলে যাওয়ার প্রবণতা বেশ পুরাতন। বিদেশে ভালো টাকা কামানোর সুযোগ থাকে। দেশে উচ্চ শিক্ষার পিছনে না দৌড়ে বিদেশে পাড়ি জমালে দেশের রেমিটেন্স বাড়ে। দ্রæত বড় লোক হওয়া যায়। এক সময় মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরত এসে বিয়ের কাজটা সেরে নেয় দামাল। আর চুমকির স্বপ্নের সে কাপুরুষটি তখনও এইচএসসি পাস করে কেবল জীবনের অনন্ত ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে। কখন ডিগ্রি পাস করে স্নাতক হবে। কখন যে স্নাতকোত্তর অর্জন করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। নাকি বেকারদের তালিকায় ভবঘুরে বা হিমু হয়ে দিনাতিপাত করবে। পরিবারকে যে কিছু না কিছু দিতে হবে, সে দায়বদ্ধতাকে না হয় বাদ দিলাম। তারপরতো নিজের চিন্তা। আর বিয়ে সেতো আরো অনেক দূরে।

জীবনের প্রথম ঈদ কার্ড বা প্রেমের আহবানকে রফিক তখন সম্মান জানাতে পারেনি বটে। তবে কার্ডের মধ্যে সে খুঁজে পায় প্রথম প্রেমের স্মৃতি। যদিও তখন সেটা বুঝতো না। কার্ডটি এখনও রফিক সংরক্ষণ করে রেখেছে এতো বছর পরেও। তার ভালোবাসার মর্যাদা ও সম্মান জানাতে এখনও মাঝে মাঝে হৃদয়ের এককোণে কেনো যেন ব্যথা অনুভূত হয়। এ ব্যথা কিসের ব্যথা। রফিক তা জানে না। তবে এর মধ্যে যে কোনো পাপ নেই সেটা জানে।
চুমকি এখন বেশ আছে। স্বামী, সংসার, বাচ্চা নিয়ে সুখের সংসার। নতুন বাড়ি। সেটা রফিকদের বাড়ির পাশে। রফিকের কাছে কাছে থাকবে, মাঝে সাঝে দেখা হবে, এইটাই তার হয়তো শেষ ইচ্ছে। এতেই হয়তো সে সুখ অনুভব করে।

আর রফিক? সে তো কেবল জীবনের বিরামহীন চিহ্নকে অবিরাম তাড়িয়ে ছুটে চলেছে …সন্ধ্যা নামে ধীরে ধীরে/পাখিরা ফিরে আসে নীড়ে/আর আমি চেয়ে থাকি/কখন তুমি আসবে ফিরে/গান গাইতে গাইতে কেটে যাচ্ছে দিন।

(লেখক: কবি ও কথা সাহিত্যিক)