ইয়াসমিন আশরাফ ডোরা : ড্যানফোর্থ ও ভিটোরিয়া পার্ক থেকে হাঁটা পথ ক্রীসেন্ট টাউন কমিউনিটি সেন্টার। সেন্টারটি ৬টি বহুতলা ভবনের মাঝখানে অবস্থিত। এইখানে খেলাধুলা এবং সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়াও ইংরেজি শেখার ক্লাস, ইয়োগা ক্লাস, সাঁতারের ক্লাস এবং সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন বিষয়ের উপর কর্মশালা হয়। ফলে এইখানে চলছে সকাল থেকে সন্ধ্যা সারাক্ষণ মানুষের আসা-যাওয়া।

আমার কর্মকক্ষটি এই কমিউনিটি সেন্টারের প্রবেশ পথে। কানাডায় নবাগতদের বসবাস সংক্রান্ত তথ্য প্রদান করাই আমার প্রধান কাজ। সোমবার থেকে শুক্রবার প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কর্মকক্ষে বসে কাজ করতে করতে, এই এলাকার মানুষগুলোর সাথে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

শিখা আপার সাথে এখানেই আমার পরিচয়। উনার বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। আপা সদালাপি এবং এই বয়সেও যথেষ্ট কর্মঠ। উনি বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নেবার জন্য সেন্টারে আসেন। শিখা আপা এবং উনার সঙ্গিসাথীরা আমাকে একা বসে থাকতে দেখলে আমার অফিস কক্ষে এসে বসেন এবং গল্প গুজব করেন, কাজের ফাঁকে এরকম অল্পসল্প গল্প করতে আমার ভালোই লাগে।

এমনি একদিন সকালে অফিসে এক নবাগত পরিবারের সাথে বসে কথা বলছি এমন সময় হঠাত শিখা আপা আসলেন এবং একটা প্যাকেট আমার কেবিনেটের উপর রেখে বললেন- এই শাড়ির প্যাকেটটা তোমার কাছে রেখে গেলাম, আজকালের মধ্যে সোফি এসে $১০০ ডলার দিয়ে শাড়িটা নিয়ে যাবে, টাকাটা আমি পড়ে এসে নিয়ে যাবো। আমি কিছু বলবার সুযোগ পেলাম না, উনি হন হন করে চলে গেলেন। বিগত তিন বছর ধরে আপাকে দেখেছি কিন্তু কখনো কাজের মাঝে এমন করে আমার কক্ষে আসেন নাই। আপার এভাবে আসাটা আমার ভালো লাগে নাই। আমিও কিছু বলতে পারলাম না। আসলে উনি কিছু বলার সুযোগও আমাকে দেন নাই। আবার কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। এমন সময় মনু আপা এসে দুটা কাগজ দিয়ে বলে গেলেন, সময় করে ফ্যাক্স করে দিও। ওখানে সব তথ্য ও নম্বর দেওয়া আছে। বলে উনি আর দেরি না করে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। আমি যে বিরক্ত হয়েছি আমার চেহারায় তা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এ দেশে আসা নবাগত পরিবারটি বেশ স্বাভাবিকভাবে বললেন, বেশতো এখানে অনেক বাঙালি আছে, আমরা এপাড়াতে বাসা নিবো। আমি একটু হেসে বললাম, জী জায়গাটা ভালো- এখানে অনেক বাঙালির বসবাস। দুইদিন পর সোফি আপার সাথে দেখা, কিন্তু উনি আমার কক্ষে না এসে হাত নাড়িয়ে সেন্টারের প্রোগ্রামে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে উনাকে ফিরে যেতে দেখলাম। কাজে ব্যস্ত ছিলাম বলে ডাকতে পারলাম না। তারপর দিন আবারও সোফি আপার সাথে দেখা, এবারও হাত দেখিয়ে চলে গেলেন। আমি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে উনাকে ডাকলাম- আপা আপনার শাড়িটা। উনি দাঁড়িয়ে বলেন, কোন শাড়ি? আমি পুরো কাহিনিটা ব্যাখ্যা করলাম। উনি র্নিবিকারভাবে বললেন, সরি শিখাকে বলা হয় নাই, আমি ভেবেছি শাড়িটা নেব না। আমি শুকনো গলায় বললাম, ও তাই। আবার বললাম, কদিন আপাকে দেখছি না। উনি জানালেন, শিখা বড় মেয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছেন। নাতির জন্মদিন, সোমবারে ফিরবে। আপনি দেখেন যদি কেউ শাড়িটা নেয়। আমি শুধু শুনলাম কিছুই বলতে পারলাম না। মনে মনে বললাম এতো খবর রাখেন আর শাড়ি নেবেন না, এই কথাটা বলতে পারলেন না। নিজেকে গাল দিলাম। এছাড়া আর কিবা করার আছে।

সাতদিন পরের কথা। সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি। ফলে সেন্টারে মানুষের আসা-যাওয়া কম। এর মধ্যে শিখা আপার দেখা। আমার অফিসে মানুষ বসা দেখে আপা বললেন, ফেরার পথে আসবো। ফেরার পথে আপা আমার রুমে আসলেন। কুশালাদি পর্ব শেষ করে শাড়ির প্রসঙ্গে আসলেন। আমি শাড়ির প্যাকেটটা আপার হাতে দিয়ে বললাম, সোফি আপা শাড়িটা নেবেন না। আর আপনি সেই যে গেলেন আর দেখা নাই। হু, আমি তো এখানে ছিলাম না- মেয়ের বাসায় গিয়েছিলাম।

উনি শাড়ির প্যাকেটটা টেবিলের উপর রেখে একটু আমতা আমতা করে বললেন, এটা আপাতত তোমার এখানে থাকুক। প্যাকেট খুলে শাড়ি দেখাতে লাগলেন। ইতিমধ্যে আমি একটু বিরক্ত বোধ করতে শুরু করেছি। তবু বললাম, ভারি সুন্দর এবং দামি শাড়ি। আমার কথা শুনে শিখা আপা বললেন, ইয়াসমিন শাড়িটা না হয় তুমি একটু কম দাম দিয়ে নিয়ে নাও। আমি বললাম, না আপা আপনি এটা নিয়ে যান। আমি এখন শাড়িটারি কিনবো না। আমার ভাবসাব দেখে আপার মুখটা শুকিয়ে গেলো। আমি যে ব্যাপারটা পচ্ছন্দ করছি না সহজে বুঝতে পেরেছেন। অনুরোধের সুরে বললেন, তুমি রাগ করো না বোন। ঠিক আছে তুমি এটা নিয়েও না। তবে তোমার এখানে আর কয়েকটা দিন থাক। বাসায় অনেক মানুষ, বৌমার ছোট বোন আর বাচ্চারা এসেছে। প্যাকেটটা দেখলে ওরা প্রশ্ন করবে। তুমি আমাকে চেনো কিন্তু জানো না। কোন কোন সময় অহেতুক প্রয়োজনে জীবনের বিভিন্ন মোড়ে মানুষকে নানা পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়, আমার এখন তেমননি সময়। সামাজিকতা নিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এমন সময় আপার সেল ফোন বেজে উঠলো। ফোনে কথা শেষে আপা বললো, বৌমা ফোন করেছে, বৃষ্টিটা কমে আসছে তাই ওরা সবাই শপিং মলে যাচ্ছে। আমি জানি সেদিন ওভাবে তোমার কাজের মধ্যে আসাটা ঠিক হয় নাই, কিন্তু উপায় ছিলো না। আপাকে আমি খুব পছন্দ করি। এমন হাসিখুশি মানুষটি এমনভাবে বলবে আশা করি নাই। এখন আমারই খারাপ লাগছে। আমি বললাম, না আপা আমার কোন অসুবিধা হয় নাই। সে দিন উপস্থিত পরিবারটি বাঙালি ছিলো বলে কিছু মনে করে নাই। অন্য দেশের কেউ হলে কে জানে কি ভাবতো। আমার হাতে কাজ ছিলো না। আপাকে বললাম, বসেন চা খাই। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সঙ্গে সঙ্গে বললেন, দাও একটু বসে চা খাই। উনি আবার শাড়ির প্রসঙ্গ উঠালেন। আমি বললাম, থাক সে কথা।

আপা বললেন, দাও শাড়িটা নিয়ে যাই, ওরা সবাই বাইরে গিয়েছে। আরো বললেন, সোফির সেদিন সেন্টারে আসবার কথা ছিলো- কেন যেন আসে নাই তাই বাধ্য হয়ে এ কাজ করেছি। সোফি শাড়িটা নিবে বলেছিলো। আপা প্লিজ অন্য কথা বলি। শিখা আপার সাথে কথা বলতে বলতে হঠাত করে জুলি এসে হাজির। জুলি ওর কানাডীয়ান সিটিজেনসীপ পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয় আলাপ করতে আগে বেশ কয়েকবার আমার কাছে এসেছিলো। আজ এসেই এক গাল হাসি দিয়ে বললো, আপা আপনাকে একটা সুখবর দিতে এসেছি। আমি সিটিজেনসীপ পরীক্ষায় পাস করেছি, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। মুহূর্তেই অফিস কক্ষটির রং বদলে গেলো। শাড়ির বাক্স দেখে জুলি শাড়িটা দেখতে চাইলো এবং পচ্ছন্দ করে ফেললো। আমাদের দুজনকে আশ্চর্য করে নিমেশেই শাড়িটা কিনেও নিলো এবং প্যাকেট নিয়ে আজ আসি এই বলে বেরিয়ে গেলো। আমরা দুজন পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকলাম। আমি বললাম, যাক শাড়িটা আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হলো না। আপা বললেন, শাড়িটা মেয়েটাকে মানাবে।

শিখা আপার চোখে মুখে সেকি তৃপ্তি! উনাকে দেখে আমার ভালো লাগলো। একটা হাসি দিয়ে বললো, আমার কাজটা হয়েছে। একটু অন্যমনষ্কভাবেই বললেন, তুমি কি জানো ইয়াসমিন আমি কেন এইভাবে শাড়িটা বিক্রি করলাম? কিছু দিন আগে আরো একটা শাড়ি বিক্রি করেছি। জিজ্ঞাসা করলাম, কেন আপা আপনি কি কোন অসুবিধায় পড়েছেন? আপা একটু সহজ হয়ে বললেন, তুমি এ সব বুঝবে না, বুড়ো মানুষের সমস্যার কি শেষ আছে। আমাকে তো তোমরা ভালোই দেখছো- খাচ্ছি, পড়ছি ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার সমস্যা হলো হাতে নগদ টাকার। আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে এই শহরে বাস করে। ওদের সংসার আর আত্মীয়স্বজন তো কম নাই। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বা কেউ দেশ থেকে ঘুরে আসলে আমার জন্য একটা শাড়ি তো বাধা উপহার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই তো সেদিন আমার মেয়ের ভাসুরের মেয়ের বিয়ে হলো। দুই বাড়ি থেকেই আমাকে দুইটা ভালো শাড়ি দিয়েছে। কেহ কখনো দেখেন না আমি আদৌ এই শাড়ি গুলি পড়লাম কিনা, আর কোথায় এতো বেড়াই বলো। তিন ঘরের ছয়টি নাতি-নাতনি। ওদের জন্মদিন, ছেলেমেয়েদের ম্যারেজ অ্যানিভারসারি সবই তো আছে। তখন কিছু একটা দিতে ইচছা হয়, কারও কাছে হাত পাততে মন চায় না। গত মাসে ওরা সবাই মিলে আমার জন্মদিন পালন করলো। দুটা দামি ব্যাগ, শাল, ঘড়ি আরো টুকিটাকি কতো কি পেলাম- কি হবে ওসব দিয়ে। সামনের মাসে বড় নাতিটা ১৫ বছরের হবে। এখন থেকে বলছে ওর একটা বাস্কেট বল চাই। জানো ইয়াসমিন, কষ্ট হয় যখন ভাবি দেশে এখনও আমার বাড়িঘর ও ব্যাংকে টাকা পড়ে আছে কিন্তু কারো সময় নাই ও নিয়ে ভাবতে। একবার ছেলেকে বলেছিলাম। ওর উল্টা প্রশ্ন- এখানে তোমার কিসের অভাব, কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে বলো। এখন বুঝতে পেরেছো আমার কেন ক্যাশ টাকা চাই। হাতে গোনা কয়েকটা বেড়াবার জায়গা আর সুটকেস ভর্তি কাপড়, আলমারি ভর্তি ব্যাগ তবে ওতে রাখার মতো টাকা কড়ি নাই, থাকে শুধু কিছু ওষুধপত্র। আপা চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতে যেতে বললেন, অনেক কথা বললাম, বাস্তব জীবন বড়ই কঠিন। জী আপা, এভাবে কখনো চিন্তা করি নাই। বিচিত্র আমাদের জীবন, সম্পদ থাকলেই যে ভোগ করতে পারবো তার কি নিশ্চয়তা? আপাকে আবারও বসতে বললাম। বললেন, না তুমি কাজ কর। বুড়ো মানুষের কথার শেষ নাই, তবে সময় হলে ওদের সাথে কথা বলো। ওদের ভালো লাগবে তুমিও অনেক জানবে। একদিন তোমাকে আমার বান্ধবী সেতার গল্প বলবো। আজ উঠি। নামাজ-কালাম আছে বলে আপা বেরিয়ে গেলেন।

আপার ছেলেমেয়ে ও বৌমারা উনাকে ভালোবাসে। আপাও ওদের ভালোবাসে। তারপরও সবার কিছু ছোট ছোট শখ-আহ্লাদ মান-অভিমান থাকে যা আমরা ভুলে যাই। শুধু সেই অনুভব করে, আপা তাই মনে করিয়ে দিলেন।