সামিনা চৌধুরী : যারা উন্নত জীবনের আশায় অথবা সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য, অথবা নিজ দেশে নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করার কারণে বা অন্য যে কোন কারণে নিজের দেশ ছেড়ে পরবাসী হন, তারা বিদেশের শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে বুকের মাঝে ফেলে আসা স্বদেশ বয়ে বেড়ান। তারা বিদেশের মসৃণ রাস্তায় দামী গাড়ি চালাতে চালাতে পথের দুধারে ফেলে আসা সবুজ ছোট গ্রাম খুঁজে বেড়ান। তাদের বুকের ভেতরে থাকা স্বদেশ আসলে তাদের স্বপ্ন মেশানো একটা দেশ আর তারা সেই স্বপ্নের দেশের ছবি দিয়ে যান তাদের পরের প্রজন্মকে। এমনি স্বপ্ন দিয়ে যাবার গল্প উঠে এসেছে জসিম মল্লিকের ‘আমি একবার বৃষ্টিকে ছুঁয়েছিলাম’ উপন্যাসে।

সাহিত্য গবেষকদের মতে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে রোমান এবং গ্রিক সাহিত্যে উপন্যাস রচিত হতো। শ্যারিটোন (Chariton) এর লেখা ক্যালির্হ (Callirhoe) গ্রন্থকে প্রাচীনতম উপন্যাস হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়ে থাকে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত ভাষায় সুবান্ধু রচিত বাসবদত্তা, ডানদিন রচিত দশকুমারচরিত ও অবন্তীসুন্দরী কথা, এবং বাণভট্ট রচিত কাদম্বরী প্রভৃতি লেখায় উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যাবলী পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’কে প্রাচীনতম বাংলা উপন্যাস বলা হলেও বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’কে প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা উপন্যাস ধরা হয়। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের রচনাকাল ১৮৬৫ সাল। সেভাবে দেখলে বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস মাত্র ১৫০ বছরের সাহিত্যরূপ। এই ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, বিভ‚তিভ‚ষণ বন্দোপাধ্যায়, মানিক বন্দোপাধ্যায় প্রমুখের পথ ধরে এসেছে অনেক কালজয়ী উপন্যাস। ১৯৭১ সালের আগে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রমূখকে দিয়ে বাংলাদেশ অঞ্চলে উপন্যাসের যে শক্তিশালী ধারা শুরু হয়েছিল, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদের লেখার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের একটি নতুন ধারা সৃষ্টি হয়। এ ধারায় লেখা উপন্যাসগুলি খুব সহজ সরল কাহিনিনির্ভর। মূলত পরিবার-কেন্দ্রিক গল্পে পাত্র-পাত্রীদের ভালবাসা, বিরহ, মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, পারিবারিক মূল্যবোধ, তরুণসমাজের হতাশা, স্বামী-স্ত্রীর জটিলতা, নারী স্বাধীনতা প্রভৃতি নিয়ে উপন্যাসের প্লট রচিত হতে থাকে। পরবর্তীকালে এই ধারাটি অন্যান্য লেখকদের লেখায়ও লক্ষ করা যায়। ‘আমি একবার বৃষ্টিকে ছুঁয়েছিলাম’ এই ধারাটির প্রতিনিধিত্ব করেছে।

সন্তানদের উন্নত জীবন গড়ে দেয়ার স্বপ্ন নিয়ে জমির সাহেব কানাডায় পারি জমান। কানাডার কষ্টের জীবনে তার একমাত্র স্বপ্ন ছিল ছেলে মেয়ে নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে গেলে তিনি দেশে ফিরে যাবেন। তাই কানাডায় নানান ধরনের কাজ করে জমানো অর্থে উত্তরায় এক খন্ড জমি ক্রয় করে ডেভলাপারকে দেন ফ্ল্যাট তৈরি করে দেবার জন্য। কিন্তু আট বছর পেরিয়ে গেলেও ডেভলাপার জমির সাহেবকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয় না। এর মধ্যে হঠাৎ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে অভিক ঢাকায় আসে। আসার একমাত্র কারণ ডেভলপারের কাছে থেকে ফ্লাট বুঝে নেয়া। ঢাকার আসার আগেই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অভিকের সাথে পরিচয় হয় শিল্পপতি তনয়া জিনিয়ার সাথে। জিনিয়ার শিল্পপতি বাবার প্রভাব খাটিয়ে খুব দ্রæত অভিকের ফ্ল্যাট হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কাজেই কানাডায় ফেরার পরিকল্পনা করে অভিক। কিন্তু এরই মাঝে অভিক আর জিনিয়ার বন্ধুত্বের সম্পর্কটি প্রণয়ে উন্নীত হয়।

জসিম মল্লিক অনেক যতœ করে গল্প তৈরি করেন। ‘আমি একবার বৃষ্টিকে ছুঁয়েছিলাম’ উপন্যাসটি বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার ফ্ল্যাট হস্তান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে শুরু হলেও উপন্যাসের শেষে এটি একটি মিষ্টি প্রেমের গল্প হয়ে উঠে। উপন্যাসটি ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপটে লেখা। উপন্যাসে উঠে এসেছে সমকালীন ঢাকার চলমান উন্নয়ন আখ্যান, জ্যাম ও শব্দ দূষণের শহরে রোজকার দুঃসহ জীবন, আবাসিক এলাকা জুড়ে বাণিজ্যিক ভবন গড়ে ওঠার দৃশ্য, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য অপ্রতুল সুযোগ সুবিধার বিষয়গুলো। একইসাথে একজন দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসী বাংলাদেশ সম্পর্কে কী চিন্তা করে, কতটা আবেগ তাড়িত হয়, কানাডায় গড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্ম আর বাংলাদেশে গড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের ভাবনার পার্থক্যটাও পাঠক অনুধাবন করেত পারবেন।

ইতিহাসের প্রতিটি শতকের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি, তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন, উন্নত দেশগুলোতে ঋণাত্বক জন্মহার, উন্নত দেশের বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রার সুবিধা, পুঁজিবাদের বিকাশ, প্রভৃতি কারণে বর্তমান শতকের মানুষেরা বহির্মুখী। তারা ছুটে চলছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে কখনো অভিবাসী হিসেবে, কখনো ছাত্র হয়ে, আবার কখনো-বা চাকরির সুবাদে। কিন্তু ফেলে আসা মাতৃভ‚মির মায়া পাসপোর্ট বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় না। কাজেই অভিবাসীদের মুখে হাসি থাকলেও বুকে জমা থাকে কান্না। ব্রিটিশ সোমালি কবি ওয়ারসন শায়ার (Warsan Shire) তাঁর ‘Home’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘No one leaves home unless/home is the mouth of a shark./you only run for the border/when you see the whole city/running as well’. ‘আমি একবার বৃষ্টিকে ছুঁয়েছিলাম’ উপন্যাসের নায়ক অভিকের বাবা জমির সাহেব এমনি হতভাগ্য অভিবাসীদের একজন প্রতিনিধি। সন্তানকে সব বাবামা-ই সর্বশ্রেষ্ঠ সুযোগ সুবিধা দিতে চেষ্টা করেন। আর সেকারণেই তিনি দেশ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে কানাডায়। কিন্তু দেশের জন্য তাঁর হাহাকার তিনি অকপটে প্রকাশ করতেন। সবসময় ফিরে যেতে চাইতেন শেকড়ের টানে। ছেলে অভিকের ভাষায়, ‘সারাক্ষণ দেশ দেশ করত, কাঁদত দেশের কথা বলে। বঙ্গবন্ধুর গল্প করত ওদের সাথে’ (পৃষ্ঠা ১০)।

লেখক যে শহরে বা গ্রামে বেড়ে ওঠেন বা বাস করেন, সেই শহর বা গ্রামের ছবি তাঁর লেখায়ও উঠে আসে। চার্লস ডিকেন্সের বেড়ে ওঠা লন্ডন শহরে। তাঁর উপন্যাসগুলোতে লন্ডন শহরের বর্ণনা পাওয়া যায়। ডিকেন্সের প্রথম উপন্যাস ‘পিকউইক পেপার্স’-এর ক্লাবের সদস্যগণ লন্ডন শহরের রেস্তোরা জর্জ এন্ড ভালচার, লন্ডনের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা লোম্বার্ড স্ট্রিট, লন্ডন শহরের ব্যস্ত সড়ক জংশন শেরিং ক্রস ভ্রমণ করেছিল। একই কথা বলা যায় তাঁর ‘অলিভার টুইস্ট’ ও ‘লিটল ডোরিট’ উপন্যাসের ক্ষেত্রেও, যেখানে উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা স্যাফ্রন হিল স্ট্রিট, বোরো হাই স্ট্রিট, জেকব আইল্যান্ড বস্তি এলাকা প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ করেছে। সমরেশ মজুমদার বেড়ে উঠেছিলেন ডুয়ার্সের চা বাগানে। তাই তার ‘সাতকাহন’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ডুয়ার্সের চা বাগান যেখানে দীপাবলির বসবাস। এভাবেই লেখকেরা তাঁর শহর বা গ্রামকে ধরে রাখেন পাঠকের চোখে, যেখানে পাঠক ঘুরে আসেন পথিক হয়ে । জসিম মল্লিক জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন ঢাকা শহরে। তাঁর ‘আমি একবার বৃষ্টিকে ছুঁয়েছিলাম’ উপন্যাসের নায়ক অভিক ঢাকা শহরের বেশ কয়েকটি আইকনিক স্থান যেমন ট্যাগোর ট্যারেস রেস্টুরেন্ট, ইউনিমার্ট রেস্টুরেন্ট, গুলশান পার্ক, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনের রাস্তা প্রভৃতি পরিদর্শন করে। অভিকের সাথে ঢাকা শহরে ঘুরতে গিয়ে পাঠক দেখতে পাবেন ঢাকা শহরের ফ্লাইওভারের চিত্র। লেখকের ভাষায়, ‘যত্রতত্র ফ্লাইওভার বানিয়ে ঢাকা শহরটাকে বস্তি বানানো হয়েছে। … রাজউক যেখানে সেখানে বাড়ি করার অনুমতি দিয়েছে। … নগর কর্তারা বসে বসে টাকার পাহাড় বানাচ্ছে (পৃ ৫৫)। ঢাকা শহরের আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রতিযোগিতার ছবিটিও পাওয়া যায় উপন্যাসটিতে। লেখকের ভাষায়, ‘গুলশান এলাকার আবাসিক চরিত্রই হারিয়ে গেছে। … একটা আবাসিক এলাকা কেমন করে বাণিজ্যিক এলাকা হয়ে গেল ভাবতেও অবাক লাগে’ (পৃ ৩৭)।

 

বাবা-সন্তানের রসায়ন নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই।’ বাবা মানে আদর, আবদার, শাসন, খেলার মাঠ; বাবা মানে নীরব ভালোবাসা। বাবারা পরিবার আর সন্তানদের জন্য তাদের সমস্ত ঘাম এবং শ্রম অকাতরে দিয়ে যান সারাজীবন। উপন্যাসের নায়ক অভিকের বাবার প্রতি ভালোবাসাও উঠে এসেছে গল্পে যদিও একজন আদর্শ ছেলের মতো সে তার মায়ের প্রতিও সমান শ্রদ্ধাশীল। বাবা-মায়ের আটপৌড়ে জীবনে মাখো মাখো ভালোবাসা থাকে না, কিন্তু তারপরও সেই বিনিসুতার বন্ধন তারা টেনে নিয়ে যান পরস্পরে প্রতি ভালোবাসার কারণেই। আর তাই সন্তানের চোখে বাবা মায়ের সম্পূর্ণ সম্পর্ক প্রকাশিত হয় না। তাই অভিকও সেটা দেখতে পায় না। অভিকের ভাবনায়, ‘জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছে দুজনের সম্পর্ক ভালো না। বাবার কোন কিছুতেই মায়ের সায় থাকে না। সব কিছুতেই বিরোধিতা করে, পিছু টানে। কোনো কিছু বাবা তার ইচ্ছে মতো করতে পারেনি’ (পৃ ৩২)।

জসিম মল্লিক খুব সমাজ ও ঐতিহ্য সচেতন একজন লেখক। তার লেখায় সবসময় সাধারণ মানুষ যে চোখে সমাজ দেখেন সেই চিত্র উঠে আসে। ‘আমি একবার বৃষ্টিকে ছুঁয়েছিলাম’ উপন্যাসে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের জীবন মান কত বদলেছে। দারিদ্র্য দূর হয়েছে। লোকজন হরহামেশা দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

হাজার হাজার স্টুডেন্ট পড়তে আসছে বিদেশের নামি দামি ইউনিভার্সিটিতে ‘(পৃ ১১)। রাজনৈতিক মঞ্চে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছে গেছে, দেশে দারিদ্রসীমা কমেছে… এই গল্পগুলো খুব শোনা যায়। ১৩ আগস্ট ২০২২ এর বণিকবার্তার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘২০১৬’-এ জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার দেখানো হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশের কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ষ্ঠান/ সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে দারিদ্র্যের হারে যে ঊর্ধ্বগতি উঠে এসেছে তা গ্রহণে সরকার অনীহা প্রকাশ করেছে। তাই দেশে দারিদ্র্যের বর্তমান হার নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে’। সেই ধোঁয়াশার পেছনে অনেক কারণ থাকলেও অনেকেই নীতিহীনতাকে আসল কারণ মনে করেন। অভিকের ডেভলাপার আট বছরেও ফ্ল্যাট হস্তান্তর করেনি। তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থাও নেয়া কঠিন। এই হতাশা থেকে ‘আমি একবার বৃষ্টিকে ছুঁয়েছিলাম’ গ্রন্থে র নায়ক অভিক ভাবে, ‘এদেশের মানুষের উপর কোন ভরসা নাই। কারো কোনো নীতি নাই। পুলিশ, আমলা, রাজনীতিবিদ সবাই এক। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝে না’ (পৃ ৩৫)। এরকম প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন আসলেই ধোঁয়াশা। তাই দেশের অবস্থা বোঝাতে ঔপন্যাসিক আরো বলেন, ‘একটা দেশের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যায় সে দেশের এয়ারপোর্ট দেখলে। রোজার মাসে শুনেছে ফ্লাইট ল্যান্ড করলেও ইফতারির টাইমে কেউ কাজ করতো না। কি ভয়াবহ কথা!’ (পৃ ১২)! মহৎ সাহিত্যের আরশিতে প্রতিবিম্বিত হয় সমাজ আর সেটাই সাহিত্যের সার্থকতা। এক্ষেত্রে লেখক একজন নিপুণ সমাজ বিজ্ঞানীর মতোই সমাজকে উপস্থাপন করেছেন, চিহ্নিত করেছেন সমাজের ক্ষতকে।

লেখকের লেখায় যেমন সমাজ থাকে, তেমনি মানুষও থাকে। লেখক তাঁর উপন্যাসে যে সময়টাকে ধারণ করেন, সেই সময়ের মানুষের মনের চিত্রটি শুধু সাহিত্যেই পাওয়া যায়, কোনো ইতিহাস বা সমাজ বিজ্ঞান বইয়ে পাওয়া যায় না। বর্তমান পৃথিবীর দেশগুলো বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। মানুষ এখন আগের চেয়ে বেশি ভ্রমণ করেছে; অন্য দেশের শিল্প, সংস্কৃতিকে জানছে, গ্রহণ করছে। কাজেই শিল্প, সাহিত্য, পোশাক, নৈতিকতা, খাবার, জীবন যাপন সবকিছুতেই একধরণের ফিউশন বা এক্সপেরিমেন্ট লক্ষ করা যায়। ফলে তরুণ তরুণীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করছে যেমনটি পশ্চিমা সমাজেগুলোতে হয়ে থাকে। এই বিষয়টি করতে গিয়ে কেউ কেউ সীমাও অতিক্রম করছে। এই অস্থির সময়টি ‘আমি একবার বৃষ্টিকে ছুঁয়েছিলাম’ উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে। লেখকের ভাষায়, ‘মানুষের মন মানসিকতা বদলেছে। নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ও দেখছে। …মেয়েরা তিনটা চারটা প্রেম করে একসাথে। ডেট করে। ছেলেরাও তাই’ (পৃ ১৮)।

কখনও দুঃখ বা ভয় বোঝাতে, কখনও কষ্টের সমাপ্তি বা নতুন জীবন শুরু বোঝাতে সাহিত্যে বৃষ্টির উপমা ব্যবহার করা হয়। লেখক উপন্যাসের নাম রেখেছেন ‘আমি একবার বৃষ্টিকে ছুঁয়েছিলাম’। বাবা মারা যাওয়ার পর নায়ক অভিকের সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয়, বাংলাদেশের সফর শেষ করে দ্রæত কানাডা ফিরে যাবার তাগিদ, জীবন সঙ্গী খুঁজে বের করার প্রয়োজন প্রভৃতি সমস্যার সমাধান ঘটেছে আলোচ্য উপন্যাসটিতে। অর্থাৎ নায়ক অভিক কয়েকটি সমস্যা শেষ করে এক নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে এই উপন্যাসের শেষে। এইসব সমস্যার সমাপ্তি বোঝাতে এবং নতুন জীবন শুরু বোঝাতে ‘আমি একবার বৃষ্টিকে ছুঁয়েছিলাম’ নামটি যাথার্থ এবং বেশ কাব্যিক। উপন্যাসের নামকরণ মারুফুল ইসলামের কবিতার বই থেকে নেয়া হয়েছে বলে বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ থেকে জানা যায়।

উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে অনন্যা। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২৩। গ্রন্থের প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। প্রচ্ছদে দেখা যায় ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার নিচে কেউ হাত পেতে আছে। নিচে কোনায় একটি পুরুষাবয়ব। নীল আবহের প্রচ্ছদে আরো অনেক বেশি বৃষ্টির অঙ্গীকার নিয়ে ঘননীল মেঘের ঘনঘটা। উপন্যাসের নামের সাথে খুব মানানসই এবং রোমান্টিক প্রচ্ছদ। জসিম মল্লিক এ যাবৎ ৪০টির বেশি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন । তিনি বর্তমানে কানাডার টরন্টো শহরে বাস করছেন এবং বেশ কিছু সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন। ২০২২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পুরস্কার পেয়ে আমাদের সবার জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন। ‘আমি একবার বৃষ্টিকে ছুঁয়েছিলাম’ পাঠকের ভালো লাগবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। নতুন এই গ্রন্থটির জন্য লেখককে অভিনন্দন জানাই।

সামিনা চৌধুরী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত হন। সরকারি কলেজে অধ্যাপনাকালে বাংলাদেশ ইউনেস্কো কমিশনেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে যুক্ত হন ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশে-বিদেশে সামিনার মোট নয়টি পিয়ার রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে কানাডায় অভিবাসী সামিনা পাঁচ বছর ধরে টিডি ব্যাংকে কাস্টমার কেয়ার বিভাগে কাজ করছেন।