সোনাই এর একুশে ফেব্রুয়ারি

মা মা; ওই শুনো মিছিল- “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”।
মা; আমি যাই?
না না বাবা, “বাচ্চাদের ওখানে যেতে নেই আজ
আমরা গরিব, তুমি ছোট, ঐসব বই পড়ুয়া আর
নেতাদের কাজ”।
না মা আমি যাব, যা…ই, যা…..ই, মা- যা………ই।
শুন বাবা শুন; শু………..ন; সোনা …………ই,
সোনা………….ই।
উড়িয়ে খেলার ঘুড্ডিখানা হাতে নিয়ে নাটাই
মিছিলের পিছু পিছু ছুটল, ছুটল দৌড়ে সোনাই।
কি আর বুঝে? রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের
মুক্তি চাই,
বাংলা চাই, বাংলা চাই।
স্লোগান উড়ে যত যায় অদূর দূরে, আরো উঁচু উপরে
সোনাই তত চিৎকার করে তারও উচ্চ স্বরে।

একী! অকস্মাৎ ধুড়ুম, ধুড়ুম শব্দ!….. কিসের শব্দ?
চিৎকার, হুড়োহুড়ি, হট্রগোল, চোখ জ্বালাপালা,
দুপুরের অব্দ!
মিছিলের পাশ কাটিয়ে সোনাই সামনে দেয় এক ঝাঁপ,
এড়িয়ে চোখ জ্বালা জব্দ।
ওমা! এ যে তারই রিকশাচালক বাবার দেহ,
নিথর, নিস্তব্দ!
“বাবা, বাবা;” ডাক দিতে পারলো না সোনাই-
নিমিষে হয়ে গেলো তারও দেহ স্তব্দ!

কি হলো তার সোয়ামি শিশুর কিছুই সে জানে না-
বড়োলোকের বাড়ি কাজ সেরে কুঠিরে ফিরে
সোনাই’র না আমেনা।
কেউ তারে খবর দিলো না- কি হলো তার স্বামীর
সোনাই-ই বা কে, কি তার ঠিকানা?
সালাম, বরকত, রফিক, জব্বর- বীর শহীদের
আগর আকবর-
বাংলা ভাষী শ্রদ্ধা জানায়!
লাশের স্তুপে তলিয়ে গেলো শুনাই’র কচি দেহখানা
সোনাইকে, কে-ইবা রিকশাচালক
খবর কেউ নাহি পাঠায়।

আর তো আসে না রোদের আলো আমেনার নিত্য
আঁধার ঘর!
সোনাই’র ঘুড়ি ঝুলছে কেঁদে বন্ধ খিড়কির
আকঁড়ার প’র!
কাজে যায় না আর আমেনা, কাহার উপর তাহার খেদ!
উপোষ উদরে দিন কাটে না, দরিদ্ররা কি বুঝে
কাক-কোকিলের ভেদ?
কাক তাড়ুয়ার ভয়ে জননী শয্যায়- নিশি পোহায়
কাক-নিদ্রায়!
“ভোর হয়েছে সোনাই এসেছে,” শোক-কাতরা অকস্মাৎ
জোছনায় জাগিয়া যায়।

ফেব্রুয়ারির একুশ

বাঙালি জাতি নয়তো তাদের অধীন, নয়তো করো চেয়ে অধম
তবুও নির্বোধ জাতি তা-ই ভেবে নিয়েছিল ভুলের কদম!
বাঙালির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে চাপিয়ে দিল তাদের বুজা ‘ভাষার’
চাপিয়ে দিলো স্ব-অভিমত, শাসন-শোষণ, রুঢ়তর স্বেচ্ছাচার!
বাংলা বাঙালির প্রাণের সুর-মায়ের মুখের ভাষা, প্রাণ খুলে হাসা,
মেনে নিতে পারেনি তাই সে নির্দেশ ছেড়ে নিজ ভাষায় স্বপ্ন দেখার আশা।
তাই বাঙালি ভাবছে হাহাকারে, “তারা কি তবে দাস ভেবে ছুড়ছে মালিকের আদেশ?”।
তবুও সমঝোতার স্বার্থে- শান্তির ক্ষুধায়- বচসা চললো নেতায় নেতায় বিশেষ।
কোন সমীচীন হয় না, উল্টো প্রতিরোধে জারি করে এক শত চুয়াল্লিশ ধারা-
সেদিন আটই ফাল্গুন কলাভবন আমতলা সাক্ষী রেখে পথ-প্রতিবাদে মিছিল ধরলে বাঙালিরা-
গুলি ছুড়ে শুষক হায়েনার দল বায়ান্নের একুশে- পথেই জীবন নিল সোনার ছেলেদের!
তারা কি তবে সেজে ঈশ্বর? ভাষার কারণে জান কেড়ে নিতে পারে মানুষের?

নির্বোধ জাতি পেল কী? লজ্জায় এখন মুখ ঢাকে- যেন কুৎসিত, কুরুপা!
ইতিহাস তাদের উপহাস করে, দিল বাঙালিরে গৌরবের নিশান, বিশ্ব নন্দিত শিরোপা।
চেয়ে দেখ সালাম, বরকত, দেখ রফিক, শফিউল- চেয়ে দেখ ফিরে জব্বার
ঢাকার রাজপথে জয়-কেতন নিয়ে উড়ছে তোমাদের রক্তাক্ত পরিধান, উড়ছে আকাশে অনিবার
আজ বিশ্বভাষার উপাখ্যানে নাম ভূমিকায় তোমাদের কথা, কাহিনী- “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”।
প্রণমি তোমাদের, প্রণমি হে ভাষা সৈনিক, প্রণমি তাই উনিশ শত বায়ান্নের ফেব্রিয়ারির একুশ!!

বায়ান্নের প্রতিজ্ঞা

আমার ভাষা মায়ের মুখের প্রথম বাংলা কথা-
এই ভাষাতেই পেয়েছি মায়ের নাড়ী-অন্ত্রের বারতা।
আমার ভাষায় বুঝি ভালো: বাবার হাসির অর্থ,
কাঁদে কখন মা বোনেরা, কেন নয়নলোর অবিরত।
খেলার মাঠে মিঠা স্বরে বন্ধু ডাকে ‘আয়’,
বুঝি কেমনে ‘ভাই’ যদি কয় ভিন কোনো ভাষায়?
আমার ভাষায় ‘আমার বই’ পড়তে শিখতে বেশ
অন্যের ভাষায় ‘আমার বই’ বিড়ম্বনার নাইকো শেষ।
আপিসে বসে কেরানি লেখেন দলি পত্তের ফর্দ,
না বুঝে মনিব, ধমকে বলে, “কি লিখেছ যাচ্ছে তাই”,
বাবু হয় ভীষম জব্দ!
মন্ত্রী এসে বলেন বাংলায়, “হুজুর, সীমানায় হয়েছে গন্ডগুল”।
পাক হুজুর হুংকারেন দ্রোষ্ঠে, “ও কোচ নেহি,
সামালো হাট-হট্রগোল”।
এমন করে আগু-পাছু শিখতে শিখতে পরের ভাষা
পর কখন প্রভু সেজে চেঁছে শুষে খেয়ে তাজা খাসা!

এইভাবে-
অনাহুতের-উদর পুরিল, পেষিত হলো- বাংলার অন্ন-শস্য, মাঠের ধান,
বিরান হলো পাঠের ক্ষেত, সবুজ শোভা ফসলি উদ্যান।
উচ্চ-পদে আমলদারি, তারাই করেন শাসন-শোষণ, বিচার-ব্যবস্থা
বাঙালি সাহেব-বাবু কাচুমাচু, মাথা নীচু, গো-বেচারা নির্বিকার অবস্থা।

কেন?
তুই কে রে চাপিয়ে দিবি তোর আদেশ মোদের উপর?
আত্মনির্ভর জাতি মোরা সিদ্ধান্ত নিতে আমরাই ত স্ব-নির্ভর।
অকস্মাৎ কেনরে তোর আদেশে ধরবো মোরা পরভাষা?
বিবাদ চায় না তাইত বাঙালি শান্তির আশায় হলো নিরাশা!

কি?
নেই কি মোদের রক্ত-শরীর, নেই কি বীর বিত্ত গৌরব গাঁথা কথা?
এই তবে ভাই ভাই?
বাঙালির শ্রম গেলো তবে হয়ে বৃত্যা, হায় অযথা!
দাস তো নই আমি ভাই, পণ করেছি তাই,
পূর্ব-পশ্চিম একসাথে থাকা যদি চাই-
শাসন কর, নেতা হও, চেয়ার নিয়ে টানো-হেচড়ো
ভাষা নিয়ে কথা নাই।

স্বৈরিণী হয়ে স্বৈরিতা চাও? এস তবে হে খাদক শক্তিমান;
আমারও আছে আত্মাদর্শ, আছে আমৃত্যু কৃপিত আহুত শত কৃপাণ।
রক্ত দিয়েছি,
আরো দেব, গৌরব মোদের বীরের গর্ব- ‘খাটি বাঙালি’।
ভেস্তে যাবে, হবে যে গুড়ে বালি”!!
ক্যালগেরি, কানাডা