Home কানাডা খবর টরন্টোর পাঠশালার আসরে “সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো : পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ”

টরন্টোর পাঠশালার আসরে “সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো : পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ”

ফারহানা আজিম শিউলী : টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৪০তম ভার্চুয়াল আসরটি নভেম্বর মাসের ২৬ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। এই আসরে মুনতাসির মামুনের লেখা বই ‘সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো: পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ’ নিয়ে বইটির লেখক ও অভিযাত্রী মুনতাসির মামুন আলোচনা করেন এবং অভিযাত্রী মুনতাসির মামুন, কনক আদিত্য ও সারাহ্-জেইন সল্টমার্শ তাঁদের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা শোনান। অভিযাত্রী-কণ্ঠশিল্পী কনক আদিত্য অভিযানের স্মৃতিবিজড়িত কয়েকটি গান গেয়ে শোনান।

সাইকেলে আমেরিকার আলাস্কার অ্যাংকোরেজ থেকে কানাডার টরন্টো। প্রায় ৮০০০ কিমি। ২০১৪ সালের জুন ১৬ থেকে সেপ্টেম্বর ২০। ৯৪ দিন সাইকেলে ভ্রমণ। প্যাসিফিক-মাউন্টেন-সেন্ট্রাল-ইস্টার্ন — ৪টি টাইমজোন অতিক্রম। কানাডার ইউকন, অ্যালবার্টা, সাসকাচিউয়ান, ম্যানিটোবা, অন্টারিও — ৫টি প্রদেশ অতিক্রম। প্রজেক্ট ট্র্যাশম্যানিয়াক — দাতা বা কর্পোরেট সংস্থার না, নিজস্ব দায়বদ্ধতা থেকে মুনতাসির মামুনের প্যাশনেট প্রজেক্ট। বিশ্বজুড়ে ক্ষতিকর আবর্জনা কমানোতে সচেতনতা তৈরির এই অভিযানে ভ্রমণের পাশাপাশি প্লাস্টিকজাত আবর্জনার নমুনা খোঁজা এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের সাহায্যে আবর্জনার মানচিত্র তৈরি করা। আর সবটা অভিযান জুড়েই লাল-সবুজ বাংলাদেশ। এই অভিযানের অভিযাত্রী – বাংলাদেশের মুনতাসির মামুন, কনক আদিত্য ও তাঁদের অস্ট্রেলিয় বন্ধু সারাহ্-জেইন সল্টমার্শ।

আলাস্কা থেকে টরন্টোর এই অভিযান নিয়ে মুনতাসির মামুন লিখেছেন – ‘সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো: পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ।’ এ বছরের অক্টোবরে বইটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের ইউপিএল (দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড)। রোজনামচার আদলে লেখা বইটিতে সাইকেলে ভ্রমণের আদ্যোপান্ত থেকে আমরা দেখতে পাই- দীর্ঘ পাহাড়ি বন্ধুর পথের নানা চ্যালেঞ্জ, হাজার ফুট উঁচু চড়াই-উৎরাই পার হওয়া, বৈরি আবহাওয়া, হিংস্র শ্বাপদের ভয়, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মহাসড়কের শোল্ডার ধরে শতশত কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া; বুনো প্রকৃতি, নিসর্গ; পথের স্বজনদের সহযোগিতা-সহমর্মিতা; লোকালয়, পরিত্যক্ত শহর-প্রান্তর, আদিবাসী ও স্থানীয়দের বৃত্তান্ত; চলমান পথে ক্রমাগত স্বদেশের স্মৃতি, স্বদেশ-বিদেশের তুলনা-প্রতিতুলনা ও ডায়ালগের মধ্য দিয়ে অভিযাত্রীর লেন্সে অন্য এক স্বদেশ নির্মাণ; সভ্যতা, আধুনিকতা, ভোগবাদী জীবন, উন্নয়ন নিয়ে ক্রমাগত সংশয় ও প্রশ্ন উত্থাপন ইত্যাদি। মুনতাসির মামুনের তোলা আলোকচিত্র অবলম্বনে বইটির প্রচ্ছদ করেছেন কনক আদিত্য ও মুনতাসির মামুন। বইটির অলংকরণ করেছেন কনক আদিত্য। মুনতাসির মামুনের তোলা অভিযানের বেশ কয়েকটি আলোকচিত্র আছে বইটিতে। ২৯২ পৃষ্ঠার এই বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে কনক আদিত্য ও সারাহ্-জেইন সল্টমার্শকে।

মুনতাসির মামুন ২০১৪ সালের আলাস্কা-টরন্টো অভিযানের আগেও আরো বেশ কিছু অভিযানে অংশ নিয়েছেন দেশে-বিদেশে। সাইকেলে, পায়ে হেঁটে। পর্বতারোহণ করেছেন। জলপথের অভিযানেও অংশ নিয়েছেন। আলাস্কা-টরন্টো অভিযানের পরেও তাঁর অভিযাত্রা অব্যাহত আছে। তিনি দেশে পদযাত্রায় অংশ নিয়েছেন এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে। দেশে সমুদ্র সৈকতের আবর্জনা পরিষ্কারে তাঁর তৈরি ‘প্রজেক্ট কেওক্রাডং।’ ২০১৩ সালে ৫জন মিলে শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলেন সাইকেল চালাতে। ২০০৫ সালে ফুজি পর্বত আরোহন করেন। ১৯১২ সালে আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল সহ আমেরিকার পশ্চিম থেকে পূর্ব উপক‚ল সাইকেলে অতিক্রম করেছেন বিশ্বজুড়ে ক্ষতিকর আবর্জনা কমাতে সচেতনতা তৈরির কাজে। এটি করেছেন তাঁর নিজের তৈরি ‘প্রজেক্ট ট্র্যাশম্যানিয়াক’ নামে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের আলাস্কা-টরন্টো অভিযান। অতিক্রমের দূরত্ব হিসেবে এই অভিযান, মানে আলাস্কা থেকে টরন্টোর অভিযান আগের যে কোনোটি থেকে অনেক দীর্ঘ। কোনো কর্পোরেট স্পন্সর ছাড়াই পরিবেশ সচেতনতায় তাঁর এসব উদ্যোগের শুরু। পরিবেশ নিয়ে গবেষণা ও গণসচেতনতার জন্য পুরষ্কারপ্রাপ্ত মামুনের ‘প্রজেক্ট ট্র্যাশম্যানিয়াক’ একটি অ্যাডভোকেসি ক্যাম্পেইন। সাধারণ মানুষের কাছে পরিবেশ সচেতনতার বার্তা পৌঁছাতে মামুন বেছে নেন অল্পগতির বাহন সাইকেল। আমেরিকা, কানাডায় প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার ও বর্জ্য অনেক বেশি, আর বাংলাদেশ ভালনারেবল দেশের অন্যতম। তাই আলাস্কা-টরন্টো অভিযানে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা ও কানাডাকে বেছে নেওয়া।

মামুনের সঙ্গী-বন্ধু কনক আদিত্যও নানারকম অভিযানে অংশ নেওয়া অভিযাত্রী। তিনি এই অভিযানের আগে পর্বতারোহণ করেছেন, আমেরিকা থেকে কানাডায় গাড়ির অভিযান করেছেন। নানান সচেতনতামূলক কাজে সাইকেলে অভিযান করেছেন, পদযাত্রা করেছেন। এখনও তাঁর নানারকম অভিযান অব্যাহত আছে।

মামুন-কনকের সঙ্গী সারাহ্-জেইন সল্টমার্শ ক্লাইমেট জাস্টিস ক্যাম্পেইনের অ্যাক্টিভিস্ট ও সক্রিয় অভিযাত্রী। সারাহর সঙ্গে মামুনের যোগাযোগ সাইকেলের সূত্র ধরেই, এই অভিযানের ৪ বছর আগে, ২০১০ সালে। কনকের সঙ্গেও সারাহর পরিচয় এই অভিযানের আগে থেকে, বাংলাদেশে। ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয় নাগরিক সারাহ্ ঢাকায় আসেন জাতিসংঘের কর্মকর্তা হিসেবে। সেখান থেকে যোগ দেন এই অভিযানে।

মামুন আর সারাহ্ চালিয়েছেন ট্যান্ডেম (দুজনে চালানোর সাইকেল)। এই ট্যান্ডেম মামুনের নানা অভিযানের সিগনেচার যান। এটি ‘বাইক ফ্রাইডে’ নামের ছোট একটা কোম্পানির হাতে বানানো সাইকেল। এই সাইকেলের আসল নাম হলো ফ্যামিলি ট্যান্ডেম ট্রাভেলার। আর কনক চালিয়েছেন দুই চাকার সাইকেল।

১৬ জুন থেকে অভিযান শুরু। তবে অভিযান বর্ণনার আগে বইতে প্রিলিউড মতো আছে ‘দ্য প্রাইস অফ মাই ফ্রিডম’ নামে। এই অভিযানে কী লাভ? সে হিসাবের নামটাই মামুন দিয়েছেন ‘দ্য প্রাইস অফ ফ্রিডম’ নামে। মূল্য হিসেবে যাত্রাপথের নানা ঝুঁকি-চ্যালেঞ্জ থেকে সঞ্চয় খরচ হয়ে যাওয়া, চাকরি খোয়ানো, পরিবারের সদস্যদের কষ্ট ইত্যাদি। আর প্রাপ্তি? প্রাপ্তি হিসেবে দীর্ঘ পথ জুড়ে ও বুকের ভেতর লাল-সবুজের নিশান ওড়ানো।

মামুনের লেখা ‘সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো: পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ’ বইটি রোজনামচার মতো করে লেখা। এখানে প্রতি দিনের লেখার শিরোনাম আছে, যাতে আছে সেদিনকার শুরুর পয়েন্ট থেকে গন্তব্যের জায়গার নাম। এর নিচে দিন-তারিখের উল্লেখও আছে। আর আছে একটা সাবহেডিং, যা বেছে নেওয়া হয়েছে সেদিনের ঘটে যাওয়া বিষয় থেকে কোনো একটা চুম্বক-আকর্ষক অংশ। যেমন: ১৬ জুন ১ম দিন, অ্যাংকোরেজ থেকে পালমার, ইনটু দি ওয়াইল্ড; ১৮ জুন ৩য় দিন, চিকালুন থেকে মাতানুস্কা হিমবাহ, মুজের দেখা হ্রদের ধারে; ২০ জুন ৫ম দিন, নেলচিনা থেকে গেøনালেন, ক্যাম্পগ্রাউন্ড অর্কেস্ট্রার সাথে কনক ভাইয়ের বাংলা গানে সকাল; ৩০ জুন ১৫তম দিন, কোডিয়ান থেকে ডেসট্রাকশন বে, ভাল্লুকের ভয়ে সারা দিন; ১৭ আগস্ট ৬২ তম দিন, অ্যামপ্রেস থেকে ইটোনিয়া: ইটোনিয়া থেকে এলরোজ, পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ; ২ সেপ্টেম্বর ৭৬তম দিন, সাবাকোয়া থেকে থান্ডার বে, শিল্পী মনিরুল ইসলাম যদি বাইক মেকানিক হতেন ইত্যাদি। এই সাবহেডিং দুটো কাজ করেছে। এক, ঐ দিনের ঘটনার চুম্বক অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে; দুই, একইসঙ্গে জানতে আগ্রহী করে তুলছে পাঠককে পড়ার আগেই।

বইয়ের বেশিরভাগ দিনের শেষটা – সেদিন অভিযাত্রীরা কতটক পথ পাড়ি দিয়েছেন, কতটা চড়াই কতটা উৎরাই তার হিসেব দিয়ে। যেমন ৯৪.৭৭ কিমি, ১৩৭৪ মিটার ওঠা, ২৬৭৯ মিটার নামা ইত্যাদি। কিন্তু কোনো কোনো দিনের শেষটা এমনভাবে লেখা, যাতে পাঠকের আগ্রহ-কৌতূহল তৈরি হয় পরের দিন নিয়ে। যেমন: ১০ জুলাই ২৫তম দিন, সামনের পথের ভয়াল কল্পনা মনকে এদিক-ওদিক করছে। এই এন্ডিং পরিকল্পিত মনে হয় না। মনে হয় খুব স্বতঃস্ফূর্ত। পাঠক নিজেকে যুক্ত করে নিতে পারেন কাহিনির সঙ্গে, এনগেজমেন্ট তৈরি হয় পাঠকের।

জুনের ৪ তারিখে মামুন, কনক, সারাহর উড্ডয়ন। ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক। প্রয়োজনীয় কেনাকাটা শেষে ১৪ তারিখে অ্যাংকোরেজ। বন্ধু মনিকা ফোর্ডের বাসায়। দুই দিন বিশ্রাম শেষে ১৬ তারিখে সাইকেল নিয়ে বের হওয়া। ২০১৪র বছর কয়েক আগে ঢাকায় কাজ করতো মনিকার ভাই ক্যান ফোর্ড। মামুনের সঙ্গে বন্ধুতা তৈরি হয় তখন। মাউন্টেন বাইকিং করতেন ক্যান। আলাস্কা থেকে শুরু করবে জেনে ক্যান তাঁর আলাস্কাবাসী বোনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন মামুনকে ইমেইলে।

‘সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো: পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ’ বইয়ের প্রথম ৪২ পৃষ্ঠা জুড়ে আছে ১১ দিনের এন্ট্রি। অ্যাংকোরেজ থেকে ইউএস-কানাডা সীমান্ত। জুন ১৬ থেকে জুন ২৬। অ্যাংকোরেজ থেকে পালমার, পালমার থেকে চিকালুন, চিকালুন থেকে মাতানুস্কা হিমবাহ, মাতানুস্কা থেকে নেলচিনা, নেলচিনা থেকে গেøনালেন, গেøনালেন থেকে মেনটাস্টা, চিস্টোচিনা থেকে মেনটাস্টা, মেনটাস্টা থেকে টোক, টোক থেকে নর্থওয়ে জংশন, নর্থওয়ে জংশন থেকে ইউএস-কানাডা সীমান্ত।

বইয়ের বাকি ২৫০ পৃষ্ঠা জুড়ে কানাডা পর্ব। ২৭ জুন ১২তম দিন, ইউএসএ-কানাডা সীমান্ত – বিভার ক্রিক, ইউকন, কানাডা থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ৯৪তম দিন, মার্কডেল, অন্টারিও।
অভিযাত্রীদের কানাডিয় বন্ধু ক্রিস্টোফার ইয়র্ক ক্রিস যোগ দেন কানাডা থেকে। ২০০৩ সালে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ট্রেকিং করার সময় একসঙ্গে থেকেছিলেন মামুন-ক্রিস সপ্তাহ দুয়েক। ১১ বছর পর আবার দেখা ক্রিসের দেশেই। ১৯তম দিন ৪ জুলাই, কানাডার ইউকন প্রদেশের রাজধানী হোয়াইটহর্সে দেখা হয় ক্রিসের সাথে। ২১ দিন ক্রিস সহযাত্রী ছিলেন।
২৯ জুন ১৪তম দিন অর্থাৎ কানাডায় ১ম দিনে অভিযাত্রীদের সঙ্গে দেখা হয় সুইজারল্যান্ডের যুগল মার্টিন আর সিমন এর। এঁরাও সাইক্লিস্ট। মাঝে কয়েকদিন বিচ্ছিন্নতার পর আবার ১৩ জুলাই ২৮তম দিনে নাগেটসিটির ক্যাম্পগ্রাউন্ডে তাঁদের দেখা পাওয়া যায়। ২৩ জুলাই ৩৮তম দিন, বেল টু লজ থেকে মেজিয়াদিন হ্রদের যাত্রায় বিদায় নেন মার্টিন-সিমন যুগল। ওঁরা চলে যান দক্ষিণে ভ্যাঙ্ক্যুভারের দিকে, আর মামুনরা পূবের দিকে টরন্টোয়। আর আগস্টের ৮ তারিখ কানাডার অ্যালবার্টা প্রদেশের ব্যান্ফ থেকে বিদায় নেন অন্যতম সহযাত্রী কনক আদিত্য।

৯৪ দিন সাইকেল ভ্রমণে উঠে আসে – প্রতিদিন যেখানে থাকা সেখানকার স্থানীয়দের কাছ থেকে পরের দিনের রাস্তার আগাম ধারণা নেওয়া, কখনো না-জানার রোমাঞ্চ-অনিশ্চয়তা, স্থানীয় মানচিত্র দেখে নেওয়া; প্রতিবার প্রতিদিন বের হবার আগে কনে সাজানোর মহাযজ্ঞের মতো সাইকেলকে তৈরি করে নেওয়া; খাবার-দাবার, প্রতি সকালের খাবার আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা ঔটমিল, বেশিরভাগ দিনই রাতের খাবার পাস্তা ডিম সালাদ, ফিল্টার দিয়ে পানি শোধন করে বোতলে ভরা, মাঝেমধ্যে রেস্টুরেন্টে খাওয়া, কখনো খিদের চোটে কাঁচা পাস্তা আর পিনাট বাটার দিয়েই খাবার সারা; খরচ বাঁচানো ও সারা দিনের ক্লান্তি নিংড়ানোর জন্য রান্না করা ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কা অভিযানে কেনা চুলায়; ক্যাম্পফায়ার-আড্ডা; পাহাড়ি চড়াই-উৎরাই পাস অতিক্রম, চড়াই ধরে শুধু উঠে যাওয়া আর উঠে যাওয়া, কখনো পাসের চুড়ায় ওঠা, কখনো আঁকাবাঁকা পাহাড়ে দোলনার মতো দুলুনির তালে এগিয়ে যাওয়া; উৎরাইয়ে ব্রেক চেপে রাখতে রাখতে হাত ব্যথা; নিসর্গ, বুনো প্রকৃতি; সাইকেল নষ্ট হওয়া – চাকা ফুটো, সাইকেলের কিক স্ট্যান্ড ভেঙে যাওয়া, টায়ার পাংচার, সাইকেলের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি ওজন চাপানো, স্পোক কেটে যাওয়া, রিম ক্ষয়, সাইকেল নষ্ট হলে নিজেরা সারাতে না-পারলে মহাসড়কে গাড়ি থামিয়ে অন্য একটা গাড়ি ধরে পেছনে যাওয়া, সিটবোনে ব্যথা, হাঁটুতে ব্যথা; প্রতিক‚ল আবহাওয়া – দমকা হাওয়া, কখনও রোদের তাপ কখনো ঠান্ডা কখনো বৃষ্টি, কুয়াশার চাদরে আদ্যোপান্ত ঢাকা পথঘাট, হেড উইন্ড, জবজবে ঘাম; পথের স্বজনদের সাহায্য-সহযোগিতা; গন্তব্যে পৌঁছে সুপারমার্কেটে কেনাকাটা, বাইক স্টোর থেকে টায়ার লিভার কেনা, ক্যাম্প করার জায়গা খোঁজা, ক্যাম্পগ্রাউন্ডে যাওয়া, তাঁবু খাটানো, কখনো বৃষ্টিতে রাতে তাঁবু ভিজে যাওয়া, সেই তাঁবু শুকানো গোটানো কখনো ভেজা তাঁবুর ভারি ওজন নিয়েই যাত্রা, কখনো বিদ্যুৎহীন কলের পানি ছাড়া মশা উপদ্রুত ক্যাম্পগ্রাউন্ডে রাত্রিবাস, কখনো আরভিতে লজে মোটেলে থাকা; হিংস্র প্রাণি – ভালুক মুজ লিঙ্কসের ভয়ে নির্ঘুম রাত, সুঁচ বেঁধার মতো হিমশীতল গø্যাসিয়াল ওয়াটারে স্নানের অভিজ্ঞতা; মহাসড়কে ঝুঁকি নিয়ে সরু শোল্ডারে বিশালাকায় যানবাহনের পাশে সাইকেল চালানো; অভিযানের অংশ প্রতিটি লোকালয়, শহর-গ্রাম, পরিত্যক্ত শহর, মানুষ, আদিবাসী, ক্যাম্পগ্রাউন্ড, রেস্ট এরিয়া, সুপারমার্কেট, মুদিদোকান, দোকানি, রেস্টুরেন্ট, মোটেল, মোটেল মালিক, লজ, লজ মালিক, বাইক স্টোর থেকে প্রতিটি ঘটনারও বিস্তারিত ও এর সঙ্গে সেসবের ইতিহাস ইত্যাদি।

আলাস্কা-টরন্টো অভিযানের বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে পথের স্বজনদের কথা, তাঁদের সহযোগিতা-সহমর্মিতার কথা। মামুনের ভাষায় – আমাদের স্বপ্ন এমন অনেককে জুড়ে জুড়ে ম্যুরাল হয়েছে। সাইকেল এমন একটা বাহন, যা মানুষকে সমীহ শেখায়। এই রাজপথে যে-কোনো সাইকেলারোহীর নিজের সুরক্ষা আসলে নিজের হাতে খুব বেশি নয়। অন্যরা যদি কৃপা না করে, তবে চালানো কঠিন অনেকখানি। ১২ আগস্ট ৫৮তম দিন, স্টার্থমোর থেকে বাসানোর পথে পাই এক রোড-সাইড গ্র্যান্ডামাদার এর কথা। পথে এক হুটারাইটদের দোকানে ঢোকেন মামুনরা। হুটারাইটরা আমিস বা ম্যানোনাইটদের মতোই। ৭০ বয়সী দোকানি। সারাহকে উপহার দেন হাতে বোনা পায়ের মোজা, বনরুটি, পাই। মামুন লিখছেন, মনুষ্যত্বের উপকরণ আর উদাহরণ রাস্তায় যত মেলে, অন্য কোথাও মেলে কিনা আমি বলতে পারব না। ২৯ আগস্ট ৭২তম দিন, অন্টারিওর ক্যানোরা থেকে ড্রাইডেনের পথে ভারমিলিয়ন বে’তে দোকানি বিনা পয়সায় ক্রোসান্ট দেন সারাহর হাতে। মামুন লিখছেন, ভালোবাসা ছোঁয়াচে; যত গাঢ়, আঁচও তার বেশি। থান্ডার বে’র শিল্পী মনিরুল ইসলামের মতো দেখতে ঝানু ইরানি বাইক মেকানিক ফারজাম ইতেমাদি মজুরি নেননি মামুন-কনক-সারাহদের। অভিযাত্রীদের কৌতুহলী প্রশ্নে তাঁর বিরক্তি নেই, আছে আহ্লাদ প্রশ্রয়। ৭ সেপ্টেম্বর ৮১তম দিন, ম্যারাথন থেকে হোয়াইট রিভারের পথে হোয়াইট রিভারে মোটেলের রেস্টুরেন্টে এক কানাডিয় যুগল প্রস্তাব দেন তাঁদের গাড়িতে অভিযাত্রীদের এগিয়ে দিতে, আরেক ফরাসি যুগল প্রস্তাব দেন চাইলে টরন্টো অবধি নিয়ে যাবার। মামুন লিখছেন, ভয়ই শুধু সংক্রামক নয়; ভালবাসা, মায়া, শ্রদ্ধাও মনে হয় আরও বেশি সংক্রামক। ২৫ জুন ১০ম দিন, টোক থেকে নর্থওয়ে জংশনে যাবার পথে, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা জিওফিজিসিস্ট ম্যারিকের চুলা ব্যবহার করে তাকো বানান এবং তাঁর টুলবক্সের লিভার দিয়ে চাকা সারান অভিযাত্রীরা। ২৬ জুন ১১তম দিন, ইউএস কানাডা সীমান্তের পাশের লজের মালিক বিনা খরচে ক্যাম্পের অনুমতি দেন। রেস্ট এরিয়ায় জল, ফলমূল এমনকি গুরুপাক খাবারও উপহার পান মামুনরা। ২৫ জুলাই ৪০তম দিন, ১২তম দিন ক্যাসিয়ার মহাসড়ক ধরে মেজিয়াদিন থেকে টেরেস যাবার পথে ট্যান্ডেমের স্পোক কেটে গেলে, ফরাসি মরিস আর মরিশাসের সুজি দম্পতির আরভিতে করে এগিয়ে যান তাঁরা। ৪ আগস্ট ৫০তম দিন, সাসকাচিউয়ান রিভার ক্রসিং থেকে লুইস হ্রদ যাবার পথে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ক্যাম্পগ্রাউন্ডে পৌঁছে অভিযাত্রীরা দেখেন সেখানে আর জায়গা নেই। কিন্তু তাঁদের অনুমতি মেলে এবং ফেরিতে ওঠার সময় তদারক করা ভদ্রলোক অন্যদের গাড়ি আটকে নিরাপদে তাঁদের উঠতে দেন। ১০ আগস্ট ৫৬তম দিন, বো উপত্যকা থেকে ক্যালগেরির পথে ক্যালগেরিতে বো সাইকেল-এ এবং উইনিপেগে যাত্রাবিরতিতে এমইসি বাইক ওয়ার্কশপে বাইক-মেকানিক মজুরি রাখেননি অভিযাত্রীদের কাছ থেকে।

১৭ জুলাই ৩২তম দিন, ক্যাসিয়ার মহাসড়ক ধরে কটনউড থেকে দেজ হ্রদ যাবার পথে দেখা যায়, একজন রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর উপুড় হয়ে বন্য স্ট্রবেরি খুঁজছেন। পিঠে বেঢপ ব্যাকপ্যাক। ২ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে ভ্রমণ করছেন তিনি। ৯ আগস্ট ৫৫তম দিন, ব্যান্ফ থেকে বো উপত্যকার পথে অভিযাত্রীরা দেখা পান ৬০ বছরের ডাচ যুগলের। ট্যান্ডেমে! তাঁরাও যাচ্ছেন ক্যালগেরিতে। সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ করছেন অনেক দিন থেকে। ওঁদের সাথেই ক্যাম্পিং করেন মামুনরা।

কানাডার ভূপ্রকৃতি সহ আরো অনেক কিছু উঠে এসেছে বইয়ে, যা অভিযাত্রীদের আলোচনায়ও উঠে আসে। যেমন: কানাডায় নারীদের অংশগ্রহণ বেশি; অনেক ক্যাম্পগ্রাউন্ডে ফি নেবার কেউ নেই; এদেশটা এত বড়ো আর এত কিছু আছে যে অনেক মানুষ হয়ত জানেই না; কানাডায় মনে হয় ছোট কিছু নেই। মেজিয়াদিন লেক প্রভিন্সিয়াল পার্কটা বিশাল, বিশাল ক্যাম্পগ্রাউন্ড। রুমা বাজার থেকে বগালেক হয়ে কেওক্রাডং – এতটাই বড়ো। জ্যাসপারের হুইসলার ক্যাম্পগ্রাউন্ড একটা শহরের মতো বড়ো; কানাডায় ট্রেনকেন্দ্রিক ভ্রমণ এক বিশেষ ধরনের ভ্রমণ। বৃটিশ কলম্বিয়ার সৌন্দর্যের জন্য বিভিন্ন স্থানে ঋতুভেদে ট্রেন চলে; পথ জুড়ে বিস্তীর্ণ ঢেউ খেলানো হলুদ রঙের বুনো ফুলের সাগর, দীর্ঘ পথ জুড়ে জ্বলজ্বলে বুনো ফুলের ঢেউ; ব্যান্ফ কানাডার রোমাঞ্চের রাজধানী; সাসকাচিওয়ান অন্যতম বন্ধুবৎসল অঙ্গরাজ্য; ১২ জন মানুষের ছোট্ট শহর; কানাডার অনেক জায়গায়ই ভালুকের ভয়; প্রমাণ আকারের উইয়ের ঢিবির মতো দেখতে তালতাল বেলে পাথরের ফুলে থাকা চাঙরের ব্যাডল্যান্ড; অসংখ্য হ্রদ; টেরি ফক্স কারেজ মহাসড়ক ও টেরি ফক্সের বৃত্তান্ত; পুটিন, ম্যাপল সিরাপের ইতিহাসপাঠ; উইনি দ্য পু, ট্র্যাপার্স মিউজিয়াম, হ্যালোইন, কানাডা ডে’র ইতিবৃত্ত; ট্রান্সক্যানে অন্টারিওর আদিবাসী ইনুইটদের তৈরি ইনুকশুকের বিস্তারিত; হাইওয়েতে ১৮ চাকার ট্রাক, অন্টারিওর শুরুতেই আবর্জনার প্রাচুর্য এবং ‘অ্যাডাপ্ট এ হাইওয়ে’ ফলক মানেই ওই এলাকায় আবর্জনা বেশি; ট্রান্স-কানাডা হাইওয়ের ওপর মায়া, ক্যাসিয়ার মহাসড়ক ছেড়ে আসার কষ্ট; কানাডিয়ান আর্ট মুভমেন্টের শিল্পীরা যে অঞ্চলে ছবি এঁকেছেন সেইসব জায়গার সৌন্দর্যের বর্ননা, যেমন – লেক সুপিরিয়র, আগাওয়া বে, স্যু সে মেরি, এলগনকুইন, হ্যিউরন লেক, আলগোমা।

সভ্যতা আদতে কী? এর মানদণ্ড কী? সভ্য কারা, সভ্য মানুষের প্রবৃত্তি, ভোগবাদী সমাজে আমাদের সীমাহীন চাহিদা – এ বিষয়গুলো বারবার ঘুরেফিরে এসেছে পুরো অভিযান জুড়ে। এসেছে জেনেটিক্যালি মডিফায়েড খাবার প্রসঙ্গ, বড়ো বনাম ছোটো শহর, ছোটো শহরে মানুষ-মানুষে আত্মীয়তা, নগরায়ণ আর উন্নয়নের পরিনাম, সভ্যতা ও আধুনিকতা, কৃত্রিম আধুনিক জীবন, সময়ের সাথে ইতিহাসবিমুখতা। উন্নতি আর প্রকৃতির সহাবস্থান কি সম্ভব – উঠেছে এই প্রশ্ন।

লেখক পাওলো কোয়েলহো দীর্ঘ ৫০০০ মাইল পায়ে হেঁটে ভ্রমণের সময় তাঁর মধ্যে এক ধরনের আধ্যাত্মবোধের উন্মেষ হয়। যার ফসল ‘আলকেমিস্ট।’ সেখানে আমরা পাই ‘মক্তুব।’ এই ‘মক্তুব’ মামুনের লেখায় বেশ কয়েকবার এসেছে। প্রকৃতি সংলগ্ন এই ধরনের দীর্ঘ ভ্রমণ মানুষের মধ্যে নানান দার্শনিক বোধের জন্ম দেয়, যা অভিযাত্রীদের পরবর্তী জীবনে প্রভাব ফেলে। এ প্রসঙ্গে মামুন ও কনক আলাস্কা-টরন্টো অভিযান তাঁদের জীবনে কী প্রভাব ফেলেছে তা তুলে ধরেন।

মামুন বলেন, গাড়ি আর সাইকেলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। ভর অনুভব করা যায় না গাড়িতে, ফলে উঁচু নিচু বোঝা যায় না, সাইকেলে যায়। সাইকেল ধীরগতির হবার কারণে অল্প বিরতিতে থামতে হয়, বেশি জায়গা দেখা যায়, বেশি লোকজনের সংস্পর্শে আসা যায়, যা গাড়িতে হয় না। বাংলাদেশে সাইকেল এখনো গরিবের বাহন কিন্তু পশ্চিমে সম্মানের-সমীহের। আমরা জানতে পারি, সাইকেলের সঙ্গে অযান্ত্রিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে এক পর্যায়ে অভিযাত্রীদের। জন্মে সাইকেলের প্রতি মায়া, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা।

‘সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো: পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ’ বইতে অভিযানের রোজনামচায় বিভিন্ন জায়গার-শহরের-জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র, সমাজমানস আমরা পাই? ইনসাইডার্স পার্সস্পেকটিভ পাই। মূল্যবোধ, প্রথা, আচার, জীবনাচরণ সম্পর্কে জানা যায়। এক্ষেত্রে অভিযাত্রীরা অনেকটা সমাজবিজ্ঞানী-নৃবিজ্ঞানীর ভূমিকা নেন সীমিত পরিসরে হলেও। ১৫ আগস্ট বাফেলো থেকে অ্যামপ্রেস যাবার পথে যাত্রাবিরতিতে, হোস্ট ক্যালি আর বনি রসের সাথে ব্যারেল রেসিং প্রতিযোগিতা দেখতে যান মামুন-কনক-সারাহ। মামুন লিখছেন, স্থানীয়দের সাথে তাঁদের কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে রীতিনীতি আরও ভালো করে জানা যায়; তাহলতান জনগোষ্ঠীর ‘স্যাকরেড হেডওয়াটার মিউজিক ফেস্টিভাল’-এ অংশ নেন তাঁরা; মহাসড়ক ১৭ বা ১১তে কাকাবেকা ঝরনা হয়ে থান্ডার বে-তে যাওয়া যায় কিন্তু ১০২ মহাসড়ক ধরে গেলে ফিনল্যান্ডের বাইরে সবচেয়ে বড়ো ফিনিস বসতি দেখতে পাবেন বলে তাঁরা সেই পথ বেছে নেন। মামুন লিখছেন, এ জনসমাজগুলোতে গেলে রীতিমতো সাংস্কৃতিক সফরের মতো হয়।

আলাস্কা-টরন্টো অভিযানের পরতে পরতে খুঁজে পাওয়া যায় – বাংলাদেশকে। সেই অর্থে বইয়ের নামটা খুব লাগসই মনে হয়। দৃশ্যমানভাবে লাল-সবুজের পতাকা বহন, বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা তো আছেই। আরো আছে অন্যরকম বাংলাদেশ। অনাবাসীদের যেমন ফেলে আসা দেশকে ঘিরে স্মৃতিকাতরতা থাকে, আর মানিয়ে-মেনে নিয়ে, অভিবাসী দেশ ও স্বদেশের ডায়ালগ ইত্যাদি ঘিরে ক্রমাগত নির্মাণ-বিনির্মাণ চলে ফেলে আসা স্বদেশের। এটি একরকম। আর মামুনের লেখায় – অভিযানের অনেক বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের স্মৃতি, তুলনা-প্রতিতুলনা, শৈশবের স্মৃতিকাতরতা পাই। কিছু প্রশ্নও পাই, মনোলগের মতো। এই সব মিলিয়ে মামুন তাঁর অভিযাত্রী সত্তা থেকে অন্য এক ধরনের স্বদেশ নির্মাণ-বিনির্মাণ করেছেন। মামুন লিখছেন, “সব দেশে দেশেই যে আমার দেশ আছে।” তাই বিদেশে এসে স্বদেশ বারবার ফিরে ফিরে এসেছে অভিযাত্রীদের অভিযানে, মামুনের লেখায়।

জ্যাসপার থেকে ব্যান্ফে যাবার পথে মহাসড়ক ৯৩ তে রাস্তায় ম্যানহোলের ঢাকনা ঢাকার কথা মনে করিয়ে দেয়; ক্যালগেরির বো সাইকেলের দোকান দেখে মনে পড়ে বাংলাদেশের আইডিবি ভবনের কম্পিউটার মার্কেটের কথা; উইনিপেগের স্টেলাস ক্যাফেতে পরিবেশন, খদ্দেরদের সঙ্গে সম্পর্ক দেখে মনে পড়ে সোবহানবাগ কলোনির সামনের সেলুনের যোগেশ নাপিতের কথা; বুরিতোতে ব্যবহৃত রুটির সাথে মনে পড়ে বাংলাদেশে মাদুর পেতে লাকড়িচুলা নিয়ে বসা মানুষের তৈরি লাল আটার রুটির আর ম্যাপল সিরাপ কুকি দেখে শৈশবের ক্রিম বিস্কুটের কথা। আবার কিছু দেখে মনে পড়ে স্বদেশের বৈপরীত্যের কথা, তৈরি হয় মনোলোগ। যেমন: কানাডার হোয়াইটহর্স ক্যাম্পগ্রাউন্ডের অপরিষ্কার টয়লেট আর ব্যস্ত স্নানাগার আর জেড সিটিতে দামী পাথরের দোকান দেখে দেশের কথা; বেল টু লজে পাঁচ তারা হোটেলের পাশেই ২০ ডলারে তাঁবু আর ৪০ ডলারে আরভির সুবিধা দেখে মামুন লিখেন, ভাবা যায় দেশের গ্র্যান্ড সুলতানের সাথে তাঁবু ফেলার জায়গা কিংবা সস্তায় পরিষেবা? ম্যানিটোবার উইনিপেগের এক বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্টে দারুণ যত্নে সংরক্ষিত ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য দেখে যেমন ফিরে আসে শৈশবের স্মৃতি তেমনি লিখেন, দেশের মতো পুনর্নিমাণের নামে নতুন করে চকচকে মরিচারোধী ইস্পাতের কোনোকিছুতে পালটে দেওয়া হয়নি; ম্যানিটোবার উইনিপেগে জাতিবৈচিত্র?্য দেখে আসে বাংলাদেশের তুলনা, প্রশ্ন; ছোট্ট শহরেও গ্যালারি দেখে প্রশ্ন করেন, অত মানুষের বাংলাদেশে শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা নেই কেন, নিজেদের তবে সভ্য দাবি করি কী করে! উল্লেখ্য, ১৭ আগস্ট ৬২ তম দিন, অ্যামপ্রেস থেকে ইটোনিয়া: ইটোনিয়া থেকে এলরোজের পথে অভিযাত্রীরা দেখা পান বাংলাদেশি মালিকানাধীন ‘ববস ডাইনার।’ সেলিম, দিশা আর লুনা মিলে রেস্টুরেন্ট চালান। তাঁদের আতিথেয়তায়ও ফিরে আসে স্বদেশ।

‘সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো: পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ’ বইয়ের লেখা খুবই স্বাদু, টেনে রাখে। কারণ যাত্রাপথ একসময় যেমন অভিযাত্রীদের মধ্যেও একঘেয়েমি নিয়ে আসে, সেই আশঙ্কটা পাঠকের বেলায় আরো বেশি। সেই তো দিনের শুরু, সাইকেলে করে পথ পাড়ি দিয়ে কোনো গন্তব্যে যাওয়া, সেদিনের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। কিন্তু মামুনের লেখার স্টাইলের কারণে পাঠক বইটা মাঝপথে থামিয়ে দেবেন না কিংবা একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হবেন না, নিশ্চিত করে বলা যায়। লেখায় অনানুষ্ঠানিক একটা অ্যাপ্রোচ যেমন আছে, তেমনি আছে সময় সময় কাব্যিক দ্যোতনাও।

নতুন শব্দ এলেই সঙ্গে সঙ্গে সেসবের বেসিক বর্ণনা আছে বইটিতে। যেমন আরভি (রিক্রিয়েশনাল ভেহিকল), ফুল হুকআপ অনলি ক্যাম্প স্পট (পানি পয়োনিষ্কাশন আর বিদ্যুতের ব্যবস্থা), লগিং (বানিজ্যিকভাবে গাছ কাটা), ট্রি লাইন (যে উচ্চতার ওপর আর গাছ থাকে না।), হেই (খড়ের গাদা), আএসিএ (এডভেঞ্চার সাইক্লিং এসোসিয়েশন অফ আমেরিকা। ট্যুরিং সাইক্লিস্টদের পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সংগঠন), ব্যানফ মাউন্টেইন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (ব্যানফ সেন্টার আয়োজক। মামুন এর বাংলাদেশের আয়োজ)- ইত্যাদিসহ অসংখ্য জিনিসের। আর আছে বইটিতে পরিমিতি। পরিমিতি লেখায়, পরিমিতি বইয়ে যুক্ত ছবির সংখ্যায়, পরিমিতি ইলাস্ট্রেশনে। সবমিলিয়ে বইটি একটা দুর্দান্ত হ্যান্ডগাইডও হতে পারে।

‘সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো: পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ’ বইটির লেখক ও অভিযাত্রী মুনতাসির মামুন বইটি নিয়ে বলেন এবং অভিযাত্রী মামুন, কনক আদিত্য ও সারাহ্-জেইন সল্টমার্শ আন্তরিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলোচনায় অংশ নেন সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো অভিযানের নানা অভিজ্ঞতার। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে কখনো বই থেকে পাঠ করা হয়। দেখানো হয় বইটির ইলাসট্রেশন ও আলোকচিত্র এবং অভিযাত্রী মামুন, কনক, সারাহ্ সেসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। কণ্ঠশিল্পী কনক ইউকেলেলে বাজিয়ে গেয়ে শোনান অভিযানের স্মৃতিবিজড়িত গান। এই ইউকেলেলে কনকদের আলাস্কা-টরন্টো অভিযানেরও সঙ্গী ছিল। দর্শক-শ্রোতা পুরোটা সময় উপভোগ করেন এবং মন্তব্য করে সক্রিয় থাকেন। পাঠশালার এ আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।

Exit mobile version