কামাল কাদের : বিলেতের শীতকালীন রাত। কনকনে শীত। বাইরে ঘোর অন্ধকার। অশীতিপর বৃদ্ধ শফিক সাহেব একাকী ঘরে সোফায় বসে টেলিভিশন দেখছেন। হঠাৎ করে টেলিভিশনটি এক তীব্র আলোর ঝলকানি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেলো, সাথে সাথে ঘরের ভিতরটাও অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো। নিজেকে তখন আরও একাকী মনে হতে লাগলো। আস্তে আস্তে স্মৃতি পটে নানা ছবি ভেসে আসতে শুরু করলো। প্রিয় অপ্রিয় এমনি অনেক জনের মুখ। সিনেমার পর্দার ছবির মতো, ছবিগুলি মনের অন্তরাল থেকে চলে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে।একটা মুখচ্ছবি যেন ইচ্ছে করে এক জায়গায় এসে স্তব্ধ হয়ে রইলো। সুন্দর মুখখানি, নীল – গভীর চোখ ,সরু চিকন নাক, আপেলের মতো টক টোকে গাল। গায়ের রং ফর্সা হলুদ মেশানো। সোনালী চুল, সুন্দর গড়ন।
প্রথম কাজে ঢোকার দিন বিভাগীয় প্রধান শফিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তার সুপারভাইজার মিস মেরিওন কুপারের সাথে।

— মিস্টার ইসলাম, ইনি এই একাউন্টেন্সি ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ মিস কুপার। আর মেরিওন, উনি মিস্টার শফিকুল ইসলাম। বাংলাদেশ থেকে ইংল্যান্ডে লেখা-পড়া করতে এসেছে। ছয় মাস আমাদের অফিসে “এপ্রেন্টিসিফ” হিসাবে কাজ করবে, তার পর সে ইউনিভার্সিটিতে ফিরে যেয়ে তার ডিগ্রী সম্পূর্ণ করবে। তুমি একটু ওর দিকে নজর রেখো। কাজ টাজ দেখে শুনে বুঝিয়ে দিও।
–তা আর বলতে হবে না মিস্টার টমাস, মেরিওন হাসি মুখে বললো।

মিস কুপার শফিককে তার পাশের একটা টেবিল এবং চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললো। শফিক যথা নিয়মে তার কাজ শুরু করে দিলো। যেদিন থেকে মিস কুপার জানতে পারলো যে, এ বিদেশে শফিক একা এবং তাকে নিজে রান্না-বান্না করে খেতে হয়, সেদিন থেকে মিস কুপার নিজের লাঞ্চের সাথে শফিকের জন্য ও অফিসে লাঞ্চ আনা শুরু করলো। প্রত্যেক দিন ওর লাঞ্চ খাওয়ার জন্য শফিকের নিজেরই খারাপ লাগছিলো। কিছুটা লজ্জাও অনুভব করছিলো। প্রথম দিকে কিছু বলতেও পারছিলোনা। অবশেষে একদিন নিরুপায় হয়ে বললো, “মিস কুপার ,তুমি রোজ রোজ আমার জন্য পয়সা খরচ করে লাঞ্চ নিয়ে আসো, এটা মোটেই ভালো দেখায় না আমি তো অফিসার কেন্টিনেই খেয়ে নিতে পারি”। মিস কুপার বলে, “আমার আর কি পয়সা খরচ হয়, ঘরে যখন নিজেরটা বানিয়ে নিই, তখন তোমারটাও বানিয়ে ফেলি”।
— কিন্তু মিস কুপার!

— না, কোনো কিন্তু টিন্টু নয়। শফিক, আমি মেরিওন তোমার বন্ধু, তোমাকে আমার ভালো লাগে, তাই তোমার জন্য এই কষ্টটুকু করতে আমার কোনো অসুবিধে হয় না।
কথাগুলি শুনে শফিক একেবারে “থ” বনে গেলো। এই সুন্দরী, বিদুষী (কোয়ালিফায়েড চার্টার্ড একাউন্টেন্ট) খাস ইংরেজ ললনা বলে কি! সে তো মাত্র এক শিক্ষানবিশ, বয়সে হয়তো সমান সমান হবে, কিন্তু অন্যান্য দিক থেকে সে তার চেয়ে অনেক উপরে। শফিক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলোনা। তাছাড়া এ দেশে বর্ণবাদী বিদ্বেষের কথা তো কারো অজানা নেই। মেরিওন বলে চলেছে, “জানো শফিক, আমার বাবা ইন্ডিয়াতে আর্মি অফিসার ছিলেন। ওনার কাছে ইন্ডিয়ার অনেক গল্প শুনেছি। ইন্ডিয়ান আর্ট, ইন্ডিয়ান কালচার, ইন্ডিয়ান সভ্যতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেই থেকে আমি মনে মনে ইন্ডিয়াকে ভালোবেসে ফেলেছি। অফিসে প্রথম যেদিন তোমাকে দেখলাম, সেদিন থেকেই তোমাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে। তারপর ধীরে ধীরে তোমার কথা -বার্তায়, তোমার ব্যবহারে আমি বুঝে নিতে পারলাম, আমি একজন খাঁটি ইন্ডিয়ানের দেখা পেয়েছি”।
শফিক বলে, “আমি ইন্ডিয়ান নই, আমি বাংলাদেশী।”

“তোমরা সবাই তা বলো, আসলে ইন্ডিয়া স্বাধীন হওয়ার আগে তোমার বাবা, দাদা, সবাই তো ইন্ডিয়ান ছিলেন”। মেরিওন শফিকের কথাটিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো।
“তোমার সাথে কথায় পারবো না মেরিওন, তোমার কথায় যুক্তি আছে”। শফিকের স্বীকার উক্তি।
তারপর মেরিওনের সাথে এমনি করে অনেকদিন কেটে গেলো। শফিকের ট্রেনিং শেষ হয়ে গেলো এবং সে ইউনিভার্সিটিতে ফুল টাইম ক্লাসে ফিরে এলো। সময়ের সাথে হাত মিলিয়ে তাদের পরস্পর সম্পর্ক মধুর থেকে মধুরতর হতে লাগলো। বছর খানিক পর একদিন মেরিওন বললো,
“চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি”। শফিক একটু ইতস্তত করে জানাল, “আমি এখনও ছাত্র, আর আমাকে প্রতি বছর ভিসা রিনিউ করতে হয়। তাছাড়া আমার নিজের কোনো রেগুলার ইনকাম নেই। দেশে বাবা মাকে কথা দিয়ে এসেছি বিলেত থেকে একটা ডিগ্রী নেবো, তাই এ ব্যাপারে আপাততঃ আমি জড়িত হতে চাই না”।

“ভালো কথা, তুমি টাকা পয়সার কথা ভাবছো কেন? তোমার যত দিন খুশি তুমি ছাত্র থাকো, আমিই সংসারের ভার নিয়ে নিবো। আর ভিসার ব্যাপারটা কিছুই না। আমাদের বিয়ে হয়ে গেলে তুমি অটোমেটিক পার্মানেন্ট থাকার সুযোগ পেয়ে যাবে”। মেরিওন শফিককে কনভিন্স করার চেষ্টা করলো।
“না মেরিওন! অনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করো, আমি সংসার ঝামেলার ভিতর দিয়ে লেখা-পড়া করতে চাই না” শফিকের একান্ত অনুরোধ।
“ঠিক আছে, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো, তোমার ডিগ্রী না হওয়া পর্যন্ত”। মেরিওনের উদার বক্তব্য।

ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলো। শফিক সম্মানের সাথে পাস করলো। আর কোনো বাধা রইলো না। একদিন সময় করে শফিক এবং মেরিওন রেজিস্টার অফিসে যেয়ে তারা বিয়ের অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করলো। দেশে বিয়ের খবরটি বাবা মাকে জানিয়ে দিলো। বাবা, মা ঘটনাটি অবগত হয়ে ভীষণ দুঃখ পেলো। কারণ উনারা দেশে তাদের পছন্দ মতো মেয়ে ঠিক করে রেখেছিলো। মনে মনে ভাবলো ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে ভুল করেছে, আদরের ছেলেটি বিপথে পা বাড়িয়েছে। কি আর করা! দেশের সাথে এভাবেই শফিকের সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলো। বিয়ের মাস কয়েক পর সপ্তাহ দুয়েকের জন্য মেরিওনকে কোম্পানির “অডিটের” জন্য তাদের মাল্টা অফিসের ব্রাঞ্চে পাঠানো হলো। যাবার সময় হিথরো বিমান বন্দরে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হলো। বেশ আনন্দ ঘন পরিবেশে সময়টা কেটে গেলো। বিমানের দিকে এগুতে এগুতে মেরিওন হাসতে হাসতে শফিককে জিজ্ঞাসা করলো, “মাল্টা থেকে তোমার জন্য কি নিয়ে আসবো”? উত্তরে শফিক বললো, “তুমি যত তাড়াতাড়ী নিরাপদে ফিরে আসো, সেটাই আমার চাওয়া, আর কিছু চাই না”। তিন দিন পর মেরিওনের বাবার কাছে খবরটি পেয়ে শফিকের মাথাটা টলতে শুরু করলো, মাল্টাতে মেরিওন নিখোঁজ। ওর কোম্পানি সন্দেহ করছে কুখ্যাত মাফিয়া বাহিনী ওকে কিডন্যাপ করেছে। মাল্টা দ্বীপে এবং তার আশে পাশে এই দলটি খুবই বেপরোয়া। তাদের অসামাজিক এবং হিংস্র কার্যকলাপে কারণে স্থানীয় পুলিশদের ঘুম নেই। শফিক ভাবছে একি তার মা-বাবার অভিশাপে এ ঘটনা ঘটলো? কিন্তু কারো মা-বাবা শত ক্ষতিতেও তার সন্তানদেরকে কখনো অভিশাপ দেয় না এতো সবাই জানে! তবে কেন এমন হলো?
এখনো এই আশি বছর বয়সে শফিক মেরিওনের পথ পানে চেয়ে থাকে, ও আসবে বলে। তার স্মৃতির জগতে আজ ও সে জীবন্ত। আজ ও মেরিওন ছাড়া সে অন্য কিছুতেই মন বসাতে পারেনা। তার সমস্ত ধ্যান, ধারণায় সারাক্ষন মেরিওনকে জড়িয়ে রয়েছে। সেই নীল গভীর চোখ, সরু চিকন নাক, আপেলের মতো টক টোকে গাল, ফর্সা-হলুদ রঙের গা, সোনালী চুল, সে যে তার মেরিওন, তার বিশ্বাস সে কিছতেই এভাবে হারিয়ে যেতে পারে না! পাড়ার লোকরা বেশ কিছুদিন ধরে বৃদ্ধ শফিককে দেখছে না। রাস্তায় বের হলে তারা “হ্যালো”, “হায়” বলে শফিকের কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতো এর বেশি কিছু নয়। সে আপন জগতে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতো। একান্ত বিশেষ প্রয়োজনীয় কেনা-কাটা ছাড়া বাইরে বের হতো না। কোনো কোনো প্রতিবেশী মনে করছে হয়তো মহামারী কোভিড রোগের জন্য কোনো আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় সে চলে গেছে। শফিকের এমন কোনো পরিচিত লোক আছে বলে পাড়ার লোকদের কখনো চোখে পরে নাই।

পাশের ফ্ল্যাটের মহিলা কিছুদিন ধরে কোন কিছু পচে যাওয়ার গন্ধ পাচ্ছে। মহিলার ভয় হচ্ছে, কোনো অঘটন ঘটলো কি -না, যখন সে দেখছে তার প্রতিবেশী শফিকের চিঠি-পত্র দরজার “লেটার বক্সের” প্রবেশ পথে জমে আছে। ফ্ল্যাটের মালিক কাউন্সিলের লোক কয়েক দিন ধরে ঘরের “কলিং বেল” বাজিয়েও ঢুকার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না, তখন কোনো উপায় না দেখে প্রতিবেশী সবাই মিলে পুলিশের কাছে যেতে বাধ্য হলো। পুলিশ গায়ের জোরে দরজা ভেঙে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলো। আশে পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা সবাই যেটা ভয় করছিলো, অবশেষে সেটাই হলো। পুলিশ ঘরের ভিতরে ঢুকার পর দেখতে পেলো সেই স্বল্পভাষী বৃদ্ধ ব্যক্তির দেহটি সোফাটার মধ্যে মরে পড়ে আছে। দেহটি পচতে শুরু করেছে, তারই দুর্ঘন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তার জাতীয়তা জানা হলো, সে একজন ব্রিটিশ বাংলাদেশী। পুলিশের কাছে শফিকের মৃত্যুটা রহস্যজনক, কিন্তু স›েদ্বহ প্রবন নয়। যথারীতি, পুলিশের আইন অনুযায়ী তার দেহখানি অপঘাত মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করার জন্যে “করোনার” অফিসে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এক প্রতিভাবান যুবকের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এই বিলেতে শুরু হয়েছিল, আর ভালোবাসার ভিখারী হয়ে এখানেই একাকী জীবনের শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করলো। প্রিয়জন কেউ জানলো না, একফোঁটা অশ্রু ঝরার কেউ কাছে থাকলো না। এক বিদেশীর জীবনপাতা শেষ পর্যন্ত এভাবেই থমকে গেলো। এরই নাম কি ভালোবাসা, না অপরিণামদর্শিতা? শেষ