কবি দেলওয়ার এলাহী তাঁর কবিতায় খুব সরল আর সাবলীলভাবে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে গড়ে তোলেন তাঁর চির চেনা এক জগতকে। এই জগতে তাঁর নিজের একান্ত বসবাস যা আমাদেরকে বলে দেয়, জীবনের অদৃশ্য আচ্ছাদিত পর্দা খুলে দেখে নাও নিজের আশপাশ। কবিতার শব্দ ও লয় ব্যবহারে তিনি এমন এক সৌন্দর্য আর সৌকর্যে নিজেকে দক্ষ করে তুলেছেন যে তাঁর ভাবনা, প্রগাঢ় ভালোবাসা, বিশ্বাস, হৃদয়-চেতনাবোধকে অবলীলায় নিপুণ কারিগরের মত প্রকাশ করেন সনেটের মত পরিমিত এক মাধ্যমে। তাঁর চতুর্দশপদী কবিতাগুলো এমনভাবে আমাদের আশপাশের জগতকে স্পর্শ করে যে পাঠক একটু সংবেদনশীল হলেই তার সামনে উম্মোচিত হয় কাল থেকে কালান্তরের আর প্রান্তর থেকে তেপান্তরের এক মূর্তমান দৃশ্যপট। ছোট ছোট শব্দ কাব্যিক স্রোতের গতিতে যে নিমিষেই আমাদের হৃদয়-মনকে কাব্যময় করে তুলতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কবি দেলওয়ার এলাহীর কবিতা। কবিতার প্রতি অনেক বেশি ভালোবাসা আর অনিন্দ্য সুন্দর কবিতাজ্ঞান না থাকলে কেউ তাঁর বাহ্যিক আর আত্মিক পৃথিবীকে এমনভাবে কবিতায় প্রকাশ করতে পারেন না। কবি দেলওয়ার এলাহী কবিতার প্রাকৃত আলোয় আলোকিত হওয়া একজন স্বচ্ছ সংবেদনশীল কবি।
-মনিস রফিক

কবি দেলওয়ার এলাহীর জন্ম বাংলা ১৩৭২ সনের ২৭ অগ্রহায়ণ হবিগঞ্জের ইকরাম গ্রামে, নানা বাড়িতে। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে সিলেটের বিয়ানীবাজারে। তিনি পড়াশুনা করেছেন বিয়ানীবাজার ও ঢাকায়। পিতা পিয়ার হোসেন ছিলেন সরকারি পশু চিকিৎসক। মা মাহমুদা বেগম পরিষ্কার।
কবি দেলওয়ার এলাহী কবিতা চর্চা করছেন আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সাহিত্য পাতা, সাময়িকী ও স্মরণিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়েছে। তাঁর কবিতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অল্প শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে এক চমৎকার সুন্দর চিত্রকল্প তৈরি করা যা পাঠককে তার আশেপাশের চির চেনা জগতকে নিজের মত করে চিনিয়ে দেয়। এখন পর্যন্ত দেলওয়ার এলাহীর কোন গ্রন্থ প্রকাশ হয়নি।
দেলওয়ার এলাহী ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কানাডার টরন্টো শহরে আসেন। কিছুদিন টরন্টোতে থাকার পর প্রায় তিন বছর কাটান মন্ট্রিয়ল শহরে। তারপর আবার শুরু করেন তাঁর টরন্টো-জীবন। টরন্টোর বাঙালি সমাজের অতি প্রিয় মুখ কবি দেলওয়ার এলাহী টরন্টোর বাঙালি সংস্কৃতির সৌকর্য ও প্রসারে একজন নিবেদিত প্রাণ কর্মী। প্রকৃতি ও মানব প্রেমে লীন কবি দেলওয়ার এলাহীর ধ্যান-জ্ঞানে সতত বিরাজ করে আশপাশের সবার মঙ্গল কামনা।

খোয়াই- ’৭১

স্রোতের প্রাবল্যে উপচে উঠে খোয়াই,
খড়কুটো ভেসে যায় ভাটির পানিতে।
প্রবল পাঁকের জোরে ঘণীভূত ফেনা,
ক্রমশই জল হয় আরো হলুদাভ।

সুনসান চারদিকে একটি দুপুরে,
তীরে এসে দেখে এক বিস্মিত বালক।
স্রোতে ভেসে আসে এক নগ্ন মরদেহ,
বিশাল শরীর; যারে সনাক্ত কঠিন।

মৃতদেহ পঁচে গেলে এতো বড় হয়,
বালক জানে না এই গুঢ় তত্ত¡ কিছু।
ভয় পেয়ে দৌড় দেয়। বাড়ি এসে ফের,
শরীরে জ্বরের ঘোর, কাঁপায় বেদম।

পাশে কোন বন্ধু এক; দেখে, আর নাই,
কোন মা’র যাদুসোনা ভাসালো খোয়াই!

খুন

সহসা চমকে দেখি, এ কেমন খুন!
রক্তপাতহীন মরা কতনা হৃদয়;
ছাই হয়ে আছে। কিন্তু, কোথায় আগুন?
যে লেলিহান শিখায় এরকম ক্ষয়!

নীরবে নিঃশেষ করে অদেখা যা কিছু;
নিজেই বহাল থাকে দৃশ্যের আড়ালে।
মানুষ যেখানে যায়, সেও যায় পিছু,
স্পর্শের বাইরে থাকে দু’হাত বাড়ালে।

খুঁজে ফিরি একা একা হেঁটে সারারাত।
কোথা থেকে কেউ বুঝি জ্বালে দেশলাই?
স্তব্ধ ক’রে দিতে পারে আনন্দ-প্রপাত,
ভিতরের মানুষটি মেরে ক’রে ছাই।

কেমন জীবন এই; আগুনবিহীন-
বহন করেই কেউ পুড়ে রাত্রিদিন!

কোথাও কোন কেন্দ্র নেই

কোথাও কোন কেন্দ্র নেই। যা আছে মানুষের ভুলে-
স্তূপীকৃত জঞ্জাল নিয়ে নাম দিয়েছে ‘সাদা ঘর’।
কালিমার দাগ প্রহরে প্রহরে এঁকে মর্মমূলে
স¤প্রীতির সাঁকো ভেঙে দূরে ঠেলে দিয়ে পরস্পর।
রক্ত চুষে পান করে। গায় উদার সুরের গান
কারো ভিটা কেড়ে নেয়। দিনযাপনের ভীত
উল্লাস-হুল্লোড়ে তত নাচে; যত যায় শিশু প্রাণ!
স্বতন্ত্র উষ্ণতা কেড়ে, দেয় মরণকামড় শীত?

কোথাও কোন কেন্দ্র নেই। পৃথিবী আমার মুঠো।
ছিঁড়ে ফেলে সব বিধান। নিয়ম। সীমানার রেখা।
শক্ত হাতে বন্ধ ক’রে সব মাতব্বরি উচ্চকণ্ঠ। ঠুটোঁ।
স্বইচ্ছায় চলে যাবো। যতদূর চোখে যায় দেখা।
কোথাও কোন কেন্দ্র নেই। আমিই মূল কেন্দ্রস্থল।
যেখানেই রাখি পা, সব আমার। অন্তরিক্ষ, স্থল।

শব্দের কাছে ঋণ

অতঃপর সীমানা হয়েছে চেনা; আর
ভেসে উঠছে দিগন্তে গন্তব্য প্রাচীর।
যেখানে খোদাই হয় ধ্বনিত কথার,
শব্দের ভাস্কর্য হয়ে রয়ে যায় স্থির।
শব্দের যে ছবি আছে করোটিতে আঁকা,
সেইতো পিছু টানে উচ্চারণের আগে।
শব্দের অদৃশ্য নৃত্য শূন্যতায় ফাঁকা;
অনড় আমিও নাচি মৌন অনুরাগে।
প্রাচীর স্থাপিত আছে। বোধের জমিন,
সংবেদনার সিমেন্টে শক্ত করা ভিত।
না বলা শব্দের যত সাম্রাজ্য রঙিন,
মৌনতার পরাজয়ে আসলেই জিৎ।
অধ্বনিত শব্দ নিয়ে থাকি রাত্রিদিন,
সনাক্ত করি একা শব্দের কাছে ঋণ।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন

কেউ ভাবে না নীরার কথা, জানতে চায় না কেউ।
কোন অবেলায় আছড়ে পড়ে একাকীত্বের ঢেউ।

সব আছে। অনেক স্বজন। নিজের দেশে থাকায়-
বেলাল জানেন কী শূন্যতা সুনীলবিহীন ঢাকায়!

কোথায় গেলো শক্তি চট্টো? সমীর রায়ের কাছে?
খুঁজতে যাবেন চাইবাসায় কে? এমন বন্ধু আছে!

খালাসিটোলায় ভাঙা বেঞ্চে পণ্ডিত এসে নাচার!
কমল কুমার পাশে আছেন জীবন খসে বাঁচার।

বেলাল শক্তি তারাপদ আর সন্দীপনকে নিয়ে,
মাঝরাতকে কান ধরে দেন দিনের সাথে বিয়ে।

পল এঙ্গেল, আইওয়া শহর, বন্ধু মার্গারেটা আছে।
তবু, কলকাতা ছাড়া কি আর সুনীল গঙ্গো বাঁচে?

এই শহরে নীরা থাকেন এবং গঙ্গোপাধ্যায় স্বাতী;
সুনীল বিহীন কলকাতা আজ চাঁদবিহীন রাতি।

ঢাকা কিংবা কলকাতায় আজ সব প্রেমিকের ঋণ;
দেখুন, গোলাপ-চাঁপা বলছে সবাই : শুভ জন্মদিন!

পথে যেতে যেতে

পথে যেতে যেতে মনে হয়,
সাথে সে আছে,
দূরে নয়, কাছে।

যে কথা বলি একা-
শব্দে বা কানে,
সবই সে জানে।

আরো কিছু বলতে তাকে,
পিছু ফিরি যেই :
দেখি সে নেই!

সে

ডাক শুনে দাঁড়ালো সে।
লিখে রাখা চিরকুট পড়ে স্তব্ধ, নির্বাক :
‘আমি তো বিজয়ী হই, তোমার হলে জয়,
আমার শুধু ইচ্ছে ছিল গল্প বিনিময়।
হয়তো এটাই আমার ভুল,
মেঘের উপর ভেসে ভেসে
দহনের তীব্ররাতে ছুঁয়ে দিইনি ফুল!’

আমার সবই মনে পড়ে

জানেন, এই নদীতেই কোন একদিন, উঠেছিল ঢেউ
ঢেউয়ের মাঝেই, একটি নৌকায় যাত্রি ছিল কেউ।
সেই দৃশ্যটি দাঁড়িয়ে তীরে, দেখছিল একজন,
কে যায় দূরে, ঢেউয়ের নৌকায়? কার সে আপনজন!

সেই ছাউনি ঘেরা নৌকোটি বেশ, ছিল ছিমছাম
কাঠ দরজায় পাখির ছবি। কী জানি তার নাম!
সামনে দুজন বৈঠা টানে। মাঝির হাতে হুঁকো;
এদের কথা জানতেন কি, দেরীদা বা ফুকো?

মাঝির মুখে হুঁকোর ধোঁয়া। আকাশ কালো মেঘে।
কে যায় দূরে, মা-বাপ ফেলে, এমন মায়া ত্যাগে!
চোখের জলে বুক ভেসে যায়, ফেলে মাটির টান।
‘গঞ্জে গেলে আলতা এনো, লেইস ফিতা, বাপজান!’

এমন গল্প হারিয়ে গেছে, জীবন গল্পের ভিড়ে;
আমার সবই মনে পড়ে, এই নদীটির তীরে!

ইকরাম, হবিগঞ্জ
১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

দুটি কবিতা
‘ছায়ার মানুষ’

সবাই ঘুমিয়ে আছে। পৃথিবী নীরব।
লতাপাতা, বৃক্ষরাজি, ঘুমায় সড়ক।
জমাট কপাটবদ্ধ সুপ্ত কলরব,
শুধু শোনা যায় এক হৃদয় ধড়ক!

কে আছে জেগে একা ঘুমের পাহারায়?
কার পদশব্দ শুনি, নিঃশব্দের লয়ে!
অশরীরে কাছে এসেই কে যেন যায়।
হৃদয় ভরে কে থাকে? না থেকেও; ক্ষয়ে!

খুঁজে দেখি কেউ নেই। আলো জ্বেলে দেই।
চেয়ে দেখি পর্দাঘেরা জানালা দূরের।
সেখানেও কেউ নেই। পদশব্দ যেই-
শুনেছি একাকী আমি অচেনা সুরের।

কে যেন কাছে এসে, সহসা দূরে যায়;
লুকিয়ে জড়িয়ে থাকে আপন ছায়ায়!

‘মানুষেই জয়’
[অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ শ্রদ্ধাষ্পদেষু]

এ কোন ধ্বনি আসে দূর থেকে? নীরব
জনস্রোতে দিনরাত জাগায় কাঁপন।
শূন্যতায় ঢেউ ছিঁড়ে ভাসে কলরব,
অজানা আশঙ্কায় কুঁকড়ে যায় মন।

বাতাসের গন্ধ আজ বৈরি দ্রæত হয়,
স্তব্ধতায় ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে পা।
কেবলই ‘মানুষের’ ক্ষেত্র হয় ক্ষয়,
একান্তই জীবন বলে দূরে চলে যা!

কোথা’ যাবো? কোনদিকে পথ নিরাপদ?
জলে-স্থলে মানুষই এঁকেছে সীমানা।
ধর্ম ধ্বজায় হারায় মানুষের পথ;
স্বর্গলোভী, রক্তচোষা যেন বা হায়েনা!

লোভী নই স্বর্গে। মানি ‘মানুষেই’ জয়,
আঁকড়ে ধরে আছি আমি, যে পরিচয়।

ঠিকানা

কিছুপথ হেঁটে গেলে সমুখে
তারপর বাঁয়ে নেবে বাঁক।
দেখবে টিনের চালার উপর সিমের মাচার
লতানো এক ঝাঁক।
অতঃপর, সামনে যে বাঁধানো পাঁচিল-
পার হয়েই দেখবে
একটি দরোজায় নেই খিল।
এই ছোট্ট একটি বাড়ি
নিভৃত,
একাকী।
তারই দু’টি কামরার একটিতে আমি থাকি।
ভয় পেয়ো না, সহসা দ্যাখো যদি বেরিয়ে আসেন ঈশ্বর।
আমরা তো একসাথে থাকি
আমাদের একই ছাদের ঘর।

নীরবতাই আমার জবাব

বাতাস এসে প্রশ্ন করে :
‘কেমন করে দিন কাটে তোর,
বারান্দাতে দাঁড়িয়ে একা?
দৃষ্টি রেখে দূর জানালায়
কোন পাখিটির উড়াল দেখে?

প্রশ্ন করে সবুজ পাখি :
‘আমি যখন উড়াল দিলাম-
খাঁচায় থাকা বাঁধন খোলে।
তুই কেন যে বাঁধতে গেলি
মানুষ নামের একটি পাখি?’

বাতাস এবং পাখির কথায়
আমার তো নেই জবাব কোন।
আমি কেবল দাঁড়িয়ে দেখি
একটি পাখি উড়ে এসে
বসল এক মায়ার কাঁধে।

পর্দাঘেরা দূর জানালায়
একটি মানুষ পাখির সাথে
খেলছে কেবল আপন মনে
অদৃশ্য এক মগ্ন খেলা।

সবাই যখন দূরে থাকে
যাপন করে আপন জীবন
উড়ে এসে কাঁধে বসে
ভীষণ মায়ার সেই পাখিটি।

কেউ জানে না পাখির দুঃখ
জানতে চায় না কোন গানে তার
ক্লান্ত দেহে শ্রান্তি আসে;
ঘুম ভেঙে যায়, এক লহমায়!

মানুষ কেবল বলছে কথা
দিচ্ছে ছুঁড়ে কথার আঘাত
প্রয়োজনহীন বাক্যবাণে।
ছুটছে ভীষণ ছন্নছাড়া।

সময় কোথায় খতিয়ে দেখার,
একটি পাখির ঠোঁট ভিজিয়ে-
কে দেয় পানি ভালোবাসার?
গহিন কত মায়ার জাদু!

আমার কেবল জানতে ইচ্ছে
কী গান জানে সেই পাখিটি?
মানুষের নেই যেই ভাষাজ্ঞান;
ঘুম ভেঙ্গে দেয় জাগিয়ে দিতে!

আমি কেবল তাকিয়ে দেখি
উড়াল দেওয়া সেই পাখিটি।
দূর জানালায় পর্দাজুড়ে
বাতাসের দোল কাঁপন জাগায়।

সে কেবলই প্রশ্ন করে,
জানতে চায় সে আমার স্বভাব।
বাতাস এবং পাখির কাছে,
নীরবতাই আমার জবাব।