অনলাইন ডেস্ক : একদিকে দেশব্যাপী প্রাণঘাতী ডেঙ্গুর ভয়াবহ থাবা, অন্যদিকে টাইফয়েড বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। আর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ফার্মাসি তো বটেই, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও দেখা দিয়েছে স্যালাইন সংকট। ৮০ টাকা দামের সাধারণ স্যালাইন খোলাবাজারে এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়। এর পরও স্যালাইন জোগাড় করতে বেগ পেতে হচ্ছে।

বছর তিনেক আগেও সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে (আইপিএইচ) মাত্র ৪২ টাকায় স্যালাইন পাওয়া যেত। সেখানে এখন উৎপাদন বন্ধ। এ কারণে স্থায়ীভাবে বিকল হওয়ার পথে প্রায় ৬শ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দিতে প্রতিষ্ঠানটি কৌশলে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে বর্তমানে বিদেশ থেকে আমদানি করা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত স্যালাইনই ভরসা।

ডেঙ্গুতে এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সময় পার করছে বাংলাদেশ। চলতি বছর ইতোমধ্যেই সাড়ে ৮শরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এ রোগে; পৌনে দুই লাখ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর বাসাতেই চিকিৎসা নিয়েছেন এরচেয়েও ৬ গুণ বেশি রোগী। ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের প্রধান চিকিৎসা আইভি ফ্লুইড বা স্যালাইন হওয়ায় এর চাহিদা বেড়েছে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। ডেঙ্গুর পাশাপাশি শিশুদের টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের সংকট প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ডেঙ্গু এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। এতদিন শহরকেন্দ্রিক থাকলেও এবার তা গ্রামেও ছড়িয়েছে। ফলে আগের তুলনায় স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে অনেক বেশি। যা পূরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে সরকারিভাবে স্যালাইন উৎপাদন। এতে করে চাহিদা যেমন পূরণ হবে, সাশ্রয় হবে সরকারি অর্থ এবং বাড়বে দেশের সক্ষমতা।

রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। ৫শ শয্যার এ প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ধারণক্ষমতার আড়াই গুণ রোগী ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় তিনশ। শয্যাসংকটে বারান্দা ও মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন শত শত মানুষ। এখানে আগে প্রতিদিন তিনশ পিস স্যালাইনের চাহিদা ছিল। এখন তা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে। বাড়তি এ চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ২০ মাস বয়সী তানজিলা আট দিন ধরে চিকিৎসাধীন মুগদা হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে। ডেঙ্গুর পাশাপাশি টাইফয়েডেও ভুগছে একরত্তি শিশুটি। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ৬ ব্যাগ বেবি (শিশু) স্যালাইন দিতে হয়েছে তাকে। তবে হাসপাতাল থেকে দুই ব্যাগ পেলেও বাইরে থেকে আনতে হয়েছে ৪ ব্যাগ। ৮০ টাকার এই স্যালাইন হাসপাতালের আশপাশের বহু ফার্মাসিতে না পেয়ে গ্রিন রোডের একটি ফার্মেসি থেকে ৪০০ টাকায় কিনতে হয় বলে জানান তানজিলার মা আয়েশা আক্তার।

মুগদা হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের স্যালাইন সংকট এখন অনেকটাই কেটেছে। তবে শিশুদের স্যালাইনের অভাব রয়েছে। কারণ, সরকারের পক্ষ থেকেই এগুলোর সরবরাহ কম। হাসপাতালের যেসব ওষুধ ও স্যালাইন দেওয়া হয় চিকিৎসা নিতে আসা ৯৫ শতাংশ রোগীর যা যা প্রয়োজন, তা-ই দেওয়া হয়। ৫ শতাংশ বাইরে কিনতে হয়। আবার যতটুকু দেওয়া হয়, চাহিদা তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। তাই কম করে হলেও সবাইকে দিচ্ছি।’

শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি হাসপাতালেও দেখা দিয়েছে স্যালাইনের সংকট। মালিবাগের সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়মিত ১৫ থেকে ২০ জন ডেঙ্গু চিকিৎসাধীন থাকছেন। বেশ কিছু দিন ধরে স্যালাইন সংকটে ভুগছে প্রতিষ্ঠানটি। জানতে চাইলে হাসপাতালের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার মো. আতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমাদের এখানে দৈনিক স্যালাইনের চাহিদা বর্তমানে ১৫০ থেকে ২০০ পিস। ওরিয়ন ও পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস এগুলো সরবরাহ

করে। কিন্তু উৎপাদন কমে যাওয়ায় মাসখানেক ধরে চাহিদার ৬০ শতাংশের মতো পাওয়া যাচ্ছে। খোলাবাজার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ধার করে চলতে হচ্ছে।

অন্যদিকে চাহিদার সঙ্গে সরবরাহ কমে যাওয়ায় ফার্মেসিগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো দাম রাখছে প্রতি পিস স্যালাইনে। মালিবাগ রেলগেট মোড়ের ফার্মাসির দোকানদার রাসেল সরকার জানান, ‘মাস দুয়েক আগেও স্যালাইনের এতটা অভাব ছিল না। আমরা ওরিয়ন থেকে নিই। কিন্তু তারা ঠিকমতো দিতে পারছে না। অনেক সময় আমাদেরই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে সরবরাহকারীর কাছ থেকে। ফলে একটু বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’

শুধু রাজধানী নয়, স্যালাইনের তীব্র অভাব এবার ঠেকেছে জেলা সদর হাসপাতালেও। ডেঙ্গুর প্রকোপ হলেও শুরুর দিকে স্যালাইন দিতে সক্ষম হলেও মাসখানেক ধরে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারছে না সরকারের এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল)। ফলে বেসরকারি কোম্পানিগুলো থেকে বেশি দামে কিনে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

ঢাকার বাইরে যেসব জেলায় ডেঙ্গুর উচ্চ প্রকোপ কক্সবাজার তার অন্যতম। চলতি বছর এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। ২৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে প্রায় তিনগুণ রোগী চিকিৎসাধীন থাকছে নিয়মিত। গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল ৯৬ জন।

রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় আগস্টে স্যালাইনের তীব্র সংকট দেখা দেয় প্রতিষ্ঠানটিতে। বর্তমানে কিছুটা কেটেছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির সদ্য বিদায়ী তত্ত্বাবধায়ক ডা. মুমিনুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘মাঝে অনেক সংকট ছিল। এখনো চাহিদা অনুযায়ী পাওয়া যাচ্ছে না। ইডিসিএল থেকে সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাইরে থেকে বেশি দামে নিতে হচ্ছে। তারপরও অনেক সময় রোগীদের বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।’

দেশি লিব্রা, অপসোনিন, ওরিয়ন, স্কয়ারসহ সাতটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রতিমাসে ৫৩ লাখ স্যালাইন উৎপাদন করে। যা দিয়ে সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাহিদা পূরণ হয়।

বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতির পরিচালক জাকির হোসেন রনি বলেন, ‘প্রতিবছর কোম্পানিগুলো যত স্যালাইন উৎপাদন করে , চাহিদা তার প্রায় দ্বিগুণ। আবার ডেঙ্গুর প্রকোপ এবার সবচেয়ে ভয়াবহ হওয়ায় চাহিদা আরও বেড়েছে। ফলে সে অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ায় বাজারে ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের উচিত উৎপাদনকারীদের সঙ্গে চুক্তিতে যাওয়া। এতে করে উৎপাদন বাড়বে, সহজেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে।’

এদিকে, সংকট মোকাবিলায় ভারত থেকে তড়িঘড়ি করে ২৯ কোটি ১৯ লাখ টাকার ২০ লাখ পিস স্যালাইন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। ইডিসিএল এসব স্যালাইন আমদানি করবে। হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করায় ভাইরাসটি মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে ইডিসিএল ২০ লাখ পিস (নরমান স্যালাইন ১ হাজার মিলিলিটার এবং গ্লুকোজ স্যালাইন ১ হাজার মিলিলিটার) আইভি ফ্লুইড ক্রয়ের নিমিত্ত সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি (ডিপিএম) অনুসরণে ক্রয় প্রস্তাবের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ৮ আগস্ট স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ৭ লাখ পিস স্যালাইন কেনার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী ইতোমধ্যে ৩ লাখ কেনা হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল পরিস্থিতির উন্নতি হবে কিন্তু সাম্প্রতিককালে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির ব্যাপকতায় ডেঙ্গুর বিস্তার আরও বেড়ে যাওয়ায় রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এতে করে স্যালাইনের সংকট আরও তীব্র হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘এত বাণিজ্যমুখী হলে চলবে না। এ রকম মহামারীর মতো পরিস্থিতিতেও ব্যবসায়িক চিন্তা মানুষের জীবনকে আরও ঝুঁকিতে ফেলবে। আমাদের দেশীয় ব্যবস্থা জনকল্যাণমুখী করতে পারলে সবচেয়ে বেশি ভালো হতো। পরিস্থিতি অনুযায়ী আনুপাতিকহারে তারা উৎপাদন বাড়িয়ে দিত। অথচ বিশে^ বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে এখন অনেক বড় বাজার কিন্তু সামান্য স্যালাইন উৎপাদনের মতো জনমুখী একটি ব্যবস্থা আমরা বন্ধ রেখেছি শুধু কতিপয় গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে। অথচ এটি থাকলে এ ধরনের সংকট সহজভাবেই মোকাবিলা করা যেত।’

তিনি বলেন, আমাদের যে ঔষধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যদি তারা বুঝতে পারত আগামীতে আমাদের এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতে পারে। তারা কেন এতদিন পরও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারল না। ডেঙ্গুতে মানুষ ভুগছে, ৮ শতাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে মানুষ কিন্তু কর্তারা সেটাকে গুরুত্বই দিচ্ছেন না। মন্ত্রণালয়ের আন্তরিকতাই পারে এটি চালু করতে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমদানি নির্ভরতা কমাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭৩ সালে আইপিএইচে চালু হয় স্যালাইন ইউনিট। প্রতিদিন ১২ হাজার ব্যাগ স্যালাইন উপাদনে সক্ষমতা ছিল প্রতিষ্ঠানটির। তৈরি হতো নয় ধরনের স্যালাইন। সরবরাহ হতো সরকারি সব হাসপাতালে। এতে বছরে কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হতো সরকারের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশি দাম রোধ এবং আমদানি নির্ভরতা হ্রাসে ফের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইপিএইচ) চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছে আইপিএইচ কর্তৃপক্ষ।