আকতার হোসেন : কালামপুর গ্রামের মোহাম্মদ আজিমউদ্দিনের ছেলে শরিফ উদ্দিনের সাথে এক লক্ষ এক টাকা দেনমোহরে আপনার বিবাহ ঠিক করা হইয়াছে। আপনি এই বিবাহে রাজি থাকিলে বলেন – কবুল।

বিয়ে বাড়িতে এতক্ষণ যেসব গান বাজছিল, হইহুল্লোড় হচ্ছিল সেগুলো থেমে গেল। বিয়ের আসল পর্ব কবুল পর্ব। সকলের চোখ দুটি মানুষের দিকে স্থির হয়ে আছে।

বঁধু বেশে বসে থাকা শাম্মি আক্তার বয়স্ক লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কাজী সাহেব রাজী-অরাজি সেটা পরের ব্যাপার। তার আগে পাত্র যে একজন ধর্ষক নয়, সেই সার্টিফিকেট এনেছেন কিনা বলেন। শুধু পাত্র নয়, পাত্রের বংশের সাবালক সব পুরুষদের নি-ধর্ষক সার্টিফিকেট চাই।

কাজী সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লো। ময়মুরুব্বিদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কি বিয়া পড়াইতে আইছি না করোনা রুগী দেখতে? পাত্রের করোনা নাই সেই মর্মে সার্টিফিকেট দেখাইতে কইলে তাও বুঝতাম। কিন্তু এমন সার্টিফিকেটের কথা তো বাপের জন্মেও শুনি নাই। নি-ধর্ষক।

শাম্মি বলল, ধর্ষণ করোনা ভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক। করোনার চেয়েও পুরাতন রোগ। এই রোগেরও কোন ভেকসিন নাই কাজী সাহেব। সব ধর্ম অনেক করে বুঝিয়েছে তবুও ধর্ষক শোনেনি তার কিছু। পড়ালেখা শিক্ষা ব্যবস্থাও বুঝিয়েছে, তাও ধর্ষক শোনেনি। সমাজ বুঝিয়েছে সে কথাও ধর্ষক শোনেনি। মেঘে মেঘে হাজার বছর পার হলে গেল। সাবান দিয়ে হাত ধুলে করোনা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। ধর্ষণ থেকে বাঁচার জন্য কোন সাবান নেই। এই যে আপনি বিয়ে পড়াতে এসেছেন আপনারও কিন্তু নি-ধর্ষক সার্টিফিকেট দেখাতে হবে।
কেন, আমাকে কেন?

এইজন্য যে আপনি ধর্ষকের পক্ষে কাজ করছেন কিনা সেটা জানা জরুরি। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই জানেন না? কাজী সাহেব, আগামীতে চাকুরীর জন্য, জমি রেজিস্ট্রেশনের জন্য, বিমানের টিকিট কাটার জন্য এমন কি লম্বা ভ্রমণের জন্যও একজন পুরুষকে ধর্ষক নয় এই মর্মে সার্টিফিকেট দেখাতে হবে।

এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না, তুমি কি গড়পত্তা সব পুরুষদের ধর্ষক মনে করো?
কেন করবো না। আপনারা যে গড়পত্তা সব নারীদের কামুক মনে করেন।
এতো দেখছি মেলা ঝামেলা
তাহলে সময় থাকতে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলেন
কীভাবে?

সরকারকে বলেন একজন ধর্ষণকারীর আয় ও সম্পত্তি থেকে ধর্ষিতাকে আজীবন অর্ধেক অংশ দিয়ে যেতে হবে। একবার ধর্ষণ করেছে তো আজীবন অর্থনৈতিক ভোগান্তিতে পড়তে হবে। ছয় মাস নয় মাসের কোন ব্যবস্থা চলবে না। এছাড়াও ধর্ষিতার আজীবন স্বাস্থ্য সেবার খরচও ধর্ষককে বহন করতে হবে। এমন কি ধর্ষিতা ধর্ষণ সংক্রান্ত যে মামলা করবে ধর্ষককেই তার খরচ দিয়ে যেতে হবে। ধর্ষণের ফলে যদি কোন সন্তান জন্ম নেয় সেই সন্তানের বাবার নামে স্থানে ধর্ষকের নাম লেখা থাকবে এবং আজীবন সন্তান ভরণপোষণের খরচ দিতে হবে। ধর্ষক যদি অপারগ হয় তবে তার কর্মস্থান অথবা পার্টির অফিস এই খরচ বহন করবে।
কেন? কর্মস্থান কিংবা পার্টির অফিস কেন?

কেননা তারা যে একজন ধর্ষককে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেনি কিংবা পার্টির সদস্য পদে বহাল রাখেনি সেটা যাচাই বাছাই না করার জন্য অপরাধী হবে। এই অপরাধ হলো ধর্ষণ পৃষ্ঠপোষকতার অপরাধ।
খালি সার্টিফিকেট আর সার্টিফিকেট। তুমি সার্টিফিকেট ছাড়া অন্য কিছু বুঝ না।
অসুবিধা কোথায়, চরিত্রগত বা ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট তো এখনই লাগে। টু হুম ইট মে কনসার্ন… সেটার সাথে নি-ধর্ষক অংশটি যোগ করে দিবেন। ধর্ষণ তো চরিত্রেরই একটা অংশ। তাই না?

আর যদি নি-ধর্ষক সার্টিফিকেট কর্মস্থান কিংবা পার্টির অফিস জমা থাকে?
সাবাস কাজী সাহেব! এইতো নি-ধর্ষক সার্টিফিকেটের পক্ষে কথা বলা শুরু করেছেন।
রাখ, আমাকে আর পাম দিতে হবে না। যদি ধর্ষককে কেউ চাকরি না দেয় তার তো কোন আয় ইনকাম থাকবে না। তখন ধর্ষিতাকে আজীবন খরচ কে জোগাবে?
ধর্ষকের বাবা মা দিবে, কিংবা তার নিকট আত্মীয় কিংবা বোনের জামাই।
কেন তারা দেবে কেন?

কেননা তারা ধর্ষকের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নাই বলেই দায়দায়িত্ব নিতে হবে। ধর্ষণ হয়েছে এই মর্মে অভিযোগ করার সাত দিনের মধ্যে আত্মীয়স্বজনকে লিখিতভাবে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার ছাড়পত্র নিতে হবে। লতায় পাতায় খালাতো মামাতো ভাই বোনদের পর্যন্ত ছাড়পত্র নিতে হবে। অভিযুক্ত কিংবা চিহ্নিত ব্যক্তি যদি আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেয়ে যায় তবে সেই আত্মীয়তার সম্পর্ক পুঃনস্থাপন করতে পারবে। যদি প্রশাসন পয়সা খেয়ে উলটো কাজ করে কিংবা কাজে গাফিলতির করে?

তবে সেই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া সকলেই সেকেন্ড ডিগ্রী ধর্ষক হিসেবে বিচারের সম্মুখীন হবে।
যদি ধর্ষকের দৈন্যদশা হয়। পথের ফকির। দেউলিয়া!
তবে, সে জেলের ভাত খাবে এবং রাষ্ট্রকে তখন ধর্ষকের পক্ষ থেকে ধর্ষিতার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে। মুক্ত অর্থনীতির যুগে টাকা ছাড়া উপায় নেই। হয় ধর্ষক টাকা দিবে নাহলে অপরিশোধিত অংশসহ অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি ভোগ করবে। অথবা উভয়ই। অথবা ধর্ষক স্বেচ্ছায় মৃত্যুদণ্ড চাইতে পারবে।

ধর্ষণের ফলে একজন নারীর যে ক্ষতি হয় তুমি টাকার সাথে তার তুলনা করছ? ছিঃ
কাজী সাহেব ইজ্জতের দিন তো শেষ। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সেই দেশ তো আর নেই। আগে মান্যগণ্য সামাজিক ইজ্জত ছিল মুল ধন। এখন টাকাপয়সা না হারানোর পণ রয়েছে সবার মধ্যে। ধর্ষিতা কত টাকা পেল সেটা বড় কথা নয়। ধর্ষকের কত টাকা গচ্ছা গেল সেটা দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে ধর্ষণ জোয়ার। একবার ভেবে দেখুন দশ পনেরো মিনিটের একটা কান্ডের জন্য আজীবন আয় রোজগারে অর্ধেক দিয়ে যেতে হবে। এখানে টাকার জোর দেখানো যাবে না। এই নাও এক বস্তা টাকা এমন কথা খাটবে না। আজীবন অর্ধেক অর্ধেক।
ধর্ষণ কালে কিংবা ভবিষ্যতে যদি ধর্ষিতা আর্থিক সচ্ছলতার মধ্যে থাকে? মানে তার যদি টাকা পয়সার কোন প্রয়োজন না থাকে?

তবুও ধর্ষক কর্তৃক কিংবা রাষ্ট্র কর্তৃক তাকে সব খরচ দিতে হবে। ইচ্ছে করলে আইনি কাজে গাফিলতি ও ইচ্ছে মাফিক রায় কিংবা রিপোর্ট লেখার জন্য প্রশাসনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির বেতন কিংবা সম্পত্তি ক্রোক করে কিংবা পেনশনের টাকা থেকে রাষ্ট্র এই খরচের অর্থ জোগান করতে পারে। ধর্ষিতা চাইলে যে কোন ফাণ্ডে কিংবা কোন অসহায় ধর্ষিতাদের জন্য এই অর্থ দান করতে পারবে। মোদ্দা কথা হলো, একবার যে ধর্ষণের সাথে জড়িত হবে তার শান্তি আজীবন আর্থিক দণ্ড। এককালীন বলে কিছু নেই। এবার ধর্ষক ও তার পরিবার ভাবুক, কেউ কি ধর্ষক হবে না স্বাভাবিক মানুষ হবে।

মা, তুমি কিন্তু তবু একজনের জন্য সবাইকে দোষী করতে চাইছ। এটা ন্যায় বিচার হইলো না। পরিবারের বাপ ভাইদের কথা ভাবলেন না। সমাজের অধিকাংশ পুরুষই ধর্ষণ বিরোধী। তারাও ধর্ষকদের শাস্তি চায়। মৃত্যুদণ্ড দিতে বলছে।

কাজী সাহেব, যা যা বলছি এগুলো সব সম্ভাবনা। হাজার বছর হয়ে গেল কেউ ধর্ষণ বন্ধ করতে পারলো না। খুনের শাস্তি ফাঁসি। তবুও কি খুন বন্ধ হয়েছে। একটু ভিন্ন ভাবে ভাবতে চেষ্টা করতে দোষ কী? রইলো সাধারণ পুরুষের কথা। সবাই যদি হুরমতি ছেঁকা লাগাতে না চায়, আগেভাগে মিলেমিশে কাজে লেগে পরুক। প্রমাণ করুক ধর্ষণ শাস্তিযোগ্য মহা অপরাধ এবং এই জঘন্য অপরাধ বন্ধের জন্য সবাই একত্র কাজ করেছে। নিজের গায়ের ময়লা তো নিজেকেই ঝাড়তে হবে। তানা হলে স্বাভাবিক অবস্থায় স্বাভাবিক গতি। বাঁকা পন্থায় কাঁটা পদ্ধতি। এখন পর্যন্ত তো দেখলাম না ধর্ষকে ধাওয়া করে কোন বীরপুরুষ পাকরাও করেছে। কিংবা ধর্ষকের গায়ে জুতা স্যান্ডেল চুনকালি দিয়ে গলির মোড়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। গাফিলতি অনেক হয়েছে। নি-ধর্ষক সার্টিফিকেটের কথা উঠত না যদি শত শত বছর পুরুষ শাসিত সমাজের পুরুষেরা ঠিক দায়িত্বটি পালন করতো। জানি, পুরুষ মানেই ধর্ষক নয় কিন্তু ধর্ষক মানেই তো পুরুষ। ঠিক কিনা?

অনেক কথা হলো, বিয়ের বর আর নিতে পারছে না। সে মাথা থেকে পাগড়ী খুলে দশ হাত দূরে ছুড়ে মারল। শেরওয়ানির বোতাম ছিঁড়ে হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেললো। তারপর দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেল বিয়ের আসর থেকে। এক ঘণ্টার মধ্যে খবর এলো বিয়ের পাত্র শরিফ উদ্দিন গাছের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। কানে হেড ফোন লাগিয়ে দূরপাল্লার বাসে ঢাকা যাচ্ছে শাম্মি। নৈশ বাসে আর দশজন যাত্রীর মত মেয়েটিও যাত্রার ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। ‘এই কুমিল্লা’, ‘কুমিল্লা – নামেন কুমিল্লা’ এমন চিত্কার শুনে তার চোখ খুলে গেল। পরক্ষণে বুঝতে পারলো ঢাকা অনেক দূর। মুখে বিরক্তের ভাব দেখিয়ে আবারো চোখ বন্ধ করলো শাম্মি। বাসের ভেতর নীল রঙের বাতি জ্বলছে। এয়ারকন্ডিশন থাকার কারণে সবাই একটু গুটিয়ে আছে। বাস ড্রাইভার হয়তো ভুল করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সিডি লাগিয়ে রেখেছিল। বাস দুলছে, বাস চলছে। পরবর্তী গান শুরু হলো। সম্ভবত ইন্দ্রাণী সেনের কণ্ঠ।