আতোয়ার রহমান : পাত্রী পক্ষের সামনে বসা নাজির হোসেনের জীবনে এই প্রথমবার। এর আগেও বিয়ে হয়েছিল তার। কিন্তু সেসব পাত্রী এত হাই প্রোফাইল ছিল না। তাই এত টেনশন ছিল না। আগে সে নিজেই সে পাত্রীর ভাইভা নিয়েছে, কিন্তু আজ তাকে পাত্রীর সামনে ভাইভা দিতে হচ্ছে।

পাত্রীপক্ষ যে প্রশ্নগুলি জিজ্ঞাসা করতে পারেন, তার যে উত্তরগুলি দিতে হবে, যেভাবে তাকে হাঁটতে হবে, কথা বলতে হবে এবং বসতে হবে, তার যে বিষয়গুলি বলতে বা বলতে হবে না, তার ব্যবসাপাতির অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তাকে যে প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে সেটি নিয়ে ভাবছে।

শরীর জুড়ে একটা কাঁপুনি। গলা শুকিয়ে গেল নাজির হোসেনের। বারিধারার বিলাশবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্টুরেন্টে বসেও তার হাতের তালু ঘামছে। পাঞ্জাবির পকেটে রুমাল না থাকায় তিনি তার প্যান্টের উপর উভয় তালু মুছলেন।

পাত্রী, মানে তামান্না, লাল শাড়ী পরে ওর চাচাতো বোন-জামাইকে নিয়ে দেখতে এল নাজির হোসেনকে। তাকে আপাদমস্তক দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল। কলপ দিয়ে ঢেকে রাখতে ব্যর্থ আধ পাকা চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ডাগরডোগর চোখ ফর্সা দেহ পেশীবহুল এক বলিষ্ঠ পুরুষ। নাজিরের দিকে তাকিয়ে চাচাতো বোনের প্রথম প্রশ্ন, “চশমার পাওয়ার কত?”
তাই ঢোক গিলে বলেছিল, “মাইনাস সিক্স।”
“ওরেব্বাবা! কী সর্বনাশ! তা হলে চশমা ছাড়া তো পুরো অন্ধ!”
এর সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধের কোনও সংযোগ খুঁজে না পেয়ে একই রকম বোকার মতো মুখ করে নাজির বলল, “এ বয়সে সবাই কম বেশি চোখে কম দেখে। এতে সমস্যা কী।”

“সমস্যা আছে। কারণ কানাডা শীতের দেশ, ওখানে গাড়ি ছাড়া চলতে পারবেন না। আর আপনাকে নিজের গাড়ি নিজে চালাতে হবে। ওখানে গাড়ির ড্রাইভার পাওয়া যায় না, আবার পাওয়া গেলেও বেতন দিয়ে কুলোতে পারবেন না। আর চোখের পাওয়ার কম হলে, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবেন না। তাই আপনার চোখের খোঁজখবর নিচ্ছি সবার আগে।”
নাজির এ কথায় হাসল বোকার মতো। সে দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করল, যখন কথোপকথনটি ঘটছিল।
তারপর দ্বিতীয় বুলেট স্বয়ং পাত্রীর তরফ থেকে, “আপনার কি ব্যবসা দেখাশোনা করার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে?”

“আছে মানে, কুড়িগ্রাম শহরে আমার নিজেরই ব্যবসা আছে। সিমেন্ট লোহার দোকান। দশ বছরের পুরোনো এ দোকান আমি একাই দেখাশোনা করি।”
ওটাতো ছোটখাট ব্যবসা। কানাডায় আমার বিশাল স্বর্ণের ব্যবসা। আপনাকে দেখতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে। পারবেন তো?”
“অবশ্যই পারব। পারব না কেন। আপনি তো পাশেই থাকবেন।” নাজির হেসে বলল।
তামান্না নাজিরের চোখে আত্মবিশ্বাসের হাসি দেখতে পেল।
“বিক্রিবাটা কেমন? কানাডা যেতে চান কেন?”

নাজির জানাল, “খদ্দেরের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। কারণ, বেকারের সংখ্যা যত বাড়ছে, দোকানের সংখ্যা তত বাড়ছে। খদ্দের বিভিন্ন দোকানের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। ছোট শহরে এত দোকান চলে? সামনে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, ব্যবসা টিকে রাখাই মুশকিল হবে।
দুপুরের খাবার শেষে প্রতিদিনের মতো আজও খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিলাম। বিজ্ঞাপনটা পড়ে আর দেরি না করে মাগরিবের নামাজ পড়ে নাইট কোচে ঢাকা চলে আসলাম। সৃষ্টিকর্তা আমার জীবনের এই সময়টা হয়ত কানাডাতেই লিখে রেখেছিলেন, তাই এখন আপনার ওছিলায় সেখানে যেতে পারবো, ইনশাআল্লাহ।”

নাজিরের কানাডা মুগ্ধ মন তামান্না ভালভাবে পড়ে নিল।
বলল, “ওইসব সিমেন্ট-টিমেন্টের ব্যবসা দিয়ে কিছু করতে পারবেন না।”
শুনে নাজির কিছুটা সঙ্কুচিত হয়ে যায়।
আপনার স্ত্রীর অনুমতি নিয়েছেন?

“না। তাকে দ্বিতীয় বিয়ের কথা এখনে বলা যাবে না। কানাডা গিয়ে হাতে টাকাপয়সা আসলে, ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে এখানে সেটেল্ড করে দিব। আমি মাঝে দেশে আসবো। টাকাপয়সা হাতে পেলে ও আপনার কথা জানলেও আপত্তি করবে না।”
“আচ্ছা আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞাসা করতে পারেন আমাকে।” তামান্না আড়চোখে নাজিরের পেশীবহুল হাত দেখতে দেখতে বলল।
“বিজ্ঞাপনে দেখলাম আপনার স্বর্ণের ব্যবসা আছে কানাডায়। তা আপনার দোকান কোন শহরে?”
“টরন্টোর ড্যানফোর্থে। দু’শ কোটি টাকার ব্যবসা।”
“বাচ্চাকাচ্চা আছে?”

“না। বাচ্চাকাচ্চা নাই। আট মাস আগে স্বামী আচমকাই হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেল। বড় বিপদে ফেলে গেল আমাকে। এতবড় ব্যবসা দেখার জন্য একজন সৎ, বিশ্বস্ত লোকের দরকার। তাই দেশে আসলাম, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম। যাক, আপনার বায়ো-ডাটা এনেছেন?”
নাজির পুরনো চামড়ার ব্যাগ থেকে বের করে সেটা তামান্নাকে দিল।
তামান্না চশমা খুলে চোখ মুছে আবার চশমা পরে বায়ো-ডাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল।
“ইংরেজি জানেন? কানাডায় আপনাকে ইংরেজিতে কথা বলতে হবে।”
“আমি ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। বায়ো-ডাটায় লেখা আছে। ইংরেজি বলতে পারি। সমস্যা হবে না।”
“আচ্ছা এখন বলেন, আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে?” নাজির হোসেন শিশুর ও মফস্বলি সারল্য নিয়ে পাত্রীকে জিজ্ঞেস করল।
একটু এগিয়ে এসে তামান্না বলল, “আমার আপনাকে পছন্দ হয়েছে। আপনি চাইলে সম্বন্ধটা…”
খুশিতে ঝলমল করে উঠল নাজির হোসেনের চোখ-মুখ।

তামান্না নাজির হোসেনের দিকে ঝুঁকে বলল, “আমার আপনাকে কেন পছন্দ হল জানেন?”
হাঁফ ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াল নাজির হোসেন। এটা জানা দরকার! কেন পছন্দ করে ফেলল তার মতো ঘোর মফস্বলের এই চশমা-পরা মাঝারি চেহারাসুরতের লোকটাকে?

তামান্না সোজাসুজি তাকিয়ে নাজিরের দিকে। নিচু গলায় বলল, “কারণ আপনি সহজ সরল, আবার স্মার্টও। আপনার মতো একজন সৎ ও বিশ্বস্ত বর খুঁজছি আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে। যে আমার বিশাল ব্যবসা দেখাশোনা করবে, দোকান সামলানোর পাশাপাশি আমারও টেক কেয়ার করবে, কানাডার মতো উন্নত দেশে তার নিজের জীবনটাকে ভালভাবে উপভোগ করবে।”
“আপনি পাসপোর্ট এনেছেন? পাসপোর্ট আর দেড়লাখ টাকা দিয়ে যান। এটা আপনার ভিসা প্রোসেসিং ও স্পন্সরশীপ বাবদ খরচ হবে।”

“এই নেন পাসপোর্ট আর ছয় হাজার টাকা। বাড়ি যাওয়ার বাস ভাড়া ছাড়া আর কিছু থাকল না আমার কাছে। বাড়ি গিয়ে ৫০ হাজার টাকা পাঠাতে পারব।”
তামান্না বিরক্তে মুখে বলল, “কী ঝামেলা? দরাদরি করলে কেমনে হবে? আপনি এত বড় ব্যবসার অংশীদার হতে যাচ্ছেন। কিছু খরচ করবেন না?”
“এসময় আমার হাতে অত টাকা নেই। হঠাৎ একসাথে এত টাকা জোগাড় করা আমার জন্যে কষ্টের।”
“ঠিক আছে তাই দিন। এস এ পরিবহনের মাধ্যমে টাকাটা পাঠাবেন।”
“ঠিক আছে।”
“আমার কাছে আপনার ফোন নাম্বার আছে। বিয়ের ডেট ঠিক করে আপনাকে জানানো হবে। ফোন পেলেই ঢাকা চলে আসবেন। শরীয়ত মতো বিয়েটা পড়িয়ে নেব। বন্ধুবান্ধবকে এসব ভুলেও বলবেন না। সবাই কিন্তু আপনার ভাল চায় না।”
নাজির সন্মতিসুচক কাঁধ ঝাঁকায়।

নাজির বিদায় নিয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে শ্যামলির বাস ধরার জন্য। তামান্নার চুলের শ্যাম্পু আর দেহ থেকে ছড়ানো মাদকতাময় কড়া সুবাসে নাজিরের নাক আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মিষ্টি ঘ্রাণটা কেমন যেন নেশা জাগানো, বুকের ভেতর শ্বাস টেনে নিতে নিতে নাজির হোসেন ভাবতে লাগলেন। দুধ সাদা রঙ, সোনালি চুল। খুব সুন্দরী, চেহারাও মায়াবী। চোখ দুটো টানা, টানা, নাকটা লম্বা। যে কেউ দেখলে প্রেমে পড়তে চাইবে। কানাডায় স্বর্ণের ব্যবসা, দু’শো কোটি টাকার মালিক। রানী ও রাজত্ব এক সাথে। এমন পাত্রী ক’জনের ভাগ্যে জোটে? কানাডায় যাব, রাজার হালে জীবন যাপন করবো। আমি রাজা, তামান্না রাজরানী… নাজির বিড়বিড় করে নিজের সাথে নিজেই কথা বলে। খুশিতে একশত পাওয়ার বাল্বের মতো ঝলমল করে ওঠে নাজিরের মুখ। ছকে বাধা এ সাদাকালো জীবনটা কি তাহলে এবার রঙিন হতে চলেছে?
বাসটা শ্যামলি ওভারব্রিজের কাছে এসে জ্যামে আটকা পড়ল, নাজির গাড়ি থেকে নেমে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। গরমে আর ভীড়ে ভর্তা হওয়ার যোগাড়। রাতে হোটেলে থেকে পরেরদিন নাইট কোচে কুড়িগ্রামে ফিরে গেল নাজির।

গতকাল দুপুরে দোকানে পত্রিকাটা পড়তে বিজ্ঞাপনটায় চোখ আটকে গেল নাজির হোসেনের। “বয়স্ক, নেশাবিহীন নামাজি পাত্র চাই। কানাডার সিটিজেন, বিধবা, সন্তানহীন (৩২), পরমা সুন্দরি পাত্রীর জন্য ৩৫-৫৫ বয়সের নামাজি পাত্র চাই। দাঁড়ি, সন্তান, দ্বিতীয় বিবাহ চলবে। যে কোন জেলা (উত্তরবঙ্গ অগ্রগণ্য)। কানাডার রাজধানী টরন্টোতে পাত্রীর স্বর্ণের ব্যবসা আছে। পাত্রকে অনতিবলম্বে কানাডা যেতে রাজি থাকতে হবে। শুধুমাত্র আগ্রহীরা ফোন করুন- ০১৭২৭-৫৮৪-***।

বিকেলবেলা নাজির রেডিওতে হাই ভলিউমে হিন্দি গান শোনে আর দাঁড়িতে মেন্দি লাগায়। তার স্ত্রী রাবেয়া সুগন্ধি জর্দা দিয়ে পান খেয়ে মুখ লাল করে পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলে, কি গো গেদুর বাপ, জুয়ান সাজতেছো যে। নতুন একটা বিয়ে করবা নাকি? নাজিরের স্ত্রী রাবেয়া নাজিরকে ঠাট্টা করে গেদুর বাপ বলে ডাকে।
নাজির আড়ষ্ঠ হয়ে যায়। রাবেয়া কি তাহলে তার গোপন পরিকল্পনা জেনে ফেলল? সে সাবধানি হয়।
স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলে, “না বউ, দোকানের মাল আনতে ঢাকা যাচ্ছি নাইট কোচে। তাই একটু শরীরের বাড়তি যত্ন নিচ্ছি।”

দাড়িতে মেহেদি, চোখে সুরমা আর গায়ে সুতার কাজ করা সাদা পাঞ্জাবি চাপিয়ে নাইট কোচে উঠল নাজির হোসেন। পরদিন সকালে যখন ঢাকার গাবতলিতে বাস থেকে নামল তখন সকালের সোনালী সূর্যের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে ঝলমল করছিল। কাছাকাছি শ্যামলিতে তার পরিচিত আবাসিক হোটেলে উঠল। ঢাকায় পাইকারী লোহা সিমেন্ট কিনতে আসলে এ হোটেলেই উঠে সে। ভাড়াও কম, কাছেই, কুড়িগ্রাম যাওয়ার নাইট কোচ স্ট্যান্ড। সকালে একটা লম্বা ঘুম দিয়ে উঠে, দুপুরে গোসল করে, আসরের নামাজ পড়ে তার স্বপ্নের পাত্রী দেখার জন্য বারিধারার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। ফোন করে বিস্তারিত ঠিকানা জেনে তার নোট বইয়ে লিখে নিল।

তিনদিন পরে ঢাকা থেকে তামান্নার ফোন পেল নাজির।
“বর্তমানে কানাডায় অনেক শীত। তাই এখন আপনাকে নেয়া যাচ্ছে না। তাই আমি কানাডা থেকে একশ কোটি টাকা এনে আপাতত দেশেই ব্যবসা করতে চাচ্ছি। তবে ওখান থেকে টাকাটা আনতে ট্যাক্স, ভ্যাট, ডিএইচএল বিল ইত্যাদি খরচ বাবদ কুড়ি লাখ টাকা লাগবে। আপনার আসার দরকার নেই। এস এ পরিবহনের মাধ্যমে টাকাটা পাঠিয়ে দেন। এক সপ্তাহ পরে আসেন, তখন বিয়েটা সেরে ফেলব।”

“এত টাকার জোগাড় নাই এখন আমার কাছে। আমি দশ লাখ টাকা পাঠাচ্ছি। আগামিকালের মধ্যে টাকাটা পাবেন।”
“দশ-বার লাখে হবে না। এক কাজ করেন, পনের লাখ টাকা পাঠান। এতগুলো টাকার ব্যবসা করবেন, টাকা খরচ না করলে হবে?”
“ঠিক আছে ম্যাডাম, পাঠাচ্ছি।”
নাজির দোকানের সব সিমেন্ট লোহা পাইকারি দরে তার এক দোকানদার বন্ধুর কাছে বিক্রি করে, কিছু টাকা ধার করে টাকাগুলো পাঠালেন। ঢাকা থেকে ফোন আসার অপেক্ষায় বসে থাকে নাজির চাতক পাখির মতো। এক সপ্তাহ যায়, দু সপ্তাহ যায়, কিন্তু কোন ফোন আসে না। এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। নাজির এবার নিজের থেকেই ফোন করে, কিন্তু তামান্না জবাব দেন না, অধিকাংশ সময় তার ফোন বন্ধ পান। নাজির হাল ছাড়েন না। ফোন করতেই থাকে। এক সময় ফোনে তামান্নাকে পেয়ে যায়।

“ফোন ধরেন না কেন? তামান্না আপনার কী হয়েছে? শরীর-টরীর ভাল?”
“কিছু হয়নি।”
“কিন্তু আমি যে অনেক টেনশনে থাকি, তা আপনি বোঝেন?”

তামান্না ফোনের অপর প্রান্ত থেকে রুক্ষ গলায় বলে, “আপনি যেহেতু বিবাহিত, তাই আপনি কানাডার আইন অনুযায়ী আমাকে বিয়ে করতে পারেন না, আমাকে নিয়ে কানাডায় যেতেও পারবেন না। আপনি যদি এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করেন তা হলে আমরা কানাডা দুতাবাসে জানিয়ে দিব। আপনার স্ত্রীকেও বিষয়টা জানাবো। তার ফোন নাম্বার আমার কাছে আছে। তাছাড়া, আপনি যে আমাকে টাকা দিয়েছেন, তার কোন প্রমাণ আপনার কাছে নাই।”
স্ত্রীকে জানানোর কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। এতদিন জলদি জলদি বড়লোক হওয়ার যে নেশার ভাবটা তার মাথার ভেতর জ্বীব বের করে লক্ লক্ করছিল, সেটা সহসাই মিলিয়ে গিয়ে এক ধরণের আড়ষ্টতা তার শরীর মনকে নিস্তেজ করে দিতে থাকল। শিকড়হীন মানুষ শিকড় গজিয়ে বসতে গেলেই ঝড়ের আবির্ভাব ঘটে। উপড়ে ফেলতে চায়।

নাজির বিষয়টা নিয়ে থানা পুলিশ করতে চাইল। অভিযোগ করবে করবে করেও শেষ পর্যন্ত মুখে কুলুপ আঁটতেই হলো। আইনি ঝামেলায় যেতে চাইল না। কারণ একে প্রমাণ নেই, তার ওপর স্ত্রীর বিষয়টা জেনে যাওয়ার ভয়। তার স্ত্রী যে চরম মেজাজী স্বভাবের, তাতে কোনক্রমে জেনে গেলে ভাগ্যে কী ঘটবে ভেবে তার গা শিউরে ওঠে, মাথার চুল খাড়া হয়। সবকিছু ভেবে নিজেকে সংযত করল নাজির হোসেন।

নাজির এখন দোকানে ঠিকমতো বসে না। মন মরা হয়ে শুয়ে-বসে থাকে। সারা রাত এপাশ ওপাশ করে, ছটপট করে কেটে গেল। অনেক চেষ্টা করেও সে দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না। তার শরীরটা কেমন অসাড় হয়ে আসে। মনে হলো ভিতরে ভিতরে সে যেন অসুস্থ। মাস দুয়েক কাটল স্ত্রী, বন্ধুদের সাথে লুকোচুরি করে। কিছুটা নিজের মনের সঙ্গেও। বন্ধুরা জানলে আড়ালে আবডালে টিটকারী, হাসাহাসি করবে।

এবার সে ভেঙে পড়েছে। জীবনে অনেক ধাক্কা সামলিয়েছে সে। কিন্তু এখন বয়স হয়েছে, সে এখন একটা কলাগাছ, কাজেই এবার এ ধাক্কা সামলাতে পারবে বলে তার মনে হয় না। ইচ্ছে করলেও এখন নতুন করে ব্যবসা শুরু করা সম্ভব নয়। এ রকম ধরাশায়ী অবস্থা দেখে তার স্ত্রী রাবেয়া নিশ্চয় খুব উপভোগ করছে, সেটা ভেবে মনে মনে বেশ অস্বস্তি বোধ করতে লাগল! যাহোক নাজির হোসেন কানাডা যাওয়া এবং টাকা খোয়া যাওয়ার বিষয়টা বেশ গোপন করেই চলেন।

জীবন তো কোথাও থেমে থাকার না। জীবন চলে জীবনের নিয়মে। দিন বদলের সঙ্গে জীবনও বদলে যায়। তাই ঝিমানোর কোন সময় নেই। সময়ের নদী বয়ে চলে। মাঝখানে পাঁচটি বছর চলে গেছে। নাজির হোসেন ব্যবসায়ে পুরোপুরি মন দিয়েছে।

দোকানের সিমেন্ট আনার জন্য নাজির ঢাকায়। সে শ্যামলিতে সবসময় যে হোটেলে ওঠে, তার পাশেই একটা নতুন খাবার হোটেল। নাজির খেতে ঢুকে কাউন্টারে দেখলেন ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলছেন হিজাব পরিহিতা এক সুন্দরী মহিলা। চেনা চেনা মনে হয়। একটু এগিয়ে ভালো করিয়ে তাকিয়ে দেখল। চোখাচোখির পর ঠাওর করতে পারল।
“আপনি তামান্না না?”

“আরে আপনি? এখানে কোত্থেকে? আপনাকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। আজ পেয়েছি আপনাকে। আজ আমার দোকানের সব খাওয়াবো আপনাকে।” তাকে দেখে হোটেল ম্যানেজার মাথাটা নিচু করে ভদ্রতা প্রকাশ করল।
বেশ খানিকটা দূরের এক কোণে একটা টেবিলে তারা দু’জন বসলো। বাচ্চা বয়সি ময়লা সার্ট পরা মেসিয়ার পানিভর্তি টিনের জগ ঠকাস করে টেবিলে রেখে তাদের দিকে না তাকিয়ে চলে গেল।
তেহেরি খেতে খেতে ওরা কথা বলতে থাকল।

“বুঝলেন নাজির, আমি আর এখন আগের তামান্না নেই। এখন আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, দান খয়রাত করি, আর আল্লাহর কাছে মাফ চাই।”
“আসলে আমার দ্বিতীয় স্বামী ও তাকে ঘিরে একটা একটা চক্র আমাকে ব্যবহার করেছে। আমার সৌন্দর্যকে পুঁজি করে অনেক টাকা কামিয়েছে। কিন্তু চোরের দশ দিন সাধুর একদিন। আপনার মতো আরও চারজন লোককে প্রতারণা করার পর একজনের অভিযোগে পুলিশ আমাকে ধরে গত বছর জেলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। ওরা বিপদ দেখে কেটে পড়ে। এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমার কোন খোঁজখবর নেয় না। আপনার মতো আমিও ওদের প্রতারণার শিকার। ওদের হাতে ব্যবহার হতে হতে আমি পুরানো, ভারী কোটের মতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।” এক নাগাড়ে বলে চলল তামান্না।

নাজির তামান্নার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল এবং তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকল।
“এখন কি করছেন?”
“আমার যা কিছু টাকাপয়সা ছিল তা দিয়ে এই খাবার হোটেলটা দিয়েছি। একজন ম্যানেজার রেখে দিয়েছি। মাঝে মাঝে এসে খোঁজখবর নেই। আল্লাহর রহমতে ব্যবসা ভালো চলছে। কাছেই একটা এপার্টমেন্ট কিনেছি। একা থাকি, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন।”
“আপনার খবর কী?”
“আমিও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। দোকানের জন্য সিমেন্ট কিনতে ঢাকা এসেছি। পাশের হোটেলে উঠেছি।”
“তা কেন? আপনি এখন থেকে ঢাকায় এলে আমার এপার্টমেন্টে উঠবেন।”
“তা কেমন করে হয়?”
“অবশ্যই হয়। আমি আপনার মতো একজন সহজ সরল মানুষ জীবনসঙ্গী হিসেবে খুঁজছি। আপনি রাজি থাকলে…”
“আমি রাজি।”
“তাহলে চলেন এখনই কাজি অফিসে যাই।”
তারা একটা বেবি ট্যাক্সিতে চড়ে কাজি অফিসে রওয়ানা দিল। লেখক : গল্পকার