কামাল কাদের : গ্রামের নাম পলাশপুর। গ্রামটি নরসিংদী রেল স্টেশন থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। নরসিংদীর আশেপাশের লোকজন অনেকেই ঢাকা শহরে গিয়ে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করে থাকে। এদের মধ্যে একজন হলো হালিম বিশ্বাস। হালিম বিশ্বাসের বাড়ি ওই পলাশপুর গ্রামে। রেল স্টেশনের কাছেই তার ছোট খাটো একটা মনহরি দোকান আছে। দোকানের মাল-পত্র কেনার জন্য অন্তত তাকে মাসে দু-তিনবার ঢাকা শহরে যেতে হয়। রেলের বেশিরভাগ যাত্রী হলো হালিমের খদ্দর। নরসিংদীর আশেপাশের গ্রামের লোকজন পালা-পার্বনে, ছেলেমেয়েদের জন্মদিনে, নানা রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, অথবা কারো বাড়ির নিমন্ত্রণ অতিথী হয়ে যাবার পথে হালিমের দোকানে ঢু মারে, কারণ তার দোকানে নানা রকমের মন কাড়ানো “গিফট” কিনতে পাওয়া যায়। দোকানের বেচাকেনা ভালোই হয়। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এর চেয়ে সে এর বেশি আশা করে না। বিধবা মা এবং ছোট বোনকে দু বেলা পেট ভরে খেতে দিতে পারছে, তাতে সে সন্তুষ্ট। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে হাজার শুকরিয়া জানায়।

ক্লাস নাইন পর্যন্ত হালিমের পড়াশুনা। ছাত্র ভালোই ছিল। হঠাৎ করে বাবা মারা যাবার পর টাকা-পয়সার অভাবে ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও লেখাপড়াটা আর চালাতে পারলো না। স্টেশনের সামনে ধলা মিয়ার চায়ের দোকানে কয়েক মাস কাজ করার পর তার একটা বড় রকমের অভিজ্ঞতা হলো। অন্যের জন্য কাজ না করে নিজের জন্য কাজ করতে হবে। সে যদি নিজে একটা ব্যবসা দিতে পারে তাহলে তার জীবনটা পাল্টিয়ে যেত। কিন্তু ব্যবসার জন্য মূলধন তো দরকার। হালিমের মাথার মধ্যে সেই চিন্তাই সর্বক্ষণ ঘুরপাক খেতে থাকে। মায়ের অনুমতী নিয়ে সে ধানের জমিটি গ্রামীণ ব্যাঙ্কের কাছে বন্ধক দিয়ে একটা বড় রকমের ঋণ নিলো। ঋণের টাকা দিয়ে একটা ঠেলা রিকশাকে ভ্রাম্যমান দোকান হিসাবে ব্যবহার করে তাতে নানা রকম “গিফট” জাতীয় জিনিসপত্র নিয়ে গ্রামে গঞ্জে বেচা-কেনা শুরু করলো। ধীরে ধীরে রোজগার ভালো হতে চললো ফলে স্টেশনের কাছেই হালিম ছোট খাটো একটা দোকান ভাড়া নিতে সমর্থ হলো। ব্যবসার চাহিদা অনুযায়ী তাকে প্রতি মাসে কয়েকবার মাল কেনার জন্য ঢাকা শহরে যাতায়াত করতে হয়। ঢাকা শহরে মাল কিনে একই দিনে সে নরসিংদী ফিরতে পারে। ঢাকা শহরে পাইকারী ব্যবসাওয়ালাদের কাছ থেকে তার চাহিদা মতো জিনিষপত্রের ভাল দাম পেয়ে থাকে এবং এরই মধ্যে সে কিছু ব্যবসায়ীর সাথে ভালো সখ্যতাও গড়ে তুলেছে। ব্যবসার উত্তরোত্তর উন্নতির জোরে হালিম তার দোকানে রকিব নামে ১৫ / ১৬ বছরের এক ছেলেকে খন্ডকালীন কাজ দিয়েছে। ব্যবসার সুবাদে হালিমকে নানা জায়গায় যেতে হয় এবং তার অনুপস্থিতিতে দোকান চালানোর ভার একমাত্র রকিবকেই দিয়ে যেতে হয়। বয়স কম হলেও ছেলেটির উপর হালিম ভরসা করতে পারে। গরীব ছেলেটিকে কাজ দিতে পেরে সে নিজেকে ধন্য মনে করে।

একদিন হালিম ঢাকা থেকে মাল কিনে নিয়ে গ্রামে ফিরতি পথে মহাবিপদে পড়ে গেলো। ভয়ে, রাগে, বিতৃষ্ণনায় সে রীতিমতো ঘামতে শুরু করে দিলো, যখন টি,টি (Ticket Tester) সাহেব তার কাছ থেকে টিকেট দেখতে চাইলো তখন সে পকেটে হাত দিতে গিয়ে দেখে যে, তার অন্যমস্কতার দরুন কোন এক সময়ে এক ধুরন্দর পকেটমার তার মানিব্যাগ নিয়ে উধাও। যার ভিতর হাজার খানিক টাকা এবং ট্রেনের টিকেটখানাও ছিল। টিকেট না দেখাতে পেরে টি,টি সাহেবকে সে ব্যাপারটা বোঝাতে চেষ্টা করলো। টি,টি সাহেব ব্যাপারটিকে কোনই গুরুত্ব দিলেন না বরং বিরক্ত হয়ে বললেন, “ধরা পড়লে তোমরা সবাই সেই একই কথা বোলো, আমাকে বিশ্বাস করুন, আমি টিকেট করেছিলাম, এখন হারিয়ে ফেলেছি অথবা চুরি হয়ে গিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি”।

হালিম তার জামার কাটা পকেট দেখিয়ে বললো, “আমি ঠিকই টিকেট কিনে ছিলাম স্যার, দেখুন আমার এই নুতন জামার পকেট কেটে চোর আমার মানিব্যাগ নিয়ে চম্পট দিয়েছে, আমি মোটেই টের পায়নি। এখন আপনি যদি আমার প্রতি সদয় না হন, তা হলে আমি আমার এ সমস্ত মালপত্র নিয়ে পথে বসবো। ঢাকা শহরে আমার আপনজন বলতে কেউ নেই। সারা রাত আমি কোথায় থাকবো আর রাত্রের খাবারের পয়সাটুকুও নেই, কি যে করি কিছুই মাথায় আসছে না”।

টি,টি সাহেব কিছুটা নরম হয়ে বললেন, “তোমাদের মতো সব যাত্রী যদি সেই একই কথা বলে, আমি টিকেট কিনেছিলাম, হারিয়ে ফেলেছি অথবা চুরি হয়ে গেছে তাহলে রেল কোম্পানীর দশা কি হবে, একবার কি ভেবে দেখেছো? রেল কোম্পানী তো দেউলিয়া হয়ে রসাতলে যাবে। যুক্তির খাতিরে তুমি হয়তো বলবে, আমি একজন টিকেট না কিনলে রেল কোম্পানীর কি আসে যাবে! এরকম সবাই ভাবলে রেল কোম্পানীর অবস্থাটা ঠিক লোম বাছতে গিয়ে কম্বল উজাড় হয়ে যাবে অর্থাৎ কম্বল আর কম্বল থাকবে না। যাকগে ওসব কথা, তোমাকে জরিমানা দিতে হবে, তা নাহলে তোমার সাথে যে সব মালপত্র রয়েছে সেগুলি ক্রোক করা হবে”।

হালিম শেষ রক্ষা হিসেবে কাকুতি-মিনতি করে বললো, “স্যার, আমাকে রক্ষা করুন,” আমি একজন গরীব লোক। ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা চালাচ্ছি, সাথের মালগুলিই আমার মূলধন। এগুলি নিয়ে নিলে আমার মেরুদন্ড ভেঙে যাবে, আমি আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবো না। বিধবা মায়ের জমি বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় করেছি, আমাকে দয়া করুন স্যার!

হালিম যেভাবে শেষ কথাটি বললো, “আমাকে দয়া করুন স্যার” তাতে টি,টি সাহেবের মন গলে গেল। তিনি বললেন, “তোমাকে আমার বিশ্বস্ত বলে মনে হয়। এই বিশাল ঢাকা শহরে রাত্রীটা একা অভুক্ত অবস্থায় কিভাবে কাটাবে সেটা চিন্তা করে তোমার এই বিপদ থেকে ছাড় দিলাম”। টি,টি সাহেব কিছুক্ষণ থেমে একটু ক্ষোভের সাথে বললেন, “আমাদের দেশে অনেক বিত্তশালী লোক নিজেদেরকে মন্ত্রী, এমপি, আরো কত নামি দামী, প্রভাবশালী লোকের পরিচয় দিয়ে বিনা টিকেটে রেলে ভ্রমণ করে বেড়ায় তার কোনো হিসাব নাই, তাই ভাবলাম তোমাদের মতো খেটে খাওয়া, সৎ লোকের এরকম বিপদে না হয় একটু সাহায্য করলাম, জানি না আমার কাজের কোনো গাফলতি হলো কিনা! তবে খুব সাবধানে থাকবে তোমার গন্তব্যস্থান না আসা পর্যন্ত”।

“ঠিক আছে স্যার, আপনার আদেশ মান্য করে চলবো, আমার এই বিপদের সময়ে আপনি যে দয়া দেখালেন, তা আমি জীবনে কোনোদিন ভুলবো না। আমার কাছে স্যার মনে হলো আমি এক নুতন জীবন পেলাম”, হালিম কৃতজ্ঞতার সুরে টি,টি সাহেবকে জানালো।
সময় এবং নদীর গতি বসে থাকে না। এমনি করে সময় গড়িয়ে চলছে, সাথে সাথে হালিমের ব্যবসাও উন্নতির সোপানে ধাবিত হচ্ছে। বেশ কিছুটা মূলধন হাতে জমা হওয়ার ফলে সে ঢাকা শহরে কোথাও নুতন একটা দোকান খোলার চিন্তা ভাবনা করছে। সুযোগ জুটে গেল। সে বিশিষ্ট সূত্রে জানতে পারলো, পুরানো ঢাকার সদরঘাটের চৌরাস্তার মোড়ে একটা দোকান ইজারা (ষবধংব) দেয়া হবে। দোকানের মালিক বৃদ্ধ হয়েছেন, অবসরে যেতে চান, ছেলেমেয়েরা কেউ ব্যবসার দিকে নজর দিতে চাইছে না। মালিক ক্রেতা খুঁজছেন। হালিম সুযোগটা লুফে নিলো। তার ধারণা বিধাতা সদয় হয়ে এই দোকানটির খোঁজ দিয়েছেন।
অবশেষে একদিন যথাসময়ে দর দাম করে হালিম দোকানটি কিনে নিলো। সেদিন উকিল আর এজেন্টের সাহায্যে ফলপ্রসূ চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর দুপুরে খাবারের জন্য সে কমলাপুর রেল স্টেশনের কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। সারাদিন কাজের ব্যস্ততায় চা, আর বিস্কুট ছাড়া কিছুই পেটে পড়েনি। ঢাকায় আসলে সে এই রেস্টুরেন্টে বরাবরই ঢুঁ মারে অর্থাৎ রেগুলার কাস্টমার, সেই সুবাদে রেস্টুরেন্টের সবাই তাকে কম বেশি চেনে। রেস্টুরেন্টে খাবারের অর্ডার দিয়ে একটু ভাবনায় পড়লো। যদি নরসিংদীর দোকানটি সে দেখাশুনা করে তাহলে ঢাকার দোকানের জন্য একজন ফুল টাইম বিশ্বস্ত লোকের প্রয়োজন হবে। আজকাল যে দিন পড়েছে, বিশ্বস্ত লোক পাওয়া বেশ কঠিন।

তার ভাবনায় ছেদ পড়ল। দোকানের বাইরে সে হৈ, চৈ শব্দ শুনতে পেলো। একটু আগ বাড়িয়ে দেখলো রাস্তার মাঝে বিক্ষোভ মিছিল চলছে। হন হন করে ছুটে চলছে সহস্র মানুষের ঢল। হাতে প্লেকার্ড, ব্যানার, আরো কত কি! তার কিছুক্ষণ পরই প্রতিপক্ষ দুই দলের মধ্যে ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেলো। অবস্থার বেগতিক দেখে পুলিশ বাহিনীকে ডাকা হলো। উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্র ভঙ্গ করার জন্য ঢাল / লাঠি ছাড়াও পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার করতে বাধ্য হলো। পথচারীদের মধ্যে অনেক নিরীহ লোক এই সংঘর্ষের শিকার হল। যে যেখানে পারছে সামনের দোকানগুলিতে ঢুকে পড়ছে। এরই মধ্যে কিছু কিছু লোক কাঁদুনে গ্যাসের কবলে পরে রাস্তার আশেপাশে চিৎ পটাং হয়ে ঢলে পড়লো। হালিম যে রেস্টুরেন্টে খাবার খাচ্ছিলো সেখানে আহত কয়েকজন লোককে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ধরাধরি করে নিয়ে আসা হলো। তাদের মাঝে এক মধ্য বয়স্ক লোককে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে তার কাছে চেনা চেনা মনে হলো। লোকটির কাছে এসে সে কিছুক্ষণ গভীরভাবে তাকিয়ে থাকার পর লোকটিকে চিনতে পারলো। উনিই সেই টি, টি সাহেব যিনি কয়েক বছর আগে ট্রেনের টিকেট দেখাতে না পেরে তাকে রেহাই দিয়েছিলেন। তৎক্ষণাৎ হালিম তার খাবার দাবার রেখে, ভদ্রলোকের চোখে মুখে পানি দিয়ে বুকে-পিঠে ম্যাসেজ করা শুরু করলো। ধীরে ধীরে ভদ্রলোকের জ্ঞান ফিরলো। হালিম ভদ্রলোককে তার পরিচয় জানালো। কিন্তু ভদ্রলোক কিছুতেই তাকে স্মরণ করতে পারছে না। তার সুদীর্ঘ চাকরীর জীবনে অনেক পেসেঞ্জারের সাথে তো দেখা – সাক্ষাৎ হয়েছে, সবার কথা কি মনে রাখা যায়! তিনি কিছুতেই হালিমকে মনে করতে পারছেন না। হালিম বেশি কথা না বাড়িয়ে ভদ্রলোককে অতি বিনয়ে সাথে জিজ্ঞাসা করলো, “স্যার, আপনি এখানে কি করছিলেন? মানে কোনো জরুরি কাজে এসেছেলিন কি না।” ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, ঢাকায় এসেছিলাম রেলওয়ের হেড অফিসে আমার পেনসনের জন্য ধন্না দিতে আর তার সাথে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটা উঠাতে। টাকা তো পেলামই না বরং আজ যে বিপদ থেকে বেঁচে গেলাম সেটা ভাবতে গেলে এখনো গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। বেশ কয়েক মাস ধরে টাকার জন্য রেলওয়ের সদর দফতরে ঘুরাঘুরি করছি, বিশেষ কোনো ফল পাচ্ছি না।

অনেকে বলছেন, ধরাধরীর লোক নাইতো তাই টাকাপয়সা খরচ করতে হবে। বর্তমানে আমার কোনো চাকরি নেই, তাছাড়া এই বুড়ো বয়সে কেউ চাকরি দিতে চায় না, মেয়ের উপার্জনে চলছি। বলুন ওদেরকে ঘুষ দেয়ার জন্য টাকা কোথায় পাবো? তাছাড়া আমার নিজের পরিশ্রমের জমানো টাকা টাকা থেকে আমাকে পেনশন দেবে, এর জন্য ঘুষ দিতে হবে কেন? কবে নাগাদ টাকা পাবো আল্লাহ মালুম। আর হালিম কথাগুলি শুনে বললো, “আমিও তাই ভাবছি, দেশের নৈতিকতা এতদূর নেমে গেছে যে আমরা আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। হ্যাঁ, ভালো কথা, আপনাকে দেখে মনে হয় না তো আপনার পেনশন নেবার বয়স হয়েছে”! “সে আর এক ইতিহাস, কোনো এক প্রতাপশালীর অদৃশ্য চক্রান্তে আমার চাকরীটা খোয়া গেছে। ব্যাপারটা আপনাকে খুলেই বলি”। টি,টি সাহেব একটু দম নিয়ে শুরু করলেন উনার কাহিনী, “ঢাকা টু নরসিংদী এবং নরসিংদী টু ঢাকা এই হলো আমার টিকেট চেকিং করার রুট। একদিন ঢাকা থেকে নরসিংদী যাবার পথে আমার কর্তব্য অনুযায়ী টিকিট চেক করে যাচ্ছিলাম। ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টে তিনজন ভদ্রলোক আমাকে টিকেট দেখাতে ব্যর্থ হলেন। ফ্রি ভ্রমণের পাস বা অন্য কোনো ডকুমেন্টস তাদের কাছে আছে কিনা, তা জানতে চাইলাম। একজন অত্যন্ত রাগ দেখিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তরে বললেন, তারা এক সরকারি নাম করা অফিসারের আত্মীয়, সে জন্য তাদের ভ্রমণের জন্য কোনো টিকেট বা পাসের প্রয়োজন হয় না। আরো বললেন, তোমার তো সাহস কম না আমরা টিকেট করেছি কি না তা দেখতে চাইছো? আমি উনাদের শুধু এইটুকু বললাম, স্যার, আমার কাজ টিকেট পরীক্ষা করা। আমি যদি টিকেট না দেখি তাহলে আমার কাজের অবহেলা হবে এবং যে কোনো লোক আপনাদের মতো সাফাই গাইতে পারে। আমার কথাটি শুনে মনে হলো উনারা আরো রেগে গেছেন। আমি আর কি করি, ছা-পোষা লোক! যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ী কম্পার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে গেলাম। ওই ঘটনার কয়েকদিন পর নোটিশ এলো, আমার বড় সাহেব আমাকে তলব করেছেন। আমার হাতে নোটিশ দিয়ে জানালেন, কোনো এক সময়ে আমার কাজের misconduct ধরা পড়েছে তাই আমাকে বরখাস্ত করা হলো with immediate effect। আপীলের কোনো সুযোগ দেয়া হলো না। কোথায়, কি কারণে আমার মিসকন্ডাক্ট হয়েছে জানা গেলো না, তবে বুঝতে পেরেছি এই কুচক্র লম্বা হাতের সূত্র কোথা থেকে এসে আমার জীবনটাকে তচনছ করে দিয়েছে। আমার আর কিছুই করার ছিলো না, আমি শুধু মনে মনে আল্লাহর কাছে এর বিচার চেয়েছি।” এই বলে টি, টি সাহেব থামলেন।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, “মেয়েটি কলেজে বি,এ, পড়ছিলো। সংসারের আয়ের কোনো উৎস না থাকায় মেয়েটির লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেলো। বর্তমানে পাড়ার এক বেসরকারী স্কুলে তার মাস্টারি করা উপার্জনে আমরা সংসারটিকে কোনোমতে টিকে রাখছি”। কথাটি জেনে হালিমের নিজের জীবনের বাস্তবতার কথা মনে পরে গেলো। সে টি,টি সাহেবকে বললো, “আপনার সাথে দেখা হয়ে মনে হয় ভালোই হলো। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি সদরঘাটে একটা দোকান নিয়েছি, অচিরেই ওটা চালু করবো। একজন বিশ্বাসী লোকের প্রয়োজন ছিল, আপনাকে পেয়ে আমার সে চিন্তাটা দূর হয়ে গেলো। আপনার যদি অমত না থাকে, তাহলে আমার দোকানটি দেখাশুনা করতে আপনাকে অনুরোধ করছি। আজও আমার মানসপটে আপনার সেই দয়ার কথা সময়ে অসময়ে ভেসে উঠে। আশা করি আপনি আমার এই অনুরোধটুকু রাখবেন”। হালিমের কথাটি শুনে টি,টি সাহেব একেবারে বাকরুদ্ধ। এ দুঃসময়ে উনার ভাগ্যে যে এমনভাবে সুপ্রসন্ন হবে সেটা তিনি ভাবতেই পারছেন না। উপরওয়ালা যে একজন আছেন এবং এই পৃথিবীটা চালাচ্ছেন, তার প্রমাণ তিনি হাতে নাতে পেয়ে গেলেন। স্বেচ্ছায়, অনিচ্ছায় মানুষের জীবনে অনেক কিছু ঘটে যায়, কিন্তু আমরা মানুষেরা কোনো কোনো সময়ে সেটার মূল্য দিতে জানি না।

হালিমের অনুরোধে এবং উদারতায় টি,টি সাহেব হালিমকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রস্তাবটা গ্রহণ করলেন। হালিমের মুখমন্ডল পরিতৃপ্তির হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। রোদ পড়ে আসছে।
হালিম আকাশে দিকে তাকালো। আকাশ যে এতো সুন্দর তার কাছে আগে কখনও কোনো মনে হয়নি। শেষ
email: — quadersheikh@gmail,com