টরন্টোতে “পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ: সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো” গ্রন্থের আলোচনা অনুষ্ঠানে কথা বলছেন মুনতাসির মামুন। চেয়ারে উপবিষ্ঠ কবি আসাদ চৌধুরী এবং ফারহানা আজিম শিউলি

আলম খোরশেদ : মুনতাসির মামুন কানাডা প্রবাসী না হলেও তিনি টরন্টোতে অনেক মানুষের কাছে এক পরিচিত নাম। তিনি সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টোতে ভ্রমণ করেছেন এবং সেই ভ্রমণ বৃত্তান্ত নিয়ে লিখেছেন এক অসাধারণ গ্রন্থ ‘পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ : সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো’। তাঁর উপস্থিতিতে তাঁর এই গ্রন্থ নিয়ে গত ১২ নভেম্বর সন্ধ্যায় টরন্টো ফিল্ম ফোরামের আয়োজনে টরন্টোর ৩০০০ ড্যানফোর্থ এভিনিউর মাল্টিকালচারাল ফিল্ম স্ক্রিনিং সেন্টারে এক আলোচনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন টরন্টোর অনেক সংস্কৃতি-প্রাণ বাঙালি উপস্থিত হয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিলেন মুনতাসির মামুনের ভ্রমণ বৃত্তান্ত।

“পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ: সাইকেলে আমেরিকার সিয়াটল থেকে ওয়াশিংটন ডি.সি.” গ্রন্থের প্রচ্ছদ

উল্লেখ্য, মুনতাসির মামুন ১৯৮২ সালের ১০ নভেম্বর বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। সেই সময় তার বাবা বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে শিক্ষকতা করতেন। মামুন পড়াশুনা করেছেন ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ হাইস্কুল, নটরডেম কলেজ এবং গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে। তিনি ওশান কনজারভেন্সি এবং ব্যানফ মাউন্টেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ওয়ার্ল্ড ট্যুরের বাংলাদেশ সমন্বয়ক। তিনি ভ্রমণ, অভিযান ও পরিবেশ নিয়ে লেখালেখি করছেন দুই দশকের বেশি সময় ধরে। পরিবেশ নিয়ে গবেষণা গণসচেতনতার জন্য তিনি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ‘কানেক্ট ফর ক্লাইমেট’ এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইমেট চ্যাম্পিয়ন’ পুরস্কারে ভ‚ষিত হন। আলোকচিত্রী হিসেবে তিনি আইইউসিএনের ‘বায়োডাইভার্সিটি ইন ফোকাস’ এবং ‘ইন্টারন্যাশনাল এইডস সোসাইটি’ পুরস্কার লাভ করেছেন। মুনতাসির মামুন আজীবন স্কাউট এবং বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। দেশে-বিদেশে তার তোলা আলোকচিত্রের ছয়টি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। পর্বতারোহণ নিয়ে প্রকাশিত তার দুটি গ্রন্থ হচ্ছে ‘এভারেস্ট’ (২০০০৫) এবং ‘দ্য টার্টেল নেক’ (২০০৮)। মামুন ঢাকায় বসবাস করেন।

আমেরিকার যে পথ ধরে তিনি যাত্রা করেছেন

মুনতাসির মামুন সাইকেলে কানাডা ভ্রমণের পূর্বে ২০১২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপক‚লের সিয়াটল শহর থেকে সাইকেল চালিয়ে দেশের একেবারে অপর প্রান্তে, পূর্ব উপক‚লের শহর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডি.সি. পর্যন্ত এসেছিল। তাঁর সেই ভ্রমণ কাহিনি নিয়ে লিখেছিলেন ‘পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ: সাইকেলে আমেরিকার সিয়াটল থেকে ওয়াশিংটন ডি.সি.’ নামে এক অসাধারণ ভ্রমণ কাহিনি। তাঁর সেই গ্রন্থ নিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলম খোরশেদ। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য লেখাটি প্রকাশ করা হলো। – সম্পাদক, বাংলা কাগজ

আমেরিকার পথে দু’জন

‘ঘরকুনো বাঙালি’ কথাটির উৎপত্তি কবে, কোথায়, কেন হয়েছিল আমার জানা নেই। তবে তার এই দুর্নাম সম্ভবত ঘুচে গেছে অনেক আগেই। আর এই কাজে যাঁরা সক্রিয় ভ‚মিকা রেখেছেন সেরকমই দুজন সাহসী ও স্বাপ্নিক তরুণ মুনতাসির মামুন ও আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল। এঁরা আজ থেকে প্রায় একযুগ আগে, ২০১২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপক‚লের সিয়াটল শহর থেকে সাইকেল চালিয়ে দেশের একেবারে অপর প্রান্তে, পূর্ব উপক‚লের শহর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডি.সি. পর্যন্ত এসেছিল। পথে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের মোট এগারোটি রাজ্য: আইডাহো, মন্টানা, ওয়াইয়োমিং, সাউথ ডাকোটা, নেব্রাস্কা, আইওয়া, ইলিনয়, ইন্ডিয়ানা, ওহাইয়ো, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ও ভার্জিনিয়া; সময় লেগেছিল মোট ৬৮ দিন এবং এই যাত্রায় তারা পাড়ি দিয়েছিল মোট ৩৫০০ মাইল তথা সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার। ভাবা যায়!

তো, তাদের এই লোমহর্ষক, অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা নিয়েই স¤প্রতি একটি সুখপাঠ্য সচিত্র গ্রন্থ রচনা করেছে এর অন্যতম অভিযাত্রী মুনতাসির মামুন, যিনি পেশায় একজন তড়িৎ প্রকৌশলী। পাশাপাশি তিনি একজন পর্বতারোহী, পরিবেশকর্মী, স্কাউট, উদ্যোক্তা, লেখক ও সুদক্ষ সংগঠকও। তার এই বইটির নাম “পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ: সাইকেলে আমেরিকার সিয়াটল থেকে ওয়াশিংটন ডি.সি.”। এটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২২ সালের বইমেলায় বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে। স¤প্রতি বইটি পড়ার সৌভাগ্য হল আমার। মামুনের লেখার হাতও বেশ ভালো, কেননা সে একজন ভালো পাঠকও, যার অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে এই গ্রন্থেই। এছাড়া সে ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি নানা বিষয়ে আগ্রহী ও অবগত, যার বুদ্ধিদীপ্ত প্রকাশ এই বইয়ের গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে অনেকখানি।

আমেরিকার পথে বাংলাদেশ

তবে সবচেয়ে বেশি যা আকৃষ্ট করেছে আমাকে, সেটি তার খোলা মন ও মুক্তচিন্তার স্বভাব। যে কারণে বইটি স্রেফ একটি ভ্রমণকাহিনি বা অভিযানের গল্পে সীমাবদ্ধ না থেকে হয়ে উঠেছে বিশ্বমানবের আনন্দ, বেদনার আখ্যান। সেখানে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণি, লিঙ্গ, ভাষা, জাতীয়তা ইত্যাদি কোনো সঙ্কীর্ণতাই তার উদার বিশ্ববীক্ষাকে কলুষিত করতে পারে না। তার এই বইয়ের ছত্রেছত্রে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যে উদার মানবিকতা, সৌভ্রাতৃত্ব ও স¤প্রীতির ছবি দেখতে পাই আমরা, তা আমাদেরকে উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত ও প্রাণিত করে, আমাদেরকে আশাবাদী হতে, শুভচিন্তা করতে এবং স্বপ্ন দেখতে সাহসী করে তোলে। এটিই সম্ভবত এই গ্রন্থের সবচেয়ে বড় শক্তি, সৌন্দর্য ও প্রাপ্তির জায়গা। আমরা এর বহুল প্রচার ও পাঠের প্রত্যাশী।

পুনশ্চ: বইটির একেবারে শেষ বাক্যটি এরকম।
“ঘাড় ফিরিয়ে ওয়াহিদ স্বভাবসুলভ সুরে বলল– দোস্ত এরপর কই যাবি? কানাডা। না ভেবেই বলে দিলাম।”
সত্যি, সত্যিই এর ঠিক দুবছর বাদে ২০১৪ সালে মুনতাসির তার অন্য দুজন বন্ধুকে নিয়ে কানাডার সর্ব উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের আলাস্কা থেকে দীর্ঘ ৯৫ দিন সাইকেল চালিয়ে একেবারে পুবের শহর টরন্টো অবধি এসে পৌঁছেছিল। এবং সেই অভিজ্ঞতা নিয়েও একটি গ্রন্থ রচনা করেছে সে, “পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ: সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো” শিরোনামে, যেটি প্রকাশিত হয়েছে বনেদি প্রকাশনী ইউপিএল থেকে, এই গেল বছরই। শুভ পাঠ।