মুরশাদ সুবহানী : (পূর্ব প্রকাশের পর)
লালন শাহ’র গান বিশুদ্ধ ইসলামী চিন্তা ও বিশ্বাসের উপর পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।

তাঁর গানগুলি আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত¡ এবং বিশ্বাসের সাথে যুক্ত। তাঁর বাউল গানে মুসলিম, হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ দর্শন বিশ্বাস এগুলো রয়েছে। এর জন্য তাঁর গান বিশুদ্ধ ইসলামী সুফি ইজম হিসেবে আমলে নেননি, অনেক ইসলামিক চিন্তাবিদ। তাদের মতে, মিশ্র দার্শনিক ও ধর্ম বিশ্বাস ছিল লালনের।
লালন শাহ কোনো বিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করেননি। একাডেমিক শিক্ষা তাঁর ছিল না। ভাবলে অবাক হতে হয়; তিনি অধ্যাত্মবাদ, দেহ- আত্মা তত্তে¡র উপর এত সুন্দর গান কিভাবে রচনা করেছেন।

তবে আমাদের চারদিকে অনেক প্রতিভাবান মানুষ আছেন, যাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা ছিল না, সাহিত্য অঙ্গন, সঙ্গীত-নাটক, চিত্রকলায় যা দিয়েছেন তা তুলনাহীন। তাঁরা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বুদ্ধি-জ্ঞান দিয়ে পারিপার্শ্বিকভাবে এই জ্ঞান অর্জন করেছেন। ফকির বাউল লালন শাহ তাদের মধ্যে একজন।
একজন কবি-গীতিকার তাঁর সৃষ্টি কর্ম দিয়ে নিজ আসন করে নেন। লালন সাঁই তাঁর সৃষ্টি কর্মে বাউল সম্রাট হয়ে আছেন।
কাঙাল হরিনাথের নাম জানেন অনেকেই। তাঁর আসল নাম হরিনাথ মজুমদার। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালিতে বৃটিশ-ভারত শাসন আমলে তিনি ১৮৩৩ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন, বাউল লালন সাঁইয়ের বহু সংখ্যক ভক্তের মধ্যে একজন। তিনি শুধু বাউল গানের চর্চাই করতেন না, রাজনীতির সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল। তিনি ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত এই পত্রিকায় তিনি বৃটিশ শাসনে অত্যাচারের শিকার গরীব দু:খী মানুষের কথা লিখতেন। পত্রিকাটি প্রথমে মাসিক পরে পাক্ষিক পরবর্তীতে প্রতি সাপ্তাহে প্রকাশিত হতো। টানা প্রায় ১৮ বছর এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। পরে বৃটিশ শাসিত ভারতে সরকারের মুদ্রণনীতির কঠোর তার কারণে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’র প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। কাঙাল হরিনাথ বাউল সম্রাট লালন সাঁইয়ের একনিষ্ঠ ভক্ত-শিষ্য থাকায় তাঁর মাধ্যমে লালন সাঁই সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানা যায়। তিনি ছাড়াও অন্যদের কাছ থেকেও লালন সাঁই সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।

মহাত্মা গান্ধীর ২৫ বছর আগে বাউল লালন শাহ পেয়েছিলেন ‘মহাত্মা’ উপাধি। রবীন্দ্র গবেষক ও সাংবাদিক হাবিবুর রহমান স্বপন তাঁর এক লেখায় এই তথ্য উল্লেখ করেছেন। তবে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হয়নি এই উপাধি তিনি কোন সালে এবং তারিখে পেয়েছিলেন।
‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এক বøগে এই লেখক দেখতে পান যে, ‘‘মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুর ১২ দিন পর ছাপা হয় ‘লালন ফকিরের নাম। হিতকরীতে প্রকাশিত একটি লেখায় লালন সাঁইকে প্রথম “মহাত্মা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।”

ঐ পত্রিকাটিতে আরও লেখা হয় “এ অঞ্চলে কাহারও শুনিতে বাকি নাই। শুধু এ অঞ্চলে কেন, পূর্বে চট্টগ্রাম, উত্তরে রংপুর, দক্ষিণে যশোহর এবং পশ্চিমে অনেকদূর পর্যন্ত বঙ্গদেশের ভিন্ন দুই স্থানে বহুসংখ্যক লোক এই লালন ফকিরের শিষ্য; শুনিতে পাই ইহার শিষ্য ১০ হাজারের ওপর। ইঁহাকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি; আলাপ করিয়া বড়ই প্রীত হইয়াছি।”
মহাত্মা গান্ধীর ২৫ বছর আগে লালন সাঁইকে মহাত্মা উপাধি দেওয়া হয়। নিদির্ষ্ট সাল তারিখ জানা যায়নি। তবে লালন শাহের সাথে যাঁদের পরিচয় ছিল তাদের মধ্যে কাঙাল হরিনাথ একজন। তাঁর সাথে গভীর হৃদিক সম্পর্ক ছিল লালন শাহের। লালনের গান প্রচারে ছিল তাঁর বিশেষ ভূমিকা। এ ছাড়াও বিশিষ্ট লেখক মীর মোশাররফ হোসেন, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, জলধর সেনের সঙ্গেও লালন শাহ’র সম্পর্ক ছিল।
ধারণা করা যায় যে, লালনের বহু সংখ্যক ভক্ত-অনুরক্ত-শিষ্যরা তাঁকে মহাত্মা হিসেবে বিশ্বাস করতেন।

সঙ্গীতের বিভিন্ন শ্রেণী বিন্যাস আছে। এর মধ্যে মুর্শিদি, মারফতি, বাউল সঙ্গীত। মারফতি ও বাতেনী তত্তে¡র ধারায় বিভিন্ন বাউলরা পূর্বে একতারা, দোতারা বাজিয়ে গাইতেন, এখনও গান। কবি নাভিল মানদারের মতে, ‘একতারা’-কে বাউল শিল্পীরা আত্মার প্রতীক বলে বিশ্বাস করেন।’

তবে আধুনিক সময়ে নানা সঙ্গীত যন্ত্র এর সাথে যুক্ত করে লালন সঙ্গীত গাওয়া হয়।
মারেফত বা মারেফতি শব্দের অর্থ জানা জ্ঞান। জাহেরী কথা যা জানানো হয়েছে। এটি ইসলামী পরিভাষা থেকে এসেছে। বাউল গান বিশেষ সুরের মারফতি গান। বাউল গানের মধ্যে ইসলাম, হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের অনেক কথা পাওয়া যায়। যেগুলো হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মে বর্ণিত হয়েছে। লালন সাঁইয়ের গানে বিভিন্ন ধর্মতত্তে¡র কথা, দেহ তত্ত¡ ও আত্মার কথা আছে।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে লালন সাঁই বয়সে অনেক বড় ছিলেন। তাঁর কিশোর বয়সের আগেই লালন শাহ’র আধ্যাত্মিক তত্তে¡র বাউল গান গ্রামে-গঞ্জে মানুষের মনে প্রোথিত হয়ে যায় এবং তিনি ও তাঁর শিষ্যরা বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে গান-বাজনা করে পরিচিতি লাভ করেন।

লালন শাহ নিরক্ষর ছিলেন। তিনি নিজে গানের চরণ লিখতেন না, তাঁর মনে গানের ভাব উদয় হলে শিষ্যদের মধ্যে অনেকে ছিলেন, সেটা লিখতেন। অনেকের নাম জানা যায়। তাদের মধ্যে অন্যতম ফকির মানিক ও মনিরুদ্দিন শাহ্ গান লিখে নিতেন। যদিও লালন শাহ গান লিখতে মানা করতেন, বলতেন “লিখিস না, ছিনায় রাখ। এ সব গান লোকে জানলে সারা বিশ্বে হৈচৈ হবে। কেউ বুঝবে কেউ বুঝবে না।” মনিরুদ্দিন শাহ্ লিখে রাখতেন। মনিরুদ্দিন নিজ হাতে কয়টা গানের খাতা লিখেছিলেন তার বিস্তারিত তথ্য সঠিকভাবে পাওয়া যায়নি। তবে একটি খাতা কারিকর পাড়ার ফকির আনোয়ার হোসেন ওরফে মন্টু শাহের বাড়িতে পাওয়া যায় বলে লালন গবেষকদের তথ্য মতে জানা যায়। অরিজিনাল খাতাটিতে পর পর ৫৯৭টি গান আছে। মনিরুদ্দিনের হাতের লেখা পরিচ্ছন্ন। এত বড় খাতায় কোথাও তেমন কাটাকাটি ছিল না। পাণ্ডুলিপির শেষভাগে আদ্যাক্ষর দিয়ে সাজানো ঝকঝকে সূচিপত্র। তবে কাঙাল হরিনাথের নাম খুব কম ক্ষেত্রেই গবেষকগণ উল্লেখ করেছেন। তিনি একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনিও লালনের গান লিখে রাখতেন বলে জানা যায়।

উনিশ ও বিশ শতকের প্রথামার্থে বাউল মতবাদের বিকাশ ঘটে। এই মতবাদের প্রবক্তাদের অন্যতম মহাত্মা লালন সাঁই। বহু সংখ্যক মানুষ এই মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। আধ্যাত্মিক তত্তে¡র ধারণায়। আধ্যাত্মিক তত্ত¡কে আমি দুই ভাবে দেখি- একটি হচ্ছে মারেফাত এবং আর একটি হলো বাতেনি তত্ত¡। বাতেনি তত্ত¡ বা গুপ্ত রহস্য একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জ্ঞাত নন। মারেফাত হলো জাহিরি তত্ত¡ অর্থাৎ যা জাহির করা, জানানো এবং প্রচার করা হয়েছে। লালন সাঁইয়ের আধ্যাত্মিক তত্ত¡ দেহ ও আত্মার সাথে সম্পর্কিত। তিনি মারেফত তত্তে¡র মধ্য দিয়ে গুপ্ত রহস্য প্রকাশ করতে চেয়েছেন তাঁর বাউল গানের মাধ্যমে।
এসব গানকে অনেকে সুফি ইজম বলে বিশ্বাস করেন না। মুসলমান ও হিন্দু শাস্ত্রের অনেক বিশারদ লালনগীতিকে গান হিসেবে দেখেছেন, আধ্যাত্মিক মতবাদ বা ইজম হিসেবে নয়। লালন সাঁইয়ের বাউল গান বিরোধী ঘোষণা দিয়েছেন, মাওলানা রেয়াজ উদ্দিন আহমেদ ১৯২৬ সালে। তিনি বলেছেন, “আজ বাঙালার ৬০/৭০ লক্ষ অশিক্ষিত মুসলমান, বাউল ফকিরের মারফতি ধোঁকায় পড়িয়া পবিত্র ইসলাম পরিত্যাগ পূর্বক তাহাদের দলে সামিল হইয়া গিয়াছে। এই ৬০/৭০ লক্ষ বাউল ফকিরগণকে প্রকাশ্যভাবে পরিচয় করা যায়। কিন্তু আরও এমন বহু সংখ্যক বাউল মত পোষণকারী ব্যক্তি আছে, যাহাদিগকে প্রকাশ্যভাবে পরিচয় করা সুকঠিন। এই উভয় প্রকার প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ মুসলমান বাউলদের সঙ্গে হিন্দু বাউলদের সংখ্যা যোগ করলে ঐ সময় অন্তত: এক কোটি জনতা বাউল ভাবাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল তা নি:সন্দেহে বলা যায়। কিন্তু বাউল মতবাদ বিনা বাধায় সহজে প্রসার লাভ করেনি। মুসলমান ও হিন্দু সমাজের একাংশ এ মতবাদ প্রচারে বাউলদের বাধা প্রদান করে।” (রেয়াজ উদ্দীন আহমদ, বাউল ধ্বংস ফতওয়া পৃ: ৬১)

লালন সাঁইয়ের একজন ভক্ত-শিষ্য দুদু শাহের ‘লালন-জীবনী’ বিষয়ক পুঁথিতে এই সম্পর্কে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে-
‘নানা দেশ হ’তে শেষে আসে নানাজন/তর্ক করিতে কেহ করে আগমন।।
চক্কর ফক্কর আর মানিক মলম/কোরবান, মনিরুদ্দিন আসে কতজন।
কোরবান আলী ছিলেন পাবনা জেলার অধিবাসী। পাবনা জেলা শহরের রাধানগর গ্রামে তোফাজ্জল হোছেনের সঙ্গে লালন শাহ’র ধর্মীয় বাহাছ (বিতর্ক) হয়।
ড. এস. এম. লুৎফর রহমানের ভাষ্য মতে, ‘সকল স্থানেই লালন জয়লাভ করেন এবং বাউল মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন।’

লালন শাহ জাত-ক‚লের চেয়ে আধ্যাত্মিক তত্তে¡র গানের প্রতি ছিলেন মনোযোগী। এই কারণে বাউল গানের জগতে তিনি শ্রেষ্ঠ আসনে আসীন হয়ে আছেন। তাঁর সম্পর্কে কিছু সঠিক তথ্য, কিছু কল্প-কাহিনী মিশ্রিত তথ্য আছে। নিজে যেহেতু কিছু বলতেন না, সে কারণে তাঁর ভক্তরাও হয়তো তেমন কিছু বলেননি। বাউল সঙ্গীত সাধনাই ছিল তাঁর মুখ্য কাজ। এই আলোচনায় আমরা কল্প-কাহিনীকে বর্জন করার চেষ্টা করেছি। নারী-পুরুষ মিলিয়ে তাঁর অসংখ্য ভক্ত ছিল এবং এখনও আছেন। দেশ-বিদেশে লালন সঙ্গীতের উৎসব হয়। মহাত্মা লালন শাহ’র জন্ম ও প্রয়াণ দিবসে কুষ্টিয়া জেলায় তাঁর আখড়া ছেঁউরিয়ায় (লালনের এবং তাঁর কয়েকজন শিষ্যর মাজার এবং এখানে লালন একাডেমি করেছেন সরকার) মেলা হয়। (চলবে)