আতোয়ার রহমান : ট্রেনটা প্রায় আড়াই ঘণ্টা দেরি করে ঢুকল শান্তাহার স্টেশনে। ভিড়ে ঠাসা কামরা থেকে প্লাটফর্মে নেমে হাঁফ ছাড়লাম, প্যান্ট শার্ট ঝাড়তে লাগলাম। ধুলো ময়লায় একাকার হয়েছে ব্যাগ। ভিড় এড়িয়ে, সঙ্গের চাকা লাগানো ব্যাগটা নিয়ে একটু সরে এসে, উদ্বিগ্ন চোখে দু’দিকে তাকালাম। কী বিশাল তার প্ল্যাটফর্ম, আকাশজোড়া লোহার ছাউনি! স্টেশনে হুড়োহুড়ি, ব্যস্ততা। ওভারব্রিজ যাত্রীতে গমগম করে। কালোধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। কুলিরা ব্যস্ত হয়ে মাল উঠাচ্ছে ট্রেনের বগিতে। বেবিট্যাক্সি-ফেরি-ট্রেনের ঝক্কি পেরিয়ে ঢাকা থেকে উত্তরের এই ছোট শহরে আসলাম। চাকুরি পেয়েই আমার প্রথম পোস্টিং। শান্তাহার সরকারি কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দিতে এসেছি।

শরীর ক্লান্ত, মনটাও বিক্ষিপ্ত। হালকা পায়ে ওভারব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে সেটা যেখানে রিকশা স্ট্যান্ডে গিয়েছে, সেখানে ব্যস্ত রাস্তায় হাতের ডানপাশে এক কোণায় তাকে দেখি। টুকরো চটের ওপর বসে মাথা নিচু করে আনমনে জুতা সেলাই করে চলেছে। শিরা উঠা হাত দুটো। ময়লা ছেঁড়া কাপড় পরা, ভাঙা চোয়াল-গালে অনেকদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি। রোডের দুপাশে সারি সারি দোকান আর মানুষের ভিড়। রিকশা, টোটো আর বাইকের জটলা। রিকশায় উঠে সরকারি কলেজ বলতেই রিকশাওয়ালা ভিড় ঠেলে চলতে শুরু করল। পা-দানিতে ব্যাগ রেখে তার ওপর পা চড়িয়ে দিয়ে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে যাচ্ছি অচেনা শান্তাহার কলেজের দিকে। রেল লাইনের পাশে ডানে সরু রাস্তা ধরে সামনে এগোলেই প্রকৃতির ভালোবাসা আর সবুজের সমারোহে ছবির মত সুন্দর কলেজ। পরিত্যক্ত রেলের কোয়ার্টারকে কলেজ বানানো হয়েছে। বিশাল কম্পাউন্ড, গাছগাছড়ায় চারদিক আচ্ছন্ন, পাখিদের ওড়াউড়ি। দেখে মনের ভেতরের উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা কমে গেল। এই মফঃস্বল শহরের ছোট্ট পরিসরে শুরু হলো আমার নতুন জীবন।

কলেজে যাওয়া আসার পথে প্রায়ই রেলস্টেশনের পাশে তাকে দেখতাম। রোগশীর্ণ শরীর। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। ছাই রঙের ছেড়া গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে একমনে জুতা সেলাই করে যাচ্ছেন এক বুড়ো। অশক্ত শরীর, কিন্তু হাতের পেশি এখনও টানটান। এরকম মানুষদের দিকে চোখ কুঁচকে তাকান অনেকেই। কেউ কেউ আবার সহানুভূতি অনুভব করেন এইসব মানুষদের জন্য। আমি দ্বিতীয় দলে।

কলেজে যাওয়া আসার পথে মাঝে মাঝে ওনার ওখানে যাই, কখনও জুতা সেলাই করাই, কখনও পালিশ করাই। আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ব্যস্ততার অজুহাতে কথা বলা হয় না। মনে কৌতূহল জাগে যে লোকটি আমার সাথে কথা বলতে চায় কেন! হয়তো নতুন দেখেছে তাই। অথবা অন্য কোন কারণে হতে পারে। কে জানে!

এরকম যেচে কথা বলা লোকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে অনেক সময় ঝামেলা হয়। তাছাড়া এরা প্রয়োজনের কথা বাদ দিয়ে অপ্রয়োজনের কথাই বেশি বলে। অতিরিক্ত কৌতূহল দেখায় এবং অযথা জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করে। কয়েকদিন আগে মোহাম্মদপুর থেকে রিকশায় আসতে এক আলাপি টাইপের রিকশাওয়ালার খপ্পরে পড়েছিলাম, ত্যক্ত বিরক্ত করে ছেড়েছিল।

খোদ ঢাকা থেকে একেবারে উত্তরের এই হারিকেন-জ্বলা মফস্বল শহরে পোস্টিং। অপরিচিত জায়গা। বেশ কিছুদিন কেটে গেল। মনটা এমনিতেই দমে ছিল। উপরন্তু এখানকার লোকগুলো বড্ড গায়ে-পড়া ও কৌতূহলী স্বভাবের। কী আর করা যায়! চাকরির দায়। আগামী দু’-তিন বছর যেহেতু এই নির্বাসনই বরাদ্দ, অগত্যা মানিয়ে নেওয়া ছাড়া পথ নেই। শহরের মাঝখানে একটা ছোট বাসা ভাড়া নিয়েছি। হাতে অনেক সময়। আমি সময়টা উপভোগ করি। অবসরে কবিতার বই পড়ি, জাপানি ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনি। ঢাকায় থাকার সময় কাজের চাপে খুব একটা শোনা হতো না। কলেজের রুটিনের বাইরে শহরে ঘুরে বেড়াই, নানা কিসিমের লোকজনের সাথে কথা বলি, মেলামেশা করার চেষ্টা করি। বিকেল ঢলে পড়লে, অনেক দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাড়িঘর পেরিয়ে চাউল কলের চিমনির মাথা থেকে ধোঁয়ার কুন্ডলী উঠে ধূসর আকাশের গায়ে মিলিয়ে যায়, আর সেই ধোঁয়ার বাতাস কেটে উদগ্র ডানার সঞ্চারে একদল পায়রা উড়ে আসে, তারা ডানা গুটিয়ে নিতে নিতে পশ্চিমের রেলের বিস্তৃত জমিতে পড়ে থাকা পুরনো ওয়াগন লাগোয়া স’মিলের পাশের গাছের মগডালে গিয়ে বসে। রেললাইনের ওপারে দিগন্তপ্রসারিত সবুজ ধানক্ষেত, অদূরে খাদ্য সাইলোর সাদা উঁচু টাওয়ার, আরও দূরে রক্তদহ বিল আমার চিন্তার জগত তোলপাড় করে দেয়। ক্ষেতের আলে দাঁড়ালেই মনের ভেতরটায় যে জমাট মেঘ, তা ভেঙে চুরমুর হয়ে যায়। গা-গতরে চাষির রক্ত বলেই কিনা, পাকা ধানের ঘ্রাণে অনিশ্চয়তার দানাদার হওয়া গুমোট ভয়-শঙ্কা উড়ে যায়। সন্ধ্যায় কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠি। ঘন ঘন বিদ্যুত চলে যায়, ক্রমশঃ রাতের রোমশ কালো থাবা যেন সবকিছুকে গিলে ফেলে। অন্ধকারে ডুবে আছে চারদিক। মেইন রোডে হলুদ আলোর দু-একটা টুনি বাল্ব মিটমিট করে জ্বলছে। নিশ্চুপ চরাচর; ঝিমঝিম করা রাতে নির্জনতার পাখা সারা শহরে মৃদুমন্দ বাতাস ছড়ায়। পায়চারি করি, দুচোখভরে দূর আকাশের তারা গুনি, তারা খসে যাওয়া দেখি। এভাবে আমি জীবনকে অনাবৃত উপলব্ধি করার জন্য চেষ্টা করি নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়ে।

একদিন বিকেল বেলা; কলেজ ছুটি হয়ে গিয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ব্যস্ততায় জুতাগুলো অনেক দিন কালি করা হয়নি, দাগ ছোপ পড়েছে, ময়লা জমেছে, সিলাইগুলো আলগা হয়ে গেছে। এখন জুতাগুলো সিলাই ও কালি করায়া নেয়া দরকার।

মোড়ের পানের দোকান থেকে একটা পান কিনলাম। পান খাওয়া আমার পুরনো অভ্যাস। পান খেতে খেতে একটা রিকশায় উঠলাম। রিকশা থেকে নেমে পায়ে পায়ে চাচার কাছে গেলাম। জুতাগুলো সেলাই করার জন্য দিলাম। সেগুলো পরখ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সাথে বললেন, আপনির সাথে এ্যানা কতা কবা চাই। কওয়া য্যাবে বাবাজি?

হ্যাঁ, বলুন।
দেকে মনে হচে এই এলাকায় আপনে লতুন আলচেন। প্রত্যেকদিন ইকশায় চড়ে কলেজে য্যাতে দেকি। তা বাবাজি কি কলেজে লতুন যোগ দিচেন?
আমি স্মিত হেসে সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকালাম।
জুতা সেলাই করতে করতে বিনয়ী কণ্ঠে বললেন, দুক্কের কতা, কষ্টের কতা। বাবাজি একসময় ভিটামাটি ছ্যাড়ে চলে গেচলাম। কারণ পাক বাহিনীর কাচে থাকা হামাকে দেশটাক মুক্তি দিবার জন্যি। শুনবিন সেই গপ্পো? সময় আছে হাতে? আসল কতা হলো, বয়স হলে কতা কবার ইচ্চা বাড়ে।

বলুন বলুন। আজ কলেজ ছুটি হয়েছে, এখন কোন তাড়াহুড়ো নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধ মানে উনিশশো

— একাত্তর। তখন হামি ক্লাস এইটে পড়ি । সেই পড়া ছ্যাড়ে হাতে তুলে নিনু বুন্দুক। তকন হামাকে চোকের তারায় আগুণ জ্বলে। ঝিলকানী দিয়া ব্যার হয়া আসে সেই আগুন। সেডা তো আগুল লয় বাঃ সেডা আস্ত বারুদ। মাতায় লাল সবুজের পতাকা বান্দা সারাদিন খ্যায়্যা না খ্যায়্যা বুন্দুকটা ঘাড়ে লিয়া হাঁটি মাইলের পর মাইল। মুকামুকি যুদ্ধ করি খান সোনাদের সাতে। বাপ মায়ে হামার নাম দিছিল বারিক। সাত নং সেক্টর থাকা যুদ্ধ করি। ভারতে গেছনু যুদ্ধের ট্রেননিং লিবা তারপর নওগাঁ, জয়পুরহাট, পাঁচবিবি, হিলি ছাড়াও ম্যালা জায়গাত যুদ্ধ করচি। একটাই ইচ্চা-মা, মাটি আর দেশকে স্বাদিন করমু। লড়াই করচি। মরতে মরতে বেঁচে যাচ্ছি। বারবার। তবুও হার মানছি না। যুদ্ধের মাঝামাঝি, ঘনঘন হামরা বিজয়ের সংবাদ পাচ্চি, হামাকেরে মনের মধ্যে আনন্দও হচে, যকন ভাবচি আর তো কয়ডা দিন তারপর হামরা স্বাদিন হমু। কিন্তু আজাকার, বিহারি আর পাকিস্তানি দালালদের ভয়ে মুকে কুলুপ এঁটে বসে থাকি, কারোসাতে গপ্পো করি না, হায়রে দুক্কের দিন গেচে বাঃ সেই দিনের কতা মনে হলে একনো গায়ের মোদ্যে কাঁটা দিয়া ওটে।

তার ক্লান্তমুখে এক প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে, হয়তো বা প্রৌঢ়ের মনে ফুটেওঠে স্বাধীনতা পাগল এক চঞ্চল কিশোরের ছবি! খুশিতে ঝলমলে হয়ে ওঠা মুখের আভায় আশপাশ আলোকিত হয়ে উঠলো।

আমি স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখিনি। তবে বাবা মার কাছে যুদ্ধের গল্প অনেক শুনেছি। যুদ্ধের গল্প শুনলে, গান শুনলে, যুদ্ধের ছবি দেখলে আমার ভেতর কি এক যেন অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায়, জানি না। আমি যদি যুদ্ধ করতে পারতাম! যুদ্ধ করতে না পারার বেদনা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে মারে। মন্ত্রমুগ্ধের মত তার কথা শুনি। লোকটির প্রতি আমার মুগ্ধতা, মমতা বেড়ে যায়।
বৈশাখের অসহ্য খরতাপ। ঝাঁ-ঝাঁ রোদ। কপাল থেকে টপ টপ করে ঝরে পড়ে ঘাম। কাঠের বাক্সে গাটা ঠেসিয়ে দিয়ে লুঙ্গির কোচ থেকে বের করে একটা বিড়ি ধরালেন তিনি। গরমে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ধুসর-লাল রঙের ব্রিজের রেলিংয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বেশ কয়েকজন ভবঘুরে মানুষ। একটা মালগাড়ি হুইসেল বাজিয়ে ঘটর ঘটর শব্দে অনিচ্ছা জানিয়ে অজগরের মতো তার দীর্ঘ কালো ক্লান্ত শরীরকে টেনে টেনে এগোচ্ছে উত্তরে দূরের পার্বতীপুরের দিকে। ইঞ্জিনের চিমনি দিয়ে কয়লার গুঁড়ো মৃদুমন্দ বাতাসে বেঁকেবেঁকে ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায় এবং ভেতরে বয়লারের প্রতিধ্বনিত শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ স্পষ্টই শোনা যয়। শেষ ওয়াগনটি আমাদেরকে ছাড়িয়ে চলে গেল।

আমার গল্প শোনার আগ্রহ দেখে চশমা খুলে চোখ দুটো ডলে চোয়াল ভাঙ্গা মুখে তার কথার ফুলঝুরি চলতে থাকল।

তিনি বলতে থাকলেন, কিন্তু স্বাদিনতার পর, না! মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে কোনও সন্মান পানু না। কাগজপত্র না থাকায় তালিকায় নাম দিলো না। অনেক দৌড়ঝাপ করচি নিজের হাতে যুদ্ধ করে স্বাদিন করা দেশ থাকে সম্মান পাওয়ার জন্যে। কষ্টের ফল কে না চায় বাবাজি। বুড়া বয়সে নিজের দেশ থ্যাকা আনা ভাতা চাওয়া কি হামার দোষ? এটা নিয়ে দেন দরবারের জন্যে একদিন ইউএনও অপিসে গেলে কুত্তা খেদানোর মত অপিস ঘর থ্যাকে বের করে দিচে। বয়সের ভারে একন সে হালও ছেড়ে দিচি। দেশ স্বাদিন করে একদিন যে আনন্দে বুক ভরাছুনু সেই আনন্দ এখন নিমের অসের মতো তিতো হয়ে গেচে।

জুতা সেলাই করতে করতে কথাগুলো বললেন চাচা, এবং খুক খুক কাশলেন। তার মুখে একটা অস্থির হাসি, চোখ দুটো দুঃখের গভীরে। হতাশাভরা কিছু কথা বললেন আপন মনে।
আচমকা কষ্টে আমার বুকটা ভার হয়ে যায়, আমি স্পষ্টত বিচলিত হয়ে পড়ি।
চাচা আবার গলা খাকারি দিলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন, সবাই কয়, ‘মুক্তিযোদ্ধারা জাতির চেষ্ট সন্তান’। নেতারা জিকির করে হামাকে নামে। গালভরা বুলি আওড়ায়, গদগদ হয়ে মুকে কয়, হামরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ঋণী, কিন্তু কেউই আসলে এই ঋণ বাস্তবে শোদ করতে চায়না। লোক দেকানো দায়সারা গোছের কিছু করেই খালাস পাবার চায়।
এইসব শক্ত কথা বলতে বলতে লোকটার চোখে আষাঢ় মাসের বৃষ্টি ঝরছিলো হঠাত দেখা গেলো একরাশ রৌদ্দুর: গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে লোকটির জুতা শেলাইয়ের গতি বেড়ে গেলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম তার নিপুণ কাজ। হঠাত আমার দিকে থাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, বাঙলার মানুষ ম্যালা অকৃতজ্ঞ।
বললাম, ঠিকই বলেছেন চাচা, আমরা বড়ই অকৃতজ্ঞ।
হ্যাঁ বড়ই অকৃতজ্ঞ। বলতে বলতে গুনগুনিয়ে গান গাইলেন-
আহার নিদ্রা লয়না মনে
নয়নে বয় ধারা গো
প্রাণ বন্ধু ছাড়া
আমি বাচিবো কেমনে গো
প্রাণ বন্ধু ছাড়া-
বাউল গান। তাও আবার নির্ভুল উচ্চারণে। গলাতে সুরও আছে। আমি অবাক হই। গান শুনি। ভেবে পাই না এইরকম দুর্বিষহ কষ্টেও একজন মানুষ কীভাবে গান গায়, এমন উজ্জ্বল হাসি হাসে!

বাবাজি, কাজ করতে করতে গুন গুন করে গান গাওয়া আমার অভ্যেস। হাতের কাজের সাথে মুখও চলে, গাই গুন গুন করে।
গান শেষ হলে প্রসঙ্গ পাল্টালাম, ‘চাচা এই বয়সে জুতা সেলাই করতে হয়, ছেলেরা দেখে না?
চাচা সিগারেটে শেষ টান মেরে বললেন, হামার চারডা ছোল। দুডা ছেলে একটা মেয়ে বাবা। ছেলেরা যে যার মতো বাইরে। একজন ঢাকায়, আর একজন বগুড়ায়। ইসকা চালায়। নিজের সংসার সামলাতে ওরা ব্যস্ত। হামাক জুতা সেলাইয়ের কাম করবা মানা করে, কিন্তু কোন ট্যাকা পয়সা দ্যায় না। নিজ এলাকায় রাস্তায় বসে জুতা পালিশ করা শরমের কতা। বড় যন্ত্রণা বুকে লিয়া একাম করে যাাচ্চি। কিন্তু খিদা তো আর লোজ্জ্যা-শরমবোজে না। শুধু ছোট মেয়েডা হামার সাতে থাকে। আপনির চাচি আগে সেলাই করে কিছু আয় রোজগার করিচ্ছিল। চোকে কম দেকায় সেটাও বন্দ হয়ে গেচে। মাতায় গোলযোগ দেকা দিচে।প্রায়ই বিচানায় পড়ে থাকে। মেয়েডা হাই স্কুলে পড়ে, ফাঁকে ফাঁকে মানুষের বাড়িত বুয়ার কাম করে। স্ত্রীর চিকিত্সা, সেবা যত্ন করতে পারি না।

বুকের কোনো এক কোণায় যেন চাচার জন্য আলাদা একটা মায়া তৈরি হচ্ছে। অন্যের জুতা মেরামত করতে করতে বেচারার জীবনটা গেল, নিজের ভাগ্যটা মেরামত করতে পারলেন না। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার ভিতরে তার গল্প শোনার আগ্রহটা ধরতে পারেন চাচা।

চাচা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকলেন, আগে ইকশা চালাতাম, ঠেলাগাড়ি চালাতাম। সারাদিন ইকশা ঠেলাগাড়ি টানে মুকে অক্ত তুলতে একন আর পারি না। প্যাট চালানোর জন্য তাই শেষমেশ জুতা সেলাইয়ের কাজ ব্যাছা নিচি। সুবিচারের আশা ছ্যাড়েই দিচি। এখন অপেক্ষা আসল মুক্তির। আল্লাহ পাক হামার জন্য যা বন্দোবস্ত করেন, তাতেই দিন চলে যায়।

তবে, বাবাজি একটা বিষয় খুব মনে কষ্ট দ্যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের বিরুদ্ধে লড়েচি তাদের দোসর বিহারিরা এ শহরে থাকে। বাংলা-উর্দুতে কতা কয়। ওরা এখন প্রতিষ্ঠিত। ওদের ছেলেপেলেরা যখন হাওয়াই শার্টের বোতাম খুলে, গায়ে আতর ম্যাকে, মাতায় ছাই অঙা গোলটুপি ফিনদে কাদামাখা জুতাসুদ্ধে পা-টাকে ধপাস করে পা-দানির উপরে তুলে দিয়ে জুতা পালিশ করতে কয় তকন রাগে দম বন্ধ হয়ে আসে। আপনি বলেন, যাদের কারণে একাত্তর সালে লাকে লাকে মানুষ মারা গেচে,মা-বোন ইজ্জত হারাচে, সেই পাকিস্তানিদের চেলা, আজাকারদের জুতা পালিশ করিচ্চি হামি একজন মুক্তিযোদ্ধা? এ কাম করার আগে হামার মরে যাওয়া উচিত আচিলো।

শান্তনার স্বরে আমি বললাম, মন খারাপ করবেন না চাচা। আপনি তো আর ইচ্ছা করে তা করছেন না। এটা আপনার দোষ নয়, আমাদের দোষ, সমাজের দোষ, আমাদের সকলের ব্যর্থতা। মাথা ঝাঁকিয়ে আমার কথায় সায় দিয়ে নিজের দুঃখের ঝুলি উপুড় করতেই থাকলেন তিনি।

শরীলের অসুখ মানা যায়, কিন্তু মনের অসুখ তো মানা যায়না। জানি দুনিয়াত খিদার মত আর কষ্ট নাই, খিদার চেয়ে বড় আর অসুখ নাই। কিন্তু এডা হামার কাচে তার চেয়েও বড় অসুখ বলে মনে হয়, বাবাজি। ওষুধ-পথ্য খেয়ে শরীলের অসুখের সাতে যুদ্ধ করা যায়, কিন্তু মনের অসুখের সাতে যুদ্ধ করি ক্যামন কোরা? আর সইতে পারি না। জীবনের প্রতি বিষে ওটে মন। দুইবার ওভারব্রিজ থ্যাকে রেললাইনে ঝাঁপ দিতে গেচিলাম, কিন্তু পারিনি, ফিরে আসি। স্ত্রীর কথা, মেয়েডার কতা মনে হলে ফিরে আসি। হামার দিকে পরিবারের অনেকগুলা মুক ত্যাকে থাকে তাই একনও একাম করিচ্চি। সমস্ত যন্ত্রণা দাঁতে দাঁত চাপে সহ্য করিচ্চি। তাও সবসময় মরার জন্য হাঁকপাঁক করি, কিন্তু মরণতো হয় না, মরণও মনে হয় হামাক ভুলে গেছে। মাজে মাজে মনে হয়, মরণও হামাক ঘিন্না করিচ্চে।

কথাগুলো বলে বেশ কিছুক্ষণ তিনি বসে থাকলেন ঘাড় নিচু করে। তার কথাগুলো যেন আমার মাথায় বজ্রপাতের মতো ঘুরপাক খেতে লাগল। মুক্তিযোদ্ধাকে জুতা পালিশ করতে হচ্ছে রাজাকারের। চাচার মতো আমার ভেতরটাও ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। চাচাকে সান্তনা দিয়ে বললাম, দুর্ধর্ষ পাক বাহিনীর কাছে হেরে যাননি, এত সহজে আপনি হেরে যাবেন না। না এভাবে জীবন শেষ করে ফেলা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। গম্ভীর গলায় অভয় দিয়ে বললাম, চাচা খুব শীঘ্রই কাজটা আপনি ছেড়ে দিবেন। সে ব্যবস্থা আমি করছি। আপনি কাল সকালে কলেজে আসুন। দেখি প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে বলে কলেজে আপনার জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পারি কি না।

চাচার চোখ ফেটে জল এসে গেল। তিনি চোখ মুছতে মুছতে জুতা সেলাইয়ে লেগে গেলেন।
আমার একটু অপরাধবোধ হলো। সারা বিকেল একটা ঘোরের মধ্যে রইলাম। তার জন্য কিছু একটা করার জন্য মনটা ছিন্নমস্তক পাখির মতো ছটফট করতে লাগল। সন্ধ্যায় প্রিন্সিপ্যাল স্যারের বাসায় গেলাম। স্যার আমাকে পছন্দ করেন। আমার বিশ্বাস ছিল উনি আমার অনুরোধ ফেলতে পারবেন না। তাছাড়া তিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। স্যারকে চাচার দুর্বিষহ অবস্থার কথা, মানসিক বিড়ম্বনার কথা সবিস্তারে বললাম। সব শুনে স্যার বললেন, তাকে কালই কলেজে আসতে বলুন। আমাদের আর একজন নৈশ প্রহরী লাগবে। মাস্টার রোলে নিয়োগ দিব।

পরদিন সকালে চাচা কলেজে এলেন। স্যার তাকে সব মিলে আট হাজার টাকার একটা চাকরি দিলেন। চাকরি পেয়ে টিচার্স লাউঞ্জে এসে খুবই কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলেন আমাকে।
ছয় মাস পরের কথা।

রবিবারের এক সকালে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চাচা আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এই ছয় মাসে একেবারেই বদলে গেছে তার চেহারা। শরীর-স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। পোশাক-আশাক সুন্দর। মেয়েটার পরনে সুন্দর জামা।

চাচা বললেন, হামরা খুব ভালো আচি স্যার। দুই হাজার ট্যাকা দিয়া ছোট একটা চালাঘর ভাড়া নিচি কলেজের কাচেই। অপনিদের দোয়ায় হামরা ম্যালা ভালো আচি।
আমি বললাম, মেয়েটাকে কলেজে ভর্তি করে দিন।

জি স্যার, কলেজে ভর্তি করে দিমু।
চাচা বললেন, ‘স্যার একটা গান শুনবেন।’
মজা লাগলো, বললাম, ‘শোনান’।
চাচা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পাখির মতো মিষ্টি কণ্ঠে গাইলেন, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলবো না’।
আমি মুগ্ধ হয়ে চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।