শুজা রশীদ : পরিচ্ছেদ-১
দক্ষিণ ওন্টারিওর সুনসান হাঁড় কাঁপানো শীতের রাতগুলো আমার বেশ ভালোই লাগে।

মাঝ ফেব্রুয়ারী। সেই বিকেল থেকেই ঢিমে তালে তুষার পড়ে চলেছে, থামার নাম লক্ষণ নেই। মাঝরাত হবার আগেই মাটিতে বেশ পুরু স্তর পড়ে গেছে। আঁধারেও কেমন উজ্জ্বল হয়ে আছে চারদিক- খানিকটা ¤øান করে রাখা ফ্লোরেসেন্ট লাইটের মত। আমাদের বিশাল চার বেডরুমের বাড়িটা একটা টিলার উপরে কুল-ডে-স্যাকে অবস্থিত, পেছনে বেশ খানিকটা এলাকা জুড়ে ঘন জঙ্গল। দোতলায় আমার স্টাডী রুমের বিশাল জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে যে দৃশ্যটা নজরে পড়ে সেটা বেশ মনরম। এই মুহুর্তে জানালার ভেনেশিয়ান পর্দাটা সরিয়ে বাইরের দিকেই তাকিয়ে আছি আমি। চারদিকের এই উজ্জ্বলতা দেখে আশ্চর্যই হচ্ছি, যদিও কারণটা জানা। ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ-গাছালির সারি আচ্ছাদিত হয়ে আছে ঘন তুষারের স্ফটিকে, ধীরে ধীরে অবনিত হচ্ছে এক শ্বেত সমাধিতে। আমার স্ত্রী নায়লার অনুপস্থিতিটাকে এই মুহুর্তে খুব অনুভব করছি। ভাবি আগের মত ও যদি এখন আমার পাশে এসে দাঁড়াত, যদি দু’জনে হাতে হাত ধরে এই অপূর্ব দৃশ্যটা উপভোগ করতে পারতাম, তাহলে কি ভালোই না লাগত!

ও আজ কাজ থেকে ফিরেছে অনেক দেরী করে। বছর দুয়েক আগে ডিরেক্টর পদে আসিন হবার পর থেকে এমনটাই চলে আসছে। নর্থ ইয়র্কে ওর অফিস থেকে বাসায় ফিরতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লেগেছে আজ। তুষার পড়তে পারে সেই আশংকাতেই রাস্তায় ভীড় জমে গিয়েছিল। বাসায় ফিরেছে ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে। দু’জনে এক রকম নীরবে রাতের খাবার খেয়ে অল্প কিছুক্ষণ টেলিভিশনের সামনে পাশাপাশি বসে ছিলাম। রাত দশটার দিকে আমার গালে একটা চুমু খেয়ে শুভ রাত্রি জানিয়ে ঘুমাতে চলে গেছে ও।

আমি হচ্ছি রাত জাগা পাখি। রাত অতিমাত্রায় গভীর না হলে আমার ঘুম আসে না। দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। দেরীতে ঘুমাই, দেরীতে উঠি। আমি ও.ঞ. কনস্যাল্ট্যান্ট, বাসায় বসেই কাজ করি, ফলে আমার খুব একটা সমস্যা হয় না। ডাউন টাউন টরন্টোর ভয়াবহ ভীড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য আস্তানা গেড়েছি শহর থেকে দূরে এই মফস্বলে। বেছে বেছে এমন একটা কাজ নিয়েছি যেন দূরে বসেই করা যায়, রাস্তার ভীড় ঠেলে অফিসে যেতে না হয়।

কতক্ষণ তুষার পড়া দেখেছি খেয়াল নেই। দৃশ্যটা সম্মোহনীয়। ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ে থাকতে পারি। হতে পারে শুধু দৃশ্যটার সৌন্দর্যের জন্য নয়। আমার হাতে অঢেল সময়। নায়লার কাজের ব্যাস্ততা, কোভিড ১৯ এর কারণে ঘরে বাইরে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা, নিঃসন্তান- সব মিলিয়ে আমার হাতে নষ্ট করার মত সময়ের কোন অভাব নেই। গত কয়েক মাস ধরে ইন্টারনেট ঘেঁটে বৈধ, অবৈধ সব স্ট্রিমিং সাইট থেকে পছন্দনীয় যাবতীয় ছায়াছবি দেখে ফেলেছি। এখন তাতেও আর রুচি হয় না। অতি ব্যবহারে ভালো বস্তুরও আকর্ষণ হারিয়ে যায়।

আরোও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে যখন পর্দাটা বন্ধ করতে গেলাম তখন চোখের কোণে কিছু একটা নড়াচড়া ধরা পড়ল। আমাদের পশ্চিম দিকের প্রতিবেশীর বাড়ীটা ফুট চল্লিশেক দূরে। তাদের দোতলার পূর্ব কোণে অবস্থিত কামরাটা থেকেও জঙ্গলের দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু কখন ঐ কামরার জানালা খোলা দেখেছি বলে মনে পড়ে না, সবসময় পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে। আজ তার ব্যতিক্রম দেখলাম। পর্দা দু’দিকে সরিয়ে রাখা, ভেতরে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। আমার অবস্থান থেকে ঘরটার ভেতরের এক চিলতে দৃশ্য নজরে আসছে। দেখতে পেলাম চিত্রাঙ্কনের একটা ইজেল জানালার পাশে বসানো, একজন মহিলা গভীর মনযোগে ছবি এঁকে চলেছে, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ সম্মুখে, মুখ ঢেকে আছে দীর্ঘ, ঘন, কৃষ্ণ চুলের রাশিতে। তার মুখাবয়ব পরিষ্কার দেখতে না পেলেও তাকে চিনতে কষ্ট হল না। সে হেলেন মিলার, ব্রায়ান মিলারের স্ত্রী। আমার জানা মতে তাদের কোন সন্তান-সন্ততি নেই।

অভিনব দৃশ্য। গত বছর গ্রীষ্মে এই বাসায় এসে উঠি আমরা। আজ অবধি হেলেনকে কখন ছবি আঁকতে দেখিনি, সে যে একজন চিত্রশিল্পী তাও জানা ছিল না। প্রথম চিন্তা যেটা মাথায় এলো, তাকে এভাবে লুকিয়ে দেখা একেবারেই সমীচীন নয়। আমার উচিৎ হবে জানালার পর্দাটা লাগিয়ে দিয়ে নীরবে সেখান থেকে সরে যাওয়া। কিন্তু চারিত্রিকভাবে আমার কৌতুহল একটু বেশীই। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের সামনে খানিকটা লাজুকও ছিলাম, ঝট করে আলাপ শুরু করতে কষ্ট হত, তাদেরকে দূর থেকে চুপিসাড়ে দেখার একটা অভ্যাস তৈরী হয়ে গিয়েছিল।

এই বাসায় ওঠার সপ্তাহ দুই পরে হেলেনের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল। এই আবাসিক এলাকাটা বেশ ছড়ানো-ছিটানো, প্রশস্ত লটে বড় বড় বাড়ী, কয়েকটা থেকে জঙ্গলের দৃশ্য দেখা যায়। প্রতিবেশীরা খানিকটা দূরত্ব বজায় রাখলেও তাদেরকে অবন্ধুত্বপূর্ণ বলা যাবে না কোন অবস্থাতেই। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে এখানে মানুষ জনের প্রাইভেসী জ্ঞানটা সাধরণের চেয়ে বেশী টনটনে।

সেইদিন ছিল ছুটির দিন, গ্রীষ্মের ভ্যাপ্সা এক সন্ধ্যা। নায়লা আর আমি গিয়েছিলাম এক পুল পার্টীতে। হেলেন তার বাসার সামনে ফুলের বাগানে কাজ করছিল। তার বাগানে চমৎকার কিছু গোলাপের সাথে নানা ধরনের ডালিয়া গাছ আছে। আসার পর তাকে বার কয়েক দেখেছিলাম, তার বাড়ীর আঙিনায় এটা-সেটা করতে, পরিচয় হবার সুযোগ হয়নি। দূর থেকে দেখে মনে হয়েছিল ভদ্রমহিলার বয়েস মধ্য ত্রিশ হবে, মাঝারী উচ্চতা, অপুর্ব সুন্দরী, নিদারুণ ফিগার, ঘন কালো চুল আর হালকা বাদামী চোখের মনিতে তার রূপ যেন আরোও কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। তবে তার আচার আচরণে খুব ভালোমানুষী একটা ভাব ছিল, ঝট করেই আপন মনে হয়। সব মিলিয়ে দৃষ্টি নন্দন এবং মনহারী এক রমণী, চোখ সরিয়ে নেয়া দুষ্কর। অস্বীকার করব না, আমার উপর সুন্দরী নারীদের একটা বিশেষ প্রভাব আছে। কিন্তু কেউ আমাকে ভুল বোঝার আগেই বলে রাখি, আমার স্ত্রী নায়লাও যেমন সুন্দরী তেমনি আকর্ষণীয়া, কারো চেয়ে সে কোন অংশে কম যায় না। তাকে আমি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি যদিও ইদানীং মনে হয় ওর অফিসের মানুষ জনেরাই আমার চেয়ে ওর আকাক্সিক্ষত সঙ্গ অনেক বেশি পায়।

আমাদের দুজনকে নায়লার ঝটঠ থেকে নামতে দেখে হাতের কাজ ফেলে আলতো করে হাত নেড়েছিল হেলেন আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য, তারপর ধীর পায়ে হেঁটে এসেছিল আমাদের দিকে, ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হাসির ছোঁয়া নিয়ে। তার পরনে ছিল লম্বা প্রিন্টেড স্কার্ট আর শরীরের সাথে আঁটো-সাঁটো সাদা টপস, চমৎকার দেখাচ্ছিল। নিজের মুগ্ধতা ঢাকার জন্য আমাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। নায়লার নজর প্রখর। কিছুই তার তীক্ষ্ণ নজর এড়ায় না।
“হাই!” নায়লাই প্রথম অভিবাদন জানিয়েছিল।
“হ্যালো!” সে বলেছিল। “আমি হেলেন। আগেই এসে পরিচিত না হবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে নিচ্ছি।”

তার নরম কিন্তু মিষ্টি কন্ঠস্বর তার ব্যাক্তিত্বের সাথে খুব মানিয়ে যায়। মনে হয় তার সাথে কথা বলা অনেক সহজ। এমন একটি মেয়ের সাথে আলাপ করতে কোন পুরুষেরই ভীত হবার কোন কারণ থাকার কথা নয়।
আমরা দু’ জনাই তার সাথে হাত মিলিয়ে ছিলাম, কিছুক্ষণ এটা সেটা নিয়ে আলাপ করেছিলাম। সে এক পর্যায়ে সংক্ষেপে বলেছিল তার স্বামী ব্রায়ান মিলার কোন এক বড় ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানীর সেলস একজেকিউটিভ। তারা এই বাসায় বছর চারেক ধরে আছে। আমরা এখানে আসা অবধি অন্য কোন প্রতিবেশির সাথে আমাদের তখনও পরিচয় হয়নি। নায়লা এই সুযোগের পূর্ণ সদব্যাবহার করতে চেয়েছিল। হেলেনের কাছ থেকে আমাদের কুল-ডে-স্যাকের অন্যন্য প্রতিবেশীদের সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাবার চেষ্টা করেছিল।

প্রথমে হেলেনকে একটু বিব্রত মনে হয়েছিল। “আমি আসলে তেমন একটা সামাজিক নই,” সে ফিক করে হেসে লাজুক কন্ঠে বলেছিল। “প্রতিবেশীদের অধিকাংশদেরকেই আমি নামে মাত্র চিনি, তবুও যেটুকু জানি বলছি।” সে আমাদের পূর্ব দিকের বাড়িটার দিকে অঙ্গুলী নির্দেশোনা করে বলেছিল, “ওটাতে থাকে হল পরিবার। ওদের দুইটা খুব ফুটফুটে বাচ্চা আছে। ওদের পরের বাসাটা হচ্ছে ব্রাউনদের। বয়েসী স্বামী-স্ত্রী। তারা কারো সাতে পাঁচে নেই। আমাদের পশ্চিমের বাড়িটা গ্রিনদের। ওদের একটাই ছেলে, ইউনিভার্সিটিতে যায়। এখানে আমি এই কয়জনকেই চিনি।” সে লাজুক ভঙ্গিতে হেসেছিল।

আমরা দু’জনাও হেসেছিলাম, খানিকটা এটা বোঝানোর জন্য যে আমরাও তার চেয়ে কোন অংশে বেশী সামাজিক নই। আমাদের আগের বাসায় আমরা ছিলাম বছর তিনেকের মত, সাকুল্যে তিন জন প্রতিবেশীর সাথে হাতে গোনা কয়েকবার বোধহয় আলাপ হয়েছিল। নায়লা ওর অফিস নিয়ে ব্যাস্ত থাকত, আর আমি ব্যাস্ত থাকতাম বাগান করা থেকে শুরু করে নানা ধরনের খেলাধুলা নিয়ে। আমাদের কোন বাচ্চা-কাচ্চাও ছিল না যে স্থানীয় বাবা-মায়েদের সাথে জোট পাকিয়ে দল বেঁধে এটা সেটা করব।

হেলেনের সাথে সেই প্রথম আলাপের পর সারা গ্রীষ্ম কালটা আর তেমন কোন আলাপই হয় নি। আমরা ব্যাস্ত হয়ে পড়ি আমাদের জীবন নিয়ে। নতুন বাড়িতে কত কাজ কর্ম থাকে। তার মধ্যেই অবশ্য লক্ষ্য করেছি তাকে তার বাড়ির চারদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাগানে কাজ করতে। মাঝে মাঝে হাত নেড়েছি, ‘কেমন আছো?’ জানতে চেয়েছি, ‘আমরা ভালোই আছি’ বলেছি তার প্রশ্নের উত্তরে। আলাপ তার বেশি গড়ায়নি। তার স্বামীকে কয়েকবার দেখেছি গাড়ি নিয়ে আসতে যেতে, আলাপ করার সুযোগ হয় নি। চেষ্টা করেছি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, কিন্তু তার হাবভাব দেখে মনে হয়েছে হয় সে সারাক্ষণ অন্যমনস্ক থাকে নয়ত আমাকে পরিপূর্ণভাবে অবজ্ঞা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যাইহোক, বর্তমানে ফিরে আসা যাক।

স্বীকার করতে লজ্জা হচ্ছে কিন্তু সত্য কথা হচ্ছে পর্দার পেছনে লুকিয়ে থেকে আমি চুপি চুপি হেলেনকে বেশ কিছুক্ষণ দেখলাম। আলোকজ্জিত একটা কামরার মধ্যে আবদ্ধ এক রুপবতী নারী আপন মনে রঙের তুলি টেনে টেনে এঁকে চলেছে কোন এক স্বপ্নময় জগত, এই দৃশ্যের মধ্যে কি যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ রয়েছে। এ যেন তার আপন ভ‚বনের অন্তরালে যাবার এক গোপন দুয়ার। দৃষ্টি ফেরাতে নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করতে হল। আমি পেইন্টিং পছন্দ করি এবং আলাপ চালিয়ে যাবার মত মোটামুটি জ্ঞান রাখি। ভাবলাম, পরবর্তিতে যখন হেলেনের সাথে দেখা হবে, এই বিষয় নিয়ে আলাপ দীর্ঘতর করার একটা সুযোগ মিলবে। আমি পর্দাটা টেনে দেই এবং নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করি যে এর পর আর কখন লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখব না। যদি কখন ধরা পড়ে যাই তাহলে কি কেলংকারীই না হবে, আমাকে নির্ঘাত একটা লম্পট মনে করবে।

পরিচ্ছেদ ২
সুযোগ যে এতো তাড়াতাড়ি এসে যাবে ভাবিনি।
ঘুমাতে যাবার আগে মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম পরদিন সকালে একটু তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে নায়লা কাজে যাবার আগে ড্রাইভওয়ে থেকে তুষারের স্তূপ পরিষ্কার করে রাখব। যেভাবে তুষার পড়ছে তাতে সকাল হতে হতে সেখানে ফুটখানেক জমে যাবার কথা। সেই তুষার না সরিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হবার কোন উপায় নেই। নায়লাও অফিসে যায় অনেক সকালে। অফিসে সর্ব ক্ষেত্রে নিজের স্রেষ্টত্ত প্রমাণ করতে সে এতো উন্মুখ যে ভোর সকালে উঠেই তার অফিস মুখে ছোটা লাগে। অতো সকালে ওঠা আমার জন্য প্রায় অসম্ভব।

সেল ফোনের তীব্র নিনাদে যখন আমার ঘুম ভাঙল তখন প্রায় সকাল নয়টা। নায়লা অফিস থেকে আমাকে ফোন দিয়েছে। ইদানীং লক্ষ্য করেছি ও বাসায় এসেও অফিসের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। আমাদের আলাপচারীতা প্রায় হয়ই না। মনে মনে নিশ্চয় অপরাধবোধে ভোগে। কাজের চাপে ব্যাক্তিগত জীবন বলতে আর কিছুই থাকছে না আমাদের। কিন্তু ওর সমস্যাটা আমি বুঝতে পারি। আজ ও যে পদে আছে সেখানে পৌঁছানোর জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে ওকে। কিন্তু ওর দৃষ্টি আরোও অনেক উপরে। আমি সংকল্প করেছি কখন ওর পথের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবো না। ওর পদন্নতি হবার আগে আমরা বাচ্চা-কাচ্চা নেবার পরিকল্পনা করছিলাম। ওর বয়েস মাঝ ত্রিশ। আমি ওর চেয়ে কয়েক বছরের বড়। মনে হয়েছিল সেটাই যথাযথ সময়। কিন্তু পদন্নতি হবার পর সেই পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত রাখতে হল। ওর ঘনিষ্ট বান্ধবীদের কেউ কেউ গর্ভবতী হবার পর তাদের ক্যারিয়ারে পিছিয়ে পড়েছে। ও সেই পরিস্থিতিতে পড়তে রাজী নয়। বাচ্চা-কাচ্চা পরে নিলেও চলবে। আপাতত ও ক্যারিয়ারের উপরেই বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে।

“সরি সুইটি,” আমি ঘুম ঘুম কন্ঠে বলি। “তোমার জন্য ড্রাইভওয়ে পরিষ্কার করব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম কিন্তু উঠতে পারি নি। তুমি আমাকে ডাকো নি কেন? যেতে অসুবিধা হয় নি তো?”
নায়লা হাসল। “চিন্তার কোন কারণ নেই। আমার বের হতে কোন সমস্যাই হয় নি। আমার ঝটঠ ফুট খানেক তুষারের উপর দিয়ে দিব্যি পেরিয়ে যেতে পারে। তুমি ঠিক আছো তো?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। কাল রাতে উপন্যাসটা লিখতে শুরু করেছি।” আমি ওকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি যদিও উপন্যাস সংক্রান্ত কথাটা মিথ্যা। এটা আমার একটা নতুন প্রজেক্ট। ইদানীং অন্য কোন কিছুতেই আর মন বসছে না দেখে শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছি লেখার। এখন পর্যন্ত অবশ্য একটা লাইনও লিখিনি। ঠিক কি বিষয় নিয়ে লিখব সেটাই এখনও মনস্থির করতে পারি নি।
নায়লা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। “সত্যিই? করলে তো ভালো। এটা নিয়ে তো সেই কবে থেকে কথা বলে যাচ্ছো।”

মিথ্যে বলে নি। আমি হচ্ছি এক আলসে স্বপ্নচারী। আমার কল্পনা শক্তি প্রখর হলেও তাকে শব্দে রূপ দেবার ক্ষমতা আছে কিনা সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। সত্যি বলতে কি অফিসিয়াল কাজের বাইরে আমার কোন কিছুতেই তেমন কোন দক্ষতা নেই। আমার জীবনে সত্যিকারের স্বার্থকতা বলতে একমাত্র নায়লাই। আট বছর আগে ভার্জিনিয়াতে একটা ওঞ কনফারেন্সে আমাদের পরিচয় হয়েছিল। বছর তিনেক প্রেম করবার পর অবশেষে সাহস করে বিয়ের প্রস্তাব দেই। রুপে, গুনে সর্ব দিকেই আমার চেয়ে কয়েক কাঠি উপরে ছিল ও। ভাবি নি আমার প্রস্তাবে রাজী হবে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বিয়েতে সম্মত হয়েছিল।
“এইবার আমি খুব সিরিয়াস,” আমি বেশ জোর দিয়ে বলি। “খুব দারুণ একটা আইডিয়া এসেছে। তোমাকে পরে বলব।”

“পরেই বলতে হবে,” নায়লার কন্ঠে আচমকা তাড়া। “আমার বস হঠাৎ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। বদমাশ একটা! পরে কথা হবে। লাভ ইউ!”
“লাভ ইউ ঠু,” ও ফোন রেখে দেবার আগেই আমি দ্রুত বলি।
ওর কাজের পরিস্থিতি নিয়ে আমি মনে মনে খুব একটা সন্তুষ্ট নই। বেচারী অতিমাত্রায় খাটছে। এই মহামারির সময় যেখানে প্রায় সব অফিসেই কর্মচারীদেরকে বাসা থেকে কাজ করবার সুযোগ দেয়া হচ্ছে সেখানে নায়লাকে প্রতিটা দিন সশরীরে কাজে উপস্থিত থাকতে হয়। সব একজেকিউটিভদের জন্যই নাকি এই নিয়ম। নায়লা ওর ঈঊঙ এড জোনস সম্বন্ধে সবসময় অভিযোগ করে। লোকটা নাকি নিজের কাজে বেশী সিরিয়াস। অধস্তনদের কাছ থেকে তার দাবীও অযৌক্তিকভাবে বেশী, ব্যবহারও রুক্ষ, ক্ষমাহীন। তাকে সবাই ভয় পায়, মনে মনে অপছন্দ করে।

আমি বিছানা থেকে উঠি, বাথরুম সারি, এক কাপ কফি বানিয়ে ধুমায়িত কফির কাপ হাতে নিয়ে সামনের দরজা খুলে বাইরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়াই, তুষার পরিস্থিতি নির্ধারণ করার চেষ্টা করি। ড্রাইভওয়েতে বেশ পুরু করেই তুষার জমেছে, ফুট খানেক না হলেও খুব একটা কমও নয়। নায়লার গাড়ীর চাকার দাগ স্পষ্ট নজরে পড়ল। তুষারের উপর দিয়ে তীরের মত বেরিয়ে গেছে। বোঝাই যায় কোন সমস্যা হয় নি। আমার নিজের কোথাও যাবার আপাতত কোন পরিকল্পনা নেই। সারা প্রভিন্স জুড়ে এমনিতেই ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী আছে। একমাত্র জরুরী প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ছাড়া আর কারো বাইরে না থাকারই কথা। আমি একটু চিন্তা ভাবনা করে তুষার পরিষ্কার না করারই সিদ্ধান্ত নিলাম। তুষার ধীরে ধীরে এমনিতেই গলে যাবে। আর যদি দূভার্গ্যক্রমে তাপমাত্রা শুন্যের নীচে নামে তাহলে অবশ্য কপালে খারাবী আছেÑ পুরো ড্রাইভওয়েটাই জমে বরফ হয়ে যাবে। (চলবে)