রাশেদ নবী : অবশেষে ক্যান্ চলচ্চিত্র উত্সবে স্থান পেল বাংলাদেশ। চলতি ৭৪তম উত্সবে (জুলাই ৬-১৭) এই প্রথম বাংলাদেশের একটি ছবি, ‘রেহানা মরিয়ম নূর’, প্রদর্শিত হয়। এর আগে, ২০০২ সালে, তারেক মাসুদ নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবি ‘মাটির ময়না’ প্রদর্শিত হয়েছিল ক্যান্এর সমান্তরাল উত্সবে, এবং তা পুরস্কারও অর্জন করেছিল। প্রায় দুই দশক পরে মূল উত্সবে স্থান পেল ‘রেহানা।’ এখনও কোনো পুরস্কার না পেলেও ছবিটি বিপুল সাড়া জাগিয়েছে। এই সাফল্য নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের নিস্তেজ চলচ্চিত্রের জন্য একটা শুভ সংবাদ। রেহানা মরিয়ম নূর’ তরুণ পরিচালক আবদুল্লাহ মোহামাদ সাদ (৩৬) এর দ্বিতীয় ছবি। তাঁর প্রথম ছবিতেই তিনি পরিচালক হিসাবে বিশিষ্টতা প্রদর্শন করেন। প্রথম ছবি ‘লাইভ ফরম্ ঢাকা’র জন্য তিনি সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসাবে পুরস্কার অর্জন করেন। ‘রেহানা’ পরিচালক হিসাবে তাঁর কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠার আরেকটি সুযোগ এনে দিল।

‘রেহানা’ প্রদর্শিত হয় ক্যান্ উত্সবের ‘অন্য দৃষ্টিকোণ’ বিভাগে। মূল প্রতিযোগিতার বাইরের এই বিভাগে সাধারণত প্রদর্শিত হয় বিভিন্ন সংস্কৃতির কুড়িটি ছবি। এই বিভাগের জন্য যেসব ছবি বাছাই করা হয় সেগুলি কাহিনী ও শৈলীর দিক থেকে ভিন্নধর্মী এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। তরুণ প্রতিভাবানদের উত্সাহিত করবার জন্য এই বিভাগে বিশেষ পুরস্কারও প্রদান করা হয়। ‘রেহানা’র পরিচালকও মূল অভিনেত্রী, আজমেরী হক বাঁধন, ছবির প্রদর্শনীর পরে যেরকম ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছেন তাতে তাঁরা এই পুরস্কার জিতেও যেতে পারেন। ছবিটির কাহিনী আবর্তিত হয় একটি মেডিক্যাল কলেজের এক তরুণ অধ্যাপিকার তীব্র মনস্তাত্তি¡ক টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে। অধ্যাপিকা রেহানা, যার নামে ছবির শিরোনাম, কর্মক্ষেত্রে নৈতিক দৃঢ়তায় আপোষহীন, যার কারণে সহকর্মী ও কর্তৃপক্ষের সাথে তার সম্পর্ক হয়ে ওঠে সংঘাতময়। অন্যদিকে তার চারিত্রিক অনড়তা তার পারিবারিক জীবন করে তোলে দুর্বিষহ। একা তাকে সামলাতে হয় তার পরিবার, তার ছয় বছরের মেয়ে এমু, তার বেকার ছোট ভাই, এবং তার বাবা-মা।

রেহানার গোচরে আসে যে তার সহকর্মী অধ্যাপক ছাত্রীদের প্রলোভিত করে তাদের যৌন হয়রানি করে যাচ্ছে। কাহিনীটি তীক্ষ্ণ বাঁক নেয় তখন যখন এক ছাত্রী, এ্যানি (আফিয়া তাবাসসুম বর্ণ), রেহানার কাছে স্বীকার করে যে সেও অধ্যাপকের যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। কেলেঙ্কারির ভয়ে এ্যানি সেই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে রাজি হয় না। ফলে রেহানা নিজেই তা তার কাঁধে তুলে নেয়। কলেজের অধ্যক্ষার কাছে গিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করে যে অধ্যাপক তাকে ধর্ষণ করেছে। সে আশা করে তার এই সাহসী পদক্ষেপ অধ্যাপককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করবে। অধ্যক্ষা প্রথমে তার প্রতি সমবেদনাশীল হলেও পরে তার পক্ষ সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানায়; তার কাছে তার প্রতিষ্ঠানের সুনাম সব কিছুর উপরে।

ছবির দ্বিতীয় ভাগে রেহানার আরেক লড়াই শুরু হয় তার মেয়ে এমুকে নিয়ে। মানসিক দৃঢ়তায় মা ও মেয়ে উভয়ের সমকক্ষ; মনস্তাত্তি¡ক প্রতিযোগিতায় উভয়েই একে অপরের কাছে বিজিত। রেহানা মনে করে সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে তার মেয়ের যত্ন নিতে। কিন্তু এমুর স্কুলের অভিযোগ তার প্রতি তার পরিবারে যথাযথ নজর দেয়া হচ্ছে না। এক পর্যায়ে রেহানা জানতে পারে যে স্কুলে তার মেয়ের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে। অবিচার নীরবে সহ্য করা রেহানার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিরোধী। সুতরাং তার মেয়ের প্রতি সুবিচারের দাবিতে তাকে নামতে হয় আরেক সংগ্রামে।

যৌন হয়রানি ও অবিচারের ঘটনা বাংলাদেশে
নতুন কিছু নয়, কিন্তু পরিচালক ও চিত্র নাট্য রচয়িতা আবদুল্লাহ মোহামাদ সাদ ঘটনাগুলির দ্বা›িদ্বক মিশ্রণের মাধ্যমে তাতে নতুন মাত্রা প্রদান করেন। মেয়েরা যৌন হয়রানির শিকার হলে সহজে সে সম্পর্কে মুখ খোলে না কারণ তাতে তাদেরকে আরো নিগৃহীত হতে হয়। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে যেমন প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতিতে মন সামাজিক সমর্থন প্রায় অনুপস্থিত। যারা প্রতিবাদ করে তাদেরকে এককভাবে সামাজিক বিরূপতা, আইনী বিদ্বেষ, ও আর্থিক ক্ষতির বোঝা বহন করতে হয়। এই বাস্তবতার মনস্তাত্তি¡ক প্রভাব যে কত জটিল ও গভীর হতে পারে তা নিপুণভাবে উপস্থাপন করেছেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন। ক্যান্ এ তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বাঁধন বলেন যে এরকম ভূমিকায় অভিনয় করাটা ছিল বেদনাদায়ক তাঁর মতে এই ছবি নারীদের সর্বজনীন বেদনার চিত্র উপস্থাপন করেছে এবং এজন্যই ক্যান্ এ দর্শকরা ছবিটি এত পছন্দ করেছে।

‘ফ্রান্স ২৪’
সংবাদ মাধ্যমের সাথে এক সাক্ষাতকারে পরিচালক সাদ বলেন যে ছবিটির কাহিনী নির্মাণে তাঁর মূল লক্ষ ছিল মানব প্রকৃতি বিশ্লেষণ। রেহানা কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনের (যেমন ‘মীটু’) প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্র নয়, যদিও কাহিনীটির রাজনৈতিক তাত্পর্য উপেক্ষণীয় নয়। রাজনীতি নয় – তাঁর মূল আগ্রহ ছিল চরিত্র সৃষ্টিতে, চরিত্রটি কত জটিল হতে পারে তা আবিষ্কার করায়, এবং চরিত্রটি কত দূর পর্যন্ত নিজেকে নিয়ে যেতে পারে তা প্রদর্শন করায়। আজমেরী হক বাঁধন অনবদ্য অভিনয়ের মাধ্যমে তা সফল করে তুলেছেন। সাদ বলেন, এই চরিত্রের কিছু উপাদান তিনি পেয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
থেকে। তবে তিনি চেষ্টা করেছেন এমন একটি চরিত্র তৈরি করতে যার সাথে শুধু বাংলাদেশের নয়, সম্ভবত অন্য দেশের নারীরাও একাত্মবোধ করতে পারে।

চিত্র সমালোচকদের পর্যালোচনা থেকে অনায়াসে এই উপসংহার টানা যেতে পারে যে তিনি সেই লক্ষ অর্জনে সফল হয়েছেন। ক্যান্এ ছবিটির আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনীর পর নারী ও পুরষ উভয়গোষ্ঠীর সমালোচক তাঁর কাহিনী নির্মাণের দক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করে। এখন পর্যন্ত কোনো সমালোচক কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করেনি।
ছবিটির কারিগরি দিক ও – আলোক প্রক্ষেপণ, ক্যামেরা ইত্যাদি -সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছে।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের যে উত্থান শুরু হয়েছিল, বলিউডের নির্মম অভিঘাতে তা ব্যাহত হয়। বাংলা অভিনয় দেখতে আগ্রহী দর্শকরা ভাল বাংলা ছবির অভাবে উত্কর্ষহীন টিভি সিরিয়ালের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ‘রেহানা’ বা ‘লাইভ ফরম্ ঢাকা’র মত একটি বা দুটি ভাল ছবি হয়ত এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না। তবে তরুণ পরিচালক আবদ্ল্লুাহ মোহাম্মদ সাদ ও তার তরুণ প্রতিভাবন দল ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে যে তারা এই পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিতে তৈরি।
রাশেদ নবী : লেখক, অটোয়া, কানাডা