ইচক দুয়েন্দে : ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করেন ইচক দুয়েন্দে। জীবনের অধিকাংশ সময় বসবাস করেছেন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় পদ্মা-বিধৌত নগরী রাজশাহীতে। কাজ করেছেন কৃষি খামার পরিচালক, গ্রন্থ সম্পাদক এবং ইংরেজি ভাষা প্রশিক্ষক হিসেবে। ইচক দুয়েন্দে’র অন্য বই: We Are Not Lovers (ইংরেজি উপন্যাস) এবং টিয়াদুর (মহাগপ্প)।

৬.
‘আমি দৈনিক পরশপাথর থেকে এসেছি। আমি সাংবাদিক। সত্যের মূল তুলে উপড়ে ফেলতে চাই আমি। আপনারা একে একে আপনাদের নাম পরিচয় বলুন। নির্ভয়ে বলুন। নির্দ্বিধায় বলুন কী ক্রাইম আপনারা করেছেন। আপনাদের ছবিসহ আমরা ছেপে দেব। বলুন, বলুন, একে একে বলুন,’ সাংবাদিক হিপ হিপ হুররে অত্যন্ত দ্রুত ব্যস্ত কথাগুলো বলে। ‘কিছুক্ষণের মধ্যে এখানে এসে পৌঁছুবে দ্য জলপাই টিভি’র ক্রুরা। আপনারা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও কাভারেজ পেতে চলেছেন। রাতারাতি নিখরচায় আপনারা পৌঁছে যাচ্ছেন খ্যাতির উত্তুঙ্গ শিখরে। কুইক কুইক তাড়াতাড়ি বলুন। আমার সময় নেই। আই হ্যাজ নো টাইম। আই ইজ ভেরি ভেরি বিজি। এখান থেকে যেতে হবে পার্কে, সেখানে একটা চিতাবাঘ খাঁচা থেকে বেরিয়ে লণ্ডভণ্ড করছে সবকিছু। তারপর যেতে হবে হাসপাতালে, সেখানে এক ছেলের মাথায় মহিষের শিঙ গজিয়েছে, তুলতে হবে তার ছবি। একসঙ্গে সতেরটা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সামলাতে হয় আমাকে। ব্যস্ত, আমি খুব ব্যস্ত। আই ইজ ভেরি ভেরি বিজি। পুরুষের ছদ্মবেশে আপনাদের মধ্যে লুকিয়ে আছেন এক ডাকসাঁইটে মহিলা, এটা জেনে আমি ছুটে এসেছি, সব কাজ ফেলে। বলুন কে সেই নায়িকা? কে সেই হার্টথ্রব? এদেরকে আপনারা ঘুস দিয়েছেন কত? দীর্ঘ আঠার ঘণ্টা কাটিয়ে দিলেন হাজতে। কীভাবে আমাদের চোখ এড়িয়ে? বলুন বলুন ঝটপট বলে ফেলুন। ভেতরে ভেতরে ড্রিল চলছে। মন্ত্রী-মিনিস্টাররা দেনদরবার করছে। বিরাট বিরাট ব্যাপার। বলেন, বলেন, বলে ফেললেন কী দিল্ পরিষ্কার। বলেন, কী করে পড়লেন এই জালে? কী ধরনের ক্রাইম? মার্ডার? কিডন্যাপ? হাইজ্যাক? ড্রিংকিং? স্টিলিং? ডাকাতি? আই এম নো এভ্রিথিং। আমার নাম হিপ হিপ হুররে। বাইরে আপনাদের জন্য আমার আরো ডজন ডজন সাংবাদিক ভাইরা অপেক্ষা করছে। ক্যামেরা হাতে রেডি। বাহির হবেন, আর ক্লিক ক্লিক। আর ক্লিক ক্লিক। সম্মান বাঁচাতে চান। মুখ খুলেন। বলেন সত্যি কথা। আমি সত্যের মূল উপড়ে তুলব। তবে ব্যবস্থা আছে। আপনারা যদি সব থামিয়ে দিতে চান। কিছু খরচ করতে হবে।’

‘প্লিজ এই টাকা কটি রাখুন,’ মিয়ান টিনটুই কিছু মুদ্রা ধরিয়ে দেয় হিপ হিপ হুররে’র হাতে। ‘প্লিজ ছবিটবি তুলেন না, খবর ছাপিয়েন না। প্লিজ।’
‘যা দিলেন তাতে আমাদের প্রত্যেকের জন্য একটা করে চকলেট হবে না। প্লিজ কিছু বাড়িয়ে দেন,’ সাংবাদিক হিপ হিপ হুররে অনুরোধ করে।
‘এখন আমাদের পকেট ফাঁকা। মনে রাখবেন আপনার ছবি আমার মনে থাকবে আঁকা,’ মিয়ান টিনটুই প্রতিশ্রুতি দেয় তাকে মনে রাখার। ‘আমরা বস্তুতপক্ষে জানি না কেন আমাদের ধরা হয়েছে। যদি নিশ্চিতভাবে জানতাম আপনাকে এতক্ষণে বলে দিতাম।’
‘আচ্ছা দেখি সামলাতে পারি কিনা?’ কণ্ঠে অনিশ্চয়তা প্রকাশ করে সাংবাদিক হিপ হিপ হুররে তার ঘাড়ে ঝোলানো ব্যাগ ঠিকঠাক করে রওনা হয়।

‘অদ্ভুত, তাই তো, আমাদেরকে ধরল কেন?’ রজেট চিনচুই বিষয়টা নিয়ে আলোচনায় যেতে চায়। ‘আমার স্বভাবের একটা বড় দিক হল, আমি কিছুতেই রেগে যাই না। কখনো এমন লাগামছাড়া কথা বলি না, যার জন্য পরে পস্তাতে হয় বা ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। দু’চার বোতল পান করলেও আমার নেশা হয় না। আমি জীবনে কোনোদিন পান করে আবোলতাবোল বকি নাই বা মাতলামি করি নাই। আমার শরীর ও মনের একটা চমৎকার মেলবন্ধন আছে। আপনাদের মনে আছে গতকালের সেই পড়ন্ত বিকেলে উদোম গায়ে আমি শুয়েছিলাম নদীতীরের বালিয়াড়িতে। কেমন ঝিমঝিম মাথা। যেন অনুভব করছি ঘূর্ণায়মান পৃথিবী। সূর্য অস্তায়মান। চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম। আর আমার ডান হাতটা আমার মুখটাকে আড়াল করে রেখেছিল সূর্যালোক থেকে। আমার খুব ভালো লাগছিল। বেঁচে থাকা কতো না আনন্দের!

‘আমার সুন্দর মনোরম বিকেলটাকে একটা অচেনা জংলি উদ্ধত কণ্ঠস্বর নষ্ট করে দিল, ‘কে এখানে মরার মতো ঘুমায়?’ কিছুতেই আমার রাগ হয় না। লোকটির উদ্ধত বেরসিক প্রশ্নটার একটা যুৎসই জবাব দেয়াটা জরুরি জ্ঞান করলাম। এদের মতো লোককে প্রশ্রয় দেয়াটা ঠিক নয়। না শুনতে চাইতেই লোকটি তার পরিচয় দিলো এভাবে যেন শুনেই আমাকে ভড়কে যেতে হবে, উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন করতে হবে। কিন্তু আমি শুধু আমার চোখটা খুললাম। হাতটা সরালাম আমার মুখ থেকে। দেখলাম লোকটাকে। আমাদেরই মতো একটা মানুষ। চেহারা বা পোশাকে একটুও আলাদা কিছু নয়। কিন্তু অতি উদ্ধতদৃষ্টি।

অলংকরণ : উদাস আব্দুল্লাহ

‘আমি ধারণা করলাম লোকটি আইন প্রয়োগকারী কোনো সংস্থার কর্তাব্যক্তি হবে। আমি বললাম, ‘আমার ভালো লাগছে এখানে আমি ঘুমিয়ে আছি। আমি একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। অপর কোনো মানুষের বিরক্তি বা অসুবিধার কোনো কারণ না ঘটিয়ে আমার মনের মতো কিছু করবার স্বাধীনতা আমার আছে। আপনার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, আপনার ঘাড়ে চড়ে ঔপনিবেশিক শাসকদের ভূত আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। আপনি আপনার পথে চলে যান। চাইলে একটু দূরে গিয়ে আমার মতো বিশ্রাম নিন। বিদায়।’ তার মুখটা থমথমে হয়ে উঠল। মনে হল তার ইচ্ছে করছে তখনি কিছু করে ফেলার। তারপর সে তার রাগটা সামলে নিল। সে তার পথটা একটু বদলাল এবং কিছুটা দ্রুত হেঁটে চলে গেল। সে আমার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল। আমি আবারো নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম নিতে লাগলাম। ক্রমে সূর্যের তাপ ম্লান হল। আমার ঐ কথাগুলির জন্য হাতকড়া পড়বে আমার হাতে, এ আমার যুক্তি-বুদ্ধি-জ্ঞানের অতীত। জানতাম আমি, হাজতে, লালঘরে যায় অপরাধীরা। আজ আমি সম্পূর্ণ নতুন কিছু জানলাম। মনে হল এতোটা কাল পৃথিবীতে কাটানোর পরও আমি শিশু।
‘আসুন, এই সুস্পষ্ট অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার হই। প্রতিবাদ করি।

আপস করা চলবে না। মিয়ান ওভাবে ঘুষ দিয়ে ঠিক করলেন না। আমরা চোর দাগি আসামি নই। আমরা ন্যুব্জ, পরাজিত নই। জয় আমাদের হবেই।’
রজেট চিনচুই-এর কথা শেষ হলে মিয়ান টিনটুই বলে, ‘আমরা দাগি আসামি নই বলেই আমাদের সুনাম রক্ষার জন্য চেষ্টা করতে হচ্ছে।’

৭.
‘আপনাদেরকে আদালতে যেতে হচ্ছে, এমনিতে ছাড়া পাবার আপনাদের আর কোনোই উপায় নেই, নগরীতে আপনাদের গ্রেফতারের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আপনারা আর আমাদের আয়ত্তের মধ্যে নেই। বিশেষ করে ঐ লোকটি,’ মসৃণভাবে দাড়ি কামানো, গোঁফওয়ালা, লম্বা, দেড়হারা, সুঠামদেহী, সুদর্শন, ওয়াকিটকিধারী, রোমান্টিক এক কর্তা ব্যক্তি ফিজ ফ্যালের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে আটক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভবিষ্যৎ কতোটা অন্ধকারাচ্ছন্ন তা সুদৃঢ়রূপে বর্ণনা করা শুরু করে। ‘যাই হোক ঐ লোকটি সবকিছু গোলমাল করে দিয়েছে। সে ওখানে অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করেছে। ফোন করেছে সে আমাদের এক বড় কর্তার কাছে। তিনি আবার ফোন করেছেন আমার এক ডাইরেক্ট বড় কর্তার কাছে। আমার ডাইরেক্ট বড় কর্তাটি নিরপেক্ষ, সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ, অবিচল ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আপসহীন আজীবন সংগ্রামী। পাশ্চাত্য শিক্ষায় তিনি সুশিক্ষিত। এই হেন অযাচিত, অনাকাক্সিক্ষত তদবিরে তিনি যারপরনাই ক্ষুব্ধ। আপনারা অপরাধী। কিন্তু প্রথমবার অপরাধ করেছেন, তাই তিনি এমনকি ভাবছিলেন তাঁর আপন ক্ষমতাবলে আপনাদেরকে ছেড়ে দেবেন, কিন্তু ঐ লোকটির অহেতুক, অশালীন তদবিরে তার মনটা গিয়েছে সম্পূর্ণ বেঁকে। আর কী যেন নাম উনার। আচ্ছা ফিজ ফ্যাল। ফিজ ফ্যাল আমাদের অফিসে যা বলেছে বা যা করেছে তা ট্রিজন-তুল্য। ট্রিজন কি বোঝেন? না বোঝেন না। যে দেশে থাকেন, সেই দেশের সংবিধান আইনকানুন বিধিবিধান জানতে হয়। ট্রিজন মানে হল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। আপনারা যতটা জুবুস্থুবু, খেয়ালি, স্টেটসে গেলে আপনাদের এয়ারপোর্ট থেকে আউট করে দিত। মিস্টার ফিজ ফ্যালের কথায় আসি। সে আমাদেরকে হুমকি দিয়েছে। বলেছে তার কোনো এক জেনারেল বন্ধু আছে, যে আমাদের সর্বনাশ করতে উদ্যত হলে, আমাদের কোনো রক্ষা নেই।

‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সভ্যদের ভয়ভীতি, হুমকি প্রদর্শন, কর্তব্য পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি মারাত্মক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু ফিজ ফ্যাল যে মারাত্মক দৃঢ়তার সঙ্গে হুমকি প্রদান করেছে, তা আমরা হালকাভাবে নিতে পারি না। তার সঙ্গে কোনো পরাশক্তির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এবং আপনারা তার সহযোগী। আপনারা জেনে বা না জেনে জড়িয়ে পড়েছেন আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে এক জঘন্য, ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্রে।

‘আপনাদেরকে রিমান্ডে নিলেই আপনাদের সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে। আপনাদের পেছনে ও সামনে যে রাঘববোয়ালরা আছে, তারা ধরা পড়ে যাবে।
‘আমরা, আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিকে নিরবচ্ছিন্ন অতন্দ্র প্রহরা ও শৃঙ্খলা দিয়ে রক্ষা করে আসছি। কোনো অশুভ শক্তির চক্রান্ত এর ভরাডুবি ঘটাতে পারবে না।
‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আমাদেরকে আইন জানতে হয়। আইন আমাদের বলে দেয়, কোন্টি সঠিক আর কোন্টি বেঠিক। আমাদের বাহিনীতে পদোন্নতি নির্ভর করে আইন জানার উপর। সুশিক্ষার উপর। সুপাণ্ডিত্যের উপর। এখানে কোনো শর্টকাট নেই। আমরা অনড় ও অবিচল।
‘আমরা সব্বাই এক সঙ্গে ছুটিতে গেলে, হরতালে গেলে, এই দেশ যেত উচ্ছন্নে, মাত্র এক রাতে এই দেশ লুটপাট খুনখারাবিতে খতম হয়ে যেত।
‘আপনারা অপেক্ষা করুন, কিছুক্ষণের মধ্যে আদালতে নেব আপনাদের। বিজ্ঞ আদালত আপনাদের রিমান্ডে নেবার আদেশ দেবেন। এতদিন আমাদের সম্পর্কে বহু কল্পকাহিনী শুনেছেন আপনারা। আমরা শুধুই ঘুষ খাই। রিমান্ডে নেই, বুঝবেন আমরা কারা।’

রোমান্টিক কর্তার মোবাইল বাজে। তার কথার তোড়ে একটু বিলম্ব হয়ে গেলেও সে অতি দ্রিত মোবাইলে কথা শুরু করে, ‘জী, জী স্যার। হ্যাঁ, হ্যাঁ স্যার। জী, জী স্যার। আমি গাড়ি দেখছি স্যার। আচ্ছা, আচ্ছা স্যার। ঠিক আছে স্যার। উনাদের সব্বাইকে আপনার ড্রইং রুমে পৌঁছে দিচ্ছি স্যার। জী, জী স্যার। চা-টা স্ন্যাকস ইত্যাদি স্যার। হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার। সফট ড্রিংকস স্যার। আচ্ছা স্যার, শীতের দিন স্যার। গরম কফি স্যার।’

‘আচ্ছা চলি। আমার ডাক পড়েছে,’ বলেই হঠাৎ করে রওনা হয় রোমান্টিক কর্তা।
রোমান্টিক কর্তার কথাগুলো হজম করতে তাদের কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু তার মোবাইল সংলাপ তাদের মনে এমন একটা অস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি করে যে তারা সহসাই ছাড়া পেতে চলেছে। এমনকি ছাড়া পাবার পরে তারা বড় কর্তার গৃহে আপ্যায়িতও হতে যাচ্ছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাদেরকে মুক্ত করবার বিন্দুমাত্র উদ্যোগও কোথাও দেখা যায় না। মনে হয় যেন পাহারা করা হয় জোরদার, গরাদ-দরজার শিকগুলো হয়ে ওঠে আরো শক্তিশালী।
‘তাহলে আমিই দায়ী,’ ফিজ ফ্যালের কথায় অনুতাপের রেশ দেখা যায়। ‘আমার বার্কি পরিস্থিতিকে এমন জটিল করে দেবে আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবি নাই। আমার এক বন্ধুকে মোবাইল করলাম। সে ক্ষমতাশালী। সে বলল, দুশ্চিন্তা কোরো না আমি দেখছি। আমার মনে পৃথিবী জয়ের আনন্দ হল। এই তো দু’মিনিটেই ছাড়া পাচ্ছি। তাই বার্কি নিতে ইচ্ছে করল। ওদেরকে জেনারেলের কথা বলে ভড়কে দিতে গেলাম। এখন কী করতে যে কী হয়ে গেল! বন্ধুরা, আমি গভীরভাবে দুঃখিত।’

‘ফিজ ভাইয়া, ভালো করছেন, ঐ বার্কিটা না নিলে আমরা এতক্ষণে গেছি। আমাদেরকে ভিতরে নিয়ে হাড় গুঁড়া করত। আমরা এতক্ষণে শেষ, পঙ্গু,’ তিয়াস ঠিসটক আশ^স্ত করতে চায় ফিজ ফ্যালকে।
ফিজ ফ্যাল আশঙ্কা করে, তার বন্ধুরা সব্বাই আক্রমণ করবে তাকে তার নির্বোধ আক্রমণাত্মক কথাবার্তার জন্য। কিন্তু দেখা যায় তারা সব্বাই নিঃসাড়, নিস্তেজ। রাতে তারা প্রায় কোনো আহার করে নাই, সকালে যৎসামান্য। যে প্রাণবন্ত ভঙ্গিতে তারা কথা বলেছে কিছুক্ষণ আগেও, তা হয়েছে উধাও। তাদের মনে এই নিশ্চিত বোধ আসে যে আদালতে তাদেরকে তোলা হচ্ছে। সরাসরি ছাড়া পাবার উপায় নেই। সেখান থেকে তাদেরকে পাঠানো হতে পারে কারাগারে। অথবা নেয়া হতে পারে রিমান্ডে। অথবা তাদের হতে পারে জরিমানা অথবা তারা পেতে পারে ছাড়া। এই শেষোক্ত সম্ভাবনাকেই তারা মনেপ্রাণে চাইছে। মনে মনে তারা মকশো করতে থাকে, জিজ্ঞাসা করা হলে তারাকী বলবে আদালতে।

৮.
‘এই সবকিছুর আড়ালে রয়েছে একটা সূ² চক্রান্ত,’ ভাবে জিয়াফ ব্যানব্যাট। ‘আমাদের বিরুদ্ধে একটা আগাম গোয়েন্দা রিপোর্ট না থাকলে এরা আমাদেরকে কিসের ভিত্তিতে ধরল? এটা যে একটা চক্রান্তের ফল এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু থাক, বন্ধুদের সামনে এই হাজতঘরে প্রসঙ্গটি আমি তুলব না। এদের সব্বাইকে দেখে রীতিমতো করুণা হচ্ছে। মনমরা হয়ে সব বসে আছে। ঘন ঘন যাচ্ছে ওরা শৌচাগারে প্রকৃতির ডাকে। সব্বাই ওরা অনভিজ্ঞ। জেল বা হাজতে ওরা কোনোদিনও কাটায়নি। দুগ্ধপোষ্য শিশু। ওদের সৌভাগ্য জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা ওরা পেয়ে গেল। ভাগ্যিস ওদেরকে মারধোর করেনি।
প্রথমে আমার মনে হল ওরা আজকে রামধোলাই দেবে। আমাদের সামনে পৌঁছেই ওদের ডায়লগ, ‘কী, আমাদের বস্কে অপমান!’ আমি তক্ষুনি বুঝে গেলাম আজকে একটা খারাবি আছে। মনে মনে রেডি হয়ে গেলাম কীভাবে ব্যাপারটা ফেস করব। আমার মনে হয় আমিই একমাত্র ব্যক্তি ঐখানে ঐ কড়া পাহারার মধ্যে যে পালাতে চেষ্টা করেছিল। আমি যেই একটা ব্যাকওয়ার্ড মুভ দিলাম, অমনি একটি কিক্ খেলাম। কিক্ খাওয়ার কথাটা এখনো কাউকে বলি নাই। সম্ভবত অন্য কেউ দেখেও নাই। কাউকে এটা বলতেও চাচ্ছি না।

ওরা যখন গাড়িতে করে প্রথম ওদের অফিসে আমাদেরকে নিল, ওদের মধ্যে একজন আমাদেরকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আপনারা সব্বাই ফার্মের মুরগির মতো ধরা দিয়ে দিলেন। মস্ত এক ফাঁকা জায়গা, নদীর চরে ছিলেন আপনারা, আপনারা এগার জন এদিক-ওদিক দৌড়ালে, ইজিলি অর্ধেক পালিয়ে যেতে পারতেন। আপনারা পালাতে চেষ্টা করলে, আপনাদেরকে ধরতে আমরা পড়িমরি করে ছুটতাম না। আমরা মানুষ চিনি, বসের হুকুমে গিয়েছিলাম ওখানে, আমরা দেখে বুঝেছিলাম, আপনারা অপরাধী নন।’
ভদ্রলোকের কথাটা শুনে মনে মনে পস্তালাম। ঠিক, একদল শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল মানুষের মধ্যে আমি পড়ে গেছি। এরা বড্ড বকতে ভালোবাসে, কিন্তু কোনো কাজের কাজ করতে চায় না।

প্রথমতঃ একটা প্রশ্ন, কীভাবে কেমন করে নিঃশব্দে, মিহির ফারতুই সটকে পড়ল? কোথায় সে হাওয়ায় মিশে গেল? কেমন করে গোয়েন্দারা জানল, আমরা নদীর চরে ঐ জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে আছি? কে জানিয়ে দিল গোয়েন্দাদের? কে ছিল ওদের চর? এই বিষয়গুলি যদি আমরা স্পষ্ট করে জানতে পারতাম, তাহলে বোঝা যেত চক্রান্তটা। কে যেন বলল, কী একটা জরুরি মোবাইল কল পেয়ে মিহির ফারতুই দ্রুত চলে গেল। কে তাকে জরুরি কল দিল? গোয়েন্দাদের সঙ্গে তবে কি তার ছিল গোপন যোগসাজস?
আমাদের মধ্যে কারো সঙ্গে মিহির ফারতুই-এর কি ছিল বা আছে এক অপ্রকাশ্য শত্রæতা? সে কি সেই শত্রুতার জের টেনে ঘটাল এই ঘটনা?
উঁহুঁ, ব্যাপারটা এরা যেমন সহজভাবে নিচ্ছে, মোটেই তা তেমন সহজ নয়। মিহির ফারতুই খুবই বাজে ব্যবহার করছিল চিকচাকরুই-এর সঙ্গে পুরোটা পিকনিক জুড়ে। কেন মিহির ফারতুই উত্যক্ত করছিল চিকচাকরুইকে? তাদের মধ্যে কি ছিল পুরনো অজানা কোনো শত্রুতা?

আমি দু’একবার প্রসঙ্গটা তুললাম। না, ওরা কেউ আগ্রহী নয়। ওরা উড়িয়ে দিল। কিন্তু আমি অজস্র রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস পড়েছি। আমি ছোটখাট কোনো ব্যাপারকেই উড়িয়ে দিতে পারি না। আমি সেই প্রথম থেকে ঘনিষ্ঠভাবে চিকচাকরুইকে দেখছি। এখানে সবচেয়ে মনমরা, চুপচাপ ও চিন্তিত মানুষটি হল সে।
কী ভাবছে সে? মিহির ফারতুই-এর সঙ্গে কতো পুরনো শত্রæতা চিকচাকরুই-এর? কী বিষয়ে শত্রæতা? ব্যবসায়িক লেনদেন? রাজনৈতিক? পারিবারিক? নাকি নিছকই ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতাজাত? নাকি প্রেম?
থাক। আর ভেবে কাজ নেই। ভেবে ভেবে আমার মাথার প্রায় সব চুলই গেছে পড়ে। মিহির ফারতুই-এর সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে বাকি চুলগুলিও যাক পড়ে তা আমি চাই না।
তবে আমি নিশ্চিত, আমি ছাড়া পেয়ে যাব। বিরাট কোনো ঝামেলা হবে না। আমার মন বলছে।

আমি জানি আমি কেন ধরা পড়েছি। এটা আমার বউয়ের বদদোয়া। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এটি আমি কোনোদিনই কাউকে বলব না।
কয়েক বছর আগের কথা। প্রতিদিনের মতো সেদিনও কাজে বেরিয়েছি। এ-কাজ সে-কাজ ও-কাজ ব্যস্ততা। সারাদিন কেটে গেল। দুপুরে বাসায় ফেরা হল না। শেষে বাসায় ফিরলাম রাত আটটায়।
‘গ্রিলের দরজা। বাহির থেকে তালা লাগানো ও খোলা যায়। আমি তালা খুললাম। ভেতরে ঢুকলাম। এবং তারপর শুরু হল। আমার বউ আমার দিকে পরপর ছুঁড়ে মারল ছয়টা বালিশ। ভাগ্যিস বাসায় মাত্র ছয়টা বালিশই ছিল। পরে জেনেছিলাম, সে আমাকে ঝাঁটা ছুঁড়েই মারতে চেয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সে অনেকক্ষণ ধরে আমার উপরে রেগে ছিল তাই সে কী করবে বা না করবে সে-সম্পর্কে দীর্ঘক্ষণ ভাবার অবকাশ পেয়েছিল। তাই সে বালিশই নিয়েছিল বেছে।
আমার অপরাধ ছিল বাসায় তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে আমি উধাও হয়ে গিয়েছিলাম। বাসার ডুপ্লিকেট চাবিটাসহ। ব্যাপারটা ঘটেছিল অন্যমনস্কতাজনিত কারণে।
আমার বউ বলেছিল, ‘তুমি আমাকে আর আমার অবলা বাচ্চাটাকে ইচ্ছা করে আজ জেল খাটালে। আজকে আমি মায়ের বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম, যাওয়া হল না। তুমি প্রতিদিনই দুপুরে বাড়ি ফের। আজকে তুমি ইচ্ছে করেই ফিরলে না। তুমি পাপ করলে। তুমি একদিন জেল খাটবে।’

কিন্তু আমার বউ একটা ব্যাপার জানত না। আমি এরই মধ্যে অর্থাৎ তার সঙ্গে বিয়ের আগেই জেল খেটেছিলাম। ব্যাপারটা তাকে বলি নাই। কারণ সে ভীরু ও সরল প্রকৃতির। সঙ্গে সঙ্গে সে ভেবে বসতে পারত, আমি চোর বা ডাকাত। তাই বিষয়টা সম্পর্কে উচ্চবাচ্য না করাই ভালো মনে করেছিলাম।
আমি রাজনৈতিক ব্যাপারে জেলে ছিলাম। ডিটেনশন এক মাসের। ডিভিশন পেয়েছিলাম। আমরা অর্থাৎ বিশ-পঁচিশ জন একত্রে জায়গা পেয়েছিলাম একটা ঘরে। সব্বাই রাজনৈতিক কর্মী। আমরা ছিলাম রাজবন্দি। ছিল বেশ একটা অন্যরকমের মর্যাদা। তাস পিটে, দাবা খেলে, আড্ডা দিয়ে, হৈ হুল্লোড় করে কীভাবে একটা মাস কেটে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি।
এবারে ব্যাপারটা খুবই নীচ। অভিযোগ অস্পষ্ট। কে জানে কী চক্রান্ত চলছে! একটা কথা জেনে অবাক হলাম, আমি ছাড়া, এখানে কেউই কোনো কারাবাস করেনি। সবাই কি সত্য বলল? না কেউ কেউ চেপে গেল?’ (চলবে)