আব্দুলরাজাক গরনা : [আব্দুলরাজাক গরনা এ বছরের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী। তার জন্ম ১৯৪৮ সালে সাবেক ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত দ্বীপ জানজিবারে, বর্তমানে যা তানজানিয়ার একটি আধা স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ। জানজিবার বিপ্লবের (১৯৬৪) অব্যবহিত পরে, আঠার বছর বয়সে আব্দুলরাজাক ইংল্যান্ড গমন করেন এবং তারপর থেকে তিনি সেখানেই বসবাস করেন। মূলত উপন্যাসিক হলেও তিনি বেশ কয়েকটি ছোট গল্পেরও প্রণেতা। তার উপন্যাসের সংখ্যা দশটি। বহুল পঠিত উপন্যাসের মধ্যে “প্যারাডাইস” বা “স্বর্গ” (১৯৯৪) “বাই দি সি” বা ”সাগরপারে” (২০০১) ও “ডেজারশন” বা “পলায়ন” (২০০৫) উল্লেখযোগ্য। “রাইটিং ও প্লেস” বা “লেখালেখি ও স্থান” শিরোনামের তার নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে “ওয়াসাফিরি” নামক জার্নালে।]

আমি লিখতে শুরু করি ইংল্যান্ডে আসার কয়েক বছর পরে। আমার বয়স তখন একুশ বছরের মত। বলতে গেলে লিখতে শুরু করাটা ছিল ঘটনার আকস্মিকতা, তেমন পরিকল্পিত কিছু নয়। আমি আগেও লিখেছি, যখন জানজিবারে স্কুলে পড়তাম। কিন্তু সেটা ছিল মজা করবার জন্য, নিষ্ঠাহীন, বন্ধুদের চমক দেয়ার জন্য ও স্কুলের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবার জন্য, হুজুগ, অলস সময় কাটানো বা নিজেকে জাহির করা। সেটাকে আমি কখনো কোনো কিছুর পূর্ব-প্রস্তুতি হিসাবে দেখি নি বা নিজে কখনো লেখক হবার আকাঙ্খা পোষণ করিনি।

আমার মাতৃভাষা কিসোয়াহিলি। প্রাক-ইউরোপীয় উপনিবেশিক যুগে বহু আফ্রিকান ভাষার লিখিত রূপ ছিল না, কিন্তু কিসোয়াহিলির ছিল। তার মানে এই নয় যে কিসোয়হিলিতে সাক্ষর মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক। কিসোয়াহিলি ভাষায় আলোচনামূলক রচনার সবচেয়ে প্রাচীন নমুনা পাওয়া যায় সতের শতকের শেষ দিকে। আমি যখন কিশোর ছিলাম তখনও এসব রচনা ছিল অর্থবহ এবং তা লিখিত এবং মৌখিক উভয় ভাষাতেই ব্যবহৃত হত। আমি যেসব সমকালীন কিসোয়াহিলি রচনার সাথে পরিচিত ছিলাম সেগুলো ছিল সংবাদপত্রে প্রকাশিত ক্ষুদ্র কবিতা, রেডিওর জনপ্রিয় গল্প-অনুষ্ঠান, বা কালেভদ্রে, গল্পের বই। জনপ্রিয়তার স্বার্থে এসবের অনেকগুলিতে নীতিকথা বা প্রহসন যোগ করা হত। যারা এসব লিখত তারা অন্য কাজও করতঃ তারা ছিল শিক্ষক অথবা আমলা। আমার কখনো মনে হয়নি আমি ওরকম লেখা লিখতে পারি বা আমার লেখা উচিত। কিসোয়াহিলিতে লেখালেখির এখন অনেক বিকাশ হয়েছে, কিন্তু আমি বলছি আমার তখনকার ভাবনার কথা। আমি বড়জোর ভাবতাম লেখালেখি মানে মাঝে-মধ্যে করবার মত ওরকম নির্বীজ কাজ। ওরকম কাজ করবার কথা আমার মনেও আসেনি; তাচ্ছিল্যের সাথে যা লিখেছিলাম তার কথা অবশ্য আলাদা।

যখন আমি দেশ ছাড়ি তখন আমার আকাঙ্খা ছিল সামান্য। সময়টা ছিল কষ্টের এবং উদ্বেগের, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এবং মেপেজুখে হয়রানি করার। সেই সময়ে, আঠার বছর বয়সে, আমার লক্ষ্য ছিল অন্য কোথাও গিয়ে নিরাপত্তা ও পরিপূর্ণতা খোঁজা। লেখালেখির ধারণা মাথার মধ্যেই ছিল না। কয়েক বছর পরে ইংল্যান্ডে যখন লেখার কথা চিন্তা করতে শুরু করি তখন বয়স একটু বেড়েছে, যে সব জিনিস আগে জটিল মনে হয়নি সেসব নিয়ে চিন্তা ও উদ্বেগ বেড়েছে। সবচেয়ে বড় যে ব্যাপার যার জন্য লেখার কথা চিন্তুা করতে শুরু করি তা হল এক অপ্রতিরোধ্য অনুভূতি যে আমি আলাদা, আমি আগন্তুক। এই প্রক্রিয়ায় এক ধরনের দ্বিধা ও হাতড়ে বেড়ানো কাজ করছিল। আমি বলব না যে আমার এইসব ব্যাপার নিয়ে আমি সচেতন ছিলাম এবং তা নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম। আমি লিখতে শুরু করি উদ্দেশ্যহীনভাবে, খানিকটা পীড়ার সাথে, পরিকল্পনা ছাড়া কিন্তু কিছু বলবার তাড়নায়।
ক্রমে আমি আমার কাজ নিয়ে ভাবতে শুরু করি। আরো ভাববার জন্য আমাকে একটু বিরতি নিতে হয়, চিন্তা করতে হয় যে লেখালেখি নিয়ে আমি কি করছি। আমি টের পাই যে আমি লিখছি স্মৃতি থেকে, সে স্মৃতি কত প্রাণবন্ত এবং প্রবল, আর তা ইংল্যান্ডে আমার শুরুর বছরগুলির অদ্ভুত, নির্ভার অস্তিত্ব থেকে কত দূরবর্তী। সে সময় মনে হয়েছিল এই অদ্ভূত বোধ ফেলে আসা জীবনের অর্থকে আরো ঘনীভূত করেছে, অবহেলাভরে বা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করে আসা মানুষদের সম্পর্কে অনুভূতি আরো অর্থবহ করেছে, একটি স্থান ও আমার চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার বোধকে তীব্র করেছে। যখন আমি লিখতে শুরু করি তখন লিখেছি এই হারানো জীবন নিয়ে, হারানো স্থান নিয়ে এবং সে সম্পর্কে যা মনে ছিল তা নিয়ে। এক অর্থে, আমি ইংল্যান্ডের জীবন নিয়েও লিখছিলাম, বা নিদেন পক্ষে কোনো এক স্থান সম্পর্কে যা আমার স্মৃতি ও সত্তায় বিরাজিত স্থান থেকে একদম আলাদা; নিজেকে অপরাধবোধ ও অবোধগম্য অনুশোচনায় জর্জরিত করতে যা আমি ছেড়ে এসেছি তা থেকে এই স্থান যথেষ্ট নিরাপদ ও যথেষ্ট দূরে। লিখতে লিখতে আমি প্রথমবারের মত অনুভব করি আমার পরাভব- সা¤প্রতিক সময়ে আমরা যে তিক্ত এবং নিষ্ফল জীবন যাপন করছি তার কাছে পরাভব, সেই সময়কে ডেকে আনতে আমরা যা করেছি তার কাছে, এবং ইংল্যান্ডে তখন যাকে মনে হয়েছিল অদ্ভুত অবাস্তব জীবন, তার কাছে।

এই পট পরিবর্তনের একটি প্রচলিত যুক্তি আছে। সেটা হল, দেশের বাইরে এলে আমাদের মধ্যে তৈরি হয় দূরত্বের বোধ, একটা দৃষ্টিকোণ, প্রশস্ততা এবং স্বাধীনতা। তা ঘণীভূত করে আমাদের স্মৃতি, যা লেখক-লেখিকার অর্ন্তদেশ। দূরত্ব লেখক-লেখিকাকে তার সত্ত্বার সাথে নিরবিচ্ছিন্ন যোগ স্থাপন করে দেয়, যার ফলে তৈরি হয় কল্পনার অবাধ চলাচল। এই যুক্তিতে লেখক-লেখিকাকে দেখা হয় একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মহাবিশ্ব হিসেবে এবং মনে করা হয় তারা কাজ করে ভাল বিচ্ছিন্ন থেকে। অনেকে ভাবতে পারে এটা অতীতের ধারণা, সাহিত্যকদের সম্পর্কে উনিশ শতকের রোমান্টিক স্ব-নাটকীয়তা; কিন্তু এই ধারণা এখনও আবেদনময় এবং এখনও টিকে আছে নানাভাবে।

এক দৃষ্টিতে দূরত্বের সহায়তা লেখক-লেখিকাকে এনে ফেলে আবদ্ধ জগতে; অন্য দৃষ্টিতে দূরত্ব মূল্যবান কল্পনাশক্তির উন্মোচন ঘটায়। দ্বিতীয় মতে এটাও বলা হয় যে এই ধরনের স্থানচ্যুতি প্রয়োজনীয়। এই মতে, লেখক বা লেখিকা বিচ্ছিন্ন থেকে মূল্যবান রচনা সৃষ্টি করে। বিচ্ছিনতার কারণে সে দায়বদ্ধতা ও অন্তরঙ্গতা থেকে মুক্ত থাকে; যে সত্য বলা দরকার দায়বদ্ধতা ও অন্তরঙ্গতা তাকে মৌন ও লঘু করে। সাহিত্যিক নায়ক, সাহিত্যিক সত্য দ্রষ্টা। প্রথম দৃষ্টিতে লেখক-লেখিকার সাথে স্থানের সম্পর্ক যে ভাবে দেখা হয় তাতে যদি উনবিংশ শতাব্দীর রোমান্টিকতার প্রতিধ্বনি থাকে তাহলে দ্বিতীয় দৃষ্টি বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের আধুনিকতাবাদীদের প্রতিফলন। ইংরেজি আধুনিকতাবাদের প্রধান লেখকদের অনেকেই তাদের স্বনিবাস থেকে অনেক দূরে গিয়ে লিখেছে যাতে তারা যা দেখেছে তা বিশ্বস্ততার সাথে লিখতে পারে, যাতে তারা ক্ষীয়মাণ সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারে।
আরেকটা মতও আছে। সেটা হল, আগন্তুকদের মধ্যে বিচ্ছিন্ন থেকে লেখক-লেখিকা তার ভারসাম্যতার বোধ হারায়, মানুষ সম্পর্কে বোধ হারায়, এবং তাদের সম্পর্কে তার ধারণার প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব হারায়। এটা বিশেষভাবে সত্য আমাদের রাজতন্ত্র-উত্তর সময় সম্পর্কে এবং সেইসব লেখক-লেখিকা সম্পর্কে যারা এসেছে সাবেক ইউরোপীয় উপনিবেশ থেকে। উপনিবেশবাদ নিজেকে বৈধ করেছে জাতিভেদের সোপানক্রম ও অপকৃষ্টতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। উপনিবেশবাদীদের এই প্রচার সংস্কৃতি, জ্ঞান, ও প্রগতির আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। উপনিবেশের অধিবাসীরা যাতে এই ধারণা মেনে নেয় সেজন্য যা করা দরকার তা উপনিবেশবাদ করেছে। উপনিবেশোত্তর কালের লেখক-লেখিকাদের বিপদ হল, উপনিবেশবাদী এই প্রচার হয়ত তাদের উপর কাজ করেছে অথবা তাদের ইউরোপের বিছিন্ন জীবনের উপর কাজ করবে। এই প্রভাবের ফলে উপনিবেশোত্তোর কালের লেখক বা লেখিকা হয়ে উঠতে পারে তিক্ত দেশান্তরী যে পেছনে ফেলে আসা মানুষদের উপহাস করে, যাকে উদ্দীপিত করে শুধুমাত্র প্রকাশক এবং পাঠক যাদেরকে অজ্ঞাত বৈরিতার স্বীকার হতে হয় নি এবং যারা অ-ইউরোপীয় বিশ্ব সম্পর্কে যে কোন নির্মমতাকে পুরস্কৃত করতে এবং প্রশংসা করে খুশি। এই মতে, আগন্তুকদের মধ্যে বসে লেখা মানে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য কঠোরভাবে লেখা, সত্যের নিবন্ধক হিসাবে আত্ম-অবমাননা মেনে নেয়া, অন্যথায় আবেগপ্রবণ আশাবাদী হিসাবে প্রত্যাখাত হওয়া।

উভয় যুক্তিই – দূরত্ব মুক্তিদায়ক বা দূরত্ব বিকৃতিপ্রবণ – সত্যের সরলীকরণ, যদিও বলা যাবে না যে এদের মধ্যে সত্যের লেশ নেই। আমার গোটা প্রাপ্তবয়স্ক জীবন কেটেছে ভিনদেশে; আমি আগন্তুকদের মধ্যে আবাস গড়েছি। অন্য উপায়ে বাস করবার কথা এখন আর কল্পনা করতে পারি না। মাঝে মাঝে চেষ্টা করি, কিন্তু যে সব কাল্পনিক সম্ভাবনার কথা চিন্তা করি তার কোনোটারই বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে হয় না। ফলে আমার নিজের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বক্ষে লেখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না; গভীর অর্থে, সম্ভবত তা কোনো লেখক-লেখিকার পক্ষেই সম্ভব নয়। আমি জানি আমি লেখালেখি শুরু করেছি ইংল্যান্ডে এসে, বিচ্ছেদবোধ নিয়ে। আমি এখন উপলব্ধি করি যে বহু বছর ধরে আমার লেখালেখির বিষয় এই পরিস্থিতি, এরকম এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গিয়ে বসবাস করা। এই বিষয় শুধুমাত্র আমার একার অভিজ্ঞতা নয়, তা আমাদের সময়ের গল্প।

ইংল্যান্ডে এসে আমি ব্যাপকভাবে পড়ার সুযোগও পেয়েছিলাম। জানজিবারে বইয়ের দাম ছিল বেশি, বইয়ের দোকান ছিল স্বল্প এবং দৈন্যদশাগ্রস্থ। যে কয়েকটা লাইব্রেরি ছিল সেগুলোও ছিল সেকেলে।

সর্বোপরি, আমি জানতাম না আমি কি পড়তে চাই, এবং যা পেতাম এলোপাথারিভাবে তাই পড়তাম। ইংল্যান্ডে এসে মনে হয় পড়ার সুযোগ সীমাহীন এবং ক্রমে মনে হয় ইংরেজি একটি প্রশস্ত বড় বাড়ি যেখানে রচনা ও জ্ঞান রক্ষিত হয়েছে যত্নহীন আতিথেয়তার সাথে। এটিও ছিল লেখালেখিতে আসার আরেকটি পথ। আমার বিশ্বাস লেখক-লেখিকারা লেখালেখিতে আসে পাঠের মধ্য দিয়ে, সঞ্চয় ও বৃদ্ধির এবং প্রতিধ্বনি ও পুনরাবৃত্তির প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তারা একটি পঞ্জি তৈরি করে যা তাদের লিখতে সক্ষম করে। এই পঞ্জি একটি সূ² ব্যাপার যা সবসময় একটি পদ্ধতি হিসেবে বর্ণনা করা যায় না যদিও সাহিত্য সমালোচকরা সেই কাজে নিয়োজিত। এটি কোনো উপকরণমূলক কর্মসূচি নয় যা একটি গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এটি বর্ণনামূলক পদক্ষেপের সমষ্টি যা যথাযথ ও বিশ্বাসযোগ্য।
আমার রহস্য তৈরি করে বলবার ইচ্ছা নেই যে লেখালেখি সম্পর্কে কথা বলা অসম্ভব বা সাহিত্য সমালোচনা একটি আত্মবিভ্রম। সাহিত্য সমালোচনা শুধু রচনা নয় সেইসব ধারণা সম্পর্কেও আমাদের অবহিত করে যা রচনাকে অতিক্রম করে যায়। কিন্তু আমি যে পঞ্জির কথা বলছি, তা একজন লেখক বা লেখিকা সমালোচনা থেকে পায় বলে মনে হয় না। তা আসে অন্যান্য উৎস থেকে যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে পাঠ।

জানজিবারে আমি যে স্কুলশিক্ষা পেয়েছিলাম তা ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশিক শিক্ষা যদিও উপনিবেশিকতার শেষ পর্যায়ে জানজিবার কিছুদিনের জন্য স্বাধীন এমনকি একটি বিপ্লবী রাষ্ট্রও ছিল। এটা হয়ত ঠিক যে অধিকাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যা শেখে এবং যে জ্ঞান সঞ্চয় করে তা তারা স্কুলজীবনে অর্থবহ মনে করে না, অথবা প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাসঙ্গিক মনে করে। আমার মনে হয়, আমাদের কাছে সেই শিক্ষা ছিল আরো গোলমেলে। আমরা যা শিখেছি তার অনেক কিছুরই আমরা ছিলাম আনুষঙ্গিক ভোক্তা, কারণ সেসব শিক্ষা উপকরণের লক্ষ্য ছিল অন্য কেউ। কিন্তু অন্য ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে যেমন, আমাদের ক্ষেত্রেও তেমনি সেই শিক্ষা থেকে ভাল কিছু বেরিয়ে এসেছে। এই শিক্ষাপদ্ধতি থেকে আমি অনেকে মূল্যবান জিনিসই শিখেছি, তবে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হল ব্রিটিশরা পৃথিবীকে কিভাবে দেখে এবং আমাকে কিভাবে দেখে। এক বারে তা শিখি নি; শিখেছি সময়ের সাথে সাথে পিছন ফিরে দেখে এবং অন্যান্য শিক্ষার আলোকে। কিন্তু সেটাই একমাত্র জিনিস নয় যা আমি শিখছিলাম। আমি শিখছিলাম মসজিদ থেকে, কোরান শিক্ষার স্কুল থেকে, রাস্তা থেকে, বাড়ি থেকে এবং আমার এলোমেলো পাঠ থেকে। এইসব উৎস থেকে আমি যা শিখছিলাম তা ছিল আমার স্কুলশিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত। এটি যতখানি অসহযোগী শোনাচ্ছে ততখানি ছিল না, যদিও কখনো কখনো ছিল বেদনাদায়ক এবং মানহানিকর। কালক্রমে এইসব পরস্পরবিরোধী বিষয় নিয়ে বোঝাপড়া করাটা গতিশীল প্রক্রিয়া বলে মনে হয়, যদিও বৈশিষ্ট্য বিচারে এটি একটি প্রক্রিয়া যা আমরা শুরু করি আমাদের অবস্থানের দুর্বলতা থেকে। এর মধ্য থেকে তৈরি হয় অস্বীকার ও প্রত্যাখান করবার শক্তি ও দ্বিধা প্রকাশের শক্তি যা সময় ও জ্ঞান বহন করে চলে। এর মধ্য থেকে তৈরি হয় সমঝোতা করবার এবং ভিন্নতা গণ্য করবার পথ, তৈরি হয় জানবার আরো জটিল উপায়ের সম্ভাবনা নিশ্চিত করার পথ।

সুতরাং যখন আমি লিখতে শুরু করি, তখন আমি নিজেকে জনতার মধ্যে ঠেলে দিতে পারি নি। আমি আশা করতে পারি নি যে ভাগ্য ও সময় ভাল হলে আমার কন্ঠস্বর সবাই শুনতে পাবে। আমি এই ধারণা নিয়ে লিখতে শুরু করি যে কিছু সম্ভাবানাময় পাঠকের আমাকে দেখার উপায় জানা আছে। আমি জানতাম আমি নিজেকে এমন কিছু পাঠকের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করব যারা নিজেদের মনে করে আদর্শিক, যারা সংস্কৃতি বা জাতিত্ত¡ থেকে মুক্ত, ভিন্নতা থেকে মুক্ত। আমি নিশ্চিত ছিলাম না ঠিক কতটুকু বলা যাবে, কতখানি জ্ঞান আমি ধারণ করব, অথবা তা যদি না করি তাহলে আমার লেখা কতখানি বোধগম্য হবে। আমি জানতাম না কিভাবে এই সবকিছু করা যায় এবং গল্প উপন্যাস লেখা যায়ও
অবশ্যই এই অভিজ্ঞতা আমার একার নয় যদিও তার খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামালে মনে হয় তা আমার একার। বলা যেতে পারে আমি যে ভাবে সে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছি তাতে সেটা এমন কি সা¤প্রতিক বা বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা নয় বরং তা সব রচনার বৈশিষ্ট্য; লেখালেখি শুরু হয় প্রান্তিুকতা ও ভিন্নতা সম্পর্কে আত্মোপলব্ধি থেকে। সেই অর্থে আমি যে প্রশ্নগুলি উত্থাপন করছি সেগুলি কোনো নতুন প্রশ্ন নয়। তবে নতুন না হলেও তারা সাম্রাজ্যবাদ, স্থানান্তর ও আমাদের সময়ের বাস্তবতা দ্বারা দৃঢ়ভাবে আনমিত। আমাদের সময়ের অন্যতম বাস্তবতা হল অসংখ্য আগন্তুকের ইউরোপে স্থানান্তর। সুতরাং এই প্রশ্নগুলি শুধুমাত্র আমার উদ্বেগ নয়। যখন আমি এসব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছিলাম তখন অন্য অনেক আগন্তুক ইউরোপে এই সমস্যাগুলি নিয়ে কাজ করছিল একযোগে এবং বিশাল সাফল্যের সাথে। তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য হল যে এই বিষয় সম্পর্কে এবং কিভাবে এই বিষয় স্থানান্তরিত ও ভাষান্তরিত হয় সে সম্পর্কে আামদের আগের চেয়ে সুক্ষ ও মার্জিত ধারণা তৈরি হয়েছে। এই ধারণা অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য করেছে পৃথিবীকে, ছোট করে এনেছে পৃথিবীকে।
অনুবাদঃ রাশেদ নবী, অটোয়া, কানাডা