অনার্য নাঈম

কবিতার বই: শিশিরের বুকে শিস দিয়ে
কবি: আলমগীর খান
প্রকাশক: প্রকৃতি, কাঁটাবন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯
মূল্য: ১২০ টাকা

‘‘অন্যায় যখন নিয়ম হয়ে যায়, প্রতিরোধ তখন কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।” চে গুয়েভারার এই মহান বাণীর আবির্ভাব হয় বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। যখন ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’ তখন কাঙালগণের তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াইয়ে নামাটা অপরিহার্য। এই অপরিহার্য লড়াই পরিণত রূপ পেতে অনেক সময় ব্যয় হয়। হয়তো সময়টা প্রস্তুতির। এই সময়ে কবি আলমগীর খান সর্বহারাদের হৃদয়ে রসদ যুগিয়েছেন তার কবিতার মধ্য দিয়ে। ‘শিশিরের বুকে শিস দিয়ে’ বন্দুক হাতে হেঁটে গেছেন বাংলার মাঠে ঘাঠে ঢেউয়ে। যার কবিতার প্রতিটি শব্দ রূপান্তরিত হতে থাকে বুলেটে। ‘যার যার বাঁশি ও বন্দুক’-এর পর ‘শিশিরের বুকে শিস দিয়ে’ কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। কাব্যগ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে ৪০টি কবিতা। প্রতিটি কবিতা যেন স্বাধীন বাংলার এক নির্ভীক কণ্ঠস্বর। নিজ দেশের ক্ষতগুলো উন্মুক্ত করেছেন জনসমক্ষে। এই গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘অবৈধ সম্পাদকীয়’তে তিনি ঘোষণা করেছেন-

‘এখন মাদক আর অবৈধ ব্যবসার জয়জয়কার
আমিও বাপের হোটেলে খেয়েপরে বহুদিন বেকার থেকে
এখন মোক্ষম এক অবৈধ ব্যবসায় নেমে পড়েছি
কবিতা লিখছি আর ছাপায়ে গোপনে বিলি করছি নষ্ট পাড়ায়।’
এইসব সামাজিক হাহাকার ঢুকে পড়েছে রাষ্ট্রীয় মগজে। রাষ্ট্রীয় মাথাগুলো গোপনে গোপনে ফুলেফেঁপে মোটা হচ্ছে। তারা টাকার থলিতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকে। আমরা তাদের এই ঘুম ভাঙাতে পারি না। আমাদের মগজে হেঁটে বেড়ায় বেকারত্বের ঘুণপোকা, মাদকের উদ্ভট গন্ধ আমাদের পথ দেখায়, আমরা অন্ধকারে চাষ করি অর্থকরী ফসল। আমাদের বুদ্ধিজীবীর মগজও রাষ্ট্রীয় মগজের সাথে একীভূত হয়ে গেছে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক এজেন্ডা পালনে তারা বদ্ধপরিকর। ফলে আমাদের কবিতাগুলো আর কবিতা হয়ে উঠছে না। আমরা সাহিত্য সম্পাদকের কাছে হয়ে উঠছি ব্যবসার পণ্য বা খেলার পুতুল। আমাদের কবিতাগুলো গোপনে গোপনে ছড়িয়ে পড়ে নষ্টপাড়ায়। এই রাষ্ট্র আমার কবিতার নিরাপত্তা দেয় না, আমার নিজের নিরাপত্তা দেয় না, আমাদের মেয়েদের নিরাপদে পথ চলার নিরাপত্তা দেয় না-

‘ইশকুল কত দূর? নাকি পোশাক ফ্যাক্টরি যাবে তুমি
থামবে না পথে এবং তাকাবে না কোনদিকে
আচার বা আইসক্রিম কিছুই খাবে না।
তোমাকে ছিঁড়ে খেতে কত শত শকুন আর হায়েনা
ওত পেতে বসে আছে আকাশের মোড়ে মোড়ে
পুঁজিপতি সন্ত্রাসি ডাকাত ধার্মিক পুলিশ
মেতে আছে যার যার ফন্দি ও ফিকিরে
এক জোট হয়ে তোমার বিরুদ্ধে।’
(ভালো থেকো প্রিয় চাঁদ)

এটা আমাদের দেশের নারী সমাজের অনিরাপত্তার চিত্র। আমাদের মেয়েরা যেন বাস করে বাংলাদেশ নামক একটি জঙ্গলে। শত শত ধর্ষণ, নিপীড়ন আমাদের মুখ বুজে সয়ে যেতে হয়। আমরা অসহায় হয়ে উঠি চোর ডাকাত পুলিশের কাছে। শুধু নারী সমাজ নয়, পুরুষ সমাজেরও একই চিত্র। রাজনৈতিক মতবিরোধ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রেই আমাদের বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে, সুচিন্তিত মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়েছে, ফলে বেড়ে গেছে আভ্যন্তরীণ হত্যকাণ্ড। কবি আলমগীর খান স্পষ্ট করে বলেছেন-

‘স্বৈরাচারী চাঁদের কবলে শান্তিপ্রিয় আকাশ
মেঘেরা পালাচ্ছে ভয়ে এদিক ওদিক
দুয়েকটা নক্ষত্রের লাশ পড়ছে স্টেশনে রাস্তায় ও পার্কে
…. …..
যদি চাঁদ হয়ে ওঠে স্বৈরাচারী
দিন ও রাত্রির মধ্যে ফারাক থাকে না
পাপ ও পুণ্যের ভেদ মুছে যায়’
(চাঁদের কবলে)

তবে কি আমরা স্বৈরাচারী চাঁদের কবলে? কেন? জোছনাতে কেন সমঅধিকার নেই? প্রতিটি বৃক্ষের অন্তরালে দুর্নীতিবাজের ছায়া। আমরা দেখেও না দেখার ভাণ করি, কিন্তু কবি দেখেন। তিনি না দেখার ভাণ করে থাকেন না, আমাদের চোখের মধ্যে আঙুল ঢুিকয়ে আমাদেরকে বলেন-

‘বেশ্যা করেীছ প্রিয় নদীরে, নারীকে তুলেছি হাটে/ আস্তিক আমি বিপ্লবী আমি উত্তরাধুনিক ষাটে’। হ্যাঁ তাইতো আমরা পাবলিক প্লেসে বড় বড় বুলি আওড়াই আর গোপনে গোপনে ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখি স্বৈরনীতি।”
কবি আলমগীর খান একজন স্বদেশ সচেতন কবি। স্বদেশের অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত তাকে ঘুমাতে দেয় না। তিনি বুঝতে পারেন এই অন্ধকার প্রকৃত রাতের অন্ধকার নয়, তাইতো তিনি জেগে ওঠেন, আমাদেরকেও জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। আমরা এইসব অন্ধকারকে প্রকৃত অন্ধকার থেকে আলাদা করতে পারি না, আমরা ঘুমিয়ে থাকি, যুগের পর যুগ আমরা ঘুমিয়ে থাকি। অনাগত ঘুমন্ত শিশুদের উদ্দেশে তার অশাহত বাণী ‘যারা মাতৃগর্ভে ঘুমুচ্ছো, ঘুমাও’।

‘এখনও যারা মাতৃগর্ভে ঘুমুচ্ছো, ঘুমাও
প্রিয় ভূমি ছেড়ে এখানে এসো না
যেখানে দাঁতাল হায়েনারা কংক্রিটারণ্যে ঘুরে বেড়ায়
শহরারণ্যের বাঘ দেখে আফ্রিকার চিতা লজ্জাবনত।’
(যারা মাতৃগর্ভে ঘুমুচ্ছো, ঘুমাও)
বর্তমান বিশ্বায়নের কালে পৃথিবীময় এক অস্থিরতা। ক্রমান্বয়ে তা বাড়ছে। আগুন জ¦লছে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে। আমরা নিজেদের আর বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমায় আটকে রাখতে পারছি না। আমাদের চিন্তার সীমা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রসারিত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদের কালো থাবা আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে দ্রুত গতিতে। কবি তার কবিতার মাধ্যমে আমাদেরকে সেদিকের পরিকল্পনা সম্পর্কেও সচেতন করিয়ে দেন-
‘ট্রাম্পের মদিরতায় রাধা পৃথিবী পুড়ছে
প্যারিসের জলবায়ু চুক্তি ধুলায় উড়ছে।
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, মসনদে
যদি তাহারাই রয়, দুঃখ পদে পদে।’
(অঙ্গারাদি)

আলমগীর খানের সবগুলো কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে বোমা ও বুলেট। তিনি আমাদের রসদ যুগিয়েছেন নিজেদের মুক্তির। তিনি আমাদের খোরাক যুগিয়েছেন মুক্তচিন্তার। তিনি কবিতার মধ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছেন, বলেছেন আমাদের স্বাধীনতা, সামাজিক নিরাপত্তা, দুঃশাসন, অব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত ইত্যাদি নিয়ে। তিনি আরো স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক চক্রান্তের দুষ্টচক্রের কথা।
হয়তো আমরা একদিন সকলেই ঋণী হয়ে যাবো তার কবিতার কাছে। কবি হৃদয়ের ভাব অনুবাদ হয়ে পৌঁছে যাবে দরজায় দরজায়। হয়তো আমরা একদিন স্বাধীনভাবে তারই মত বলে উঠবো: ‘আমাদের প্রেম হোক/ বাসর হোক/ সন্তান হোক/ সেইভাবে, যেইভাবে/ কানে কানে কথা হয় নির্যাতিত মানুষের/ দিনে দিনে সে মানুষ জড়ো হয়/ এখানে ওখানে নদীতে প্রান্তরে বনে/ চেতনা হাতবদল হতে থাকে/ নিবিড় আঁধারে বিড়ির আগুনের মতো’
অনার্য নাঈম: কবি ও সমালোচক