কামাল কাদের : সময়টা বিংশ শতাব্দীর ষাট দশকের শেষের দিকে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় মাতাল পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান তখন সারা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। উত্তর বঙ্গের যশোর শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে খ্র্রিষ্টান মিশনারীদের পরিচালনায় একটি হাসপাতাল। নাম তার নর্থ বেঙ্গল দাতব্য চিকিৎসালয়। মার্কিন নাগরিক ফাদার মার্টিন ওই হাসপাতালের পরিচালক। হাসপাতালের অধিকাংশ স্টাফ বাঙালি খ্রিস্টান এবং হিন্দু ধর্মালম্বী। আমেরিকার খ্রিস্টানদের দানে হাসপাতালটির খরচ পত্র চলে। মাঝে সাঝে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অনুদানও পেয়ে থাকে। ৪০ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালটির বেশির ভাগ রোগী সন্তান সম্ভাবনা মায়েদের জন্য। হাসপাতালটি মফস্বল শহরে হলেও সুচিকিৎসার জন্য বেশ নাম ডাক। যশোর জেলার এবং আশে পাশের জনসাধারণের মাঝে বিশেষ করে দরিদ্র মায়েদের জন্য এ যেন হাতের কাছে স্বর্গ পাওয়া।

বর্ষা কালে এক সন্ধ্যায় খুলনা জেলার এক তরুণ শিল্পপতি মিস্টার ফিরোজ আলম তার শশুর বাড়ি যশোর শহরের দিকে নিজেই ড্রাইভ করে যাচ্ছিলেন। সাথে তার সন্তান সম্ভাবনা সুন্দরী স্ত্রী মিসেস নাদিয়া আলম। তিনি প্রায় ছয় মাসের অন্তঃসত্ত¡া। এটাই হবে তাদের প্রথম সন্তান। মিস্টার আলম কিছুক্ষণ ড্রাইভিং করার পর আকাশ মেঘে ছেঁয়ে গেলো। তারপর শুরু হলো প্রবল বেগে বৃষ্টি। রাস্তার চারিদিকে অন্ধকারে একাকার। সামনের কিছুই ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না।

গাড়ির হেডলাইটের আলোয় একমাত্র ভরসা। পথের দু পাশে শুধু ক্ষেত আর ক্ষেত। আশে পাশে কোথায়ও কোনো বাড়ি ঘর বা দোকান পাট নজরে পড়ছে না। গাড়ির wiper চলা সত্তে¡ও খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না। এই রকম অবস্থায় মিস্টার আলম একটু নার্ভাস হয়ে গাড়ি ড্রাইভিং করছেন।

যশোর সিটি সেন্টার আর বেশি দূরে নয়, সামনেই সেই মিশনারী হাসপাতালটি দেখা যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ মিস্টার আলম ড্রাইভিং করলে যশোর সিটি সেন্টারের কাছে চলে আসবেন। কিন্তু এরই মধ্যে অঘটনটি ঘটে গেলো। মিস্টার আলম হাসপাতালের মোড় কাটিয়ে যাবার সময় গাড়ির তাল সামলাতে না পেরে হাসপাতালের গেটের দেয়ালে ধাক্কা লাগিয়ে দিলেন। এদিকে মিসেস আলম এই আচমকা ধাক্কা সামলাতে না পেরে ড্যাশবোর্ডের সাথে উনার মাথাটা প্রচন্ড ধাক্কা খেলো, আর পরক্ষণেই তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। মিস্টার আলমও গাড়ির স্টিয়ারিং এ ধাক্কায় কপালের এক পাশে আঘাত পেলেন। তবে উনার আঘাত এতটা গুরুতর নয়। তিনি কোনোমতে গাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা হাসপাতালের রিসেপশনের দিকে ছুটলেন চিকিৎসার আশায়। হাসপাতালের কর্তব্যরত রিসেপশনিস্ট ব্যাপারখানা সঙ্গে সঙ্গে এমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টে ফোন করলেন। তড়িৎ গতিতে A & E ডাক্তার উৎ রবিন গুপ্ত তার সহকারী নার্স সিস্টার হেলেন মিত্রকে সাথে নিয়ে দুর্ঘটনার দিকে ছুটে গেলেন। অভিজ্ঞ নার্স সিস্টার মিত্র সাথে করে হাসপাতালের “ট্রলিটি” নিতে ভুললেন না। ডাক্তার গুপ্ত মিসেস আলমের শোচনীয় অবস্থা দেখে, আর দেরী না করে সোজা অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেন। কারণ মায়ের পেটের বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হবে। তাছাড়া মিসেস আলমের ও জরুরি চিকিৎসার দরকার। উনার ডান পা এবং ডান হাতখানা ভেঙে গেছে। সার্জন ডাক্তার সমীর গুহকে ডাকা হলো অপেরেশনের জন্য। ডাক্তার গুহ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে “সিজেরিয়ান” অপারেশন করে বাচ্চাটিকে এই পৃথিবীর আলো দেখাতে সক্ষম হলেন।

বাচ্চাটি অসময়ে হওয়াতে তাকে “ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে” রাখা হলো, আর তার দেখা শুনার ভার পড়লো সিস্টার হেলেন মিত্রের উপর। এদিকে মিসেস আলমের ও অবস্থা ভালো না। যদিও উনার জ্ঞান ফিরে এসেছে, তবুও শারীরিক দিক থেকে উনি আশঙ্কা মুক্ত নন। উনার ভাঙা হাত-পা সারতে কত দিন লাগবে কে জানে?

দেখতে দেখতে মিসেস আলম এবং বাচ্চাটির হাসপাতালে থাকার মাস খানিকের উপর হয়ে গেলো। সিস্টার মিত্রের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সেবায় বাচ্চাটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলো। অবশেষে তাদের বাসায় ফেরার দিন ক্ষণ ঠিক করা হলো। তবে শারীরিক দিক থেকে মিসেস আলম এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেননি। ক্রাচে করে হাঁটতে হচ্ছে, অর্থাৎ কোনোমতে নিজেকে চালিয়ে নিতে পারছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই অবস্থায় ছোট বাচ্চাটিকে সামলাবেন কি করে? মিস্টার আলম সমস্ত ব্যাপারখানা জানিয়ে ফাদার মার্টিনকে অনুরোধ করলেন যে, উনার স্ত্রীর এই শারীরিক প্রতিবন্দকতায় তাদের বাসায় কয়েক মাসের জন্য অর্থাৎ মিসেস আলম সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত উনারা কোনো নার্স দিয়ে সহযোগিতা করতে পারবেন কিনা। ঠিক সেই মুহূর্তে ফাদার মার্টিনের যে নার্সটির কথা মনে পড়লো সে হলো সিস্টার মিত্র। ফাদার মার্টিন মিস্টার আলমকে জানালেন, “আমি এ ব্যাপারে সিস্টার মিত্রর সাথে আলাপ করে জানাবো”। ফাদার মার্টিনের প্রস্তাবটা শুনে সিস্টার মিত্র কথাটি লুফে নিলেন। কারণটা হলো এতটুকু বাচ্চাকে দেখা শুনা করতে করতে সিস্টার মিত্রের কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিলো। একদিন যথাসময়ে মিস্টার এবং মিসেস আলম বাচ্চাটিকে তাদের নিজের বাসায় নিয়ে আসলেন, সাথে সিস্টার মিত্রও যোগ দিলেন।

চিরাচিতভাবে সময় বয়ে যেতে লাগলো। ধীরে ধীরে মিস্টার এবং মিসেস আলমের জীবনধারা স্বাভাবিক হতে চললো, তার সাথে সিস্টার মিত্রের হাসপাতালে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে এলো। আলম পরিবার সিস্টার মিত্রের সেবা -যত্নে অত্যন্ত খুশি এবং কৃতজ্ঞ, বিশেষ করে ছোট বাচ্চাটিকে মিস মিত্র যে ভাবে দেখা- শুনা করেছেন সে জন্য। বিদায় বেলায় তাদের সবাইকে নিয়ে গ্রুপ ছবি তোলা হলো। দুপাশে গর্বিত বাবা-মা দাঁড়ানো, আর বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বসা সিস্টার মিত্র। সিস্টার মিত্রের সেবা যত্নে মিসেস আলম এতই খুশি যে, তাকে একটা দামী উপহার দিলেন, তারপর বললেন, “তুমিতো আমার ছোট বোনের মতো, বলো আর কি পেলে তুমি খুশি হবে! আমরা তোমাকে আজীবন মনে রাখবো”। “আমার তো আর কোনো কিছুর প্রয়জন নেই, আপনারা আমাকে ভালোবেসে সময়ে অসময়ে অনেক কিছুই দিয়েছেন, আপনাদেরকে সেবা করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি”। “তবুও বলো, তোমার যদি বিশেষ কোনো জিনিস মনে চায়, তাহলে বলো আমরা তা দিতে চেষ্টা করবো”। “এতো করে যখন বলছেন, তবে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?” “নিশ্চয়! কি সে অনুরোধ?” আপনার ছেলেকে অবশ্যই আপনাদের মনের মত নাম রাখবেন, শুধু ওর ডাক নামটা যদি ‘বিজয়’ রাখেন তাহলে আমি ধন্য হবো, সে যেন জীবনে সব কাজে বিজয়ী হয়ে আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করে।

“ঠিক তাই হবে, আজ থেকেই আমাদের ছেলেকে আমরা ‘বিজয়’ বলে ডাকবো”, মিসেস আলম খুশি হয়ে জানালেন।

ক্রমে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা চরম বিপর্যয়ের দিকে রূপ নিলো। মুক্তি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। প্রথম থেকেই পাক সেনাদের অমুসলিম বাঙালি স¤প্রদায়ের উপর আক্রোশ ছিল। আর সেটা দিনের পর দিন বেড়েই চললো। এক পর্যায়ে তারা সেই মিশনারি হাসপাতালে হামলা চালালো। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স এবং অন্যাণ্য স্টাফরা কে কোথায় ছিটকে পড়লো, কেউ জানলো না।

কতজন মারা গেলো, কতজন পালতে পারলো সে হিসাব অজানা রয়ে গেলো। হঠাৎ করে যেন সব কিছু হারিয়ে গেলো। এক নিমেষে হাসপাতালটি ভুতুড়ে বাড়িতে পরিনিত হলো।
দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ প্রায় চল্লিশ বছর হলো। ডাক্তার জাভেদ আলম ওরফে বিজয় আজ বাংলাদেশের স্বনামধন্য হৃদরোগ বিশেজ্ঞ। বিলাত থেকে এম,আর,সি,পি, করে এসেছেন। এক নামে সবাই তাকে চেনেন। পৃথিবীর মেডিকেল জার্নালে তার সুচিন্তিত লেখা বিজ্ঞ মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মোটকথা সে ডাক্তারী বিদ্যায় প্রচুর কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছেন। হর হামেশা তাকে দেশের বাইরে নানা সেমিনার, কন্ফারেন্সে সাদর আহব্বান করা হয়। এমনি এক সেমিনারে দিল্লীতে তাকে আমন্ত্রণ করা হলো। দিল্লী যাবার পথে তাকে কোলকাতায় একদিনের জন্য থাকতে হবে, বাংলাদেশ হাই কমিশনে কিছু জরুরী কাজ সারার জন্য। সে বাংলাদেশ বিমানে করে কলকাতায় পৌঁছালো। হাই কমিশনে কাজগুলি শেষ করে রাত্রিটা একটা হোটেল কাটিয়ে দিলেন। পরদিন সকালে “জেট এয়ার ওয়েজের” প্লেনে দিল্লীর পথে রওয়ানা দিলেন। প্রায় ঘন্টা দেড়েক বিমানটি আকাশে উড়ার পর বিমানের ককপিট থেকে আচমকা মেয়েলি কণ্ঠে প্রথমে হিন্দীতে এবং পরে ইংরেজীতে ঘোষণা করা হলো, “যাত্রীদের মাঝে কোনো ডাক্তার আছেন কিনা? এই মুহূর্তে একজন বৃদ্ধা যাত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন, বোধয় ‘হার্ট এটাক’ হয়েছে”, বিষয়টি জরুরী মনে করে শীঘ্র আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন”।

ঘোষণা শুনা মাত্রই ডাক্তার জাভেদ আলম ওরফে বিজয় তার প্রথম শ্রেণী কেবিন থেকে দ্রূত ককপিটের দিকে ছুটে গেলেন এবং এয়ার হোস্টেসকে বললেন, “আমি একজন ডাক্তার, বলুন রোগী কোথায়!” এয়ার হোস্টেস ডাক্তার জাভেদকে রোগীর কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার জাভেদ রোগীর নাড়ী পরীক্ষা করে দেখলেন, রোগীর নাড়ী অত্যন্ত দুর্বল, এও নিশ্চিত হলেন যে রোগীর হার্ট এটাক হয়েছে।

তিরিশ হাজার ফিট আকাশের উপরে অতি সীমাবদ্ধতায় রোগীর চিকিৎসা পুরোদমে চললো। অবশেষে আস্তে আস্তে রোগীর জ্ঞান ফিরে আসলো। রোগী চোখ খুললেন, আর দেখতে পেলেন তার সামনে দেবদূতের মত এক সুদর্শন যুবক মায়াবী চোখে তার দিকে চেয়ে আছেন। ডাক্তার জাভেদ ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “ম্যাডাম, আপনি এখন কেমন ফিল করছেন”?
রোগী ইংরেজিতেই ছোট্ট করে উত্তর দিলেন, “ভালো”।

সময়মত বিমানটি দিল্লীর “ইন্দিরা গান্ধী” এয়ারপোর্টে অবতরণ করলো এবং সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ইতোমধ্যেই রোগীর নিকটস্থ আত্মীয় যারা অভ্যর্থনা করতে এসেছিলো তাদেরকে ঘটনাটি জানিয়ে দেয়া হলো। রোগীর আত্মীয় বলতে মেয়ে এবং মেয়ের জামাই যথাসময়ে হাসপাতালে উপস্থিত হলেন। এদিকে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর্যন্ত ডাক্তার জাভেদ রোগীর সাথেই ছিলেন রোগীর আনুসাঙ্গিক “ব্রিফ” করার জন্য। রোগীর মেয়ে যখন জানতে পারলেন যে ডাক্তার জাভেদের অশেষ চেষ্টায় তার মা নুতন জীবন ফিরে পেয়েছেন ,তখন ডাক্তার জাভেদের কাছে যেয়ে তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তাদের মাঝে কথোপকথনের মাধ্যমে ডাক্তার জাভেদ অবগত হলেন যে, রোগী মিসেস বাগচী এবং তার পরিবারের সবাই বাঙালি। মিসেস বাগচী কয়েক সপ্তাহের জন্য তার ছোট মেয়ের কাছে কোলকাতায় বেড়াতে গিয়েছিলেন, বেড়ানো শেষ করে বড় মেয়ের কাছে দিল্লীতে ফিরছিলেন।

মিসেস বাগচী দিল্লীতে বড় মেয়ের কাছে স্থায়ী ভাবে থাকেন। ফেরার পথে এই বিড়ম্বনা।
মিসেস বাগচীর মেয়ে আরতি রায়, দিল্লী য়ুনিভার্সিটির বাংলা এবং সংস্কৃতির অধ্যাপক, আর জামাতা মিস্টার অরুন রায় একই য়ুনিভার্সিটির গণিতের অধ্যাপক। মিসেস রায় কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ডাক্তার জাভেদকে তাদের বাসায় ডিনারের নিমন্ত্রণ করলেন। কিন্তু সময়ের অভাবে ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও তাদের এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে ডাক্তার জাভেদ তার অপরাগতা জানিয়ে বললেন, “আমি বাংলাদেশ থেকে এক সপ্তাহের জন্য দিল্লীতে একটা সেমিনারে এসেছি, সিডিউল একদম টাইট, আমাকে সব সময়ে ব্যস্ততার মাঝে থাকতে হবে”। মিসেস রায় যখন জানতে পারলেন যে, ডাক্তার জাভেদ বাঙালি, তখন ডাক্তার জাভেদ আর যায় কোথায়! এবার মিসেস রায় নাছোড়বান্দা হয়ে বললেন, “ডাক্তার জাভেদ আপনাকে আমাদের বাসায় আসতেই হবে, আপনার এই ফর্সা, লম্বা ফিগার দেখে আমরা ভাবছিলাম আপনি অবাঙালি”।
নিরুপায় হয়ে ডাক্তার জাভেদ বললেন, “এতো করে যখন বলছেন তখন সামনের রোববারের বিকেলে আপনাদের বাসায় চা খেতে আসবো, তবে বেশি সময় দিতে পারবো না, কারণটা তো কিছুক্ষণ আগেই বললাম”। “ঠিক আছে, তবে তাই হবে”, মিসেস রায় সম্মতি দিলেন। পূর্বের কথা মত মিস্টার রায় তার গাড়ি করে রোববার দিন বিকেলে হোটেল থেকে ডাক্তার জাভেদকে তাদের বাসায় নিয়ে আসলেন।

পড়ন্ত বেলা, শেষ বিকেলের রোদ। আবহাওয়াটা বেশ মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। মিস্টার রায় ডাক্তার জাভেদকে ড্রয়ইং রুমে বসতে বলে ভিতরের ঘরে চলে গেলেন। ডাক্তার জাভেদ আড় চোখে ড্রয়ইং রুমের চারিদিকটা তাকিয়ে নিলেন। নিপুন করে ঘরটি সাজানো। এক কোনে টেবিলের উপর সারি সারি বই -পত্র। অন্য এক দিকে দেয়ালের সাথে ঠেকানো একটা তানপুরা, তার পাশেই নানা রকম বাদ্য-যন্ত্র। দেয়ালের উপরে দিকে ফ্রেমে আটানো নানা রকম ছবি। প্রায় সব ছবিগুলি রঙিন এবং তার মধ্যে কিছু সাদা কালো ছবিও রয়েছে। ডাক্তার জাভেদ একটা সাদা কালো ছবি দেখে স্থম্বিত হয়ে গেলেন। এ কেমন করে হয়! সে কি স্বপ্ন দেখছেন?
অবিকল এ রকম একটা ছবি আজও তাদের বাসায় টাঙানো আছে। ছবিটা দেখে তার মনে নানা প্রসন্ন জেগে উঠলো। এরই মাঝে মিসেস বাগচী একটা ট্রেতে করে চা আর কিছু হালকা খাবার নিয়ে এলেন। ট্রেটি টেবিলের একপাশে রেখে মিসেস বাগচী ডাক্তার জাভেদকে জিজ্ঞাসা করলেন, “অমন হাঁ করে ছবিটির দিকে তাকিয়ে কি দেখছেন?” ডাক্তার জাভেদ মিসেস বাগচীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “আপনি এ ছবিটি কোথায় পেয়েছেন?” মিসেস বাগচী একটু আহত সুরে বললেন, “এ ছবিটির মাঝে আমার অনেক সুখ-দুঃখ জড়িয়ে আছে”। “আপনি অনুগ্রহ করে বলুন, আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে,” ডাক্তার জাভেদের আকুল অনুরোধ। পরোক্ষণই মিসেস বাগচী শুরু করলেন তার হারানো অতীত জীবনের কাহিনী।

“আমি অরিজিনালি বাংলাদেশের যশোর জেলার মেয়ে। আমার মেয়েরা কোলকাতায় জন্মেছে। ওই যে ছবিটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন,চেয়ারে বসা মেয়েটি আমি নার্স হেলেন মিত্র। আমার দুপাশে দাঁড়িয়ে বাচ্চাটির মা আর বাবা, খুলনা শহরের বিরাট শিল্পপতী মিস্টার এবং মিসেস আলম। বাচ্চাটির নাম আমি রেখেছিলাম ‘বিজয়’। পরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে আমার পরবর্তী জীবন তছ-নছ হয়ে গেলো। বাংলাদশে তখন মুক্তি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমাদের হাসপাতালটি পাক বাহিনীর হামলার শিকার হলো। আমরা মানে হাসপাতালের স্টাফরা প্রাণের ভয়ে যে যেদিকে পারলাম পালিয়ে গেলাম। এরই মধ্যে অনেকের মৃত্যুও হলো। তারপর আমি ,,,,,,

মিসেস বাগচীকে আর কিছু বলার অপেক্ষা না রেখে ডাক্তার জাভেদ মিসেস বাগচীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, “আমিই তোমার কোলের বাচ্চাটি ‘বিজয়’, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তোমাকে আমরা কত যে খুঁজেছি, কিন্তু কোথায়ও পেলাম না। তুমি যে আমার সেই হারিয়ে যাওয়া ‘মা’। পরক্ষণেই বিজয়ের দু চোখের জল টপ টপ করে মিসেস বাগচীর কপালে ঝরে পড়ছে, আর তারি সাথে সাথে মিসেস বাগচীর চোখের তপ্ত অশ্রæতে বিজয়ে জামার বুকের দিকটা ভিজে চলছে। ঠিক ওই সময়ে পশ্চিম গগনের শেষ বিকেলের সূর্যের রস্মি ফ্ল্যাটের জানালার শার্শি ভেদ করে তাদের দু জনের মুখের উপর উপচে পড়ছে, মনে হচ্ছে যেন কোনো এক স্বর্গীয় আভা আজ দুটো জীবনে অফুরন্ত সুখ বিলিয়ে দিচ্ছে। শেষ
email :– quadersheikh@gmail,com