শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

ভিক্টোরিয়া একটি ভীষন মজার চরিত্র। পৃথিবীর কোন কিছুই তার পছন্দ নয়, কাউকে তার ভাল লাগে না, কেউ কিছু পারে না, সবাই তার কাছে খারাপ কারণ ওর মনে হয় কেউ ওকে পছন্দ করে না। ভিক্টোরিইয়ার স্বামী ছিলেন একজন মিনিস্টার, তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান যখন ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করে তখন ছেলের বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর এবং মিনিস্টার সাহেব চলে গিয়েছিলেন ছেলে প্রয়াণের ঠিক ২ বছর বাদেই হার্ট এটাকে। অর্ধেকটা জীবন ভিক্টোরিয়া পার করেছে একা একা। ভিক্টোরিয়া আর্থিকভাবে ভীষন সচ্ছল। সে আবার কেন বিয়ে করে সংসার করেনি সেই গল্প বলার মত কেউ ওর জীবনে নেই। ভিক্টোরিয়ার জীবনে আত্মীয় স্বজন বলতে কেউ নেই, তার আত্মীয়রা হল ডাক্তার, নার্স, সেন্ট মাইকেলস হসপিটালের সব কর্মীবৃন্দ আর এখন আমরা। কারো সাথে ভিক্টোরিয়ার বনে না, সে সব সময় সবার খুঁত ধরাতে ব্যাস্ত, আর এই কারণে তার নিজের সহ হোমের সবার জীবনও অতিষ্টপ্রায়। হঠাত একদিন সকালে নার্স তাকে আবিষ্কার করল সে মেঝেতে বসে আছে, নার্স দৌড়ে গেল তাকে তুলবার জন্য কিন্তু ভিক্টোরিয়া কিছুতেই উঠবে না, বোঝা গেল সে প্রায় সারারাতই মাটিতে বসে ছিল। তার সাথে কথা বলবার জন্য একে একে সবাই গেল কিন্তু সে কিছুতেই উঠবে না। সবাই মহা বিপদে পড়ল, কি করবে বুঝতে পারছে না।

ভিক্টোরিয়ার ২০ বছরের ফ্যামিলি ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা হল, সে বলল এমন ঘটনা আরো অনেক বার ঘটেছে এবং ভিন্ন ভিন্ন কারণে সে ঠিক এই ভাবেই সারাদিন মেঝেতে বসে থেকে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবে তাকে তুলবার জন্য একটাই ম্যাজিক কাজ করে সেটা হল তাকে বলতে হবে যে ৯১১ কল করছি। সে কিছুতেই ইমারজেন্সিতে যেতে চায় না। হসপিটালের সবাই যেহেতু তার এইসব ঘটনাগুলোর সাথে নিয়মিত ভাবে পরিচিত তাই সে ইমারজেন্সিতে গেলে তাকে কেউ খুব একটা পাত্তা দেয় না। খুব প্রাথমিক ভাবে তার ভাইটাল সাইনগুলো চেক করে দেখা হয় সব ঠিক আছে কিনা তারপরে তাকে করিডরে স্ট্রেচারে ফেলে রাখে ঘন্টার পর ঘন্টা, কেউ তার কথা শোনে না কারণ কারো সময় নেই ওর এই ছেলেমানুষীকে প্রশ্রয় দেবার জন্য আর এই ভয়ে ও ইমারজেন্সিতে যেতে চায় না। ভিক্টোরিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি এবং ওর এরিয়ার আর কোনো হেলথ কেয়ার এজেন্সী ওকে আর সার্ভিস দিতে চাইতো না বিধায় ভিক্টোরিয়াকে নার্সিংহোমে আসতে হয়েছে। নার্সিংহোমে আসবে না এই নিয়েও অনেক লম্বা ইতিহাস সে সৃস্টি করেছে, ওর ফ্যামিলি ডাক্তার ধীরে ধীরে ওকে বুঝিয়ে সব ব্যাবস্থা করেছে। হোমে আসার পরে ওর এই প্রথম “মেঝে ধর্মঘট” তাই শুরুতেই ৯১১ এর ভয় না দেখিয়ে আমরা বোঝার চেস্টা করছিলাম ওর এই ধর্মঘটের কারণ। সকাল থেকে তার ব্রিফ বদলানো হয়নি, সে কিছু খায়নি সব মিলিয়ে একটা হযবরল অবস্থা। অনেক সাধ্য সাধনার পরে জানা গেল গতকাল রাতে যে নার্স ওকে সার্ভিস দিয়েছিল তার ব্যাবহার নাকি ভাল ছিল না, সে নাকি খুব রূঢ় আচরণ করেছে ওর সাথে। ভিক্টোরিয়া কিছুতেই আর সেই নার্সের মুখ দেখতে চায় না এবং এটা নিশ্চিত হলেই সে উঠিবে এবং খাবে। এই প্রমিস হোমের পক্ষে করা সম্ভব নয় কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য তাকে বলা হল যে সেই নার্সের সাথে সিরিয়াসলি কথা বলা হবে এবং তাকে প্রয়োজনীয় শাস্তি দেয়া হবে, ভিক্টোরিয়া যেন ওকে আরেকবার সুযোগ দেয়। এই কথার পরে সে “মেঝে ধর্মঘট” ভেঙ্গে উঠতে রাজি হল। সবাই নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচল কিন্তু হোমে ক্রমশ তার নাম হয়ে গেল কুইন ভিক্টোরিয়া। আমি সত্যিকারে কুইন ভিক্টোরিয়ার কথা ভেবে মনে মনে হাসি আর বলি বলি- “বেচারা”।

মাসিমা হাসপাতালে গিয়েছে ৩ সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে আর ওঁর খবর নেবার জন্য জর্জ নিয়মিত যেত সেখানে এবং ফিরে এসেই দৌড়ে আসত আমার কাছে বিস্তারিত বলবার জন্য কারণ ও জানত যে আমার সাথে মাসিমার একটা অলিখিত সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে ঠিক যে টানে ও মাসিমাকে দেখতে যায়।

ডাক্তার কি বলেছে সেটা জর্জ বলতে পারে না কারণ ও ফ্যামিলি মেম্বার নয় বলে কনফিডেনশিয়ালিটির কারণে এসব তথ্য জর্জের সাথে আলাপ করে না ওরা। ওই খবরটুকুর জন্য আমি মাঝে মাঝে অরুণকে ফোন করে বিরিক্ত করি। আমি শুরুতেই সরি বলে নিয়েছি এবং বলেছি সে যেন বিরক্ত না হয়। অরুণ আমায় আশ্বস্ত করে বলেছে যে আমি যখন খুশি ফোন করতে পারি সে কিছুই মনে করবে না। মাসিমা এখন আর হাঁটাচলা করতে পারেন না, শিঘ্রই তাঁকে আবার হোমে পাঠানো হবে কারণ হসপটালের আর কিছু করার নেই, এখন শুধু মাসিমার কমফোর্ট প্রয়োজন এবং নার্সিংহোম যখন বুঝতে পারবে ওঁর সময় ঘনিয়ে এসেছে তখন মাসিমাকে Hospice এ পাঠিয়ে দেবে, Hospice হল এমন একটা জায়গা যেখানে মৃত্যু পূর্ববর্তী সেবা দেয়া হয়, যেখানে মৃত্যু পথযাত্রী কে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করা হয়। হেলথ কেয়ারে কাজ করবার কারণে এই প্রক্রিয়াগুলো আমাদের মনে আর কোন ভাবান্তর জাগায় না, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে দেখতে গা সয়ে গিয়েছে। এই দেশে এটাই এদের জীবন প্রনালী, ১৮ বছরে এরা স্বাধীন, বিয়ে, সংসার এবং এক সময়ে নাতি নাতনী পালন তারপরের পর্যায় হল গাট্টিবোঁচকা বেধে একদিন সিনিয়র হোমে বা নার্সিংহোমে প্রস্থান, অতঃপর বিদায়। কিন্তু আমরাতো এমন ক্রান্তিকালে বিশ্বাসী নই! মাসিমার জীবনের শেষ অধ্যায়টা অদ্ভুতভাবে নাটকীয়! সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশে, অপরিচিত মানুষের, ভিন্ন ভাষার মানুষের মাঝে সে নিজেকে প্রস্তুত করছে শেষ বিদায়ের জন্য। না সে পুরোপুরি বুঝতে পারে অন্যের কথা না নিজের কষ্টের কথা সে কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারে। মাসিমা নার্সিংহোমে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়েছে, জর্জের দেখা পেলেই বলছে “I go nursing home, I go Monira”. শুনে আমার এত মন খারাপ হয়েছে যে বলবার নয়। কতবার ভেবেছি দেখতে যাব মাসিমাকে কিন্তু কিছুতেই সময় করতে পারিনা, ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করছে নিজের ভেতরে। ব্যাস্ততার দোহাই দিয়ে যাচ্ছি না কিন্তু আমার নিজের মা হলে কি আমি এমন করতে পারতাম? এই একই কারণে আমি অরুণের উপরেও কখনো রাগ করতে পারিনি, আমরা জানি কত পরিস্থিতি সামাল দিয়ে, কতদিকে জোড়াতালি দিয়ে তবে আমাদের দিন শেষ হয়। মাসিমা ঠিক কবে হোমে ফেরত আসবেন জানি না তাই ঠিক করলাম আসছে শনিবারে আমি নিশ্চিতভাবে মাসিমাকে দেখতে যাব।

মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে ভয় হয়, যদি ততদিন বাঁচি কি হবে আমার অবস্থা? সন্তান কি দেখবে আমায়? নাকি হোমে রেখে আসবে? খারাপ লাগবে হোমে থাকতে নাকি ততদিনে এই সমাজ ব্যাবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে যাবো? সন্তানের কথা মনে হতেই নিজের তলপেটে হাত দিলাম, তার আগমনের অস্তিত্ব পেয়েছি আমার শরীরে। ধীরে ধীরে সে বাড়ছে আমার ভেতরে। Over the counter test kit নিশ্চিত করেছে সে এসেছে, ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে তার আগমনের খবর তারপরে শুরু তার জন্য হবে আমার প্রস্তুতি। (ক্রমাগত)

শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা