ইউসুফ কামাল : পুরো একটা দিন সময় হাতে। সকালে চলে গেলাম বিড়লা প্লানেটোরিয়াম, কোলকাতার দর্শনীয় স্হানের মধ্যে এটা একটা অন্যতম স্থান যাকে বাংলায় ‘তারা মন্ডল’ও বলে। সমগ্র সৌরমণ্ডলকে যেন এক কক্ষের মধ্যে বন্দী করে ফেলেছে। এ এক আশ্চার্যতম দর্শনীয় স্থান। প্রত্যহ হাজার হাজার মানুষ এটা দেখতে আসে। বিশেষ ধরনের চেয়ারে বসে ছাদের দিকে তাকিয়ে সমস্ত সৌরমণ্ডলীকে চেনা যায়, মানে ইংরেজি, হিন্দি ও বাংলায় ধারা বিবরণীর মাধ্যমে চিনিয়ে দেয়। সমগ্র গ্রহ মন্ডলীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলোকে পরিচিতি দিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরে। তখনো এ উপমহাদেশে এটাই একমাত্র এই ধরনের স্থান ছিলো। এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। প্লানেটেরিয়ামের মধ্যে এদের একটা মিউজিয়ামও আছে সে খানে টেলিস্কোপ থেকে শুরু করে সৌরমণ্ডল দেখার বিভিন্ন প্রকার আদি ও বর্তমান আমলের যন্ত্রপাতি দেখা যায়। বিড়লা প্লানেটেরিয়াম থেকে বেড়িয়ে সামনেই রাস্তার উপর পেয়ে গেলাম কমলা, মোসাম্বির জুসের ভেন্ডার। সরাসরি ফলের এত সস্তা জুস পাওয়া যাবে কেউই ভাবিনি। সবাই এক গ্লাস করে মোসাম্বির জুস নিলাম শুধু সিকান্দর নিলো দুই গ্লাস। সিনেমা দেখার কথা মনে করিয়ে দিল আলম, ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম ‘রক্সি’ তে। তখনকার সুপার ডুপার হিরো রাজেশ খান্নার ছবি ‘কটি পতঙ্গ’। ষ্ট্রীট ফুডের জন্য কোলকাতা খুবই নামকরা। হাজার হাজার অফিস কর্মচারীর দুপুরের লাঞ্চের সমাধান এখানেই হয়ে যায়। খাবারের মানও সন্তোষজনক। রক্সি’র সামনের ভেন্ডার থেকে সবাই মিলে পেট পুরে গরম ‘এগ রোল’ খেয়ে নিলাম। তখনকার ভারতীয় চলিচ্চিত্রে রাজেশ খান্নার মতো জনপ্রিয়তা খুব কম নায়কই পেয়েছ। এখনো মনে আছে সেই বিখ্যাত, ‘এ যো মহব্বত হ্যায়’ সুপার হিট গানের কথা। এই সমস্ত স্বনামধন্য শিল্পীরাই ভারতীয় চলচ্চিত্রকে এক অনন্য সাধারণ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলো। শো শেষে বেরুতেই সন্ধ্যে হয়ে এলো, চারদিকে আলোয় ঝলমল করে উঠেছে রাস্তাঘাট আশে পাশের দোকানপাট। বড় শহরের সৌন্দর্য্য সব সময়েই যেন নব রুপে উদ্ভাসিত হয় রাতের বেলাতেই। রাতের সৌন্দর্য্যই আলাদা, এটা ভ্রমণকারীদেরকেই মূলত: আকর্ষণ করে। পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোই তার প্রকৃষ্ট উদাহারণ। নিউইয়র্কের টাইম্’স স্কোয়ারের নিওন আলোর ঝলকানী দেখতে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। কোলকাতা শহরকে বৃটিশরাই সাজিয়ে দিয়ে গেছেন, নামকরা প্রধান স্থাপনাগুলোই তাদের করা। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, হাওড়া ব্রীজ, রাইটার্স বিল্ডিংসহ আরো অনেক কিছুই তাদের তৈরী করা। সেই সুতানটি গ্রাম থেকেই আজকের এই আধুনিক কোলকাতার জন্ম। এটাই ইতিহাস। বেশি দেরী না করে ফিরে গেলাম হোটেলে, সকাল দশ’টায় প্লেন, দু’ঘন্টা আগে রিপোর্ট করতে হবে। সুকুমার বাবুকে হোটেলের সমস্ত বিলের দেনা পাওনা মিটিয়ে দিলাম রাতেই। সকালে উনি আসার আগেই যদি চলে যাই তাই আনুষ্ঠানিক বিদায়ও নিয়ে নিলাম। ভদ্রলোক স্বাভাবিক গ্রাহকের চেয়েও যেন একটু বেশি খাতির করলেন, হয়তো তার জন্মস্থানের কথা মনে হওয়াতে একটু আবেগ প্রবণও হয়ে পড়লেন। ভোরে উঠতে হবে সবাই তাই একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

জীবনের সুখ স্মৃতিগুলো কখনোই মনের আড়াল হয় না তা সে যত পুরনোই হোক না কেনো। কিছু কিছু ঘটনা দারুণভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকে জীবনের শেষ মূহুর্তের সীমারেখা পর্যন্ত। কিছু বিষয় পছন্দের তালিকায় উঠে আসে যার জন্য কিছু মাধ্যম লাগে, কিছু কারণও থাকে। সোজা সাপ্টা অনেক জিনিষ মনের মধ্যে গেঁথে যায় বিশেষভাবে, নন্দিতভাবে উপস্থাপিত হবার পর। উপস্থাপনাও যেনো বিশেষ একটা আর্ট সেটা বুঝেছিলাম বুলার সংস্পর্শে এসেই। যেমন আলাদা একটা স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখতো তার প্রায় প্রতিটা কাজেই, আর আমার রবীন্দ্র সংগীতের প্রতি ভালো লাগাটাও তখন থেকেই। চিন্ময়, সাগর সেনকে যেন নতুন করে চিনলাম, নতুন করেই যেন ভালো লাগা শুরু হয়ে গিয়েছিলো ওদের গানগুলো। আর তার যোগসূত্রটা ছিলো বুলা। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো সেই ভালো লাগাগুলো এখনও অবিকল রয়ে গেছে। তখন থেকেই কেনো জানি গানের কথাগুলো শুনে আলাদা করে ভাবতে শিখে ছিলাম। দেখেছিলাম কি অদ্ভুত তার অর্থগুলো, কতো গভীরভাবে হ্রদয় ছুয়ে যায়। সে কি আপন রং এ ফুল রাঙাবে সে কি মর্মে এসে ঘুম ভাঙাবে।
যদি তারে নাই চিনি গো সেকি আমায় নেবে চিনে
এই নব ফালগুনের দিনে জানি নে গো জানি নে।।

কত গভীর তার অভিব্যাক্তি। মুগ্ধ হয়ে ভাবতাম কেমন করে এত দরদ দিয়ে গায় ও। একদিন বিকেলে টিএসসির কাছাকাছি রেসকোর্সের মাঠে বসেছিলাম আলম রোজী বিদ্যুৎসহ চার জন। মোটামুটি সবাই ওর গানের গুনমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলো। রোজীর হাল্কা অনুরোধে গাইলো-
আমার সকল ভালোবাসায় সকল আধার সকল আশায়
তুমি ছিলে আমার কাছে দেখতে আমি পাইনি তোমায় ।
তুমি মোর আনন্দ হয়েছিলে আমার খেলায়
আনন্দে তাই ভুলে ছিলেম কেটেছে দিন হেলায়।
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায়
দেখতে আমি পাইনি।।

অবস্থা এমন দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো যে, ও রোজীর একটু জুনিয়র হলেও শুধু ওর সাথে আমার সম্পর্কের কারণেই রোজী অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিলো বুলার সাথে। রোজীর হলের অনেকেও বিষয়টা জেনে ফেলায় ওদের মধ্যের সহজ হওয়া নিয়ে কেউ কিছু মনে করতো না। দু’জন প্রায় বন্ধুর মতোই সহজ হয়ে গিয়েছিলো। রোজী নিজেও বুলার গানের প্রচন্ড ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। সবার মধ্যেই একটা আলাদা স্থান করে ফেলছিলো যেন, ভালোলাগার ভালোবাসার ও স্নেহের। ডিপার্টমেন্টের সবাই আস্তে আস্তে জেনে গিয়েছিলো, আমাদের বিষয়টা মেনেও নিয়েছিলো। ওর নম্র ব্যবহার আর স্বাতন্ত্রপূর্ণ চলাফেরায় সবার কাছেই হয়ে উঠেছিলো অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষ। আর আমার কাছে একান্ত প্রিয় সুন্দর একজন আপনজন।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউষ্টন, টেক্সাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র