আতোয়ার রহমান : তখন শেষ বিকেল। ভারী বৃষ্টি হয়ে গেছে তার আগেই। আকাশে ছন্নছাড়া মেঘ। ফুর ফুরে হাওয়া ভেসে আসছে ওদিক থেকে। আমি পকেট থেকে দশ টাকার একটি নোট তার হাতে দিতেই সে খুশিতে টগবগ করে উঠল। তাকে দাদি বলে সম্বোধন করে আলাপ জামাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি জীবনের সমস্যা-সংকটের কথা খুব একটা বলতে চান না।। আলাপ শুরু করতেই বোঝা গেল, তাঁর কথা কিছুটা বেঁধে বেঁধে যায়। তার জীবনকাহিনী জানতে চাইলে তিনি বলেন,
‘শরীরে কুলায় না, আমার শ্বাসের ব্যারাম, মাজায় ব্যথা; তবু কষ্টমষ্ট করি ভিক্ষা করি। অবস্থার কথা কইয়ে লাভ নাই। কেউ শুনতে চায় না। পয়সাঅলার সাথে কথা বলা যায় না। তারা যেমন খুশি চলে আর মিথ্যা সান্ত¡না দেয়।’

তাকে অভয় দিয়ে বললাম,
-আমি অন্যদের মতো না। আপনি আমাকে সবকিছু বলতে পারেন। আমি আপনার সবকথা শুনবো।
দাদি হেসে বললেন, ‘শোনো দাদু, দুনিয়ায় সব্বাই এই কথা বলে। আসলে সকলে যেই লাউ, সেই কদু। যাহোক আমার পিড়াপীড়িতে অবশেষে তিনি কথা বলতে রাজি হলেন।

আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে আলাপ জমাতে শুরু করলাম। একটা-দু’টো কথার পর তিনি নিজের জীবনকাহিনী বলতে শুরু করলেন। তারপর যাত্রীদের ভিড় থেকে নিজের হাতের ব্যাগটা যত্ন করে কোলের মধ্যে টেনে নিলেন। ইঞ্জিনের একটানা আওয়াজে কান ঝালাপালা। নৌকা তখন মাঝনদীতে। ফেরির নিচ দিয়ে নদীর স্রোত বয়ে যাওয়ার কুলু কুলু শব্দের কল্লোল। রেলিংয়ের ধারে এলান দিয়ে এদিক-ওদিক তাকাই। দূরে পানকৌড়ি বকের ওড়াউড়ি। ঝপাঝপ বৈঠা ফেলছে মাল্লারা। আদিগন্ত বিস্তৃত পদ্মার ঘোরালো জলধারা, স্নিগ্ধ স্রোত আর উত্তাল ঢেউয়ে মিশে যায় আমার হৃদয়। উপরের রেস্টুরেন্ট থেকে একটি ছোট্ট রেডিয়ো জোরে জোরে বেজে চলেছে ভাটিয়ালি গান- ‘কুল নাই, কিনার নাই, অথই দইরার পানি/ সাবধানে চালাইও মাঝি, আমার ভাঙা তরী রে…’। ফেরির রেডিও থেকে ভাটিয়ালির সুর তখন চারিদিকে নদীর ঢেউয়ের মতোই আছড়ে পড়েছে। নদীর বুক ছুঁয়ে আসা বাতাস আমার বুকের উপর ঢেউ খেলে যায়, আমাকে ব্যাকুল করে। অনেক কষ্ট ও ব্যস্ততার ফাঁকেও কখনো আনমনা হয়ে যাই। নদীর জলের মতো কিছু মায়া। অনেক কষ্টের মাঝেও কী এক ভালো লাগা আছে যেন, কী এক শান্তি আছে যেন। অস্ফুট কানে ভেসে আসছে মানুষের কথা-
কর্মসূত্রে আমি বহুকাল একা দেশের নানা প্রান্তে যাতায়াত করেছি।এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই একলা ভ্রমণ আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছে, নিজের অনেক আত্মপ্লব্ধি হয়েছে, নিজের মনের মাঝে ভিড় করে আশা ভয়ের অমানিশা থেকে আমায় মুক্ত করেছে। জলপথে ভ্রমণ আমার ভীষণ প্রিয়। সময় সুযোগ হলে জলপথে বহুদূরে গিয়ে ঘুরে আসি।

সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজে আমার পোস্টিং হয়েছে। মালিবাগ লেভেল ক্রসিং থেকে সোহাগের এসি বাস ঢাকা থেকে সাতক্ষীরার উদ্দেশে ছেড়ে গেল। ঝাঁকুনি কম ও হেলেদুলে চলায় ঝিমুনি আসায় বাসটি কখন যে পাটুরিয়ায় এসে থামল তা বুঝতে পারলাম না। ফেরির জন্য অপেক্ষা। পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া প্রায় দশ কিলোমিটার পথ যাবো জলপথে।

ফেরিতে গিয়ে বসে আছি। বাসের জানালা থেকে নজর গেল চোখের সামনে বয়ে চলা পদ্মা নদীর দিকে। নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম তাই অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় ও ছিল না। ফেরি চলা শুরু করল। হাল্কা কিছু খাওয়ার জন্য সারি সারি বাস ট্রাকের ভীড় কাটিয়ে ফেরির ভেতরের রেস্তোরাঁর দিকে হাঁটতে থাকলাম। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন আমার কাঁধে টোকা মারে। একটি হাতের স্পর্শে আমি চমকে যাই। ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় মা যেমন কাঁধে টোকা মেরে খাওয়ার টেবিলে বসাতো, ঠিক সেরকম এক আদুরে হাতের স্পর্শ।

পেছনে ফেরে দেখি যে কুঁজো হয়ে যাওয়া এক বছর সত্তর–আশির বয়স্ক বৃদ্ধা ভিখারি আমার দিকে হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁত আর কয়েকটি মাত্র অবশিষ্ট আছে। তাঁর সর্বাবয়বে একটা কষ্টের অবলা জলছাপ। তবু তার মুখের অমলিন হাসি সত্যি মন ছুঁয়ে গেল। সে ভিক্ষা চায়। চৈত্রের গনগনে রোদে পোড়া ফসলের ক্ষেতের ফেটে যাওয়া মাটির মতো মুখে অসংখ্য ভাঁজপড়া ভিখারিকে দেখে আমার মায়া লাগে। আমি ওই বৃদ্ধা ভিখারির সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলাম। ভিখারি সম্বন্ধে আমি যত জানি, ততই অবাক হই। ভিখারিকে আমি প্রশ্ন করি, আপনার বয়স কত?
ভিখারি মাথা নিচু করে উত্তর দেয়, জানি না।
-আপনার স্বামী-সন্তান আছে? বা ছিল কোনোকালে?
-ছেলো। এহন নাই।
-এখন কোথায় তারা?
-জানি না।
-আপনি কোথায় থাকেন?
-থাকপো আর কোথায়? এই হানেই।
-কোন গ্রাম বা এলাকা?
-জানি না।
আপনার নাম কী?
-গোলাপির মা।
-আহা। সেটা তো আপনার মেয়ের নামে নাম। আপনার নিজের নাম কী?
-জানি না।

এ জানি না বিষয়টি আমার মনে লেগে যায়। সে যে তার নাম ঠিকানা কিছুই জানে না, তাতে কিছু আসে যায় না। যেমন যে মানুষ একেবারে প্রান্তিক, তার ঠিক কী চাই জানে কেউ? আমি চিন্তা করি এই ঠিকানাবিহীন বৃদ্ধা ভিখারিরও আছে একটি জীবনকাহিনি। সে নিশ্চয়ই ভিখারি হয়ে জন্ম নেয়নি। একদিন তার শৈশব ছিল। ছিল সুখের ঘর আর ভরা যৌবন। সেই যৌবনে ছিল জোয়ার–ভাটা। তারপর ধীরে ধীরে সবকিছু হারিয়ে যেতে থাকে। যেমনটি বাংলাদেশের অনেক নদী হারিয়ে গেছে বা যায়।

পদ্মার ওই খাল দিয়ে কিছুদুর এগোলেই তার গ্রাম। নৌকার মাঝি স্বামীর সঙ্গে সুখেই দিন কাটছিল। বাইশ বছর বয়সে দুইটা ছোট বাচ্চার সাথে তাকেও অনাথ করে আচমকা তার স্বামী মারা যান। তখন তার তাজা শরীর। মনে অনেক সাদ-আহ্লাদ, কিন্তু তার কিছুই পূর্ণ হয়নি। মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করা শুরু করলো। সে রোজ সকালে মানুষের বাড়িতে এসে একগাদা শুকনো মরিচ, আদা, রসুন, ধনে এসব পিষত। মালিকের লোলুপ চোখ এড়িয়ে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে নিজেদের পেট চালিয়ে ছোট ছেলে বাচ্চা দুটোর লেখা পড়ার খরচ চালাতো সে। কিন্তু ঝিয়ের কাজটাও সে একদিন হারাল। চোখে তখন অন্ধকার। খাবার টাকা পর্যন্ত ছিল না তার কাছে। অগত্যা নিজের এবং দুই সন্তানের মুখে খাবার জোগাতে ভিক্ষা করা শুরু করে।

কিন্তু শেষ কবে বাড়িতে গেছেন, বাড়িটা এখন কেমন আছে, সেটা আর কিছুই মনে করতে পারছেন না। নাই-বা পারলো। ক্ষতি নেই। কারণ, এই ফেরি আর আশপাশের খুপরি দোকানগুলোকেই নিজের বাড়ি বানিয়ে সেখানে বাস করছেন তিনি। হয়তো সেখানেই মৃত্যু হবে তার।
কথার ফাঁকে ফাঁকে শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখ মুছে নিচ্ছিলেন দাদী; তিনি কি ক্লান্তি, দুশ্চিন্তাও মুছে নিচ্ছিলেন? যেভাবে প্রতিবার দুঃখ-দুর্দশার কথা বলার পর হাসছিলেন; শব্দহীন স্মিত সেই হাসির আড়ালে পড়ে থাকছিল যেন জীবনের সব ক্ষত, কালশিটে দাগ, ময়লা ঝুলি।

ভাবলাম, আর হয়ত কিছু বলবেন না। কিন্তু এ বার তিনি লাজুক মুখে আমাকে প্রশ্ন করলেন,
কী নাম আপনার? কোথায় যাচ্ছেন? সাথে কারা?
এত প্রশ্নের জবাব আজকাল কাউকে খুব একটা দিতে ভালো লাগে না, কিন্তু ওনাকে দিয়ে দিলাম। কারণ অল্প কিছু সময় তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে থেকে তৈরি হয়েছিল এক অদৃশ্য মায়াবন্ধন। বললাম,
– আমার নাম আতোয়ার। নতুন কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার জন্য সাতক্ষীরা যাচ্ছি। সাথে কেউ নেই, একাই যাচ্ছি।
-শুনে মাথা নাড়ল। বলল,
-দোয়া করি, নতুন জায়গায় ভালভাবে যাও, ভাল থাকো।
আমি খুশি হয়ে মাথা ঝাকালাম।

কিছুটা লাজুকতা মিশ্রিত চোখে তাকিয়ে অনুচ্চ স্বরে বলল,
-বাবাজি, আমার একটা জর্দা মেশানো পান খাওয়ার শখ। পান না খাইতে খাইতে মুখের ভেতরটা শুকাইয়া গ্যাছে। তোমার কাছে একটা পান খাওয়ার পয়সা হবে?
পকেটে হাত দিয়ে দশ টাকা বের করে তার হাতে দিলাম। খুশিতে উজ্জ্বল হওয়া তার মুখ গোধূলির রং মিশে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। টাকাটা কোলের মধ্যে রাখা ভিক্ষাপাত্রে রাখতে রাখতে নদীর একটা পাড় দেখিয়ে দাদি বলল,
-ওই পাড়ে আমার বাড়ি ছিল এক সময়। সুখে-দুঃখে ভালই ছিল সংসার। এখন ছেলেরা সব বাইরে থাকে। বড় ছেলে বড় অফিসার। ছোট ছেলে ট্রাকের ড্রাইভারি করে।

তার কথা শুনে চোখ কপালে উঠে গেল আমার। আমরা সবাই যে ওনার সব কথা বিশ্বাস করতে পেরেছিলাম তা নয়, কিন্তু এক বৃদ্ধা মাকে থামিয়ে দিতে পারিনি। যদি এসব তাঁর মন গড়া গল্পও হয়, তবু এই গল্পই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। চোখের চশমাখানি বেশ ঝাপসা, কিন্তু মনের চোখে তিনি নিজের সুখের সংসার দিব্যি দেখতে পান। অন্য এক যাত্রী খানিকটা কৌতুকের সুরে প্রশ্ন করলেন,
-তা এত বড়োলোক ছেলেরা তোমায় খাবার দিতে পারে না, একটা ভালো শাড়ি কিনে দিতে পারে না?
দাদি হেসে বললেন,
-ভালো খাবার খেয়ে, ভাল কাপড় পরে কী হবে, আল্লার দুয়ারে সবাই তো এক।

এর পর আর কেউ প্রশ্ন করেনি তাঁকে। এত বড় জীবন দর্শনে যে মানুষ বিশ্বাস করেন, তাকে বৈষয়িক প্রশ্ন করে বোধ হয় বিব্রত করা যায় না। মাত্র পাঁচ মিনিটের এই পরিচয় আর কথোপকথনে আমি এক অন্য অভিজ্ঞতা লাভ করলাম। মনে হল এই তো জীবনের না পাওয়াগুলোকে অতিক্রম করে ভালো থাকা, স্বপ্ন দেখা, এগিয়ে চলাই তো জীবন। জীবনের চোরাস্রোতে পরাজিত হতে হতে এত পথ পেরিয়েও কী এমন প্রতিজ্ঞা পণ! সঙ্গে কেউ থাকুক বা না থাকুক, কিছুই যায়-আসে না তাতে!

বাইরে তখন ফেরি ঘাটে ভেড়ার ভট ভট শব্দ, বিদায়ী গর্জন। আমার বাসে ওঠার তাড়া। বৃদ্ধা ভিখারিকে ‘আবার দেখা হবে’ বলে দ্রুত বাসের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। ‘আল্লা তোমার ভাল করুক’-বলতে বলতে হাঁটা শুরু করলেন। ধীরে ধীরে আমার দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেলেন তিনি, কিন্তূ তাঁকে ঘিরে আমার বুকের ভেতর তৈরি হল এক অদৃশ্য মায়ার প্রবাহ।