বকুল ভৌমিক : আজকের দিনটি যে খুব একটা ভাল যাবে না সেটা সকাল বেলার গাড়ির স্টার্ট দেয়ার সময়ই টের পেলাম, আমার নয় বছর পুড়ানো গাড়িটা একটা খর খরে শব্দে যেন বিরক্তিটা প্রকাশ করে দিল। কিছুটা গায়ের জোরেই গাড়ির ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেন আমি বেরিয়ে পরলাম। ভাবখানা এরকম যেন যদি সে রাস্তায় থেমে পরে সব দোষই আমার। খুব জোরে সোরেই স্নো পরছে, রাস্তাটা যেন একদম সাদা কার্পেটে মোড়ানো আমাকে খুব সতর্কতার সাথে গাড়ি চালাতে হল। এত প্রতিকুলতার মধ্যেও আমি সকালের ক্লাসটা কোনভাবেই মিস করতে চাই না, তাহলে যে আমি আর একটি সপ্তাহ ওঁকে দেখতে পাবো না, ওর আর আমার কমন ক্লাসটা সপ্তাহে ঘুরে একবার আসে। মনের ভিতর কেমন একটা গোপন আশা সবসময়ই ঘোরাফেরা করে ওর স্বান্নীধ্য পাওয়ার জন্য। ঠিকই আজ ক্লাসে এসে ওঁকে দেখতে পেলাম না, মনটা বিষন্নতায় ভরে গেল টিচারের লেক্চার আমার কানে এসে থেমে যাচ্ছে মাথা পর্যন্ত পৌঁছোতে পারছে না।

ওর নাম কেইলা, নামটি যেদিন ওর মুখে প্রথম শুনলাম আমি অবাক হয়েছিলাম এই রকম একটি সুন্দরী মেয়ের নাম নাকি কয়লা, সে যে ভাষায়ই হোক না কেন নামটা যে শ্রæতিতে ওর সাথে বেমানান এতে কোন সন্দেহ নেই। ওর গায়ের রং ঠিক দুধের সাথে আলতা মিশিয়ে যে রংটা হয়, চুলের রং কাল, একদম সাদাদের মত নয়। ও সাউথ আমেরিকান ওর কথা বলার এক্সেন দেখে বুঝতে পেরেছি। আমাদের ইউনিভারসিটিতে এরকম আর একটি মেয়ে নেই। চোখ দুটো বাঙ্গালী মেয়েদের মত হরিণী আঁচের। শরীরের গঠন শুকনো, বিধাতার কার্পণ্যতা স্পস্ট যতটুকু মাংস পেশী না হলেই নয়। ক্লাসে আর চোখে যে শুধু আমিই তাকে দেখতাম তা নয় মেয়েটির কাল্চারেও এমন কিছু বাঙালিপনা আছে, সেও আমাকে মাঝে মাঝে আর চোখে দেখতো, কিরকম যেন একটা হাইড এন্ড সিক খেলা। কানাডায় এসেছি মাত্র, এদেশীয় কালচারালের সাথে এখনো পুরোটা অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। যদি মনের বাগানে কোন ভাল লাগার কলি ফুটে থাকে তাকে পরিপক্ক ফুলে রূপান্তরিত করতে কি করতে হবে তা আমার মোটেও জানা নেই, আবার যদি হিতে বিপরীত হয় বা অযাচিত কিছু ঘটে যায় এই ভয়টা আমাকে সর্বদা স্থিত করে রাখতো। তবে মনের ভিতর একটা ঘোর পাক চলছিল ঠিক একদিন কয়লা এসে আমার কাছে ডিসকৃট ম্যাথের এসাইনমেন্টের সাহায্য চাইল, কেইলাকে আমি ইচ্ছে করেই কয়লা বলে ডাকতাম। এতো দেখি মেঘ নাচাইতেই বৃষ্টি। এই সুযোগটাই আমি খুঁজছিলাম কোন না কোন ভাবে ওর কাছাকাছি যাওয়া। শুরু হল বিদ্যার আদান প্রদান মার্কভ চেইন, মিন ম্যাক্স, এস্টার, জেনেটিক আলগরিদম থেকে শুরু করে ডিস্কট্রাসএর সরটেস্ট পাথ। এদিকে আমার মনের ভিতরেও সরটেস্ট পাথের আলগরিদমের এনালাইছিছ চলছে কিভাবে স্বল্প সময়ে ওর হৃদয়ের নুডগুলোতে ঢোকা যায়। মনের কথাগুলো অনেকবার চেস্টা করেও ওঁকে বলতে ব্যার্থ হয়েছি একদম টিপিক্যাল বাঙালি ছেলেদের মত। আরে বেটা কিসের এত দ্বিধা মার তো দিবে না বড়জোর প্রত্যাখ্যান করতে পারে। এই দেশীয় ছেলে মেয়েদের মত ওর সাথে ইউনিভার্সিটির ক্লাবেও গিয়েছি যদি কোন এক অন্তরঙ্গ মূহূর্তে মনের কথাটা বলতে পারি। কিন্তু বিধি বাম, মনের কথা বলা হয়ে উঠেনি কখনো কি যেন এক অজানা কারণে।

ক্লাস প্রায় অর্ধেক হঠাৎ কয়লা এসে হাজির, এসেই আমার পাশে বসে পরল। কি একটা মিস্টি অনুভূতি আমার মন জুড়ে বয়ে যেতে লাগল। ভাল লাগার মৌমাছিগুলো মধু আহরণ করে মনের মধ্যে ভালোবাসার মধুচক্র তৈরি করতে লাগল। ও আমাকে জিজ্ঞেস করল “ক্যান আই গেট এ রাইট ফ্রম ইউ টুডে। আমি তো মহাআনন্দে বলে ফেল্লাম শিউর, হোয়ার ইউ ওয়ানা গো, ও বলল এয়ার পোর্ট। দুসপ্তাহের জন্য চিলি যাবে। চিলি ওর জন্মস্থান। আমি দারুণ মেজাজে আছি আজ গাড়িতে পাশাপাশি এবার মনের কথাটা বলেই ফেলব আর দেরি করা যাবে না। ক্লাস শেষে সরাসরি ওর ডরমে সেখান থেকে এয়ারপোর্ট যাব।

গাড়িতে এয়ারপোর্টের রাস্তাটা প্রায় এক ঘন্টার পথ, গাড়ির সিডিতে হেমন্তের গান বাজছিল নীড় ছোটক্ষতি নেই আকাশ তো বড়.. ভাবলাম গানটা চেঞ্জ করে এফ এম দেব যাতে বাংলা গানগুলো ওর বিরক্তির কারণ না হয়। চেঞ্জ করতে গেলেই ও বলে উঠল ডোন্ট চেঞ্জ, ইট ইজ ছো মেলোডিয়াস, হোয়াটইজ দি লিরিক্স এবাওট, আমি বুঝালাম ভাংগা ভাংগা ভাবার্থে, লাভ ইজ গ্রেট ইভেন ইউ আর পোওর, হ্যাভ স্মল হাউজ বাট হ্যাভ বিগ স্কাই, ওর খুব ভাল লাগল গানটির অর্থ শুনে। অনেক অপ্রাসঙ্গিক গল্প শুরু হল যেমন চিলি সান্টিয়াগো গামী সেই উরুগোয়ার রাগবি টিমের আন্দিজ পর্বতমালায় এক্সিডেন্টের লোমহর্ষক কাহিনী, সার্ভাইভালের জন্য বন্ধু খেলোয়াড়দের গায়ের মাংস খাওয়া। নানা ধরনের গল্পের মাঝে আমার মনের ভিতর শুধু একটা কথাই ঘুরছে কি ভাবে আমার মনের কথা ওঁকে বলি। হাইওয়েতে গাড়ির স্পিড একশ, একশ দশ, মনের স্পিডও ফোরথ গিয়ারে আছে, আজ বলতেই হবে মনের কথাগুলো। গাড়ি চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেল সামনে বিশাল এক্সিডেন্ট গাড়ি বাম্পার টু বাম্পার, এটা খুব কমন চিত্র ৪০১ হাইওয়েতে। ওর চোখে বিরক্তির ছাপ যদি প্লেইন মিস করে সেই টেনশনে। এরমাঝে একটি ফোন বেজে উঠলো, ফোনে ওপার থেকে শুনা গেল স্প্যানিশ ভাষা, কয়লা স্প্যানিসে কি যেন বলল ফোন থেমে গেল। আমি ভাবলাম পেরেন্টস হবে নিশ্চয় তারা খুব এক্সাইটেড এবং খোঁজ নিচ্ছে বোর্ডিং হল কিনা। আমি কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম হো ওয়াজ ইট, ও হয়তো কোন একটা কিছু ভাবছিল ওই মূহুর্তে আমাকে বলল পার্ডন, আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম হো ওয়াজ ইট, ও বলল মাইফিয়ন্ছে। মাথার উপর একটা বিদ্যুৎ চমকিয়ে উঠল, শিরায় শিরায় যেন টু টুইন্টি ভোল্টের রেগিং চলল, স্তব্ধ হয়ে গেলাম। একদিকে ৪০১ হাইওয়েতে গাড়ির জ্যাম তার সাথে কয়লার ফিয়ন্ছে কেমন যেন গোমটে অসস্থি লাগছে, গাড়ির এসিটা বাড়িয়ে দিলাম তবু অসস্থিটা যেন কাটছে না ভাবছি কখন যে এইপথ শেষ হবে। এর মধ্যে সিডিতে এই গানটি বেজে চলছে এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতÑ মনে হলে হেমন্ত বেটাকে যদি এখন গাড়িতে বসিয়ে দেওয়া যেত তাহলে বুঝত কেমন হত.. । যেন গরম তেলেজল ঢালার মত বুঁদ বুঁদ করছে হৃদয়ের কোন পাশটা। ওদিকে সিডিতে গানটি শেষ হতেই পরের গানের সাড়িতে নিরবে বেজে উঠলো আজ দুজনার দুটি পথ গেছে বেকে.. হোয়াট এ সিনেমাটিক কোইনসিডেন্ট।

যে কয়লাকে এত যতনে পুষেছিলাম মনের গহীনে সেও আজ হারিয়ে গেল কোন বনে। কয়লাকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছি আর ভাবছি গাড়িটা কিভাবে সকালে বুঝতে পেরেছিল আমার আজকের দিনের ভাগ্যের ফলাফল। বিষন্নতা ভর করলো মনের পরে, বুকের মধ্যে কি একটা শুন্যতা চিরচির ব্যাথা দিচ্ছে, হৃদয়ে যেন কয়লার একটা দাগ পরে গেল।

বকুল ভৌমিক : কবি ও লেখক, অটোয়া, কানাডা