অনলাইন ডেস্ক : প্রায় দু-শতাব্দী পর গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম মসজিদ উদ্বোধন করা হয়েছে। শুক্রবার জুমার নামাজের মধ্যদিয়ে এ মসজিদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে তুরস্কভিত্তিক গণমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড ও আল জাজিরা। তবে সেকেন্ড ওয়েভে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো গ্রিসেও করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব ও কঠোর স্বাস্থ্যবিধির মেনে স্বল্পসংখ্যক মুসল্লির উপস্থিতিতে এ মসজিদের কার্যক্রম শুরু হলো।

গ্রিক সরকারের অর্থায়নে নির্মিত এ মসজিদটি তৈরি করতে আনুমানিক ৮ লাখ ৮৭ হাজার ইউরোর খরচ হয়েছে। ২০১৬ সালে চূড়ান্তভাবে এ মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করা হয় এবং ২০১৭ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়।

গ্রিসের শিক্ষা ও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী কোস্তাস গাভ্রোগলু গত সপ্তাহে এক রেডিও সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, এ মসজিদে একসঙ্গে ৩৫০ মানুষ নামাজ আদায় করতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে এ মসজিদের নাম রাখা হয়েছে ভোতানিকোস মসজিদ।

এথেন্সের হার্টখ্যাত সিনতাগমা স্কয়ার থেকে প্রায় চার কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নৌবাহিনীর একটি পরিত্যক্ত ঘাঁটিতে নির্মাণ করা হয়েছে মসজিদটি। তবে গতানুগতিক মসজিদগুলোর থেকে কিছুটা ভিন্ন হওয়ায়- বিশেষত কোনো ধরণের মিনার বা গম্বুজ না থাকায় অসন্তোষ জানিয়েছেন দেশটিতে বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠীর অনেকে।

বলকান উপদ্বীপের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত ৫০,৯৪৯ বর্গমাইলের মাঝারি আয়তনের দেশ গ্রিস। উত্তরে আলবেনিয়া, মেসিডোনিয়া ও বুলগেরিয়া, পূর্বে তুরস্ক ও এজিয়ান সাগর, দক্ষিণে ক্রেতান ও লিবিয়ান সাগর এবং পশ্চিমে আইয়োনিয়ান সাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত এ দেশটি আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিত্তিভূমি হিসেবে পরিচিত। পাশপাশি গ্রিস পূর্বাঞ্চলীয় অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের প্রধান তীর্থভূমি হিসেবে সমাদৃত। সর্বশেষ ২০১৯ সালের জনগণনা অনুযায়ী দেশটিতে প্রায় এক কোটির মতো মানুষ বসবাস করেন যাদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ অর্থোডক্স খ্রিস্টান। দেশটিতে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা। তাদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার দেড় শতাংশের মতো।

গ্রিসে বসবাসরত ইসলাম ধর্মালম্বীদের একটা বড় অংশ তুর্কি ও আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত। এছাড়া বেশ কিছুসংখ্যক গ্রিকভাষী রয়েছেন যারা জন্মগতভাবে মুসলিম। গ্রিসের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত থ্রেস দেশটির সর্ববৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল এবং গোটা ইউরোপের মধ্যে থ্রেসই একমাত্র অঞ্চল যেখানে শরীয়া আইন চালু রয়েছে। ১৯২৩ সালে স্বাক্ষরিত লুজার্ন চুক্তির ফলে দেশটিতে বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠীর সিংহভাগকে তুরস্কে চলে যেতে হয়। বিপরীতক্রমে, তুরস্ক তথা এশিয়ান মাইনরে ববসাস করা খ্রিস্টান ও ইয়াহুদি ধর্মালম্বীদের গ্রিসে স্থানান্তর করা হয়। সত্তরের দশকের পর থেকে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকেই অভিবাসী হিসেবে গ্রিসে পাড়ি জমাচ্ছেন, যাদের মধ্যে একটি বড় অংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী।

মূলত তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের হাত ধরে গ্রিসে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটে। ১৮২১ সালে এথেন্সসহ বর্তমান গ্রিসের বেশকিছু অঞ্চল অটোমান শাসন থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দেয়। অবশেষে ১৮২২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম হেলেনিক প্রজাতন্ত্র যার রাজধানী হিসেবে নির্বাচিত করা হয় এথেন্সকে। ১৮৩৩ সাল থেকে তৎকালীন হেলেনিক প্রজাতন্ত্রের সরকারের অর্থায়নে এথেন্সে একটি মসজিদ নির্মাণের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন এ অঞ্চলে বসবাস করা মুসলিম ধর্মালম্বীরা। এমনকি ১৮৯০ সালে সরকারিভাবে এথেন্সে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিলো। তবে বিভিন্ন সময়ে দেশটির অতি ডানপন্থী ও রক্ষণশীল রাজনৈতিক জোটগুলোর তীব্র বিরোধিতা, বিভিন্ন ধরণের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অর্থোডক্স চার্চগুলোর বাধার কারণে দীর্ঘকাল সেখানে মসজিদ নির্মাণের বিষয়টি আলোর মুখ দেখেনি।

গ্রিসের সঙ্গে তুরস্কের রাজনৈতিক বৈরিতা দীর্ঘদিনের। এ কারণে গ্রিসের অনেক সাধারণ মানুষও এতোদিন এথেন্সে মসজিদ নির্মাণের বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলো। তাদের অনেকের মতে, গ্রিসে নতুন করে কোনো মসজিদ নির্মাণ করার অর্থ পুনরায় দেশটিতে অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসের পুর্নজাগরণ ঘটানো।

উল্লেখ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর মাঝে এতোদিন পর্যন্ত এথেন্স ছিল একমাত্র রাজধানী শহর যেখানে সরকারিভাবে কোনো মসজিদ ছিল না।