Home আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিরতিতে তোপের মুখে মোদি

যুদ্ধবিরতিতে তোপের মুখে মোদি

অনলাইন ডেস্ক : ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত থামাতে আসরে নেমেছিল যুক্তরাষ্ট্র। শনিবার দু’দেশের মধ্যে সংঘর্ষবিরতি নিয়ে আলোচনায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজের সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে টুইট করে জানিয়েছিলেন, দুই দেশ সংঘর্ষবিরতিতে রাজি।

আর এখানেই সংঘাত থামাতে আমেরিকার ‘নাক গলানো’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ভারতের বিরোধী দলগুলো। কেন মার্কিন হস্তক্ষেপ মেনে নিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি? এই প্রশ্নের পাশাপাশি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের অনুরোধ নস্যাৎ করা ‘আয়রন লেডি’ ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছে কংগ্রেস। সোশাল মিডিয়া পোস্টে নেতাদের দাবি, ‘আজ দেশ ইন্দিরা গান্ধীজির অভাব অনুভব করছে।’ কংগ্রেসের অভিযোগ, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র মার্কিন মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হয়েছে মোদি সরকার। এটা মেনে নেয়া আর কী? তাদের ব্যাখ্যা, আমেরিকার অঙ্গুলিহেলন নোয়াতে পারেনি ইন্দিরা গান্ধীকে। কিন্তু মোদি মাথা নোয়ালেন। গোটা দেশে আজ ইন্দিরার মতো দৃঢ়, ঋজু ব্যক্তিত্বের বড় অভাব। এ প্রেক্ষিতে বিরোধীরা জানতে চাইছে, ভারত কি এবার তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার প্রতি উন্মুক্ত অবস্থান নিয়েছে? তারা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে, যাতে সরকার যুদ্ধবিরতির প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে পারে।

এদিকে, মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, পাকিস্তানের পাল্টা হামলার হামলার মাত্রা দেখে ভারত হতবাক হয়ে পড়ে এবং পরে আলোচনায় আন্তরিকভাবে অংশ নিতে শুরু করে উভয় পক্ষ। প্রভাবশালী এই সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা ছিল বলে জানিয়েছেন পাকিস্তান সরকারের একটি সূত্র। ওই সূত্রটি (সংঘাত নিরসনে) আলোচনা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি সিএনএনকে জানান, দু’দেশের মধ্যে তীব্র লড়াইয়ের পর যখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তখনই এই চুক্তির প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। সূত্রটি সিএনএনকে বলেন, শুক্রবার উভয় পক্ষ শান্তিচুক্তির পথে অগ্রসর হচ্ছিল, কিন্তু শনিবার ভোরে ভারত তিনটি পাকিস্তানি বিমানঘাঁটিতে আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে ইসলামাবাদ বিস্মিত হয়। পাকিস্তান মনে করেছিল কূটনৈতিক সমাধান প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান পাল্টা জবাবে ভারতের বিমানঘাঁটি ও কাশ্মির সীমান্তে সামরিক স্থাপনায় বড় ধরনের হামলা চালায়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জানায়, এটি ছিল “চোখের বদলে চোখ” নীতি অনুযায়ী চালানো হামলা।

সূত্রটি জানান, পাকিস্তানের পাল্টা আক্রমণের মাত্রায় ভারত হতবাক হয়ে পড়ে। এরপর শনিবার উভয় পক্ষ আলোচনায় আন্তরিকভাবে অংশ নিতে শুরু করে। যদিও আলোচনা চলার সময়ও ভারত কিছু রকেট নিক্ষেপ করেছিল এবং পাকিস্তান তার পাল্টা জবাবও দেয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাসের কারণে আলোচনা থেমে যায়নি। পাকিস্তানি ওই সূত্রটি আরও জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও (ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে) এই আলোচনা এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে “বড় ভূমিকা” পালন করেন। পাশাপাশি সউদী আরব ও তুরস্কের কর্মকর্তারাও আলোচনায় যুক্ত ছিলেন।

৮৭ ঘণ্টার যুদ্ধে ভারতের ক্ষতি সাড়ে আট হাজার কোটি ডলার : দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এ যুদ্ধে সব চেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। এ সংঘাতে ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারতের শেয়ারবাজারÑ নিফটি ও সেনসেক্স মিলিয়ে উবে যায় প্রায় ৮২ বিলিয়ন ডলার। উত্তর ভারতের আকাশসীমা বন্ধ থাকায় প্রতিদিন ৮ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে বিমান চলাচলে। আইপিএল বন্ধ হওয়ায় আর্থিক ক্ষতি হয় ৫০ মিলিয়ন ডলার। সামরিক ব্যয়ে যোগ হয় আরও ১০০ মিলিয়ন ডলার এবং যুদ্ধবিমান হারিয়ে ক্ষতি হয় ৪০০ মিলিয়ন ডলার। লজিস্টিক ও বাণিজ্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ২ বিলিয়ন ডলার।

অন্যদিকে পাকিস্তানের মোট ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৪ বিলিয়ন ডলার। করাচি শেয়ারবাজারে সূচক পড়ে গিয়ে ক্ষতি হয় ২.৫ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) বন্ধ থাকায় ক্ষতি হয় আরও ১০ মিলিয়ন ডলার। আকাশসীমা বন্ধ থাকায় ক্ষতি হয়েছে ২০ মিলিয়ন ডলার, আর সামরিক খাতে প্রতিদিন ২৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের পাশাপাশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যয় হয় ৩০০ মিলিয়ন ডলার। এই যুদ্ধ দেখিয়ে দিয়েছে, আধুনিক যুগে যুদ্ধ মানে শুধু বোমা, ট্যাংক আর যুদ্ধবিমান নয়। এখন যুদ্ধ মানেই শেয়ারবাজারে ধস, বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারানো, বৈদেশিক বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশা। ঘণ্টায় এক বিলিয়ন ডলার ক্ষতিÑ এটি প্রমাণ করে, সীমিত সময়েও সংঘর্ষ দুই দেশের অর্থনীতিকে কতটা ঝাঁকুনি দিতে পারে।

দুই দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি ট্রাম্পের : দু’দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সিদ্ধান্তের জন্য তিনি গর্বিত, তা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার পরই জানিয়ে দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবার তার দাবি, কয়েক দশক ধরে চলা কাশ্মীর সমস্যা মেটাতেও তিনি আগ্রহী। শুধু তাই নয়, উভয় দেশের সঙ্গেই বাণিজ্য সম্পর্ক মজবুত করার কথা জানালেন তিনি।

যুদ্ধবিরতি চুক্তির একদিন পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল ট্রুথে লিখেছেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের শক্তিশালী এবং অটল নেতৃত্বের জন্য আমি অত্যন্ত গর্বিত। কারণ তাদের শক্তি, প্রজ্ঞা এবং সাহস রয়েছে। দুই দেশই বুঝতে পেরেছে যে এবার আগ্রাসন বন্ধ করার সময় এসেছে। দু’পক্ষের সাহসী পদক্ষেপ সত্যিই উল্লেখযোগ্য।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমি গর্বিত যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ঐতিহাসিক এবং বীরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে (যুদ্ধবিরতি) পৌঁছাতে সাহায্য করতে পেরেছে। আলোচনা না হলেও, আমি এই দুই মহান দেশের সঙ্গে বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে আগ্রহী। পাশাপাশি দশকের পর দশ ধরে চলা কাশ্মীরের বিষয়ে কোনও সমাধানে পৌঁছানো যায় কিনা সেটাও মেটানোর চেষ্টা করব।’

শনিবারই পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে শান্তির বার্তা দেয়া হয়েছিল। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশাক দারের বক্তব্য ছিল, ভারত আর আক্রমণ না করলে পাকিস্তানও করবে না। তবে তাদের ওপর হামলা হলে পাল্টা আঘাতের অধিকার তাদের রয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফও তার আগের মন্তব্য থেকে সরে এসে যুদ্ধবিরতির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তিনি মনে করেন খুব দ্রুত উত্তাপ কমে আসবে দুই দেশের মধ্যে। হয়ও তাই। শনিবারই ভারত এবং পাকিস্তান- দু›তরফেই জানিয়ে দেয়া হয় তারা আর সংঘাতে যাবে না।

স্বাভাবিক হয়ে আসছে পরিস্থিতি : যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর এবার নিজেদের আকাশসীমা সব ধরনের উড়োজাহাজের জন্য খুলে দিয়েছে পাকিস্তান। অন্যদিকে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরেও পরিস্থিতি ক্রমে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। খুলছে দোকানপাট। পাকিস্তান এয়ারপোর্ট অথরিটি (পিএএ) জানায়, দেশটির আকাশসীমা এখন উন্মুক্ত রয়েছে।

পিএএ-এর একজন মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তানের সব বিমানবন্দর উড়োজাহাজের স্বাভাবিক চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। যদিও ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের আকাশসীমায় উড়োজাহাজের চলাচল পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে। এদিকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরদিন আজ রোববার সকাল থেকে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগর শহরের সড়কে স্বস্তির ভাব দেখা গেছে। খুলতে শুরু করেছে দোকানপাট। মানুষ নিত্যদিনের স্বাভাবিক কাজে ফিরছেন। যদিও অনেকে বলছেন, তাঁরা যেকোনো পরিস্থিতির জন্য সতর্ক আছেন।

শ্রীনগরের হায়দারপোরা এলাকায় একটি মুদিদোকান চালান মোহাম্মদ আনাস। যুদ্ধবিরতির পর দোকান খুলেছেন তিনি। বললেন, ‘আমরা সতর্ক আছি। কেননা এ যুদ্ধবিরতি কত দিন টিকবে, সেটা কেউ জানে না।’ আজ ভোরে অনেকে একটি বেকারির সামনে ভিড় করেছিলেন। রুটি কেনার জন্য সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা শাকিলা জান বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির খবরে আমি খুব খুশি। কিন্তু গত রাতেও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। এটা আমাকে আবারও উদ্বিগ্ন করেছে।’ শাকিলা আরও বলেন, ‘আমরা আর কোনো দেশকেই বিশ্বাস করি না। তারা যেকোনো মুহূর্তে মন পরিবর্তন করতে পারে।’ ‘আমরা সবাই শান্তি চাই। মর্যাদার সঙ্গে স্বাভাবিক জীবন চাই। রাজনীতির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই’, যোগ করেন শাকিলা।

সূত্র : ডন, সিএনএন, ইন্টারন্যাশনাল দ্য নিউজ, আল-জাজিরা, এনডিটিভি।

 

Exit mobile version