শুজা রশীদ : (পর্ব ৫০)

৭৩

রিমা মনে মনে চেয়েছিল মিলা ওকে অযথা নির্বাচন সংক্রান্ত কর্মকান্ডের মধ্যে না টানুক। রাজনীতি নিয়ে ওর কখনই কোন আগ্রহ ছিল না। এন ডি পি থেকে বাংলাদেশী যে মেয়েটা ভোটে দাঁড়িয়েছে তাকে সমর্থন করতে ওর কোন আপত্তি নেই, তার নির্বাচনী ফান্ডে হাজার দুয়েক ডলার দিতেও ও রাজী, কিন্তু সশরীরে কোথাও হাজিরা দিতে চায় না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। মিলার সমস্যা হচ্ছে যা করে একেবারে জান প্রাণ দিয়ে করে। একটা ব্যাপারে অবশ্য রিমা খুশীই হয়েছে। এই নির্বাচন জিতে ইতিহাস সৃষ্টি করবার আগ্রহ এবং উদ্দীপনায় প্রেম সংক্রান্ত ব্যাথা বেদনা আপাতত ভুলে গেছে তার বান্ধবী। কিন্তু সে আবার একাকী কোন কিছু করতে চায় না। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরকে সব কিছুর মধ্যে সে টানবেই। রিমা জানে শত চেষ্টা করলেও তার হাত থেকেও নিস্তার পাবে না।

মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ। রিমা আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওর দোকানটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুলতে। কিন্তু কাজ যেন শেষ হয় না। একদিন সকালে মিলা এসে হাজির হল। কোথায় নাকি নির্বাচন সংক্রান্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে। রিমা যেহেতু নির্বাচনী ফান্ডে টাকা পয়সা দিয়েছে, দাতা হিসাবে তার সেই মিটিংয়ে থাকাটা নাকি খুবই জরুরি।

সেন্ট ক্লেয়ার এভ আর ওয়ার্ডেন এভের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত ওয়ার্ডেন উডস পার্কের কাছে একটা বিশাল দোতলা বাড়ির লিভিং রুমে হল মিটিং। এখান থেক ওয়ার্ডেন এভ সাবওয়ে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। যে কারণে এই এলাকায় বাসার দাম তুঙ্গে উঠেছে, জানে রিমা। মিটিংয়ে মিলা ছাড়া আর কাউকেই চেনে না ও। প্রথম যার সাথে রিমার পরিচয় করিয়ে দিল মিলা সে হচ্ছে আয়েশা। তার বয়েস বিশ বাইশ মনে হল, সুশ্রী, বন্ধুত্বপূর্ণ মুখে এক জোড়া উজ্জ্বল চোখ। পরনে প্যান্ট এবং শার্ট, মাথায় টাইট করে হিজাব পরা, দেখলেই বোঝা যায় তার শারীরিক আকার আকৃতি ক্ষুদ্রকায় হলেও মন মানসিকতায় সে অনেক শক্তিমতী।

ডজন খানাকের মত মানুষ জড় হয়েছে, পুরুষ মহিলা আধাআধি। মিলা সবার সাথেই একে একে ওর পরিচয় করিয়ে দিল। দেখা গেল অভ্যাগতরা শুধু যে ওকে নামে চেনে তাই নয় ওর সম্বন্ধে প্রায় সবই ওয়াকিবহাল। রিমা খুব একটা অবাক হল না। তবে উপস্থির সকলকেই বেশ উদারচেতা মনে হল। ওর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়নি কেউ। ওর স্বামীর মৃত্যু নিয়ে পেছনে পেছনে কানাঘুষা শুরু করেনি। বরং সবাই ওকে সহানুভূতি জানিয়েছে।
ব্যাপারটা ভালো লেগেছে ওর। একজন স্বল্প পরিচিত নির্বাচন প্রার্থীর সমর্থনে সমবেত হয়েছে তারা। তাদের আচার আচরণে উৎসাহ আর উদ্যমের ছড়াছড়ি। এই নির্বাচনে জিততে পারলে কানাডায় বাংলাদেশী অভিবাসীদের চেহারা পালটে যেতে পারে। সেই মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে এগুচ্ছে সবাই। অল্প পরিচয়েই দলের সকলকে বেশ পছন্দ হয়ে গেল রিমার।
কিছুক্ষণ পরে নোমানকে এসে হাজির হতে দেখে অবাকই হল। তার চেয়েও বেশী অবাক হল মিলার উচ্ছ্বাস দেখে। দরজা পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলো। সবাইকে লক্ষ্য করে আহ্লাদি কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল, “এই! দেখ কে এসেছে!”

নোমান উপস্থিত সবাইকে বেশ ভালো ভাবেই চেনে। সবাইকে অভিবাদন জানাল। রিমাতে দেখে তারও অবাক হবার পালা। “বিশিষ্ট ব্যবসায়ী যে এই মিটিংয়ে চলে আসবেন সেটা তো আমি একেবারেই আন্দাজ করি নি,” ঠাট্টা করে বলল।
উত্তরটা এলো মিলার কাছ থেকে। “একটু খোঁচাখুঁচি করতে হয়েছে।”
“এক রকম ধরেই নিয়ে এসেছে,” রিমা অসহায় কন্ঠে বলল।
হাসল মিলা। “বেশ করেছি!”
রিমা ছদ্ম কোপে তার পিঠে আলতো করে একটা চাপড় বসাল।
ওর পাশেই একটা চেয়ারে বসল নোমান। “তোমার খবর-টবর কি?”
“চলে যাচ্ছে,” রিমা হেসে বলল। “জানতাম না তুমিও এই সবের সাথে জড়িয়ে গেছ।”
“নিরুপায় হয়েই জড়াতে হয়েছে। বুঝতেই তো পারছ কার কাজ।”
“তাইই ভেবেছিলাম,” রিমা হাসতে হাসতে বলল।

অল্পক্ষণ পরে একটা প্রাথমিক বক্তব্য রেখে আয়েশা মিটিং শুরু করল। “কয়েক মাস আগে আমার বন্ধু ডলি যখন আমাকে বলল ও প্রভিন্সিয়াল এম পি ইলেকশনে দাঁড়াবে আমি লাফ দিয়ে উঠেছিলাম। কানাডাতে প্রায় এক লক্ষ বাংলাদেশী আছে, এই GTA তেই আছে প্রায় ষাট হাজারের মত। অথচ আমাদের ভেতর থেকে এখন পর্যন্ত একজনও এম পি নির্বাচিত হয়নি। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। যে কারণে প্রথন থেকেই ডলিকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছি আমি। ওর চেয়ে ভালো প্রার্থী আর কে হতে পারে? ওর বাবা মা কানাডায় এসেছিলেন ২০০২ সালে। একটা মারাত্বক সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে ওর বাবা একরকম অক্ষম হয়ে পড়েন। কষ্ট করে বড় হয়ে হয়েছে ডলি, দেখেছে অভিবাসীদের নানা ধরনের সমস্যা। স্থানীয় কাউন্সেলরদের সাথে ঘনিষ্ট ভাবে কাজ করেছে বছরের পর বছর। এনডিপির স্থানীয় চ্যপ্টারের সাথে জড়িত আছে দীর্ঘ দিন ধরে। শুধু আমার বান্ধবী বলে বলছি না, মানুষ হিসাবে ওর তুলনা হয় না। ও নম্র, ভদ্র, সুভাষী, এলাকার মানুষদের সমস্যা বুঝবে এবং তার প্রতিকার করবার চেষ্টা করবে।”

ডলি নিজেই এসে উপস্থিত হল কিছুক্ষণ পরে। মেয়েটার সাথে রিমার আগে কখন পরিচয় হয় নি। কিন্তু দেখেই ভালো লেগে গেল। আশা করেছিল এক রাজণীতিবিদ, দেখল হাসি খুশী আলাপী একটা মেয়ে যাকে দেখলে মনে হয় কত কালের পরিচয়। কথা বার্তাতেও তুখোড়, বিনীত, স্পষ্টভাষী। জানাল ওর দল এবং পরিবার ওকে অর্থনৈতিকভাবে অনেক সাহায্য সহযোগীতা করছে কিন্তু তারপরও দাতার প্রয়োজন হবে। এই জাতীয় নির্বাচন সাধারণত যেমন দীর্ঘ হয় তেমন হয় ব্যায়বহুল।

নির্বাচনের এখনই মাস চারেক বাকী। লিবারেল প্রিমিয়ার ক্যাথলিন ওয়েনের জনপ্রিয়তা মাটিতে লুটপুটি খাচ্ছে ওন্টারিওর পাওয়ার অবকাঠামোসহ আরোও কিছু ক্ষেত্রে তার ব্যার্থতার কারণে। সবার ধারণা তার জন্যেই তার পার্টীও আগামী নির্বাচনে ভুক্তভোগী হবে। এই এলাকায় বহু বছর ধরে লিবারেলেরই রাজত্ব। কিন্তু এইবার শুধু ডলি নয় অন্যান্য পার্টীর প্রার্থীরাও আশান্বিত হয়ে উঠেছে। অতীতে লিবারেলের ব্যার্থতার কারণে সাধারণত এনডিপি উপকৃত হয়েছে। এইবারও তেমন কিছু একটা হবার সম্ভাবনা দেখছে সবাই। কিন্তু ভোটে জিততে হলে শুধু এনডিপির সমর্থকদের ভোট পেলেই চলবে না, এলাকায় বসবাসরত সকল বাংলাদেশী অভিবাসীদেরকে তাদের পার্টির উর্দ্ধে উঠে তাকে ভোট দিতে হবে।

ঘন্টা দুই পরে রিমা যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মিটিংয়ে এসে ওর ভালোই লেগেছে কিন্তু এবার যাওয়া দরকার। ওর অনেক কাজ পড়ে আছে। আসার সময় মিলার সাথে এসেছিল কিন্তু দেখল মিলা ভীষণ ব্যাস্ত। কথা বলার সুযোগই পেল না রিমা। নোমান ওর ব্যাস্ততা খেয়াল করে থাকবে। খোঁজ নিতে এলো।
“চলে যাবে?”
“হ্যাঁ, যেতে হবে,” রিমা বলল।
“আমি নামিয়ে দেব?” নোমান বলল।
“যদি তোমার কোন অসুবিধা না হয়। মিলা তো দেখছি খুব ব্যাস্ত।”
নোমান মিলার সাথে কথা বলে দ্রæত ফিরে এলো। “চল। মিলার এখনও বেশ কিছুক্ষণ থাকতে হবে।”
রিমা যাবার আগে দূর থেকে মিলাকে লক্ষ্য করে হাত নাড়ল। মিলা প্রত্যুত্তরে হাত নেড়ে চীৎকার করে কিছু একটা বলল। কিছুই বুঝল না রিমা।
ফিরতি পথে ওর দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকাল নোমান। “দোকানে তোমাকে সাহায্য করছে কে? আমার হাতে অনেক সময় আছে। যদি চাও।”
“লাগবে না,” রিমা বলল। কয়েক মুহুর্ত নীরব থাকার পর বলল, “এবার খুলে বল, ডলির ক্যাম্পেইনে কিভাবে জড়িয়ে পড়লে।”
“বুঝতেই তো পারছ, মিলাই এনেছে আমাকে” নোমান হেসে বলল। “জানইতো কেমন নাছোড়বান্দা ও। তোমাকে তো বলেছিলাম, ওর সাথে এক অনুষ্ঠানে পরিচয় হয়েছিল। ফোন নাম্বার নিয়েছিল। দিন দুই পর আমাকে ফোন দিয়ে সাহায্য চাইল। না বলতে পারিনি। উদ্যোগটা খুবই ভালো। জানি ডলির জেতার সম্ভাবনা কম কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাতে বেশি সময় লাগে না।”

রিমা আলতো করে মাথা দোলাল। মিলা যেমন সুন্দরী তেমন আকর্ষনীয়। প্রেম সংক্রান্ত ব্যাপারে ওর কোন বাঁধা-বন্ধন নেই। অনেক দেশী মেয়েই বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা থেকে বিরত থাকে। মিলা সেই সবের তোয়াক্কা করে না। নোমান সব দিক থেকে সুযোগ্য, নিঃসঙ্গ। দু’ জনার মধ্যে যদি কিছু একটা হয়েই যায় তাতে ও দু’ জনার কাউকেই দোষ দিতে পারবে না।

নোমান ওকে দোকানে নামিয়ে দিয়েই চলে গেল না। গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষন ঘুরে ঘুরে দেখল। শেলফ বানানোর কাজ হয়ে গেছে। কাপড় টাঙ্গানোর হ্যঙ্গারগুলো কয়েক দিনের মধ্যে এসে পড়বে। ফার্নিচার কেনা হয়ে গেছে, জায়গা মত বসেও গেছে। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে দোকান খুলতে পারবে বলে রিমার বিশ্বাস।
এখনও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ বাকী রয়ে গেছে। নোমানের নজর এড়াল না। “তোমার সাইন বোর্ড কোথায়?”
রিমা হাসল। “আসবে।”
“কি নাম রেখেছ দোকানের?”
“খুব সাধাসিধা কিন্তু মনে হল যথাযথ,” রিমা রহস্য করে বলল। “জানতে হলে আরোও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।”
হেসে কাঁধ ঝাঁকাল নোমান। “অপেক্ষাই সই। কোন রকম সাহায্য লাগলে জানিও।”
“সাহায্য লাগলে কখন কি না নিয়ে থেকেছি,” রিমা আড় চোখে তাকিয়ে অর্থপূর্ণভাবে বলে।
“তুমি তো কখনই কিছু চাও না। আমাকেই জোর করে করতে হয়।” নোমান বলল।
“দরকার হলে নিশ্চয় চাইব,” রিমা হেসে বলল। “যাও এবার। ওরা তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে।”

৭৪
সেন্ট ক্লেয়ারে ডলির প্রাথমিক নির্বাচন সংক্রান্ত মিটিংটাতে যেতে চেয়েছিল মরিয়ম। পুরানো এক বন্ধুর কাছ থেকে আয়েশার ফোন নাম্বার পেয়ে তাকে ফোন দিয়েছিল, সাহায্য করবার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। যেতে পারলে সবার সাথে পরিচয় হবার একটা সুযোগ পাওয়া যেত। কিন্তু দোলনের জন্য বাসায় খুব একটা গোলমেলে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং না পারলে বাসা থেকে বের হয় না মরিয়ম। কয়েক দিন আগে দোলন ডাইনিং টেবিলের উপর হাতে লেখা ছোট্ট একটা নোট রেখে বাইরে গিয়েছিল।
বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে দেরী হবে। দোলন।

তারপর সারা দিন তার কোন খবর নেই। মরিয়মের ফোন ধরেওনি, টেক্সট মেসেজেরও কোন উত্তর দেয়নি। বিকালের দিকে কালামের টেক্সট পেয়ে জানতে পারল দোলন গেছে লরার সাথে দেখা করতে। বাসায় সবাই চিন্তায় পাগল হয়ে যাবার জোগাড়- বিশেষ করে ওর বাবা মা। তারা আবুলকে অফিস থেকে ডেকে বাসায় পর্যন্ত নিয়ে এসেছিলেন।

দোলন আগে কখনই খুব একটা বহির্গামী ছিল না। অধিকাংশ দিন সে বাসায় বসে হয় বাসার কাজ কর্ম করত নয়ত সেলফোনে ফেসবুকে গিয়ে সময় কাটাত। মাঝে সাঝে দোকানে যেত, কিন্তু একাকী প্রায় কখনই না। ইদানীং তার মাঝে বেশ কিছু বড় সড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সুযোগ পেলেই গাড়ী নিয়ে বাইরে চলে যায়। মাঝে মাঝে বলে যায়, মাঝে মাঝে তারও প্রয়োজন বোধ করে না। আবুল সন্দেহপ্রবণ স্বামী নয়। সে দোলনকে ভালোবাসে এবং বিশ্বাস করে। যখন দোলন তার ফোনও ধরে না তখন স্ত্রীর নিরাপত্তা কথা চিন্তা করে সে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন বোধ করে। যে দিন দোলন লরার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল সেই দিন কালামের টেক্সট পাবার পরই ওরা সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। দোলন বাসায় ফিরবার পর স্বাভাবিকভাবেই তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়েছিল। দোলন তাতে খুবই অপমানিত বোধ করে। বন্ধুদের সাথে বাইরে যাবার অধিকার কি তার নেই? সে কি এই পরিবারের দাসত্ব করছে?

ঘটনা সেখানে থেমে গেলেও হত। শ্বাশুড়ী দোলনের পিছু ছাড়লেন না। দোলন লরাকে কিভাবে চেনে? রেস্টুরেন্টে কবে কখন গিয়েছিল? কেন গিয়েছিল? মিথ্যা বলায় দোলন খুব একটা পারদর্শী না। অবশেষে সত্যটা বেরিয়ে এলো। তাদের দুজনার সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্বের হোক আর না হোক, সে যে কালামের সাথে বাইরে দেখা করেছে এই তথ্য জানার পর থেকেই পুরো পরিস্থিতি খুবই জটিল হয়ে গেছে। এমনকি আবুল পর্যন্ত মন খারাপ করে আছে। সবাই এমনভাবে মরিয়মের দিকে তাকাচ্ছে যেন সে-ই এই সব কিছুর জন্য দায়ী। কালাম তো তার মেয়েদেরই গৃহ শিক্ষক। কি যন্ত্রণা!

মরিয়ম চেষ্টা করে ওর বাবা-মায়ের সাথে দোলনকে একাকী রেখে কোথাও না যেতে। তাদের সার্বক্ষনিক বিড়বিড়ানি বিশেষ করে ওর মায়ের ক্রমাগত গঞ্জনায় অতিষ্ট হয়ে উঠেছে দোলন, ইদানীং সেও ফুঁসে উঠতে শুরু করেছে। সুন্দরী, তরুণী স্ত্রীর উপর আবুলের কখনই তেমন কোন আধিপত্য ছিল না। সে সাধারণত তার বোনের উপরেই সব সময় নির্ভর করেছে।
মরিয়ম একটু দিশেহারা বোধ করছে। কালামকে ছাঁটাই করতে পারে কিন্তু তাতে এই সমস্যার সমাধান হবে না। দোলন চাইলেই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং বাইরে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারে। বরং কালাম কাজে বহাল থাকলেই ভালো। মরিয়মের কিছু নিয়ন্ত্রন থাকবে। ও শুধু মনে মনে প্রার্থনা করছে পিন্টু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদেরকে যেন বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে। মরিয়মকে ফিরে যাবার জন্য তার সাধ্য সাধনা করবারও আর কোন প্রয়োজন নেই। ভদ্রভাবে বললেই বাক্স পোটরা গুছিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে রওনা দেবে মরিয়ম। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত, গর্দভটা এখন পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই করে নি। তবে প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও ফোন দেয়, সাধারণত রাতে বিছানায় গিয়ে, কথা বলতে বলতে দুজনার ঘুম এসে যায়। ভালোই লাগে মরিয়মের। খানিকটা রোমান্টিক মনে হয়। আগে কখন ভাবে নি পিন্টুর পক্ষে এমনটা করা সম্ভব।

মিটিংয়ে যেতে না পেরে মনটা একটু খারাপই লাগছিল। বাসায় তেমন কিছু করার নেই। দেখল লিভিং রুমে ওর দুই মেয়ের সাথে খুব আড্ডা চলছে দোলনের। পিন্টুকে ফোন দিল ও। এই সময়ে রেস্টুরেন্টে থাকার কথা।
“মরিয়ম?” ফোনের পিন্টুর কন্ঠ শান্ত শোনাল।
“ব্যাস্ত?”
“তেমন ব্যাস্ত না।” পিন্টুর কন্ঠ নীরস শোনায়। “তুমি কোথায়? বাসায়?”
“হ্যাঁ। মেয়েরা দোলনের সাথে গল্প করছে। আমি বেকার বসে আছি।” অকারণেই হাসল। “এই শোন, সেদিন রাতে টাকা পয়সা নিয়ে আলাপ করছিলে। কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছ?”
পিন্টূ কয়েক মুহুর্ত নীরব থাকল। “তেমন কিছু করার নেই, মরিয়ম। হয় আমাদের ব্যঙ্করাপসি ঘোষনা করতে হবে নয়ত জীবন যাত্রার মান কমাতে হবে। কিন্তু যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। ঋণের পরিমাণ হু হু করে বাড়ছে।”
তার কন্ঠে হতাশার ছোঁয়া। মরিয়মের খারাপই লাগে। জানে এই লোকটার অনেক বড় বড় স্বপ্ন ছিল কিন্তু এখন কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে পথ খুঁজে পাচ্ছে না। “পিন্টু, তোমার তো একাকী সব কিছু সামলানোর দরকার নেই।”

পিন্টু সশব্দে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। “সরি মরিয়ম। তোমাদেরকে খুব মিস করছি। মিথ্যা বলছি না। কিন্তু এই ঝামেলার মধ্যে তোমাদেরকে টেনে আনতে চাই না। আমাকে মাস দু’য়েক সময় দাও। আমি আবার প্রথম থেকে সব কিছু শুরু করতে চাই। তোমাকে আমি কোন কষ্ট করতে দেব না। সব ঠিক ঠাক করে লিমসিন ভাড়া করে তোমাদেরকে নিয়ে আসব।”
কি? দুই মাস! লিমোসিনে কে উঠতে চেয়েছে?
মরিয়ম একটা বড় করে শ্বাস নিল। “তুমি মনে হয় রেস্টুরেন্টে?”
“হ্যাঁ। অফিস রুমে বসে আছি। হিসাব কিতাব করছি। লরা সামনে সামলাচ্ছে। কেন?”
“আমি বিশ মিনিটের মধ্যে আসছি,” মরিয়ম বলল। “তোমাকে আমি একাকী এতো ঝামেলার সহ্য করতে দেব না।”
পিন্টু নীরব থেকে বলল, “চলে আসো। আলাপ করা যাবে। ডিনারকে বলছি তোমার প্রিয় চিকেন কাবাব বানাতে। একসাথে লাঞ্চ করব।”

মরিয়ম ফোন রেখে দিল। অনেকগুলো বছর পিন্টুকে নিজের মত যা ইচ্ছা করবার সুযোগ দিয়েছে ও। সেটাই হয়ত ওর ভুল ছিল। এবার এই পাগলা ঘোড়াটার লাগাম টেনে ধরে তাকে নিয়ন্ত্রণ করবার সময় এসেছে। নীরবে বসে থেকে কোন সমস্যারই সমাধান করা যায় না। তেমন আশা করাটাই মস্ত ভুল।