কামাল কাদের : — Do you love me?

মেয়েলী কণ্ঠে আচমকা কথাটি পিনাকীর কানে ভেসে আসলো। বাসের সীটে বসানো অবস্থায় সে পিছনে ফিরে তাকালো। দেখতে পেলো তারই ঠিক পিছনের সীটে বসা ২৪/২৫ বছরের এক সুন্দরী যুবতীর মুখ বেয়ে লালা পড়ছে, আর বলে চলছে, “Do you love me?” কিছুক্ষণ পর পর “হি, হি”, করে হাসছে। হাসির মাঝে কেমন যেন এক বেদনার উচ্ছ¡াস দেখা যায়। যুবতীর পরনে সালোয়ার কামিজ, ইন্দো-এশিয়ান বংশধর হবে। যাত্রীদের মাঝে সবাই চুপ চাপ, কারো দিকে কারোর কোন খেয়াল নেই। পশ্চিমা বিদেশে এই এক গুন্। কেউ কারো ক্ষতি না করলে যাত্রীরা কে কি বলছে, অথবা কে কি করছে তা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। তবুও মায়াভরা এক সুন্দরী যুবতী এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দৃশ্যটা যেন পিনাকীর কাছে বেখাপ্পা মনে হলো। ভাবলো, হয়তোবা এরা উন্নত এবং শিক্ষিত জাতি বলেই এটাই তাদের সৌজন্য এবং শিষ্টাচারের বিশেষ লক্ষণ।

পিনাকী সেন ঢাকার বেসরকারী ইউনিভার্সিটি মেডিকেল কলেজ থেকে এম,বি,বি,এস পাশ করে কানাডায় এসেছে। প্রায় দু বছর হলো। এখানে পার্মানেন্টলি থাকার ইচ্ছে ছিলো না। উদ্দশ্য একটাই ছিল, মেডিসিনে উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে দেশের ছেলে দেশে ফিরে ডাক্তারী পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে জনসাধারনের সেবা করে যাবে। তার আর হলো না। ইংল্যান্ড থেকে মেডিসিনের উপর উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার খুব ইচ্ছে ছিল, কারণ আমাদের দেশে এখনো অনন্যা বিদেশী ডিগ্রীর মাঝে ইংল্যান্ডের ডিগ্রীকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কিন্তু ইংল্যান্ডে বহিরাগত ছাত্রদের আগের মতো সে সব সুযোগ সুবিধা আর নাই। খুবই ব্যায়বহুল। সেই তুলনায় কানাডায় লেখাপড়ার সুযোগটা অনেক। আর দ্বিধা না করে পিনাকী স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে সোজা কানাডার টরন্টো শহরে ঘাঁটি বাধঁলো। এখানে এসেও দেখলো লেখাপড়া করাটা ব্যায় সাপেক্ষ। একটা “কেয়ার হোমে” খণ্ডকালীন কাজ জোগাড় করে নিলো তার সাথে নিজেকে MCCQE (মেডিকেল কাউন্সিল অফ কানাডা কোয়ালিফায়িং এক্সামিনেশন) পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলো। ডাক্তারী করতে হলে এই পরীক্ষায় পাশ না করতে পারলে কানাডাতে ডাক্তারী করার লাইসেন্স পাওয়া যায় না। কয়েক বার পরীক্ষা দেয়ার পর পাশ করা আর হলো না। নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগলো, সেই সাথে দেশে ফিরে যাবার কথা মাথা থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। ডাক্তারী ছাড়া অন্য কোনো লাইনে চাকরী করা যায় কিনা সে ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে লাগলো।

কপাল ভালোই বলতে হবে, যে “কেয়ার হোমে” সে কাজ করতো সেখানে তার এক শেতাঙ্গ কলিগের সাথে বেশ ভাব হয়। সেই তাকে উপদেশ দিলো, “তোমার তো মেডিকেল স্টাডিজের উপর পড়াশুনা রয়েছে সে সুবাদে “Diploma in Psychiatry” কোর্সটা করে ফেলো, মানসিক রোগের চিকিৎসা এবং আরোগ্য বিধান। পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেই রাতারাতি মোটা অংকের চাকরী পেয়ে যাবে। কারণটা হলো ওই লাইনে সহজে কেউ পড়তে চায় না, বলে পাগলদের নিয়ে কাজ কারবার, না বাবা ওরকম কোর্স করার দরকার নাই। ফলে চাকরীর বাজারে অসম্ভম চাহিদা। বেতন ও ডাক্তারদের চাইতে কোনো অংশে কম না।” পিনাকীর প্রস্তাবটা যুৎসই মনে হলো। তাই সময় আর নষ্ট না করে কোর্সটিতে লেগে পড়লো। এরই মধ্যে জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করেছে, তাই খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে ডিপ্লোমা কোর্সটিতে কৃতকার্য হলো।

টরন্টো থেকে অলধী শহরটি প্রায় ২৮ মাইলের ব্যাবধান। সে শহরের “অন্টারিও পাবলিক মেন্টাল হসপিটাল” নামে একটা মানসিক হাসপাতালে ক্লিনিকাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরী পেলো, সাথে হসপিটালের সংলগ্ন থাকার ফ্লাটও জুটিয়ে নিলো। ডাক্তারী চাকরী না হলেও এই পেশায় ক্যারিয়ার গড়া যাবে ভেবে পিনাকী মনকে সান্তনা দিচ্ছে, “যাক গে, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যাবে তো!” অলধী শহরটা নিতান্তই ছোট্ট শহর। আধঘন্টার ভিতর পুরো শহরটা ঘুরে ফেলা যায়। হাসপাতালটি একটু শহরের বাইরে, বিপুল খোলামেলা জায়গা নিয়ে অবস্থিত। একদিন রোজকার মতো শপিং করার সময় ওই বেদনাদায়ক দৃশ্যটি পিনাকীর চোখে পড়লো। আজকাল কানাডা সরকার হালকা মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগীদেরকে সাধারণের সাথে মিলে মিশে থাকার প্রয়াসে হাসপাতালে থাকার পরিবর্তে নিজেদের বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ এবং উৎসাহ দিয়ে থাকে। তাই তো এসমস্ত রোগী শহরের আশে পাশে প্রায়শ দেখা যায়। অনেক সময় বোঝা মুশকিল, কে যে রোগী, আর কে না!

পিনাকী যে হাসপাতালে কাজ করে সেখানে অত্যন্ত সংকটজনক মানসিক রোগীদের চিকিৎসা করা হয়। তার মানে যে সমস্ত রোগী শারীরিক এবং মানসিকভাবে সম্পূর্ণ রূপে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং নিজেকে নিজে আর কোনোমতে সামাল দিতে পারে না, তাদেরকেই হাসপাতালে রাখা হয়। এমনি পরিস্থিতিতে “প্রাপ্তি বসু” নামে এক রোগীর আগমন হলো। “বসু” পদবি দেখে ভাবলো বাঙালি হবে। হাসপাতালে রোগীর রেজিস্ট্রেশন করার সময় রোগীর অভিবাবকদের সাথে আলাপ হলো। অভিভাবক বলতে রোগীর বাবা আর মা এবং তার সাথে পিনাকীর ধারণাটা সত্যিই হলো, তারা বাঙালি। হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী, ক্লিনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে পিনাকী রোগীর অতীতের ঘটনাসমূহ লিপিবদ্ধ করার জন্য তৈরি হলো। রোগীর মা শুরু করলো তাদের মেয়ের জীবনের আকস্মিক পরিবর্তন।

“সে দিনটি প্রাপ্তির জীবনে সবচেয়ে সুখীময় দিন হতে চলছিল। নানা রকম মধুর স্বপ্ন এবং পরিকল্পনা ধারণ করে অবশেষে চার বছেরর পরিচয়ের ভালোবাসার সাথীকে সে বিয়ে করতে যাচ্ছিলো। যেই না সাত পাঁকে ঘুরতে শুরু করলো, তখনই দীপঙ্করের হৎপিন্ডের চলাচল বন্ধ (Cardiac Arrest) হয়ে গেলো। আমরা CPR (Cardiopulmonary Resuscitation) চালিয়ে গেলাম কিন্তু সে আর জেগে উঠলো না। ঘটনার দু দিন পরে দীপঙ্কর হাসপাতালে মারা গেলো।

দীপঙ্করের সাথে প্রাপ্তির পরিচয় হয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে। দুজনেই একই ক্লাসে, একই সাবজেক্ট নিয়ে চার বছর পড়াশুনা করেছিল। এই দীর্ঘ সময়ে একজন আরেক জনকে জানার প্রচুর সময় পেয়েছিলো। য়ুনিভার্সিটির নবাগত ছাত্রছাত্রীদের অভিষেক অনুষ্ঠানের দিন ওদের প্রথম পরিচয়। দীপঙ্করের অত্যন্ত মনোমুকদকর এবং চিত্ত আকর্ষণ করার মতো ব্যবহার, যেন জাদু মন্ত্রের মতো প্রাপ্তিকে পেয়ে বসলো। প্রথম দেখাতেই ওর প্রেমে পড়ে গেলো। দিন দিনে ওর শিশু সুলভ রসিকতা, তামাশা, কৌতুক, প্রাপ্তিকে প্রতি মুহূর্তে আনন্দে ভরিয়ে দিতো। দীপঙ্কর ছিল এক বিরাট ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আমরা, আমাদের পরিবারের সবাই তাকে মনেপ্রাণে ভালো বাসতাম। অগাস্টে ওদের ফাইনাল পরীক্ষার ফল বের হবার পর ওদের বাগদান হলো। উত্তেজনায় ওদের মন প্রাণ প্রজাপতির পাখার মতো ভেসে বেড়াতে শুরু করলো। সবাই সেই বিশেষ দিনটির অপেক্ষায় দিন গুনতে লাগলো। তারপর, সব স্বপ্ন এক নিমেষে ধ্বংস হয়ে গেলো!”

কথাগুলি বলে মিসেস বসু কিছুক্ষণ নীরব থাকলো। পাশেই মিস্টার বসু, মিসেস বসুর হাত দুটি ধরে সমবেদনা প্রকাশ করলো। কিছুটা দম নিয়ে মিসেস বসু বললো, “সেই থেকে মেয়েটি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতো, কোনো কথা বলতো না। তার কিছুদিন পর প্রাপ্তির স্বভাবের পরিবর্তন ঘটলো। তার একগুঁয়ে, জেদী ব্যবহারে আমরা অতিষ্ঠিত হয়ে পড়লাম। ওকে নিয়ে বাইরে বেরুলে আমরা বিব্রত বোধ করতাম। সে রাস্তায় কোনো পুরুষ মানুষকে দেখলেই বলে বেড়াতো, “তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?”

Do you love me? “সে এক লজ্জাজনক ব্যাপার। কিন্তু কি করবো, সন্তান তো আমাদের, ফেলে দিতে পারি না। ক্রমেই তার ব্যবহার চরমে উঠলো, তাই আপনাদের শরণাপন্ন হলাম”। “ভালোই করেছেন, আমরা আপনার মেয়ের চিকিৎসার কোনো ত্রুটি করবোনা, বাকিটা ভগবানের ইচ্ছা”। পিনাকী মিস্টার এবং মিসেস বসুকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করলো।

হাসপাতালের ফর্মালিটিজ শেষ করে পিনাকী তার সহকারী নার্স মিস ডোরিন হিথকে সাথে নিয়ে রোগীর ঘরে প্রবেশ করলো। রোগীকে দেখে পিনাকীর বিন্দু মাত্র অসুবিধা হলো না, এই সে রোগী যাকে নাকি সে কিছুদিন আগে রাস্তা রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখেছিল।

রোগীর কাছে আসতেই, বড় বড় চোখ করে পিনাকীকে প্রাপ্তি প্রশ্ন করলো, “Do you love me?”
– Yes, I do! পিনাকীর সোজা উত্তর।
– Then, Where have you been?
– I was away for some urgent business
– you know I love you dearly!
– Yes , that’s I know

তারপর আর কোনো কথা না বাড়িয়ে প্রাপ্তি পিনাকীকে সজোরে জড়িয়ে ধরে বললো “D’nt leave me again darling”।
– No , I will not
– promise
– I promise

এর কয়েক সপ্তাহের পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রাপ্তিকে হাসপাতাল থেকে মুক্তির জন্য অনুমোদন জারি করলো। দিনটি ছিল নীল, ঘন নীল আকাশ। প্রকৃতির কোন পরশে আকাশটাকে কে যেন হাতের মুঠোয় এনে দিলো। শেষ
email : quadersheikh@gmail.com