শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : “দরকার কি আমাকে দেখাবার! মরে যখন গেছেই, ওটাকে কোন জায়গায় ফেলে দিলেই তো হয়!”, আমি না সূচক ভঙ্গি করে মাথা নাড়লাম। মৃত পাখীটার শরীর থেকে একটা তীব্র পচা গন্ধ বেরিয়ে আসছিলো। হুই সিয়েন তখনও ওটাকে ধরে তাজিমের সাথে পুজার বেদীর উপর রেখে মাথা নীচু করে ওটার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছিলো। মৃত পাখীটাকে মর্যাদার সাথে সমাহিত করার হুই সিয়েনের এই আকাক্সক্ষা দেখে আমার বহুকাল আগের সেই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কথা মনে পড়লো! মোমবাতির অল্প আলোতে একটু এগিয়ে গিয়ে আমি মেয়েটির হাত ধরলাম। মেয়েটির অবয়বে দেখতে পেলাম এক অন্য রকম ভিন্ন মাত্রার ছায়া! ওর চেহারার উপরে যেন ভাসছে ঐ মরে যাওয়া ছোট পাখীটার একটা পালক। আর ঐ পালকটাই যেন ঢেকে রেখেছে মেয়েটির রক্তিম আভা যুক্ত সুন্দর চেহারাটা। আমি হাত দিয়ে ওর হীম শীতল মুখমণ্ডল স্পর্শ করলাম। আমার পুরো হাতের তালুটা ওর চোখ থেকে নেমে আসা অশ্রুজলে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে।

হুই সিয়েনের অশ্রুজল যেন ঝর্ণা ধারার মতো বয়ে যাচ্ছিলো। ফোঁপানো কান্নার মধ্যে সে মাঝে মাঝে থেমে আবৃত্তি করছিলো আমার পাঠানো প্রত্যেকটা গদ্য কবিতা। সব শেষে সে আবৃত্তি করলো ‘বর্জিত অক্ষরের দেব কাঞ্চন ফুল’ নামের কবিতাটা! তারপর সে হঠাত করেই সে আমার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পরলো, জড়িয়ে ধরলো আমাকে, আমিও এই হতভাগ্য মেয়েটাকে আমার বুকের সাথে চেপে ধরলাম সুদৃঢ়ভাবে! মেয়েটি যেন জ্ঞান হরিয়ে ফেলেছিলো আমার বুকে এসে? আমি ওকে জড়িয়ে ধরে থাকলাম অনেকক্ষণ, ওকে ছাড়লাম যখন মনে হলো ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে!

ঐ রাতে বাঁশ বাগানের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া শন শন শব্দ ভেসে আসছিলো বাইরে থেকে কড়ি কাঠবিহীন কক্ষের ভিতরে। মনে হচ্ছিল যেন, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ভেসে আসছে আনন্দহীন শোকাবহ ধ্বনি! কক্ষের ভিতরে পচা কাঠের গন্ধের সাথে মিশে গিয়েছিলো মেয়েটির শরীর থেকে আসা রাস্না ফুলের সুবাস। আমার, মনে হচ্ছিলো আমি যেন আছি স্বপ্নের ঘোরে! আমি জানি, এখন আমি সত্যি সত্যিই জড়িয়ে পরতে যাচ্ছি নারী-পুরুষের গভীর আবেগ আর প্রগাঢ় প্রেমের জালে!

“যে ভাবেই হোক, আমি এই মেয়েটিকে বিয়ে করবো, ওকে দেবো ছোট রানীর মর্যাদা!”, আমি ইয়েন লাঙ-এর উদ্দেশ্যে এ কথাগুলো বললাম।
শেষ কালে আমি আমার দুই অভিভাবক মহিলাকে রাজি করালাম হুমকি দিয়ে; যদি আমি হুই সিয়েনকে প্রাসাদের ছোট রানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি, তবে আমি অভিমানে আমার নিজের হাতের আঙ্গুল নিজেই ভেঙ্গে ফেলবো! এই চিন্তাটা মাথায় এসেছিলো ইয়েন লাঙের মুখ থেকে বলা একটা লোক কাহিনী শোনার পর! কাহিনীটা ছিলো এমন, চাং সিয়াং কোং নামের একটা পতিতা মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো একটা ছেলে।
বাবা-মা কিছুতেই রাজি হয় না! শেষমেশ ঐ ছেলেটি ওর বাপমায়ের সামনে কেটে ফেলে ছিলো নিজের হাতের একটা আঙ্গুল!

আমি জানি না, অতি বুদ্ধিমান ইয়েন লাঙ এই গল্পের মাধ্যমেই আমাকে এই জটিল সমস্যার সমাধানের একটা উপায়ের ইঙ্গিত দিচ্ছিলো কি না!
তবে বাস্তবে ওর ইঙ্গিতে প্রদান করা পদ্ধতিই করতে পেরেছিলো আমার সেই জটিল সমস্যার সমাধান!

আমার মনে আছে সে দিন বিকেল বেলা গুলজার কক্ষে বসা সুধী বৃন্দের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার কথা। আমি ছোট তলোয়ারের ধারালো দিকটা রেখেছিলাম আমার বাম হাতের তর্জনী আঙ্গুলটা বরাবর! দরবার কক্ষের আসনে উপবিষ্ট দুই ভদ্র মহিলা হয়ে পড়েছিলেন আতঙ্কিত! তাঁদের মুখ অবয়বে ফুটে উঠেছিলো আতঙ্ক মিশ্রিত বিস্ময়ের ভাব, আর ভিতরে ভিতরে তাঁরা হচ্ছিলেন চরমভাবে রাগান্বিত। পর্যায়ক্রমে খুবই অনিচ্ছার সাথে তাঁদের একগুঁয়ে সিদ্ধান্ত থেকে তাঁরা সরে এলেন, হয়ে গেলেন একে বারে নিঃশ্চুপ! আমার মা মং ফুরেন উঠে এসে টান দিয়ে আমার হাত থেকে ছোট তলোয়ারটা কেড়ে নিলেন। আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেন ছিলেন বেজীর চামড়ায় তৈরী একটা ধূসর রঙের কোট পরিহিত অবস্থায়, তাঁর দেহটা গরম জামার ভেতর যেন খানিকটা সংকুচিত হয়ে পরছিলো। হঠাত করেই শুনতে পেলাম তাঁর শোকাবহ দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ! আমার এই অপ্রত্যাশিত আচরণ বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে আসা তাঁর দেহটাতে যেন করেছে এক কঠিন কর্কশ আঘাত! তাঁর ধূসর সাদা চুলের মাথাটা বেশ হাস্যকরভাবে বাম থেকে ডানে ক্রমাগত এ দিক ও দিক করে তাঁর নেতিবাচকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছিলেন, তাঁর কুঁচকে যাওয়া ত্বক বিশিষ্ট মুখ অবয়ব বেয়ে নেমে আসছিলো অশ্রু ধারা!

আপাত দৃষ্টিতে দেখে মনে হচ্ছিলো আমি যেন দাবা খেলায় একটা ভুল চাল খেলেছি! হুয়াং ফু ফুরেন তাঁর পোষা চিতা বিড়ালটার দিকে তাকিয়ে, উদ্বেগ আর হতাশার গলায় তিনি যেন বিড়ালটার উদ্দেশ্যই বললেন, “একটা দেশের বাদশার এই অবস্থা হলো কি করে? দেখে মনে হচ্ছে তুয়ান পাই ওর বুড়ো আঙ্গুলটা দেখিয়েই সিয়ে দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার ভারসাম্যকে পুরোপুরি নষ্ট করে দিচ্ছে!”

রাজ প্রাসাদের রাষ্ট্রাচার সচিব এ দিক, ও দিক তাকিয়ে কলম হাতে বালাম বই খুলে বসলেন। সবশেষে তিনি বুঝতে পারলেন যে তার সামনে ঘটে যাওয়া নাটকীয় ঘটনাগুলোর অবসান হতে যাচ্ছে, হুই সিয়েনকে ছোট রানীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্তের কোন নড়চড় হবে না। ফিন চৌ এলাকা থেকে আসা হুই সিয়েন নামের গোত্র পরিচয়হীন অনভিজাত মেয়েটির নাম সোনালী রঙের বালাম বইতে লিপিবদ্ধ হলো, আর সে পরিণত হলো ছোট রানীতে। আমার নিজের পছন্দ মতো বেছে নেয়া এক মাত্র জন, এক মাত্র নারী!

হুই ছোট রানীর আগমন ঘটে ছিলো আমার ধারালো তলোয়ারের কল্যাণে! হুই ছোট রানী সিয়ে রাজ প্রাসাদে বাস করেছিলো ছয় বছর, কড়ি কাঠবিহীন কক্ষের পিছনে নির্মিত পক্ষী ক‚জন ঘরে! এই নামটা আমার দেয়া, আমারে পছন্দের! আমার নির্দেশে রাজকীয় সূত্রধররা নির্মাণ করেছিলো এই ছোট দালানটি। যা ছিলো আনন্দ আর বিষাদ মাখা বহু স্মৃতির স্বাক্ষী!

২.
ফং শ্রি-কে বড় রানী হিসাবে আমার গ্রহণ করার রাজনৈতিক পটভূমি সম্পর্কে সিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ অবগত ছিলো। সিয়ে দেশের ক্রমশ অধঃপতন আর এই একই সময়ে ফং কুয়ো দেশের জৌলুশ এবং সমৃদ্ধির ক্রমশ উন্নয়ন, যেন একটা চলমান দাবা খেলার মতো অগ্রসর হচ্ছিলো। কালো ঘুঁটি খেয়ে নিচ্ছে সাদা ঘুঁটিকে, এমন প্রবনতা এরই মধ্যে দৃশ্য মান হয়ে উঠেছে কিংবা উঠতে যাচ্ছে! আমার সিংহাসনে আরোহনের চতুর্থ বছরের বসন্ত কালে, সিয়ে কুয়ো দেশ এবং ফং কুয়ো দেশের মাঝে এক শত লি দীর্ঘ সীমান্ত রেখা বরাবর একটা উত্তপ্ত যুদ্ধ পরিস্থিতির খবর পাওয়া যাচ্ছিলো। মানুষ জনের মধ্যে বিরাজ করছিলো একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ। ওখানকার কৃষকরা জমি চাষের লাঙ্গল ও অন্যান্য কৃষি কাজের যন্ত্রপাতি সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে নিয়ে রাজধানী বরাবর সিয়ে দেশের ভিতরের দিকে ভয়ে পালিয়ে আসতে শুরু করেছে। ওরা নিয়ে আসছিলো আরও ভয়ের খবর! শোনা যাচ্ছিলো ফং কুয়ো দেশ কর্তৃক অধিকৃত ভূমির প্রান্ত সীমায় অবস্থিত নি চৌ শহরের প্রবেশ দ্বার বরাবর এসে দাঁড়িয়ে আছেন কর্তৃত্ব পরায়ণ নাক উঁচু প্রকৃতির মানুষ ফং কুয়ো দেশের রাজা চাও মিয়েন। মানুষ জন আরও বলাবলি করছে, যে ফং কুয়ো দেশের রাজা না কি, সিয়ে কুয়ো দেশকে হেয় করার জন্য সিয়ে দেশের রাজধানী বরাবর তাক করে মূত্র ত্যাগ করছেন! তিনি না কি, আরও হুমকি দিচ্ছেন যে ফং কুয়ো দেশের সেনা বাহিনী আট দিন আট রাতের মধ্যেই সিয়ে দেশের রাজার রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত দখল নিতে সক্ষম!

আমার বিয়ের প্রস্তাবটা ছিলো একটা বিপজ্জনক দাবা খেলার ঘুঁটি চালার মতো বিষয়! কোন সন্দেহ নাই, এই বিবাহ প্রস্তাব হতে পারে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা কমিয়ে আনতে সহায়ক বলে বিবেচিত একটা সর্বশেষ বুদ্ধিদীপ্ত দাবার চাল! ঐ সময়টাতে আমি ছিলাম একজন সাধারণ দুর্যোগ মোকাবেলাকারী সম্রাটের মতো, যে কিনা উদ্বিগ্ন আর অস্থির চিত্তে সারাক্ষণ বসে থাকে বিলাস কেন্দ্র প্রাসাদের ভেতরে! যে কি না কান খাড়া করে শুনে মন্ত্রী আর সেনাপতিদের তীক্ষ্ণ ধারালো বাক্যালাপ, তাদের প্রশ্ন বান, যেগুলোর প্রতিত্তোর দেয়া তার সাধ্যের বাইরে!

আমি ভালো করেই জানতাম যে, আমি একটা অক্ষম আর অপদার্থ সম্রাট! সব কিছুই চলে, আর সব কিছুরই আয়োজক হচ্ছেন আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেন, আমার মাতা মং ফুরেন এবং প্রধানমন্ত্রী ফং আও।
আমার কাজই হচ্ছে চুপচাপ মুখ বন্ধ করে নির্বাক হয়ে বসে থাকা!

ফং কুয়ো দেশে বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন আর আলোচনার গুরু দায়িত্বটি দেয়া হলো রাজ দরবারের বিবাচক লিউ ছিয়েন-কে। মধুর কন্ঠের মিষ্ট ভাষী লিউ ছিয়েনের কথাবার্তার বুদ্ধি দীপ্ত সাবলিলতার কারণে সে হয়ে উঠে ছিলো একজন দক্ষ ক‚টনীতিবিদে! দূত হিসাবে তাকে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে মন্ত্রী পরিষদের মধ্যে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো। সবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেন, তিনি একই সাথে একটা বড় ধরনের ঝুঁকিও নিলেন। তিনি লিউ ছিয়েনের ঘোড়ার গাড়িতে উঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন ছয় বাক্স সোনা, রূপা, মুক্তা আর নানাবিধ রত্ন পাথর, সাথে আরও দিলেন দেশের বিখ্যাত কিছু হস্তশিল্পের কাজ যা বিবেচিত হতো দেশের অমূল্য সম্পদ হিসাবে। লিউ ছিয়েন যাত্রা শুরু করার আগে হুয়াং ফু ফুরেন ওকে কথা দিলেন যে, যদি সে দ্রুততা ও সাফল্যের সাথে কাজটা শেষ করতে পারে, অর্থাত আমার সাথে ফং কুয়ো দেশের রাজকুমারীর বিয়ের প্রস্তাবটা ঐ দেশের রাজাকে সন্তুষ্ট করিয়ে যদি গ্রহণ করাতে পারে, তবে ফিরে আসার পর তিনি বরাদ্দ দিবেন হাজার বিঘা কৃষি জমি এবং অযুত ভরী স্বর্ণ। যা পাবে লিউ ছিয়েন কাজের সফলতার পুরষ্কার স্বরূপ!

আমার নিজের খানিকটা দুঃখ ভারাক্রান্ত ও নির্লিপ্ত আচরণের ব্যাপারটা কেউ ই যেন লক্ষ্য করলো না! কেউই জানে না দেশের ক্রান্তিকালে দৃঢ় চিত্তের ভাব নিয়ে বসে থাকা সিয়ে সম্রাটের ভূমিকা কতটা তুচ্ছ আর নগণ্য! ধাবমান ঘোড়ার খুড়ের প্রতিধ্বনি শুনার অপেক্ষায় থাকা সেই দিনগুলিতে, আমি বহু বার ভেবেছি ওয়েন তা নামের ফং দেশের রাজকন্যার অপরূপ রূপের কথা!

আমার বড় আকাক্সক্ষা হতো, ঐ মেয়েটির শরীরে যেন থাকে একটা মোহনীয় সুবাস, যে সৌরভটা আমি অনুভব করতাম হুই সিয়েনের শরীরে! আমার আকাক্সক্ষা ছিলো ঐ মেয়েটি তাই নিয়াং-এর মতো বীণার তারে তুলতে পারবে পাঁচ রকম সুরের ঝঙ্কার! আমি আরও আশা করেছি, ঐ মেয়েটি হবে বুদ্ধিমতী প্রজ্ঞাবান! ওর থাকবে ইয়েন লাঙের মতো আমার প্রতি যত্নশীল মমতাময় দৃষ্টি। যদিও এ সব কিছুই ছিলো আমার ঘোরের কল্পনা! (চলবে)