বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে টরন্টো ফিল্ম ফোরামের পাঁচ সদস্য শেখ শাহনওয়াজ, বিদ্যুৎ সরকার, ফয়েজ নুর ময়না, সাহিদুল আলম টুকু এবং আরিফ হোসেন বনি সিদ্ধান্ত নেন তারা পাঁচ দিন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকার টি-শার্ট পরে গাড়িতে ঘুরতে বের হবেন অজানার উদ্দেশ্যে। আগস্টের তিন তারিখে টরন্টো থেকে রওনা হয়ে তারা চলতে থাকেন অন্টারিও’র পথ ছাড়িয়ে কুইবেক, নিউ ব্রন্সুইক, নোভা স্কোশিয়া আর প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড প্রভিন্সের পথে পথে। প্রকৃতির মধ্যে উদ্দাম এক ছুটে চলার তারুণ্য আর কানাডার পাঁচ প্রভিন্সের পথে প্রান্তরের ছোট-বড় জনপদের অপরূপ সৌন্দর্য তারা তাদের দেহমনে মেখে নেন।
পাঁচ দিনে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটারের এক মহাকাব্যিক ভ্রমণ তাদের জীবনের এক মাহেন্দ্র সময়। এই পাঁচ দিনের ভ্রমণে তাদের মনোজগতে জমা হয়েছে পঞ্চাশ বছরের এক ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। তাদের এই ভ্রমণে নিউ ব্রন্সুইক এর দৃষ্টি নন্দন ‘হোপ ওয়েল কেভ’ সবাইকে বিমোহিত করেছে প্রচণ্ডভাবে। সেই বিমোহিত করা আবেশ আর বিস্ময়ের উপলব্ধি থেকে বিদ্যুৎ সরকার তাঁর কাব্যিক আবহে লিখেছেন ‘জল-পাথরের ভালোবাসা বাসি।’
এখানে জল আর পাথরের ভীষণ ভাব। কবে থেকে যে তাদের এ ভাব জমতে শুরু করেছিল তা শুধু পাহাড়টাই জানে। এ পাহাড়ের অমোঘ আস্কারাতেই প্রথম প্রথম খুনসুটি অতঃপর ভাবের আদান-প্রদান দু’জনায় পাথর আর জল। এক জলজ শিহরণ পাথরের গা ছুঁয়ে যায়। তাই বুঝি সারাটা বেলা পাথরকে জড়িয়ে থাকে চঞ্চল জল। দিনের মাঝে দু’এক বার যে ওদের মধ্যে মান অভিমান হয় না তা কিন্তু নয়। তখন জল তার সোহাগী হাত ছাড়িয়ে দূরে চলে যায় কিছু না বলেই।
তাতে পাথরের মন খারাপ। এক সময় জলতো ফিরে আসবে পাথরের একান্ত টানে। জল জানে ওর হৃদয়ের খবর, না বলা কথা, অনুচ্চারিত ভালো লাগার উপকরণ, উপাত্তসমূহ। ভাল লাগার ইচ্ছেটা যেমন জাগরুক সব সময়, রাগ করার অধিকারটুকুও আদায় করে নিয়েছে সজ্ঞানেই। তাই রাগ-অনুরাগের দোলাচল পাশা-পাশি, এক সমান্তরাল পথের সহযাত্রী দু’জন। অতি বর্ষণ বা স্নো ফল ওদের জন্য মন খারাপের দিন বয়ে আনে। তখনতো কেউই আসবে না বন্ধু হতে। শুধু একাকী দু’জন দু’জনার মুখ পানে চেয়ে থাকা অবিরত। একটু বাতাসে হৃদয় পুলকিত হয় শিহরন জাগে বক্ষ জুড়ে, ঢেউয়ের পরে ঢেউ উথাল-পাতাল তবুও কেন পাথরের ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে’ বলে উঠে বার বার। জলের মধ্যে থেকেও কেন জলের জন্য এতো হাহাকার?
একটু জলের সোহাগী হাতের ছোঁয়া, ভালোবাসার শীতল আর্দ্রতা পাথরকে কতটা শান্ত করে দেয় অশান্ত মুহূর্তগুলোতে তাতো কাছের এই পাহাড়টাই বলে দেবে। জন-মানবহীন একলা দুপুরগুলো কেমন এক বিষন্ন দুপুরে রূপান্তরিত হয়ে যায়। ক্লান্ত দু’চোখে তোমার চোখ ভাংগা চোখের অনুপ্রবেশ। তোমার চোখের যত স্বপ্ন এখনি বুঝি নেমে আসবে শুধু ছোট্ট ঢেউগুলোর মৃদু ছোঁয়া পেলেই। পাথর তুমি নিথর দেহে দাঁড়িয়ে থাক জল-যোগের অনুপম আশায়। যে নদী সমুদ্র অভিমুখী সে তো ছুটবেই মিলনের আকাক্সক্ষায়, ‘নদী চলে যাবে জানি সাগরের টানে…. ’।
এক অভিমানী পাথর কতটা একাকী হয়ে যায় বিষন্ন দুপুরগুলোর মতোন। শুধু নিস্তব্ধতা তার সংগী হয়ে যায়। হিরন্ময় সকালগুলো কেমন ধূসর হয়ে যায় মেঘময় বেলা-অবেলায়। এভাবেই বুঝি দুঃখগুলো জমে জমে এক দিন মস্ত একটি পাথরে রূপান্তরিত হয়ে যায়।