অনলাইন ডেস্ক : পবিত্র কোরআনের উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছে আল্লাহর নিয়ামতের বর্ণনা। এই নিয়ামত তার পরিচয় প্রকাশ করে। তিনি যে রাব্বুল আলামিন, তিনি যে নিখিল বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা এটা বোঝা যায় তার নিয়ামতরাজির মাধ্যমে।

আল্লাহ মানুষকে যে নিয়ামত দান করেছেন তা সীমাহীন। এমন অনেক নিয়ামতও রয়েছে, যেগুলোর খবর মানুষ জানেই না। কত লক্ষ-কোটি নিয়ামত আমাদের ওপর রয়েছে তা গুনে শেষ করা যাবে না। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যদি আল্লাহর নিয়ামত গুনতে চাও, তাহলে তা গুনে শেষ করতে পারবে না।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত :৩৪)

আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত এত অধিক যে সব মানুষ একত্রিত হয়ে সেগুলো গুনে শেষ করতে পারবে না। মানুষের নিজের অস্তিত্বই স্বয়ং একটি ক্ষুদ্র জগত্। চোখ, কান, নাক, হাত-পা, দেহের প্রতিটি গ্রন্থি ও শিরা-উপশিরায় আল্লাহ তায়ালার অন্তহীন নিয়ামত নিহিত রয়েছে। আসমান-জমিন আল্লাহর নিয়ামত। এছাড়া সাধারণভাবে ধনাত্মক আকারে যেগুলোকে নিয়ামত মনে করা হয়, নিয়ামত সেগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রত্যেক রোগ-শোক, দুঃখ-কষ্ট, আপদ-বিপদ থেকে নিরাপদ থাকাও বড় নিয়ামত।

মহান রবের সেই সব অগণিত নিয়ামতের একটি হচ্ছে দুধ। প্রাচীনকাল থেকেই দুধ মানুষের অতিপ্রিয় পানীয়। শাস্ত্রে দুধকে বলা হয়েছে পৃথিবীর অমৃত। দুধ রোগ প্রতিরোধের শক্তি বাড়িয়ে দিয়ে শরীরকে রোগমুক্ত রাখে। মূল কথা, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য দুধের ভূমিকা অপরিসীম। সর্বোচ্চ পুষ্টিমানের জন্যই দুধ সব খাদ্যের সেরা।

দুধকে বলা হয় সুপার ফুড বা সর্বগুণসম্পন্ন খাবার। এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ফসফরাস, প্রোটিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি-১২, নিয়াসিন ও রিবোফ্লভিন। অ্যাসিডিটির সমস্যা, পিরিয়ডের সময় তীব্র যন্ত্রণা, কাজের স্ট্রেসে অস্থির অবস্থা—এসব সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে এক গ্লাস দুধ। দুধে থাকা ভিটামিন ও মিনারেল ফিটনেস বাড়ায় এবং মানসিক চাপ দূর করতে সহায়তা করে।

সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর সর্বপ্রথম খাদ্য হলো মায়ের দুধ। দুগ্ধদানকারী সব স্ত্রীলিঙ্গ প্রাণী বাচ্চার লালন-পালনের জন্য কুদরতিভাবে একটি হরমোন তৈরি করে, যাকে দুধ বলা হয়। ইসলামে প্রত্যেক প্রসূতি মায়ের জন্য দুই বছর পর্যন্ত সন্তানকে বুকের দুধ পান করাতে হয়, যাতে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ পূর্ণাঙ্গভাবে সাধিত হয়। মায়ের দুধে শিশুর প্রয়োজনীয় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান সঠিক মাত্রায় থাকে। মায়ের দুধের অ্যান্টিবডি শিশুর প্রথম টিকা হিসেবে কাজ করে। শিশুর দেহের রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর করে তোলে। শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে দেয়।

সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোটা মায়ের জন্যও উপকারী। সন্তানকে দুধ খাওয়ালে মা নিজেও উপকৃত হন। প্রসবজনিত রক্তপাত দ্রুত বন্ধ হয়। পরবর্তী সময়ে রক্তস্বল্পতা হয় না। গর্ভজনিত স্ফীত জরায়ু দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। শিশুকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।

যেসব মা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ান তাদের স্তন, জরায়ু ও ডিম্বকোষে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। বুকের দুধ খাওয়ালে স্বাভাবিক জন্মনিয়ন্ত্রণে তা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এছাড়া যারা ঘন ঘন গর্ভবতী হতে চান না, তাদের জন্যও তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। মা ও শিশুর আত্মিক বন্ধন দৃঢ় হয়।

হাজার বছর আগে থেকে মানুষ দুধ ব্যবহার করে আসছে। দৈনন্দিন বিভিন্ন দুধের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন গাভি, মহিষ, বকরি ও উট। আমাদের দেশের মতো পশ্চিমা দেশগুলোতে গাভির দুধ বেশি ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় বেশি ব্যবহার করা হয় মহিষ ও গাভির দুধ। বাংলাদেশসহ পাকিস্তানের কিছু কিছু এলাকায় ভেড়া-বকরির দুধও ব্যবহার করা হয়। মরুভূমি এলাকাগুলোতে উটের দুধ গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য।

দুধ মহান রবের এমন এক নিয়ামত, যার উপমা বের করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এর মধ্যে মানব জাতির শিক্ষা রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই গবাদি পশুর মধ্যে তোমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। তাদের উদরস্থিত গোবর ও রক্তের মধ্য থেকে আমি তোমাদের পান করাই বিশুদ্ধ দুধ, যা পানকারীদের জন্য সুস্বাদু।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৬৬)

আয়াতটিতে মানবকুলের প্রতি মহান স্রষ্টার অন্যতম বড় নিয়ামত দুধের বিবরণ পেশ করা হয়েছে। গোবর ও রক্তের মাঝখান দিয়ে পরিষ্কার দুধ বের করা সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, জন্তুর ভক্ষিত ঘাস তার পাকস্থলীতে একত্রিত হলে পাকস্থলী তা সিদ্ধ করে। পাকস্থলীর ক্রিয়ার ফলে খাদ্যের বিষ্ঠা নিচে বসে যায় এবং দুধ ওপরে থেকে যায়। দুধের ওপরে থাকে রক্ত। এরপর যকৃত এই তিন প্রকার বস্তুকে ভাগ করে দেয়, রক্ত পৃথক করে রগের মধ্যে চালায় এবং দুধ পৃথক করে জন্তুর স্তনে পৌঁছে দেয়। এখন পাকস্থলীতে শুধু বিষ্ঠা থেকে যায়, যা গোবর হয়ে বের হয়ে আসে। (ইবনে কাসির)

হজরত হাসান বসরি (রহ) বলেন, সুস্বাদু ও উপাদেয় খাদ্য ব্যবহার করা দীনদারির পরিপন্থি নয়। তবে শর্ত হলো, হালাল পথে উপার্জন করতে হবে এবং অপব্যয় যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রাসুল (স) বলেছেন, ‘দুধ পান করার সময় তোমরা এভাবে দোয়া করবে, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি-হি ওয়া জিদনা মিনহু।’ অর্থাত্ হে আল্লাহ! আমাদেরকে এতে বরকত দেন এবং আরো বেশি দান করুন। কারণ, মানুষের খাদ্যতালিকায় দুধের চেয়ে উত্তম কোনো খাদ্য নেই। (আবু দাউদ, হাদিস :৩৭৩০) আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তার নিয়ামতগুলো অনুধাবন করার ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।