কামাল কাদের: ধনীলোক, সুন্দরী রমণী এবং সুদর্শন যুবক সবাই নিজেদের দাম্ভিকতা নিয়ে কল্পনার ভুবনে বিচরণ করে। তারা মনে করে এই গুণাবলী ঈশ্বর প্রদক্ত উপহার। সবার মাঝে এই উপহার জোটে না। সে কারণে তারা নিজেদেরকে সাধারণ মানুষের চাইতে এক ধাপ উপরে দেখে। আমাদের আজকের গল্পে এমনি এক অপূর্ব সুন্দরী যুবতীর উথাল-পাথাল জীবন কাহিনী নিয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে দিব।

নাম তার ফাইজা জামান। ডাক নাম শিল্পী। সাধারণ পরিবারের মেয়ে। বাবা হাই স্কুলের পি,ই (ফিজিক্যাল এডুকেশন) টিচার।

ঢাকার ফরাশগঞ্জে তাদের বাপ-দাদাদের পুরোনো বাড়িতে এক ছোট বোন এবং মা, বাবার সাথে বসবাস করে। ছোট বোনটির স্বভাব, চাল চলন, কোনো কিছু পাওয়া না পাওয়া, যে কোনো সাধারণ পরিবারের মতো ধীর এবং বাস্তববাদী। শিল্পীর ধ্যান-ধারণা ঠিক ছোট বোনের উল্টো। সে উচ্চ- আকাঙ্ক্ষী এবং প্রতিবাদ মুখর। সে নিজেকে প্রশ্ন করে, আমরা কেন ধনী না? কেন আমরা দরিদ্র? আমরাও তো মানুষ! আমাদের কি সাধ- আহ্লাদ জাগে না! আমাদেরও তো ভালো, সুন্দর, দামী জামা কাপড় পড়তে মন চায়। আমরাও তো নামি-দামী রেস্টুরেন্টে ভালো ভালো খাবার খেতে যেতে পারি, দেশ ভ্রমণে বেড়িয়ে আসতে পারি। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না কারণ সে সাধারণ ঘরের মেয়ে। এ সমস্ত বিলাস বহুল জীবন ভোগ করতে হলে প্রচুর টাকা-পয়সার দরকার। তাহলে সে কি হেরে যাচ্ছে?

চট করে মাথায় এক বুদ্ধি আসলো, ভাবলো সে তার ঈশ্বরের দেয়া এই রূপ এবং সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে ওই সমস্ত অবাস্তব চাহিদাকে বাস্তবে পরিণীত করার জন্য চেষ্টা করে দেখতে পারে। বি,এ, পড়ছিলো, লেখাপড়া ছেড়ে পরিবারের কথা অমান্য করে এক “তিন তারা” হোটেলে রিসেপশনিস্টের কাজ জোগাড় করে নিলো। বছর খানিক হোটেলে কাজ করার পর নিজের শ্রম এবং মনের দৃঢ়তার ফলে ঢাকা শহরের এক “ফাইভ ষ্টার” হোটেলে রিসেপশনিস্টের কাজ পেয়ে গেলো। শিল্পীর আকর্ষণীয় চেহারা এবং মধুর ব্যবহারে সে হোটেলের গেস্ট এবং বোর্ডারদের মাঝে মধ্যমনি হয়ে দাঁড়ালো। হোটেলের ম্যানেজার থেকে সমস্ত স্টাফ তার কাজে সন্তোষজনকভাবে তৃপ্ত। শিল্পী ধীরে ধীরে ধনী এবং দেশের খ্যাতিমান ব্যাক্তিদের সাথে পরিচিত হয়ে অবাধ মেলা মেশার সুযোগ পেয়ে গেলো। তার কাছে দেশের অনেক নামী দামী ধণাঢ্য ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক কলা-কুশলী প্রখ্যাত সাংবাদিক, সরকারি উচ্চপদস্ত আমলা প্রভৃতির ব্যক্তিত্বের সাথে হর হামেশা দেখা সাক্ষাৎ একটা নিত্য নৈমেত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো।

এক সময়ে তার রূপের জৌলুশ দেখে দেশের বরণ্য পরিচালক শাশ্বত ব্যানার্জি তাকে সিনেমাতে অভিনয় করার আমন্ত্রণ জানালেন। শিল্পীকে বললেন, “আমি তোমার চেহারার মাঝে এক নায়িকাচিত সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছি, মানে এই সুন্দর চেহারাখানি আমার গল্পের নায়িকা চরিত্রের জন্য একেবারে পারফেক্ট। তুমি ফিল্ম লাইনে আসলে উন্নতি করতে পারবে এ বিশ্বাস আমার আছে। আমার ইচ্ছা তুমি সিনেমা জগতে এসে পড়”। শিল্পী জানালো, “অভিনয় আমার দ্বারা হবে না, কারণ আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাছাড়া এই শিল্পে অনেক প্রতিদ্ব›দ্বী রয়েছে তাই এটাকে পেশা হিসাবে নিতে সাহস হচ্ছে না”।

“ওসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও, আমি তোমাকে শিখিয়ে নিবো। তুমিই বল, রিসেপশনিস্ট কাজটি নেবার আগে তোমার কি আগে থেকে কোনো ট্রেনিং বা অভিজ্ঞতা ছিল? মোটেই না, এখন এমন পটু হলে যে তুমি তোমার জুনিয়রদেরকে এই কাজ শিখাচ্ছ। আমার বলার কথা হলো কেউ কারো মার পেটের থেকে কোনো কিছু শিখে আসে না। সবাইকে যার যা পেশা অনুযায়ী শিখে নিতে হয়। পরে সময়ের সাথে সাথে অভিজ্ঞতার ভান্ডার পূর্ণতা পায়। তুমি একটা খাটি কাঁচা সোনা, কাঁচা সোনাকে মনের মত তৈরি করতে বেশি বেগ পেতে হয় না। এখনই তোমাকে হাঁ বলতে হবে না। তবে আমার এই প্রস্তাবটা তোমার বিবেচনার মধ্যে রাখ। আমি এবং আমাদের কলা কুশলীরা তোমাদের এই হোটেলে প্রায়ই ছবির শুটিংয়ের জন্যে এখানে উঠি, তাই চিন্তা ভাবনা করে এক সময়ে তোমার মনের কথাটি আমাকে জানিও। তাছাড়া এই লাইনে একবার নাম করতে পারলে তোমাকে আর পায় কে! রাজ্যের লোক তোমার পিছনে পিছনে ঘুরবে”, মিস্টার ব্যানার্জী কথাগুলি এক নাগাড়ে শিল্পীকে বলে গেলেন।

শিল্পী রিতীমত ভাবনায় পরে গেলো। রিসেপশনিস্টের কাজ করে যে টাকা পয়সা উপার্জন করা যায়, তার চেয়ে নিশ্চয়ই অভিনয় পেশায় কাজ করলে প্রচুর রোজগার হবে, সেই সাথে রাতারাতি ধনী লোক হয়ে যেতে পারবে। ফলে তার পূর্ব পরিকল্পিত উদ্দেশ্য সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, যেটা শিল্পী সব সময়ে চেয়ে আসছে। হয়তো এ সুযোগ আবার কখনো নাও আসতে পারে।

অন্য ভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, আমাদের সুশীল সমাজ আজও এ পেশাটাকে ঘৃণার চোখে দেখে। এমনকি শিল্পীর এই রিসেপশনিস্টের চাকরিও তার বাবা মা খুব সহজভাবে নেয়নি, যার জন্য তাকে ঘর ছাড়া হতে হয়েছে। এও দেখা গিয়েছে যে যারা এই সমস্ত “শো বিজনেসে” এ কাজ করে তাদের বিবাহিত জীবন খুব বেশি সুখকর হয় না। তাদের মাঝে সেপারেশন, ডিভোর্স খুবই কমন। হয়তো একে অপরের সাথে খুব বেশি মেলা মেশার করার ফলে তাদের শেষ পরিণীতি এমন হয়ে দাঁড়ায়। অনেক চিন্তা ভাবনা করে শিল্পী সিদ্ধান্ত নিলো যে, এরকম অভূতপূর্ব প্রস্তাব হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না, বরং না নিলে পরে হয়তো অনুশোচনা হবে। তাছাড়া সে নিজের মনকে সান্তনা দিলো এই ভেবে “নাচতে যখন নেমেছি, তখন ঘোমটা দিয়ে লাভ কি”!

সত্যিই এক সময়ে শিল্পী তার সিনেমায় অভিনয় করার অভিপ্রায় মিস্টার ব্যানার্জীকে ব্যক্ত করলো। মিস্টার ব্যানার্জী শিল্পীর কাছ থেকে হ্যাঁ সূচক জবাব পেয়ে ভীষণ খুশি হলেন।
শিল্পীর জীবনের পরবর্তী কাহিনী জয় জয়কার। দেশের উদীয়মান অভিনেত্রীদের মাঝে সে অসম্ভব জনপ্রীয়তা অর্জন করলো।

চারিদিক থেকে অন্যান্য প্রযোজক, পরিচালক তাদের ছবিতে কাজ করার জন্য ধন্না দিতে লাগলো। মৌমাছির মতো দেশের অনেক ধনী এবং বিখ্যাত লোকের ছেলেরা শিল্পীর এতটুকু সান্নিধ্য লাভের আশায় তার পিছনে পিছনে ঘুরাঘুরি করা শুরু করলো। সে কাকে রেখে কার সাথে বেশি করে সময় কাটাবে অথবা প্রেমে জড়িয়ে পড়বে এ সমস্ত ব্যাপার নিয়ে আপাতত তার চিন্তা-ভাবনার মধ্যে আসছে না। সে জীবনটাকে প্রাণ ভরে এভাবেই কাটিয়ে দিতে চাইছে। গাড়ি বাড়ি সবই হলো। প্রচুর টাকা পয়সা কামিয়ে যাচ্ছে, যা তার জীবনে প্রধান লক্ষ্য ছিল। ফিল্ম জগতে এবং ফিল্ম জগতের বাইরে থেকে তাকে অনেকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে কাউকে এ বিষয়ে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। সে রীতিমত সবাইকে এড়িয়ে যাচ্ছে। সে মনে করে বিয়ে করে ফেললে গ্ল্যামার কমে যাবে, ফলে তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পরে যেতে পারে।

মানুষের সৌন্দর্য চিরস্থায়ী নয়, বিশেষ করে মেয়েদের বেলায়। সময়ের সাথে সাথে তা মলিন হয়ে যায়, যেটা রয়ে যায় সেটা বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা। শিল্পীর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হলো না। শিল্পী লক্ষ্য করলো তার জীবনেও এর প্রভাব শুরু হয়ে গেছে। আগের মতো দলে দলে উপযুক্ত অর্থাৎ যোগ্য ব্যক্তি এখন আর তার পিছনে সে রকম ভাবে ঘুর ঘুর করছে না। এ রকম পরিস্থিতে সে সিদ্ধান্ত নিলো আর দেরি নয় এখনো সময় আছে কোনো এক মনের মতো মানুষকে বেছে বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করবে।

ইচ্ছে করলেই তো জীবনে যখন তখন সব কিছু পাওয়া যায় না। তাইতো মনের মতো মানুষ যাকে জীবন সঙ্গিনী করা যায় সে রকম মানুষ শিল্পীর জীবনে এখনো দেখা মিলছে না। বিয়ে করাটা মানে এক বিশ্বস্ত বন্ধু পাওয়া। যখন কোনো কারণে সেই বন্ধুত্ব অটুট হওয়ার আগেই ভেঙে যায় তখন দুর্ভ্যাজ্ঞবশতঃ সেটা অনেকে সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। আবার অনেকে সে বেদনা নীরবে সহ্য করে নিজের অজান্তে নিজেকে মানসিক চাপে মধ্যে ফেলে দেয়।

একদিন এক ঘরোয়া জলসায় শিল্পীর সাথে পরিচয় হলো “লেডি কিলার” খ্যাত তাহের সাজ্জাদের সাথে। সে দেখতে যেমন সুদর্শন, তেমনিই তার কথা বলার বাচন ভঙ্গি উপভোগ্য। খুব সহজেই তাহের মেয়েদের সাথে বন্ধুত্বের বিশ্বাস তৈরি করে ফেলতে পারে। তাছাড়া তাহেরের বড় পরিচয় হলো তার বাবা দেশের একজন খ্যাতনামা শিল্পপতি। এহেন ছেলের সাথে শিল্পীর পরিচয় হওয়ার ফলে সে তাদের বন্ধুত্বটাকে আরো জোরদার করার চেষ্টা শুরু করলো। শিল্পী মনে মনে ভালো এ ছেলের সাথে মন দেয়া নেয়া যেতে পারে, উদ্দেশ্য জীবন সঙ্গিনী করা, প্রেম-ভালোবাসা পরের কথা।

কেউ কারো চাইতে কম যায় না। তাহেরেরও মনে মনে সে একই ভাবনা। জীবন ভোগ করার জন্য, বিয়ে করার জন্য নয়। তাই শিল্পীর বিয়ের আহ্বানে তাহের সারা না দিয়ে এক সাথে থাকার প্রস্তাব জানালো। শিল্পী বুঝতে পারলো এই প্রস্তাবটা সে গ্রহণ না করলে দামী প্রেমিক হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। নিরুপায় হয়ে শিল্পী তাহেরের প্রস্তাব মেনে নিয়ে দুজনে একসাথে থাকার জন্য একটা ফ্ল্যাটে উঠে এলো। সমঝোতা হলো যথা সময়ে নিজেদের মাঝে বুঝা বুঝির পর দেখা যাবে বিয়ে করাটা শ্রেয় কিনা। এদিকে শিল্পী আস্তে আস্তে নুতন ছবিতে স্বাক্ষর করা কমিয়ে দিতে লাগলো, তাহেরের সাথে বেশি করে সঙ্গ দেয়ার জন্য। সে আজকাল অনেক প্রযোজক /পরিচালকের ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। শুধুমাত্র হাতে গোনা, মানসম্মত এবং গুনগত, ছবিতে শিল্পীকে দেখা যায়। একসময়ে শিল্পী দেশের প্রখ্যাত পরিচালক আব্দুল্লাহ ইবনে রশিদ সাহেবের ছবিতে বিরাট অংকের অর্থের বিনিময়ে অভিনয় করতে চুক্তিবদ্ধ হলো। ফিল্মি পাড়ায় ছবিটির মহরত ঘটা করে হওয়ার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো এবং সময় মতো মহরতের জন্য দিন ক্ষণ ঠিক করা হলো। ছবিতে জড়িত থাকা সকল কলা কুশলীদেরকে তা জানিয়ে দেয়া হলো।

যখন মহরতের প্রস্তুতি চলছে ঠিক সেই সময় শিল্পী প্রেগনেন্ট হয়ে পড়লো। সুখবরটা শিল্পী তাহেরকে জানালো। খবরটা শুনে তাহের ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব বা আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করলো না। প্রথমে সে কথাটা হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলো, পরে শিল্পীকে বললো, “এ সময়ে অনর্থক বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে লাভ কি?, তাতে তোমার গ্ল্যামার কমে যাবে এবং এর ফলে তুমি অনেক ভক্ত এবং দর্শক হারাবে। তোমার জনপ্রিয়তা অনেক কমে যাবে, আর তোমার মূল্যায়ন আগের মতো থাকবে না। সুতরাং ব্যাপারটা নিয়ে অন্য কিছু ভাব।” “আমাকে কি ভাবতে বলছো”? কথাটি বলে শিল্পী তাহেরের দিকে সন্দেহের চোখে তাকালো। “তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাচ্ছি।” শিল্পী ঘৃণায় তাহেরের সাথে আর কথা বাড়াতে আগ্রহ দেখালো না।

শিল্পীকে এরকম অমানবিক পরিস্থির সম্মুখীন হতে হবে সেটা তার কল্পনার বাইরে ছিল। কি করবে সে ভেবে পায় না। সে মনে করছে তাহের তাকে আবর্জনার মতো ফঁসঢ়বফ করে মাটিতে ফেলে দিলো। নিজেকে সে ভঙ্গুর মনে করছে। ঝড়ে ভেজা পাখীর মতো বিধস্ত এবং দিশাহারা। তাকে কেউ দেখলে মনে করবে ঝড়ে পড়া গাছ মুখ থুবড়ে পরে থাকার দৃশ্যের মত। তার এখন ইমোশনাল সাপোর্ট প্রয়োজন। কে দেবে আশা কে দেবে ভরসা! সবই যেন গুড়ে বালি। আপন জন বলতে তার কেউ নেই, কারন সে সম্পর্ক সে অনেক আগেই ছেড়েছে।
পৌষের প্রথম দিক। শীত পড়বে, পড়ছে। শিল্পী তার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। অনেকক্ষণ এদিক ওদিক ড্রাইভ করে পোস্তগোলায় বুড়িগঙ্গা ব্রিজের সামনে এসে পৌঁছালো। গাড়ি থেকে বের হয়ে ব্রিজের রেলিঙের সামনে দাঁড়ালো। সে নদীর দিকে তাকিয়ে আনমনে নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ প্রভৃতি যানবাহনের আনাগোনার দৃশ্য দেখছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো। জোস্না ভেজা পূর্ণিমা রাত। ধীরে ধীরে ব্রিজের আশে পাশে ভ্রমণ বিলাসী এবং পথচারীদের সংখ্যা কমতে শুরু করলো। রাত্রী বাড়ার সাথে সাথে ব্রিজটার উপর দিয়ে লোকের আনাগোনা প্রায় জন শুন্য হয়ে পড়লো। যাকে বলে একেবারে সুশান। ব্রিজের উপর দিয়ে শুধুমাত্র ট্রাক এবং প্রাইভেট গাড়ির চলাচল ছাড়া চোখে পড়ার মতো আর কোনো বাহন দেখা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে শিল্পী নিজেকে প্রশ্ন করছে, “আমি কে? পৃথিবীটা সত্যিই কি রহস্যজনক? আমরা সবাই অদ্ভুত এক অলৌকিক কাণ্ডের উপর হেঁটে বেড়াচ্ছি, মনে হয় আমরা যেন কোনো ফ্যাক্টরির প্রোডাকশন লাইনে রয়েছি। এটা সত্যি, আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষের তুলনায় ভীষণভাবে চতুর হচ্ছি কিন্তু সেই সাথে আমরা দুর্বলদের সাথে অন্যায় এবং দুর্ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়ে পৃথিবীটাকে অবিরাম আতঙ্কের সৃষ্টি করছি। তাহলে আমি কে? আমি একজন মানুষ। আমি ঈশ্বরের একজন সৃষ্টিশীল জীব। এই সৃষ্টি হলো আমার জীবনের কাঠামো। তবুও কেন সব সময়ে মারামারি, অন্যায় পরিহার করে মানুষের মত মানুষ হয়ে এ জীবন চালাতে পারছি না। এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব কে দিবে? এর জন্য দায়ী কে?” শিল্পী আর কিছুই ভাবতে পারছে না। তার মাথা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, চিন্তাধারায় ফাটল ধরছে।

ব্রিজের কাছেই সন্ন্যাসীদের আশ্রম, তার পাশেই খৃস্টানদের মঠ। কভেন্টের ভিতরে ব্রাদার কলিন পাল রাত্রির আরাধনা শেষে এই ভরা রাতে ব্রিজের দিকে হাঁটতে বেরিয়েছে। দূর থেকে সে দেখতে পেলো শাড়ি পড়া এক মহিলা ব্রিজের উপর ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। এতো রাতে মহিলা একা বসে আছে; তার মনে কেমন যেন খটকা লাগলো। ভূত, প্রেত, না তো। সে মনে প্রাণে সাহস নিয়ে সামনের দিকে এগুতে শুরু করলো। কাছে আসতেই মহিলাটি ব্রিজ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিলো। সাথে সাথে নিজের বিপদের কথা না ভেবে ব্রাদার কলিন ও নদীতে ঝাঁপ দিলো। নদীর খড়স্রোতায় ব্রাদার কলিন অজানা (?) মহিলাটির দেহ ধরে রাখতে পারলোনা, হাত থেকে ফসকিয়ে দেহটি অতল জলে তলিয়ে গেলো। তার পাশ কাটিয়ে একটা নৌকা সুরুৎ সুরুৎ শব্দ করে চলে গেলো। সেই নৌকা থেকে কোনো এক মাঝির করুন কণ্ঠে ভেসে আসলো হৃদয় কাঁপানো সুর “মন মাঝি তোর বৈঠা নেড়ে, আমি আর বাইতে পারলাম না, সারা বছর বাইলাম বইঠা, তবু তর মন পাইলাম না।”
এদিকে ছবির মহরতের দিন চলে এলো। শিল্পীর খোঁজ নেয়া হল। মোবাইলে তাকে পাওয়া গেলো না। তাহেরকে ফোন করা হলো।

জানা গেলো শিল্পী কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ, পুলিশকে খবর দেয়া হয়েছে। অন্যনোপায় হয়ে পরিচালক শিল্পীর অনুপস্তিতে মহরত প্যাক-আপ করতে বাধ্য হলো। পরিচালক অত্যন্ত দুঃখের সাথে উপস্থিত সবাইকে জানিয়ে দিলেন “আজ যে ঘটনা ঘটলো তার ফলে আমাদের প্রোডাকশনর আর্থিক দিক থেকে অনেক ক্ষতি হয়ে গেলো। মানুষের জীবনে উচ্চ আকাঙ্খা থাকা ভালো, কিন্তু সীমানা লংঘন করে নয়। সীমা লংঘন হলেই একে অপরের প্রতি অবিচার করা হয়, অন্যায় করা হয়, ক্ষতি করা হয়, যা আমাদেরকে এখন সইতে হচ্ছে।” শেষ
email :— quadersheikh@gmail,com