হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

সে অনেকবছর আগের কথা। মনে হয়, এই তো সেদিন। আমার মনে যখন স্মৃতিরা ভিড় জমায় তখন মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনাই অনেককাল আগের স্মৃতি হয়ে যায়। এ এক অদ্ভুত খেলা, সুনীল সাগর কিংবা বø্যাক সী’র মতো। কেবলই সাঁতরাইÑকূল কিনারা নাই। কোনো সিগন্যাল বা সূত্র নেই; হঠাৎই উঁকি দিয়ে যায় বিশেষ কোনো স্মৃতি। এর কোনো পরম্পরা হয়তো আমার অবচেতন মনে খেলে যায়। সেটা সুগভীর প্রাণপাত চেষ্টায় চেতন মনে একসময় জেগে ওঠে। তখন বুঝি, বিশেষ কোনো স্মৃতি হামলে পড়ার যৌক্তিক কারণ।

‘মনে পড়ে আজ সে কোন্ জনমের বিদায় সন্ধ্যাবেলায়।’ এই নজরুল সংগীতটি আমার খুব প্রিয়। তখন এই গান টা আমি জানতাম বা শুনতাম কিনা, তা আমার ঠিক মনে নেই। হয়তো শুনেছিলাম, হয়তো নয়। একটা মেয়ে সত্যিই ওপারে ভেলা ভাসিয়ে ছিল। এটা আমার কাছে কোনো রূপক বা জাদুবাস্তবতা ছিল না। নেহায়েত একটা ঘটনা ছিল।

আজ সেই ঘটনা আমার মনে জাদুবাস্তব ও রূপকথা হয়ে দেখা দিল। আর এই গান টা অনেক বিখ্যাত শিল্পীই গেয়েছেন। এক পর্যায়ে আমি খুঁজে বের করতে শুরু করলাম কার কন্ঠে এই গান আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগবে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম। অনুপ ঘোষালের দরদী কন্ঠ ও অসাধারণ গায়কী আমার করোটি স্পর্শ করে গেল। তিনি মাত্র কিছুদিন আগে এই ধরাধাম ত্যাগ করেন। তার কন্ঠে গান টা শুনি আর ফিরে যাই সেই মনে দাগ কাটা দৃশ্যেÑএকটা মেয়ে ওপারে ভেলা ভাসিয়েছিল।
বিশেষভাবে গত প্রায় একবছর আমি চেষ্টা করেছি অনুপ ঘোষালের আদলে গান টা গাইতে। কিছুতেই হয়ে উঠছিল না। সবশেষে মনে হলো যে, আমি নজরুল সংগীতে তেমন পারদর্শী নই, যদিও আমার গাওয়া ‘শাওন রাতে যদি’ অসংখ্য প্রশংসা পেয়েছে একটা একটা গ্রুপে ও ইউটিউবে। কিন্তু আমি অনুপ ঘোষালের মায়াবী পরিবেশনার ধারে-কাছে যেতে পারছিলাম না। কিন্তু আমাকে যে যেতে হবে। কেন?

কারণ এই গানের বাণীর মতো একটা গল্প সত্যিই তৈরি হয়েছিল আমার জীবনে। তখন আমি তারুণ্য থেকে সদ্য যুবা। দেখতে সুশ্রী ও রোম্যান্টিক। আমার মেজো দুলাভাই তখন রাজউকের চেয়ারম্যান। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিমুল আমাকে বলল যে, তার এক চাচা ভীষণ বিপদে আছেন দুই বাড়ির সীমানা নিয়ে বিবাদের সূত্রে। জায়গাটা মিরপুর মণিপুরীপাড়ায়। আমি ও বন্ধু গেলাম। তখনকার গ্রামীণ আবহের মণিপুরীপাড়া আর এখনকার সেই স্থানের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। একটা কুঞ্জবনের ভেতর চৌচালা বাড়ি। আলাদা রান্নাঘর। আর একটা খালি ঘর। আমি সীমানা বিবাদ মিশনের কথা ভুলে চারপাশ গভীর আগ্রহে দেখতে লাগলাম। একদিকে ডোবা, অন্যদিকে দুই চারটা ঘর। তাদের সাথেই বিবাদ। এসময় দুটি মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের জন্য উঠোনো পাতা চেয়ারটেবিলে নাস্তা এনে রাখল। বড় মেয়েটির নাম ডেউজি। ডেইজি ফুলের মতোই দেখতে। ছোটো মেয়েটার নাম জ্যোতি অথবা যূথি- এমন কোনো নাম ছিল।

এসময় আংকেল এলেন। তার কথা বলার ভঙ্গি, ভাষা ও উপস্থাপনা, মেয়ে দুটির চোখেমুখে আনন্দের ছাপ দেখে মনে হলো ওরা আগাগোড়া একটা সোজা সরল পরিবার। এরপর কদিন আমি একাই আসা যাওয়া করলাম। সেই খালি ঘরটায় অনিন্দ্যসুন্দর ডেইজি মেয়েটার সাথে আমার আবেগাপ্লুত সম্পর্ক পর্যন্ত গড়াল।
এরমধ্যে আংকেল আমার বাসায় এলেন বাজারের চটের ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে। আমি তো বিস্মিত। আমি জানালাম, আমার তো টাকা লাগবে না। আমি দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলে আপনাকে জানাব।

এর কদিন পর আমি আবার গেলাম। দুই চার ঘরের সীমানা পেরিয়ে। তারা হা হা করে উঠল, জানাল এটা নাকি ও বাড়ি যাওয়ার পথ না। আমি উদ্ধত ভঙ্গিতে সেই দুই চার ঘরের উঠোন পেরিয়ে ডেইজিদের বাড়িতে পড়লাম। এখন আমার দুটি মিশন হয়ে দাঁড়াল। ডেইজির দেখা পাওয়া আর দুই বাড়ির বিবাদ মেটানো। আমি গিয়েছিলাম পড়ন্ত বেলায়। ডেইজি বাড়িতে ছিল না। জ্যোতি বা যূথি আমার সেবায় নিমগ্ন হলো। সন্ধ্যা প্রায়। এসময় দেখলাম রাস্তার ধারে ডোবার ওপারে ভেলা ভাসাল ডেইজি। কারণ শত্রæপক্ষ তাদের বাড়ির ওপর দিয়ে এ বাড়িতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সেই সন্ধ্যায় ডেইজির সাথে গল্প করে কাটালাম।

পরদিনই আমি দুলাভাইকে জানালাম। তারপর দিনই তিনি একজন পরিদর্শক পাঠিয়ে দিলেন। এর কয়েকদিন পর শুনলাম আমার বন্ধুটি তার এক ভয়ঙ্কর মাস্তান বন্ধু নিয়ে ডেইজিদের বাড়িতে গেল। গণ্ডগোলটা সেখানেই বাজল। তারা শত্রুপক্ষের বাড়ি ডিঙিয়ে চাচা’র বাড়িতে ঢুকল। একটা মারামারি হবার উপক্রম হলো। বিষয়টাতে আমি নাখোশ হলাম। মাস্তান দিয়েই যদি কাজ হবে তাহলে আমাকে ডেকে আনা কেন। আমি পরে বন্ধুকে বললাম, এটা সময়ের ব্যাপার। সময় লাগলেও একদিন হয়তো মীমাংসা হবে; কিন্তু মাস্তান দিয়ে তো কাজ হবে না। তুমি মাস্তান ভাড়া করে আনবে আর শত্রæপক্ষ স্থানীয়, কাজেই তারাও কম শক্তিশালী নয়।

আমি অনেকটা আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। আমি পরীক্ষা ও নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। চাচাও আর আমার বাসায় আসেননি। শুনেছিলাম বন্ধু ও তার মাস্তান বন্ধু নাকি অব্যাহতভাবে সে বাড়িতে যাতায়াত করছিল।
আমার বন্ধু থাকত মগবাজারে। আর আমি থাকতাম বিক্রমপুর হাউসে। দেখা সাক্ষাৎ হতো না। তখন তো আর মোবাইল ইন্টারনেটের যুগ ছিল না। তার পরপরই আমি একদিন জানলাম আমার বন্ধু জাপান পাড়ি দিয়েছে। আর জায়গাটার ও বিবাদের কোনো সুরাহা হলো কিনা জানতে পারিনি। আমার দুলাভাই একদিন জানালেন যে, সুরাহা হবে তবে সময় লাগবে। আর এই সময়টা আরও বেশি লাগবে কেননা, শত্রুপক্ষ দাবি করেছে যে, তাদের ওপর মাস্তান দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। তারা মামলাও করেছে।

আমি আমার প্রয়াত বন্ধু আলম ও অন্যান্য ক’জন বন্ধুর সন্ধানে মগবাজার যেতাম। কেননা আমরা একসময় মগবাজার এলাকায় দীর্ঘ সময় ছিলাম। একদিন সেই মাস্তান বন্ধুর সাথেও দেখা হয়। কুশল বিনিময় হয়, তবে সেই বিবাদ মিটল কিনা আমি তাকে জিজ্ঞেস করিনি। সে নিজে থেকে আমাকে কিছু বলেনি। আমার দুলাভাই তো বটেই, সেই পরিদর্শক ভদ্রলোকও আমাদের ল্যান্ডফোনে জানালেন যে, আমি যেন ওদিকে আর না যাই।
একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। তবে পরবর্তীতে আমি যখনই ‘মনে পড়ে আজ সে কোন্ জনমের বিদায় সন্ধ্যাবেলায়’ গানটা শুনতাম আমার চোখে ভেসে ওঠত সেই মিষ্টি মেয়েটার ভেলা ভাসানোর দৃশ্যটা।

মাঝেমধ্যে আমার মনে হতো, দুলাভাইয়ের নির্দেশ অমান্য করে আমি সেই কুঞ্জবনে চলে যাই। কিন্তু আমি যাইনি এই ভেবে যে, দুলাভাই আর আমার দুজনের জন্যই কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। শুনেছিলাম, সীমানা বিবাদ নাকি বড় রকমের বিবাদ।
আরও অনেকবছর কেটে যায়। আমি ভুলে গেলাম অস্থায়ী প্রেমিকার কথা। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমার ওই গানটার প্র্যাক্টিসের সুবাদে খুব মনে পড়ত মেয়েটার কথা।
তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো ডেইজি।