হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

আমি বোধহয় এমন একজন, যে ভূতপূর্ব অফিস ত্যাগ করে একদশক আর সেই পথ মাড়াইনি। প্রথম কারণ, চাকরি ছাড়বার পর প্রথমদিকে একটি ইংরেজি পত্রিকায় ডেপুটি এডিটর হিসেবে যোগ দিয়ে সময় আর পেতাম না। তবে ঘনিষ্ঠ কলিগদের সাথে ফোনে কথা হতো, বাইরে দেখা হতো। এরপর তো ক্যানেডায় পাড়ি দিলাম। ক্যানেডা থেকে ২০১৬ সালে তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশে এলাম। আমার কলিগ খালেদ বারবার বলছিলো অফিসে যেতে। এটা অন্যায়, আন্তরিকতার অভাব, তার ভাবখানা এমনই ছিলো। আমি যেনো আসি কলিগ অনবরত তাগিদ দিয়ে যাচ্ছিলো অনেকদিন ধরেই।

আমি অফিসে প্রচার প্রকাশনা, অনুবাদ, ডকিউমেন্টারি ফিল্ম ও টিভি স্পট নির্মাণ, অনুবাদ ও অন্যান্য ক্রিয়েটিভ কাজগুলো উপভোগ করতাম। ঘৃণা করতাম পলিটিক্স, ছাড়পত্রের ব্যবসা ও নথি ঠেকিয়ে ঘুষ খাওয়ার মতো কাজগুলোকে। এবিষয়ে আমার অভিমানও ছিলো। অফিসে সামগ্রিকভাবে দুটি দল ছিলো। একটি দুর্নীতিবাজ-ঘুষখোর দল, অন্যটি আমরা গুটিকয় অফিসার, যারা এসব থেকে দূরে থাকতাম। দুর্নীতিবাজেরাই দলে ভারি ছিলো।
শেষ পর্যন্ত গেলাম। পুরোনো কলিগদের সাথে একদশক পর দেখা হলো। ঙঁঃ ড়ভ ংরমযঃ, ড়ঁঃ ড়ভ সরহফ–কথাটা এখানে আংশিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দশবছর দেখা না হবার পরও কলিগেরা যে উষ্ণতা সঞ্চিত করে রেখেছিলো আমার জন্য, তাতে আমি বিমুগ্ধ হয়েছিলাম। কলিগ ও বন্ধু খালেদের অনুরোধে ৩১ অক্টোবর ২০১৬ অনেক স্মৃতির পরিবেশ অধিদপ্তরে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম ভিন্ন চিত্র। অফিস আগের চেয়ে সৌন্দর্যপূর্ণ হয়েছে। খালেদ অবশ্য আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজেই থাকতে পারলো না- অফিসের জরুরি কাজে তাকে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিলো। তাতে কী, আরো কলিগ তো আছে। অবশ্য, একমাত্র খালেদের সাথেই আমার যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। ফোনে/ভাইবারে, কিংবা ঢাকায় এলে ওর সাথে দেখা করতাম।

আমি সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিই ২০০৬ সালে। অবশ্য ২০০৬ সালেই মুক্তিলাভ করিনি। সেটা প্রায় তিনবছর গড়িয়েছিলো। আমি গা করিনি; মোহভঙ্গ হয়েছিলো আমার। সরকারি অফিসে আলোকিত লোকের সংখ্যা কম থাকে। একেবারে থাকে না, তা নয়। তবে নগণ্য সংখ্যক। আমি খুব আলোকিত মানুষÑএকথা বলছি না। আলোকিত হতে চেয়েছিলাম আলোর মানুষদের কাছে। অত্যন্ত নিম্নপদ থেকে অফিসার, তারপর পরিচালক বনে যাবার নজিরও আছে। এই পরিচালক কী আলো বিতরণ করবেÑতা নিয়ে চিন্তিত থাকতাম।
এমএলএসএস থেকে অতিরিক্ত মহাপরিচালক পর্যন্ত সবাই আপ্লুত হয়ে পড়লেন। ডিজি সাহেব আমার অচেনা। একজন ডিজি (অতিরিক্ত সচিব মর্যাদার) বাইরে থেকে ডেপুটেশনে আসেন।

আমি কেমন যেন হয়ে পড়লাম। দিশেহারা ভাব কাটিয়ে নিজকে ফিরে পেয়ে নিজের ভেতরে আনন্দ¯্রােত অনুভব করলাম। হাশমী ভাইকে (অতিরিক্ত মহাপরিচালক) দেখে আমার যেমন মনে হলো মধ্যিখানে একটি দশক উড়ে যায়নি, তেমনই তার হাস্যোজ্জ্বল কৌতুকপ্রবণ মুখ দেখে মনে হলো আমি এখনও এই দপ্তরে বিচরণশীল, এবং হররোজ তার সাথে মোলাকাত হয়। হেডঅফিসে আমি আর হাশমী ভাই নানা কৌতুকে মেতে থাকতাম অফিসের আবহের এবং কিছু অফিসারের কৌতুকময় দিক নিয়ে।
চাকরি ত্যাগের পর আমি আর এই অফিসমুখো হইনি; জানতাম না আমার জন্য অনেকেরই অন্তরে স্থান ছিল। মনে হলো, কয়েকদিনের ছুটি কাটিয়ে যেন অফিসে এসেছি আবার।

দেখা হলো সুকুমার বিশ্বাসের সাথে। সেই সুকুমার দাদা, যে আমাকে ঢাকায় আমার বাড়ির স্ট্রাকচারাল এঞ্জিনিয়ার হিসাবে শ্রম দিয়েছিলেন। এবিষয়ে তার অভিজ্ঞতা ছিলো। বহুবছর পরও তার আগের মতো আন্তরিকতা দেখে ভালো লাগলো। আমার ও ডিজি’র পিএ শিল্পী রানীর আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। মৃদুভাষী কিন্তু প্রাণবন্ত রাজিনারা বেগম (বর্তমানে পরিচালক) আগের মতোই আছে। তাকে একটা রত্ন পাথর উপহার দিলাম। এটা আমার পুরোনো অভ্যাস, আগেও দিয়েছি। কলিগ হিসাবে তাকে আমার কাছে আদর্শ মনে হতো বলে। তার কক্ষে বসে বহু গল্প করেছি, চা খেয়েছি। সেই রেশ যেন এখনও আমার কানে রিনিঝিনি শব্দ তোলে।

অফিসের প্রাণ আর কৌতুকের রাজা আবদুল হাইয়ের সাথেও দেখা হয়ে গেলো। সে তো ‘স্যার’ বলে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আমি আমাকে ভাই বলে সম্বোধন করতে বললেও সে রাজি হলো না। তার কক্ষে বসে আরেক দফা চা-চক্র হলো। সে আমার দুলাভাই মরহুম এসএইচএম আবুল বাশার সম্পর্কে আলোকপাত করে উচ্চকিত প্রশংসা করল। হাইয়ের রুমে আরো দুজন অতিথি তার গল্প উপভোগ করল। দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, আবদুল হাই বছর দেড়েক আগে মারা গেছে।
সমর দাস ছিল আমার সহকারি। আর ছিল রশিদ। সমর চমৎকার মনের মানুষ। ওর কক্ষে কিছুক্ষণ কাটালাম। সে চমৎকার লাঞ্চ প্যাকেট দিয়ে আপ্যায়ণ করল। রশিদ আগের মতোই আছে। আর আগের মতোই পার্টটাইম ঘটকালি করে বেড়াচ্ছে। একে একে বিভিন্ন জন লাঞ্চ এর ব্যবস্থা করতে লাগলো। আমি একা মানুষ কতোটা খেতে পারি। পরে সেসব ভাগাভাগি করে সদ্ব্যবহার করা হয়েছিলো।

তবে নাটকের শেষের দৃশ্যটা বিয়োগান্তক ছিল। আমি হেড অফিসে থাকাকালিন আমার মূল দায়িত্বের পাশাপাশি মহাপরিচালকের (অতিরিক্ত সচিব পদ মর্যাদার) স্টাফ অফিসার হিসাবে বাড়তি দায়িত্ব পালন করতাম। ২০০২-২০০৩ সময়ে মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন হেদায়েতুল ইসলাম চৌধুরী। গোটা অফিসে বোধহয় আমি তার সবচেয়ে প্রিয় অফিসার ছিলাম। তিনি যখন সচিব পদে প্রমোশন পেয়ে স্থানিয় প্রশাসন বিভাগে চলে যান তখন তিনি আমার অজান্তেই পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে অনুরোধ করেন আমাকে তার সাথে প্রেষণে স্থানিয় প্রশাসনে নিয়ে যেতে। কিন্তু তৎকালিন সচিব তা অনুমোদন করেননি লোকবলের অভাব ও আমার লেখালেখির গুণাবলির কারণে।
শুনলাম হেদায়েত সাহেব আর নেই এই পৃথিবীতে। মন বিষাদে ভরে গেলো। হেদায়েত সাহেবের সরল অথচ ব্যক্তিত্বপূর্ণ চাহনী মনের কোণে ভেসে উঠল। আল্লাহ্ উনাকে বেহেশত নসিব করুন।

তারপর তো মাত্র এই সেদিন অনেক কলিগের সাথে দেখা হয়ে গেলো কাকতালীয়ভাবে। ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ বড়দিনে শীতের এক মিঠে সকালে কাাঁটাবনের কবিতা ক্যাফেতে সুকুমার দাদা তার দুটি কবিতার বই উন্মোচিত করলেন। আমি উপস্থিত ছিলাম বিশেষ অতিথি হিসেবে। সেখানে একপাল পুরোনো কলিগদের সাথে দেখা হয়ে গেলো।
দূরের, কাছের কারুর সাথে যেনো আবারও কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়।