Home কানাডা খবর রবিশঙ্করের জন্মশতবর্ষে “রাগ অনুরাগ” নিয়ে পাঠশালার আসর

রবিশঙ্করের জন্মশতবর্ষে “রাগ অনুরাগ” নিয়ে পাঠশালার আসর

টরন্টোভিত্তিক সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ২৬তম আসরটি এপ্রিলের ২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। সেতার-কিংবদন্তি পণ্ডিত রবিশঙ্করের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে নিবেদিত এই আসরে আলোচিত হয় রবিশঙ্করের সঙ্গীতবিষয়ক আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথন “রাগ অনুরাগ।”
“রাগ অনুরাগ” বইটি নিয়ে আলোচনা করেন বাংলাদেশের অগ্রগণ্য আবৃত্তিশিল্পী, অভিনেতা, লেখক জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। সেতার বাদনে ছিলেন রবিশঙ্করের সুযোগ্য উত্তরসূরী পণ্ডিত দীপক চৌধুরীর শিষ্য এবাদুল হক সৈকত।

ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের রাজপুত্র পণ্ডিত রবিশঙ্কর, এই বিস্ময়কর সঙ্গীতভাণ্ডারকে বিশ্বসভায় পরিচিত করে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের প্রথম রূপকারই শুধু নন, তিনি – ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে একান্ত নির্জনলোকের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে মুখরিত জনতার সংগ্রামের প্রান্তরে নিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহ ও বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা ঐতিহাসিক “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” এর আয়োজক রবিশঙ্কর; শাস্ত্রীয় সঙ্গীতসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সন্তানসম স্নেহধন্য শিষ্য, এই বাংলারই সন্তান রবিশঙ্কর; সত্যজিৎ রায়ের অপু ট্রিলজি – পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার ছাড়াও ঋত্বিক ঘটক ও তপন সিংহের একাধিক চলচ্চিত্রের সঙ্গীতস্রষ্টা রবিশঙ্কর; বিংশ শতকের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সহযোগী সাংস্কৃতিক সংগঠন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের মুম্বাই শাখার প্রধান সংগঠক রবিশঙ্কর। সঙ্গীত ইতিহাসের এমন কিংবদন্তী রবিশঙ্কর, সেতারের দিগন্ত ছাড়িয়েও কখন যেন সন্তর্পণে প্রবেশ করেন আমাদের মনের গভীর অন্দরে!

“রাগ অনুরাগ” বইটির আগে রবিশঙ্কর লিখেছেন – মিউজিক মেমোরি (১৯৬৭), মাই মিউজিক মাই লাইফ (১৯৬৮), লার্নিং ইন্ডিয়ান মিউজিক: এ সিস্টেমেটিক অ্যাপ্রোচ (১৯৭৯) এবং পরে লিখেছেন রাগ মালা (১৯৯৭, জর্জ হ্যারিসন সম্পাদিত)। কিন্তু বাংলায় রবিশঙ্করের একমাত্র বই “রাগ অনুরাগ।”

পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গীতবিষয়ক আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথন “রাগ অনুরাগ” বইটি ১৯৮০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় কোলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। এর আগে ধারাবাহিকভাবে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বইটি অনুলিখন করেছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য।

শঙ্করলাল ভট্টাচার্য ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি থেকে সোয়া দুই বছর ধরে বিভিন্ন পরিবেশে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জায়গায় রেকর্ড করেছেন রবিশঙ্করের কথা। মাদ্রাজ, দিল্লী, লন্ডনসহ নানা জায়গায় ধারণ করা হয়েছে রবিশঙ্করের ভাষ্য। শঙ্করলাল ভট্টাচার্য ইন্টারভিউ ফর্ম্যাটে রবিশঙ্করকে প্রশ্ন করে উত্তর রেকর্ড করেন। টেপ থেকে হুবুহু অনুলিখন করেন তিনি। তাঁর ভাষায়, “কোনো কেরামতি বা মেরামতি হয়নি।” রবিশঙ্করের তথ্যের উৎস তাঁর অভিজ্ঞতা, স্মৃতি আর সঙ্গীত সম্পর্কে জানাশোনা।

রবিশঙ্কর সারগর্ভ সঙ্গীতশাস্ত্র গোছের কিছু লিখতে চাননি। মজলিশী মেজাজে নিজের অভিজ্ঞতা, অনুভূতির কথা লিখেছেন। লিখেছেন সরল আত্মকথন। বলেছেন, তিনি দেবতা নন, তাঁকে রক্তমাংসের মানুষ জেনেও যদি মানুষ ভালোবাসে তবেই তাঁর জীবন সার্থক। অনেক বিষয়, মানুষ, শিল্পী সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করেছেন রবিশঙ্কর “রাগ অনুরাগ” এ।

কিন্তু রবিশঙ্কর মজলিশী মেজাজে লিখলেও এবং সারগর্ভ সঙ্গীতশাস্ত্র গোছের কিছু লিখতে না চাইলেও, যত সঙ্গীতব্যক্তিত্বের আলোচনা করেছেন, তার তালিকা দেখলে ধারণা করা যায়, “রাগ অনুরাগ” এ গল্পচ্ছলে আসলে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পুরো ক্রমবিকাশ ও ইতিহাসটাই উঠে এসেছে। বইতে বিভিন্ন প্রজন্মের কণ্ঠসঙ্গীত, যন্ত্রসঙ্গীত, তালবাদ্যসহ অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের যেসব গুণিজনের কথা এসেছে তাঁরা হলেন — আমির খসরু, তানসেন, বিলাশ খাঁ, মসিদ খাঁ, বাহাদুর সেন, নিয়ামত সেন, অমৃত সেন, নিহাল সেন, ফজল হুসেন, বরকতুল্লাহ, স্বরস্বতী, নির্মল খাঁ, বন্দে আলি খাঁ, মুরাদ খাঁ, বাবু খাঁ পান্নালাল বাজপেয়ী, পশুপতি, মনমোহন, ইমদাদ খাঁ, এনায়েত খাঁ, বিলায়েত খাঁ, রেজা খাঁ, আমির খাঁ, কল্লু, হাফিজ, নাসির খাঁ, তিমিরবরণ ভট্টাচার্য, বিষ্ণুদুগম্বর, বিষ্ণুদাস শিরালী, অমিয়কান্তি ভট্টাচার্য, মিহির ভট্টাচার্য, শিশিরশোভন, গোকুল নাগ, মণিলাল নাগ, শংকরন নম্বুদ্রি, ইউসুফ আলি খাঁ, রামেশ্বর পাঠক, ওয়াহিদ খাঁ, মুশতাক আলি, ওয়াজির খাঁ, জাফর খাঁ, শামির খাঁ, রজব আলি খাঁ, আমানত আলি, আমান আলি খাঁ, শিবকুমার শুক্লা, ওমরাও খাঁ, আবদুল করিম খাঁ, সওয়াই গন্ধর্ব, ভীমসেন জোশী, রোশেনারা, হীরাবাঈ, বড়ে গুলাম আলি, ফৈয়াজ খাঁ, সুরেশবাবু মানে, ওংকারনাথ ঠাকুর, তারাপদ চক্রবর্তী, জ্ঞান গোসাঁই, রাধিকা গোসাঁই, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, গঙ্গুবাঈ হাঙ্গল, হীরাবাঈ, মঘুবাঈ, কিশোরী আমনকর, আলাদিয়া খাঁ, কেশরবাঈ, মঞ্জী খাঁ, মল্লিকার্জন মনসুর, আখতারীবাঈ, সিদ্ধেশ্বরীবাঈ, রসুলানবাঈ, বিরজু মহারাজ, লচ্ছু মহারাজ, বরকত আলি, দেওঘর, কুমার গন্ধর্ব, ডি ভি পালুসকর, আহমেদজান থিরকুয়া, আজিম খাঁ, জাহাঙ্গীর খাঁ, কণ্ঠে মহারাজ, কিষেন মহারাজ, আনোখেলাল, বীরু মহারাজ, কেরামত খাঁ, কানাই দত্ত, চতুরলাল, আল্লারাখা, মিয়া কাদের বক্স, ফকির বক্স, জাকির হুসেইন, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, দেবব্রত, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, বিষ্ণু দে, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, সলিল চৌধুরী, তাপস সেন, খালেদ চৌধুরী, পান্নালাল, গিরিজা চক্রবর্তী, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, দুর্লভ ভট্টাচার্য, কুটে গোপাল, অমর ভট্টাচার্য, গোপেশ্বর বন্দোপাধ্যায়, দবির খাঁ, রাধিকামোহন মৈত্র, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, বিমলাকান্ত রায় চৌধুরী, আবেদ হুসেন খাঁ, হীরেন্দ্রকুমার গাঙ্গুলি, শ্যামবাবু, রাইচাঁদ বড়াল, কাননবালা, পঙ্কজ মল্লিক, শচীন দেব বর্মণ, পাহাড়ি সান্যাল, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অমিয় সান্যাল, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, সুরেশ চক্রবর্তী, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, নগেন দে, খগেন দে, উদয়শঙ্কর, শুভলক্ষ্ণী, বিসমিল্লাহ খাঁ, রবীন্দ্রনাথ, অন্নপূর্ণা, গোলাম মোহম্মদ, আলি আকবর খাঁ, নিখিল বন্দোপাধ্যায়, ইমরত খাঁ, নিশাত, ইরশাদ, সুজাত, আমজাদ খাঁ, হাফিজ আলি খাঁ প্রমুখ। শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনে ভারতের বাইরের দেশের ব্যক্তিত্বরাও আলোচনায় এসেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন – রোমাঁ রোলাঁ, সিলভা লেভি, ফ্রিৎজ ক্রাইসলার, মেনুহিন, জর্জ এনেস্কো, জ্যঁ পিয়ের রামপাল, অয়েস্ট্রাখ, সেগোভিয়া, জর্জ হ্যারিসন প্রমুখ।

আলোচক জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় বলেন, “রাগ অনুরাগ” বইটিতে রাগ আর অনুরাগ মোটা দাগে ভাগ করা গেলেও রাগ আর অনুরাগ পর্ব আবার বেশ কিছু জায়গায় মিলেমিশে একাকার।
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় রবিশঙ্করের শৈশব-কৈশোরে বেড়ে ওঠা, দাদা উদয়শঙ্করের নাচের দলের সঙ্গে নৃত্যশিল্পী হিসেবে পশ্চিমে ভ্রমণ, সেই দলের সদস্য বাবা আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গে পরিচয়, তাঁর কাছে প্রাথমিক তালিম ও পরে নাড়া বেঁধে মাইহারে বাবার কাছে তালিম নিয়ে বলেন। এ পর্যায়ে আলোচক মাইহার বা সেনী ঘরানার বিস্তারিত, আলাউদ্দিন খাঁর নুলো গোপাল থেকে ওয়াজির খাঁর কাছে তালিম এবং বাবা আলাউদ্দিন খাঁর সর্বব্যাপী ভূমিকা আলোচনা করেন, সঙ্গে রবিশঙ্করের মাইহারের দিনের গল্প। বাবার হাতে তৈরি সর্বপ্রথম ভারতীয় ব্যান্ড “মাইহার” নিয়েও বলেন তিনি।

জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় সেতারের আবিষ্কার, সেতারবাদন পদ্ধতি, বাজ ও ক্রমবিকাশ নিয়ে বলেন। বলেন রবিশঙ্করের নিজস্ব স্টাইল তৈরি নিয়ে। বাবা আলাউদ্দিন সরোদ, বেহালা, সুরবাহার, রবাব, সানাই, পাখোয়াজ, সুরশৃঙ্গার, তবলা বাজাতেন। সেতারও জানতেন কিন্তু বাজাতেন না। সরোদ বাজিয়ে বা বোল দিয়ে শেখাতেন রবিশঙ্করকে। একইসঙ্গে আলাপ ও গৎ করা যায় এমন সেতার বানান রবিশঙ্কর। বাবার দেওয়া শিক্ষাসহ সব মিলিয়ে একটা নতুন আওয়াজ ও টোন এবং নতুন বাজ সৃষ্টি করেন তিনি যাতে মধ্য-দ্রæত-বিলম্বিত, আলাপ, জোড়, তোড়া, ঝালা, ঠুংরি, ধুন সবকিছুরই সমন্বয় ঘটে। জয়ন্ত বলেন, মসিদ খাঁর হাতে ত্রিতন্ত্রী বীণা থেকে সুরবাহার হয়ে আধুনিক সেতার তৈরি হয়, বাবা আলাউদ্দিন আরেকটা মোড় ঘোরান এবং পরবর্তীতে এটি পত্রপুষ্পে বিকশিত করে আধুনিক ও সর্বজনীন করে তোলেন রবিশঙ্কর।

জয়ন্ত বলেন, বাবার মতো রবিশঙ্করেরও সঙ্গীতেই ছিল তপস্যা। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, এই সঙ্গীতেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়, যাকে বলা হয় নাদব্রহ্ম। রবিশঙ্করের বাদনে স্পিরিচুয়ালিটি ও সেন্সুয়ালিটির এক অদ্ভুত মিলন মূর্ত হয়। একদিকে আধ্যাত্মিক সংযম, গাম্ভীর্য আরেকদিকে রোম্যান্টিক এপ্রোচ – সেনসুয়ালিটি। এবং রবিশঙ্কর বিশ্বাস করতেন, সঙ্গীতে ভালোবাসাই শেষ কথা।

জয়ন্ত রবিশঙ্করের দাদা উদয়শঙ্করের নাচের দল, তাঁর হাতে তৈরি প্রথম ব্যালে, ভারতীয় নৃত্য সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া, “কল্পনা” চলচ্চিত্র এবং উদয়শঙ্করের ব্যাপ্ত ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

জয়ন্ত বলেন, রবিশঙ্করের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তাঁর পিতৃতুল্য বড়ো ভাই উদয়শঙ্কর ও বাবা আলাউদ্দিন খাঁর। রবিশঙ্করের ভার্সেটাইলিটি, বহুমাত্রিকতা ও বহুমুখী চিন্তার ক্ষেত্র প্রশস্ত হবার উৎসমুখও এঁরাই। শিল্পের দিব্যচোখ খুলে গিয়েছিল রবিশঙ্করের ১২ বছর বয়স থেকে দাদার ট্রুপের সঙ্গে ভ্রমন করতে করতে। আন্তর্জাতিকতাবোধ তাঁর মধ্যে কিশোরকাল থেকে বিকশিত হতে আরম্ভ করে। নিজেকে ছাড়িয়ে উঠেছেন তিনি প্রতিনিয়ত। ভারতীয় পরিচয় থেকে আন্তর্জাতিক পরিচয়ে পরিচিত করিয়েছেন নিজেকে। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের মূল যে ব্যাপারটা, ধ্রæপদাঙ্গের ব্যাপারটা, সেটির সঙ্গে তাঁর জীবনে যোগ হয়েছিল আধুনিকতা এবং তিনি ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতকে সমস্ত পৃথিবীর কাছে পরিচিত করিয়েছেন। জয়ন্ত বলেন, নাচকে দেবদাসীদের কাছ থেকে বের করেছেন উদয়শঙ্কর, সঙ্গীতকে রাজারাজড়ার দরবার থেকে বের করেছেন বাবা আলাউদ্দিন আর সঙ্গীতকে দেশের বাইরে বের করে বাইরের বিশ্বে নিয়ে গেছেন রবিশঙ্কর।

জয়ন্ত বলেন, বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমে কাজ করার অভিজ্ঞতার ফলে শিল্প সম্পর্কে রবিশঙ্করের একটা দিব্যদৃষ্টি খুলে যায়। তিনি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অঙ্কনশিল্প, নৃত্যশিল্প, মঞ্চ নাটক, চলচ্চিত্র ও অর্কেস্ট্রার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মাধ্যমটা আসলে বিষয় না। মূল বিষয়টি হচ্ছে শিল্পরসবোধ বা শিল্পবোধ। শিল্পবোধ থাকলে এবং টেকনিক্যাল দিকগুলো আয়ত্ত¡ করে নিলে যে কোনো শিল্পী যে কোনো মাধ্যমে কাজ করতে পারেন, যে কোনো মাধ্যমে অবাধ সঞ্চরণ করতে পারেন। কারণ সমস্ত শিল্পই একে অপরের পরিপূরক।

জয়ন্ত মার্গ সঙ্গীতের বিকাশ ও প্রসার প্রসঙ্গে বলেন, মার্গ সঙ্গীতের বিকাশ ও প্রসার হয়েছে বেশি আর্যদের এলাকায়, যেমন পারস্যে, পারস্য থেকে ভারতবর্ষে (উত্তর ভারতে) এবং এই আর্যদের ডাল ছড়িয়ে যাওয়া প্রুশিয়ায় অর্থাৎ বর্তমানের জার্মান অঞ্চলে। এর কারণ হিসেবে তিনি আর্যদের প্রকৃতিসংলগ্নতার কথা বলেন। জার্মান অঞ্চলে বিকাশ হয়েছে পাশ্চাত্য মার্গ সঙ্গীতের। আর আফ্রিকা ও আদিবাসীপ্রধান অঞ্চলে হয়েছে তালবাদ্যের বিকাশ, দক্ষিণ ভারতেও। কিন্তু মেলোডি মূলত আর্যদের মধ্যেই দেখা যায়। প্রকৃতিকে এরা ট্রান্সক্রিয়েট করতো সুরের মধ্য দিয়ে। এই প্রকৃতিতে আছে ষড়ঋতু আর আছে সময় বা প্রহর। ঋতু আর প্রহর ভেদে রাগের ভিন্নতা দেখা যায়। ঋতু ও প্রহর মানুষের মনে কী অভিঘাত সৃষ্টি করে, কী চেতনা তৈরি করে সেই চেতনার বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায় আমাদের রাগে। রাগগুলো মানুষের মনের অবস্থা ও প্রকৃতির অবস্থাকে প্রকাশ করে। এটিই ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত এবং পাশ্চাত্য মার্গ সঙ্গীতের চরিত্র। তবে পাশ্চাত্য মার্গ সঙ্গীতে একজন কম্পোজার থাকেন। তিনিই মূল সঙ্গীতকার। যেমন সোনাটা, সিম্ফনির স্টাফ নোটেশন আগে থেকে একদম ঠিক করা, এর বাইরে কেউ যেতে পারে না এবং এটি নিখুঁতভাবে বাজানো পারফর্মারের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে একজন স্রষ্টা, আরেকজন পারফর্মার। কিন্তু ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতে যিনি স্রষ্টা তিনিই পারফর্মার। তিনি শুধু একটা মৌলিক কাঠামোতে থেকে নিজের মতো করে তাৎক্ষণিকভাবে সঙ্গীত তৈরি করেন।

অনুরাগ পর্বে জয়ন্ত, বাবা আলাউদ্দিন খাঁর কন্যা অন্নপূর্ণার বিশুদ্ধ সুরবাহার বাদন, তাঁর সঙ্গে রবিশঙ্করের বিয়ে, বিচ্ছেদ, আজীবন তাঁর প্রতি রবিশঙ্করের অটুট শ্রদ্ধা নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনা করেন রবিশঙ্করের পরবর্তী জীবনসঙ্গিনী কমলা, স্যু জোন্স ও সুকন্যা এবং সন্তানদের কথাও।

রবিশঙ্করের আমৃত্যু বন্ধু-ভাই আলি আকবর খাঁর কথা বলেন জয়ন্ত। উল্লেখ করেন আলি আকবর ও রবিশঙ্করের অসাধারণ যুগলবন্দীর কথা।

রবিশঙ্কর যাঁকে সেতার বাজাতে দেখে প্রথম উৎসাহিত হয়ে ওঠেন সেই তিমিরবরণ ভট্টাচার্য এবং তাঁর তৈরি প্রথম ভারতীয় অর্কেস্ট্রার কথা বলেন জয়ন্ত। তিনি বলেন, বাবা আলাউদ্দিন খাঁ, তাঁর সন্তান আলি আকবর খাঁ, পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও তিমিরবরণ – এঁরাই ভারতীয় সঙ্গীতের মোড় আন্তর্জাতিকতার দিকে ঘুরিয়ে দেন। এর মূল উৎস উদয়শঙ্কর ও বাবা আলাউদ্দিন খাঁ।
সর্বদা আলোচিত রবিশঙ্কর বনাম বিলায়েত খাঁ বিতর্ক এবং ইমদাদ খানী বাজ নিয়ে বলেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়।

পশ্চিমের অন্যতম সেরা বেহালাশিল্পী ইহুদি মেনুহিনের সঙ্গে রবিশঙ্করের জার্নি নিয়ে বলেন জয়ন্ত। বলেন এ দুই দিকপালের অসাধারণ যুগলবন্দী “ইস্ট মিটস ওয়েস্ট” এর কথা। মেনুহিনকে স্টাফ নোটেশন তৈরি করে দেননি রবিশঙ্কর, শিখিয়েছেন গুরুশিষ্য পরম্পরায়, হাতে কলমে।

রবিশঙ্করের কাছে গত শতকের ষাটের দশকে দুনিয়া তোলপাড় করা বিটলসের জর্জ হ্যারিসনের শিষ্যত্ব গ্রহণ ও তালিম নিয়ে বলেন জয়ন্ত। এ পর্যায়ে রবিশঙ্কর ও বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ও বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে আমেরিকার ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজিত “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” নিয়ে বিস্তারিত বলেন জয়ন্ত। উল্লেখ্য, এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার এবং একইসঙ্গে “কনসার্ট ফর বাংলাদেশে”রও সুবর্ণজয়ন্তী। এ পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের তহবিল সংগ্রহে মুম্বাইয়ের সম্মুখানন্দ হলে আরেক বাঙালি কুমার শচীন দেব বর্মন আয়োজিত কনসার্ট “টাকডুম টাকডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল” এর কথা বলেন জয়ন্ত, যাতে ভারতের শিল্পাঙ্গনের সমস্ত নামী শিল্পীরা অংশ নিয়েছিলেন।

কোলকাতায় রবিশঙ্করের কর্মযজ্ঞের আলোচনায় বরেন্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালী” চলচ্চিত্রে রবিশঙ্করের সুরসৃষ্টির গল্পও উঠে আসে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনায়। উঠে আসে ভারতীয় গননাট্য সংঘে রবিশঙ্করের ভূমিকা, নেতাজি সুভাষ বসুর অনুরোধে মাত্র ২১ বছর বয়সে মহাকবি ইকবালের “সারে জাঁহা সে আচ্ছা”তে রবিশঙ্করের সুরারোপের কথাও।

জয়ন্ত বলেন, রবিশঙ্কর আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন তাঁর নিজ হাতে গড়া “কিন্নর স্কুল অফ মিউজিক” ও কন্যা সেতারশিল্পী আনুশকা শঙ্করকে।
জয়ন্ত বলেন, “রাগ অনুরাগ” এর সাহিত্যমূল্য অসাধারণ। সঙ্গীত সম্পর্কে পুঙখানুপুঙখ বিশ্লেষণ এবং সেই সঙ্গে নিজের জীবনের ফিকশন রবিশঙ্কর বইটিতে এমন মুন্সিয়ানায় মিশিয়েছেন যে, একটি থেকে আরেকটি আলাদা করা যায় না।

“রাগ অনুরাগ” এ রবিশঙ্করের বয়ানে আলোচিত প্রতিটি বিষয়কেই জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় আরো সম্পূরক তথ্যের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। আলোচনার অনেকটা সময় জুড়ে “রাগ অনুরাগ” বইয়ের স্থিরচিত্র প্রদর্শিত হয়।

সেনী বা মাইহার ঘরানার সরাসরি উত্তরসূরী সেতার শিল্পী এবাদুল হক সৈকত, “রাগ অনুরাগ” নিয়ে আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে, আলোচনার প্রাসঙ্গিক সূত্র ধরে, রবিশঙ্করের ঘরানার এবং রবিশঙ্কর সৃষ্ট রাগের কম্পোজিশন বাজিয়ে শোনান। তিনি মোট ৭টি কম্পোজিশন ও একটি সরগম বাজিয়ে শোনান। এর মধ্যে ছিল – পঞ্চম সে গারার দাদরা তালের ওপর কম্পোজিশন, কল্যাণ অঙ্গটাকে হাইলাইট করা বাবা আলাউদ্দিন খাঁর কম্পোজিশনের সরগম বা স্বরমালিকা যা সেনী ট্র্যাডিশনের সবাই অত্যাবশ্যকীয়ভাবে বাজিয়ে থাকেন, ইমন কল্যাণে গৎ, অন্য ঘরানায় যেটা তিলককামোদ বলে বাজানো হয় সেটাই বাবা একটু অন্যরকম করে বিহারী নাম দিয়েছিলেন এবং পথের পাঁচালীতে রবিশঙ্করের ব্যবহৃত বাবার তৈরি সেই বিহারীর কম্পোজিশন, রবিশঙ্কর সৃষ্ট রাগ ইমন মাঁজ এর কম্পোজিশন, “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” এ রবিশঙ্কর ও আলি আকবরের যুগলবন্দীতে বাজানো “বাংলা ধুন”, পঞ্চম সে গারার আরেকটি কম্পোজিশন এবং জয়জয়ন্তী রাগের ওপর কম্পোজিশন। প্রতিটি বাদনই ছিল রবিশঙ্করের ঘরানার, রবিশঙ্করের পছন্দের কিংবা স্বয়ং রবিশঙ্কর সৃষ্ট। আলোচনার পাশাপাশি সৈকতের বাদনে, রবিশঙ্কর যেন আরো বেশি মূর্ত হয়ে ওঠেন।

সারাজীবন নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়া পণ্ডিত রবিশঙ্করের বর্ণিল, কর্মময় বিস্তীর্ন জীবনের ভীষণরকম ব্যাপ্ত ক্যানভাস তুলে ধরার দুরূহ কাজটি জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় আসরের স্বল্প পরিসরে বেশ সার্থকভাবেই সম্পন্ন করেছেন। “রাগ অনুরাগ” বইটি নিয়ে তাঁর গভীর, নিবিষ্ট ও সরেস আলোচনা এবং এবাদুল হক সৈকতের সেতার বাদন পাঠশালার আসরটিকে এক অন্য মাত্রায় উত্তীর্ণ করে। দর্শকরাও তাঁদের মুগ্ধতা প্রকাশ করেন তাৎক্ষণিক মন্তব্যের মধ্য দিয়ে।

সেতার কিংবদন্তি পণ্ডিত রবিশঙ্করের জন্মশতবর্ষে নিবেদিত পাঠশালার এই আসরের পরিকল্পনা, সমন্বয় ও সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।

Exit mobile version