কবি শিউলী জাহান ছোট ছোট শব্দ খেলায় অবলীলায় গড়ে তোলেন আমাদের একান্ত জীবন আর আমাদের চারপাশের এক অপূর্ব চিত্রিত ক্যানভাস। তাঁর এই শৈল্পিক কাব্য তুলিতে তিনি এই ছবি আঁকতে গিয়ে ভ্রমণ করেন মানুষের দৃঢ় আত্মিক জগৎ থেকে মহাজাগতিক অসীম পথের বাঁকে বাঁকে। তাইতো তাঁর কবিতার রূপকাশ্রিত ছবিগুলো একেবারে আমাদের সাদামাটা জীবনের গান গাইতে গাইতে ধেয়ে চলে মহাকালের সিম্ফনির ঝংকারে, যা আমাদের মাঝে নিয়ে আসে প্রাণিত প্রাণের স্পন্দন। শিউলী জাহানের এই ভ্রমণ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে একেবারে বর্তমান সময়ের মানুষের স্বরূপকে তুলে ধরে, সেই সাথে তিনি আমাদের সামনে উম্মোচিত করেন প্রকৃতিকে ভালোবেসে ঋজু হয়ে এই প্রকৃতির অপার আনন্দে নিজেকে অবগাহিত করতে। কবি শিউলী জাহানের কবিতার জীবন ঘনিষ্ঠ শব্দের লয়ে এক অপূর্ব প্রাণ জুড়ানো সোনালী গান ভেসে আসে, যে গান আমাদের মাঝে বারে বারে জাগিয়ে তোলে আমাদের ঈপ্সিত জীবনবোধ আর প্রত্যয়ী জীবনানন্দকে।
– মনিস রফিক

শিউলী জাহান এর জন্ম তাঁর পৈতৃক নিবাস মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানার পারিল গ্রামে। তিনি পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিউলী জাহান সাংবাদিকতা দিয়ে পেশাজীবন শুরু করেন এবং তাঁর সাংবাদিকতা পেশা তাঁকে লেখালেখির জগতে প্রবেশের ক্ষেত্র প্রসারিত করে। মূলত কবিতার নিগড়ে বেঁধে থাকতেই তিনি বেশি পছন্দ করেন। তবে যা কিছু মন ও হৃদয়কে আন্দোলিত করে, ভাবনার সাগরে ঢেউ তোলে এমন সব বিষয় নিয়েই তিনি লিখতে পছন্দ করেন। প্রকৃতি ও মানুষ তাঁর লেখার মূল বিষয়।

বাংলাদেশ ও টরন্টোর স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতা ও রচনাসমূহ। বর্তমানে তিনি সপরিবারে বসবাস করছেন কানাডার টরন্টো শহরে।
শিউলী জাহানের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে, ‘আশার বাগানে নীল প্রজাপতি’ ও ‘দ্রোহের সাত রঙ’।

বিজয়ের উচ্ছ্বাস

আজ ভোরের চাদরে
শুধু না হয় দেখি বিজয়ের অকপট হাসি,
চোখের ঝিলিকে প্রফুল্ল আকাশে
অনেক অপ্রাপ্তিতেও ভীষণ কিছু প্রাপ্তি
সব অশ্রু ছাপিয়ে স্বাধীনতার প্রাপ্তি
পরজীবীর বর্ম ছিঁড়ে মাতৃভূমির প্রাপ্তি
বুকের দরজা খুলে আপন বর্ণমালায়
চিৎকার করে মা, বাবা ডাকার প্রাপ্তি।

সব না পাওয়ার না না গুলোকে আজ
না হয় মিশিয়ে দেই প্রিয় বঙ্গোপসাগরের
সুনীল ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে; ঢেকে রাখি
হিমালয় পর্বতমালার প্রশান্তির পাদদেশে;
না হয় লুকিয়ে রাখি সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে
চিতল হরিণের মায়াবী চোখে।

আজ না হয় শুধু পাওয়ার আনন্দেই হোক
কিছু অশ্রুপাত; হোক আনন্দ মিছিল
স্মৃতির পাতায় ওড়ে যাক আকন্ঠ দীর্ঘশ্বাস;
আজ না হয় বাংলাদেশের পীচ ঢালা পথ,
মেঠো পথ-প্রান্তর থেকে প্রান্তর-পূর্ব থেকে পশ্চিম
উত্তর থেকে দক্ষিণ-দিগন্ত থেকে দিগন্তে
শুধু মুখরিত হোক
প্রতিধ্বনিত হোক
স্বাধীন মানুষের বিজয়ের উচ্ছ্বাস।

কাঙ্ক্ষিত মানচিত্র

রাতের শেষে ভোরের সূর্যালোকে
এ-কোন খেয়ালি আলোয় রঙিন তুমি,
বিহ্বল আমি চেয়ে থাকি অপলকে
কম্পিত হৃদয় নিশ্চুপ মনোভূমি।

স্নিগ্ধতা ভেসে আসে দূরের নিঃশ্বাসে
ছায়াপথ আলোকিত নীরব আশ্বাসে,
সুনিপুণ বুননে ফোটে নকশীকাঁথার হাসি
টিয়ে ঠোঁট নেড়ে বলে, তোমায় ভালোবাসি।

সোনালি উত্তাপে মেখে দিয়েছ তৃষ্ণায় জল
অনাবাদী বালুচরে উলসিত সর্ষে ফুলের ঢল,
তোমার সুনীল আকাশে দেখি বসন্তের মেলা
কর্ণফুলির ঢেউয়ের ফেনায় নক্ষত্রের খেলা!

আমার জন্মভূমি,
পদ্মার নরম পলির তীরে বৃষ্টির নৃত্যকলায়
মুগ্ধ নয়নে দেখি, শামুকের খোলে বোনা
স্বপ্নবীজ সফল ফসল ফলায়,
দুরাশার মিছিল সরিয়ে ওড়ে মুক্ত জোনাকি
হৃদয়ের প্রিয় রঙে কাক্সিক্ষত মানচিত্র আঁকি!

ময়ূরাক্ষির ডাক

তোমার চোখের গভীর ছায়ায়
জানি, আজও কাঁপে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি!
সবুজ আঙিনার খোদিত মানচিত্রে
আজও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ময়ূরাক্ষি,
পেলব ডানার আর্দ্র ওমে বেঁচে থাকে
ভোরের শিশির আর জোনাকির মন।
কবিতার পঙক্তি আজ নরম রোদ, বিবর্ণ ক্রোধ
কেবলই ছুঁয়ে দিতে চায় অরুণিত পালক,
মেলে দেয়া আকাশ;
না-ফেরার নীল খামে লিখে যায়
ফিরে যাবার বোধ!
জানি, আজ তোমার চোখ নির্জন ভূমিহীন
তবুও দৃষ্টিজুড়ে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি
আজও ডেকে যায়,
ফিরে পাবার অবরুদ্ধ বাসনায়!

ভৌগলিক আবেগ

আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আভাস ছিল না
মোটেও, তবুও ভিজে গেলাম
তদুপরি দমকা হাওয়া ও বিজলির আর্তনাদে
থমকে গেল পথ- সবুজ সমতটে!

আমাদের সমুদয় শোকগুলো
আলিঙ্গন করে থাকা বাঞ্ছনীয় নয় জেনেও
ভালোবাসাকে যতটা না আঁকড়ে থাকি
নোনা শোকে জড়িয়ে থাকি ততোধিক!

সেইসব পুরাতন সব, চির-পুরাতন মেঘ
ক্লেদাক্ত অনুতাপ জমে জমে
নীল থরথর শ্যাওলায়
সেখানে নদী আজ বদ্ধ জলাশয়!

দূরের ঈগল চোখে যতটুকু দেখা যায়
অদেখা থেকে যায় তারও কিছু বেশি
অমিত ভাবনা নিয়ে প্রতিদিন সংশয়ে
তবুও-
নিবিড় জড়িয়ে থাকি ভৌগলিক আবেগ।
আভাস ছিল না মোটেও আজকের হাওয়ায়
ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল দিন- মেঘশূন্য চোখের তারায়!

চল একসাথে

উঠেছে যখন ঝড়
চল ভাঙি, একসাথে ভাঙি
একসাথে পাহাড় খুঁড়ি
গড়ে তুলি বিশুদ্ধ নগরী।

নেমেছি যখন পথে
চল হাঁটি, একসাথে হাঁটি
পায়ে পায়ে দলি জীর্ণ পাতা,
মেলে ধরি জীবনের রঙিন ছাতা।

মেলেছি যখন পাখা
চল উড়ি, একসাথে উড়ি
ছিঁড়ে ফেলি শ্বাশত বাঁধা,
এসো আঁকি জীবনের অমরগাঁথা।

জীবনের অভিজ্ঞান

পাখিদের কোলাহল থেমে গেলে
পড়ন্ত দুপুর
মেলে দেয় একখন্ড নীরবতা।
নিস্তব্ধ প্রহরে জেগে ওঠে গুঞ্জন
মনের ভেতর
প্রশ্ন ভিড়ে খুঁজি জীবনের বুনন।
অস্তিত্বই কেবল ঋজু হয়ে দাঁড়ায়
একাকী সম্মুখে
মস্তিস্কের নকশায় বাঁচার আয়োজন।
অথচ হৃদয়ের তারে তুমুল বাজে
বেহালার সুর
বাউল বাতাসে সৃষ্টির আলিঙ্গন।
কাঠঠোকরার ঠোঁট নিরন্তর কাটে
আয়ুর রেখা
কেবল চলে নিরতিশয় টিকে থাকা।
পানকৌড়ির মতো অতল জলের খননে
জীবনের অভিজ্ঞান
তবুও নীরবে প্রণতি জানায় আপন সৃজনে।

এমন প্রান্তিক সময়ে

তপ্ত মাখনের মতো ফোঁটায় ফোঁটায়
ঝরে পড়ছে
ক্ষয়িষ্ণু জীবন;
মৃত পাখিদের মতো;
শুকনো ডালে ডালে লেখা হয় হলফনামা
জরায়ু টিপে ধরে যেন বলে- শুদ্ধতার
জন্ম দিও না; অমরাবতী হওয়া ধৃষ্টতা!
আর দেখো, মনীষীদের কঙ্কাল থেকে
কেমন উড়ে যাচ্ছে শাদা পালক; ক্রমাগত
শব্দহীন হচ্ছে সামাজিক পৃষ্ঠায়
আমাদের কাগজের ঠোঁট।
দেবীর বিবস্ত্র অবয়ব
ন্যায়ের পাল্লা হাতে–নিশ্চুপ
নিয়মিত প্রদর্শনীতে মানুষের ব্যবচ্ছেদ;
মৃতদের সারিবদ্ধ মানবিক শরীরে লেপ্টে
থাকে ধর্ম ও জাতির লেবাস
থাকে ফুল ও ভালোবাসা!
এমন প্রান্তিক সময়ে
সর্ষে দানার মতো আমার কেবল
তাকিয়ে দেখা; আমাদের কেবল
ডানায় মুখ গুঁজে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা
এমন প্রান্তিক সময়ে
আমার কেবল পাথরচোখে
দূরের নদীটিকে দেখা।

কুয়াশার আস্তরণ

ঔপনিবেশিকতার অন্ধকার গ্রাস থেকে মুক্ত হলেও
তার বিভাজননীতি গেঁথে আছে দুরারোগ্য ব্যাধির মতো
আমাদের অস্থিমজ্জায়;

তাই স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অহংকার আজ দ্বিধাগ্রস্ত
’৫২-এর আন্দোলন আজও খন্ডিত হয় বিচ্ছিন্ন অবয়বে,
একুশের চেতনা কলুষিত মিশ্র অভিব্যক্তির আঘাতে!

রক্তার্জিত বর্ণমালাকে নিয়ে চলছে নিরন্তর কাটাকুটির খেলা
আধুনিকতার বয়ানে ভাষার জগাখিচুড়ি,
কিংবদন্তির ইতিহাসের জটিলতায় ধারাপাতের নাভিশ্বাস
শিশুমনে ঝরছে ঘাম সঠিক-বেঠিকের বেত্রাঘাতে!

বোধের গ্রীবায় জমে উঠছে স্তরে স্তরে কুয়াশা
মুক্তি কী নেই কুয়াশার আস্তরণ থেকে?

হায় স্বাধীনতা

তোমার কোমল গর্ভে জন্ম নিয়েও
তোমাকেই খুঁজি অন্তহীন পথযাত্রায়,
রক্তকণিকায় অবিশ্বাসী উইয়ের ঢিবি
বেড়েই চলেছে নিয়ত ছারপোকার দৌরাত্ব।
কুরে কুরে নিঃশেষ হলো হাস্নাহেনার বন
কণ্ঠনালি চেপে ধরে থাকে আটপৌরে জীবন।
মুক্তির মাদল যখন বাজলো বাতাসে
নিঃশ্বাসে ছিল পলিমাটির ঘ্রাণ,
রোদমাখা শরীরে সর্ষে ফুলের জোয়ারে
হাওড়ের পাড়ে নিয়েছিলাম শপথ
সাজাব মানচিত্র,
কৃষ্ণচূড়ার আগুনে পুড়ে, হাতে হাত রেখে
ধুপজ্বালা মেঠো পথে, হলুদ ধানের শীষে
শাপলা ফোটা জমাট দুপুরে,
কিশোরীর বাসন্তী শাড়ির আঁচলে
তুমুল ছড়াব প্রিয় বর্ণমালা।
অথচ, তুমি যেন আজ সোনালী ডানার চিল
হায় স্বাধীনতা, হায় সোনালী ডানার চিল!

ক্ষমাহীন দৃষ্টি

কেন নিংড়ে নিতে চাও কষ্টেরও শেষ নির্যাসটুকু,
কেন নিভে যাওয়া চিতায় বার বার জ্বালাও চিত্ত?
কেন স্মৃতির দরজায় বারবার কড়া নাড়ো
যুদ্ধচেতনা নিয়ে বিশ্ববাজারে বিকিকিনি করো!

চেতনাকে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়েছি সে-ই কবে
অবচেতনেও আঁকি না কোনো সুখের প্রতিশ্রুতি,
পদ্মা-মেঘনার জলে আজও লিখি দুঃখের পাণ্ডুলিপি!
স্বাধীন দেশে স্বাধীন আমরা কেমন করে বলি
আজ শুধু ক্ষমাহীন দৃষ্টি পিছে ফেলে চলি।

হাসিতে ধরিয়েছি আগুন
যখন স্বাধীন দেশে রাতের আঁধার কেড়ে নিল নাকছাবি,
স্বার্থের কোপে নিজভূমে ঘরের মানুষ হলো
ঘরহীন, ধর্মের অনলে পুড়ে অঙ্গার হলো
জাগ্রত বিবেকের বসন!

দু’চোখে আজ অনন্ত আষাঢ়
বর্জ্য ভাগাড়ে পশু আর শিশুর সকরুণ ভাগাভাগি,
মুক্ত বাতাসে রক্তাক্ত ধর্ষিতার চিৎকার
এখনও প্রকম্পিত হয় অধিকারের শ্লোগানে,
শাসকের স্বৈরনীতি নিয়ত দলিত করে গণতন্ত্রের নীতি!

স্বাধীন দেশে স্বাধীন আমরা কেমন করে বলি
আজ শুধু ক্ষমাহীন দৃষ্টি পিছে ফেলে চলি।

উঠোন জুড়ে জমিয়েছি তোমাদের শতবর্ষীয় অঙ্গীকার,
তারই ভারে চাপা পড়ে আছে লাল-সবুজের অধিকার,
আর বাড়িওনা মৃগনাভির প্রলোভনে অপ্রাপ্তির হাহাকার!

জগতের নিকুঞ্জ বনে

মুঠো থেকে জোনাকি ছেড়ে দিলেও
আলোটুকু মেখে রাখি হাতে,
গোধূলির রঙিন আভা ক্ষণিকের যদিও
রঙটুকু মিশে থাকে সেই প্রভাতে।

সাগরের পাড় ছুঁয়ে ঢেউ সরে গেলে
বালুতট অপেক্ষার অশ্রুজল আঁকে,
পাতাহীন বৃক্ষ যদিও বিষণ্ণ হাওয়ায় দোলে
জানে সে,
সৌরভে চঞ্চল হবে আবার বসন্তের ডাকে।

যেতে যেতে আমাদেরও ফিরে আসা থাকে
মানুষ যায় মানুষ আসে জগতের নিকুঞ্জ বনে,
এই যে তুমি, ঢেউয়ে ঢেউয়ে হারাও তৃষ্ণানদীর বাঁকে
ফিরে ফিরে আসো বৃষ্টি শেষে আবার রঙধনু মনে।

সেদিন ঝরবে তুমুল জ্যোৎস্না

বারুদের গন্ধ নিয়ে যেদিন সবটুকু জ্যোৎস্না ডুবে গেল তোমার বুকে
চৈত্রের উত্তপ্ত রাতে স্তব্ধ হলো আমার দিনরাত্রির হিসেব-নিকেশ,
বুভুক্ষু অন্ধকারে তোমার চোখে জ্বলে উঠেছিল শত নক্ষত্রের আহ্বান
হৃদস্পন্দনে বল্গাহীন ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি, প্রকম্পিত হয় চরাচরের নিস্তব্ধতা,
আমি শঙ্কিত, প্রাণপণে ব্যথিত আকাশ লুকাই তোমার অগোচরে।
তুমি বলেছিলে,
কোনো এক সিঁদুররাঙা বিকেলে
বসন্তের সুগন্ধি নিয়ে আসবে বীর্যের অন্ত্যমিলে
যুদ্ধ শেষ হলে–আমার সবুজ জমিনে ঝরাবে দারুণ কৃষ্ণচূড়া।

জীবন-মৃত্যুর ভয়াল তমসার অবসানে অবশেষে যখন
ফিরে এলো রণক্ষেত্র থেকে বিজয়ী সব চিবুক স্বাধীন পতাকা হাতে,
জীবনের সেই উত্তাল সমুদ্র-তরঙ্গে কোথাও দেখি না তোমাকে
তোমার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা খুলে দিল প্রলম্বিত অন্ধকারের জানালা।
আমি তোমাকে খুঁজি, রণক্ষেত্রের ধোঁয়া-ধূলি মাখা ওঁদের ঝাঁকড়া চুলে,
দাড়ি-গোঁফের অন্তরালে; বুলেটের খোসা মাড়িয়ে বিজয়ের অট্টহাসিতে;
ওঁদের চোখের তারায় তারায়, ভরা বর্ষায় পদ্মার স্রোতের মতো
কলরবে, আমি তোমাকে খুঁজি;
নবান্নের খইয়ের মতো ওঁদের ঠোঁট থেকে
ঝরে পড়া প্রতিটি অভিজ্ঞতার অক্ষরেও খুঁজেছি অনেক–
কোথাও দেখি না গভীর জলে
বুনোহাঁসের মতো তোমার বহুকালের অনাদ্র চোখ।
কোনো কাগুজে তালিকায় নেই তুমি, নেই কোনো সনদে
সরকারি, বেসরকারি কিংবা ব্যক্তিগত ডায়রিতে, পাইনা তোমাকে
বেওয়ারিশ লাশের সারিতে, গণকবরে, পরিত্যক্ত ক্যাম্প কিংবা বাঙ্কারে
নদীর ধারে ধারে, বনে-বাদাড়ে, শ্মশানে-গোরস্থানে স্তূপীকৃত করোটি ও হাড়ে
শত্রুর ঘাঁটিতে, পত্রিকার পাতায় পাতায়, কোন উপাধিতেও নেই তুমি
আমি অপেক্ষা করতে থাকি, কান পেতে থাকি তোমার অশ্বক্ষুরের।

আজও ধ্রুপদী অভ্যাসে সবুজ আঁচল মেলে রাখি তোমার প্রত্যাবর্তনের
অপেক্ষার পাত্র চুমুক দিয়ে আকণ্ঠ পিপাসায় ছুঁয়ে যাই তোমার নির্বাক অস্তিত্ব
বিবর্ণ হয়ে ফিরে গেছে কত কাকাতুয়া-বিকেল; বিমূর্ত নকশায় লেপ্টে গেছে কত বসন্তদিন
আমি অপেক্ষায় আছি আজও–
বহু দিনরাত্রির যাত্রা শেষে একজোড়া ক্লান্ত পা,
কাদাজলে মাখানো একটি তামাটে শরীর
কোনো এক সিঁদুররাঙা বিকেলে,
আমার ধূসর জমিনে হঠাৎ ঝরাবে বহু রজনীর অনাহারী ঠোঁটের সুতীব্র চুম্বন
সেদিন আকাশ খুলে অঝোরে ঝরবে তুমুল জ্যোৎস্না, বিজয়ের বিলম্বিত অশ্রু।

আষাঢ়ের দোলাচল

আকাশ আর ঢেউয়ের আলিঙ্গনে
দরজার এপারে বৃষ্টি নামছে,
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে অস্থির হৃদয়
সিঁড়ির প্রান্ত ছুঁয়ে বসে আছ উন্মুখ
রুপালি চিবুক জুড়ে ঐশ্বর্যের খনি
তবু মন—কেন আজ ঘামছে!
হেঁটেছ অনেকটা পথ,
আরও অনেকটাই বাকি
ছিল রঙধনু—ছিল কাঁকর এবং ফণিমনসার অবরোধ
জানি, সহজ ছিল না কিছুই—হয় না কখনও
অনিরুদ্ধ আবেগে ভাবছ, থেমে যাবে?
তা হয় নাকি!
অনির্বাণ দুচোখে তুমুল জোছনার শিখা
ঋতুতে ঋতুতে গভীরতর হয় তার রঙ
করতল জুড়ে আরও বিস্তৃত হয় পথের রেখা,
জানো তো,
দক্ষ চালক ভোলে না গন্তব্যের পথ
খাঁটি কৃষকের হাত কখনও হয় না শ্লথ।

সংকেতের অনুবর্তী

থামো! দৃষ্টি মেলো! রেড সিগন্যাল!
দাঁড়াতে হবে তোমাকে!

তুমি সমাজ পোষ্য! লাল সংকেত তোমাকে মানতে হবে।
যেমন গ্রীণ সিগন্যালে তুমি পাবে গতি কিংবা অধিকার!
সবুজ সংকেতে সবাই গতিময়। স্বাধীন!
গতি মানেই স্বাধীনতা। কেমন স্বাধীনতা?
তুমি সমাজ পোষ্য। সামাজিক অনুজীবী।
তোমার স্বাধীনতা মানে সীমাবদ্ধতায় বন্ধনহীনতা।
নাকি স্বাধীনতার অদৃশ্য ডানায় শৃঙ্খলের সহস্র পালক–
পরিবার–সমাজ–ধর্ম–রিপু!
নতজানু পালকে ঢাকা জীবন।

গ্রীণ সিগন্যাল।
থেমো না।
চলতে হবে। তোমাকে অতিক্রম করতে হবে।
এই জীবন রেড সিগন্যাল ও গ্রীণ সিগন্যালের অধীন।
আমরা সংকেতের অনুবর্তী!

মূলত মানুষ কখনোই স্বাধীন নয়।

আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ পা

জিম্মি সময়ের মধ্যে আজ জিম্মি
আমাদের প্রতিটি কথোপকথন!

বাতাসে ধুলিকণার মত উড়ছি আমরা সর্বত্র
কে কোথায় পড়ছি, হোঁচট খাচ্ছি! অস্থির বিচরণ!

নৈতিকতার শিরদাঁড়ায় মৃত্যুর শীতলপাটি!
ভাতের থালায় আজ লাশের ছবি নিয়ে হাঁটছি
দ্বারে দ্বারে, অট্টালিকা থেকে পর্ণোকুটিরে
ঝুলে আছে ‘ছাড়পত্রের’ চিঠি:
উত্তর নেই, নেই কোনো প্রতিচিঠি!

আমরা এক ক্রোশ হাঁটি, চার ক্রোশ পিছিয়ে যায়
আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ পা!
আমাদের উদ্যত মুষ্ঠি লজ্জ্বাবতী পাতার মতোই
দুমড়ে নুয়ে আসে! আমাদের যুগল মুষ্ঠিতে আজ
কোনো ফুল নেই, গান নেই!
আত্মজের রক্তমাখা স্বপ্নগুলো চেপে ধরে আছি।

আমরা চিৎকার করে বলতে চাই–
আমরা ভালোবাসি এই পৃথিবী,
ফিরিয়ে দাও আমাদের গভীর অরণ্য, ধোঁয়াহীন মানচিত্র!
আমরা আবার ফিরে পাই আমাদের!