সুহেল ইবনে ইসহাক: বছর পরিক্রমায় আবার আমাদের মাঝে এসেছে সিয়াম সাধনার মাস রমজান। রমজান এমন এক আকাংখিত মাস যার আগমনে সমগ্র মুসলিম মিল্লাত নব উদ্যমে জেগে উঠে। মহিমান্বিত এ মাসকে বরণ করার জন্য উপযুক্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা আমাদের সকলের ইমানি দায়িত্ব। পবিত্র মাহে রমজান আসে আমাদের জন্য অবারিত ইবাদত-বন্দেগির বাড়তি সুযোগ নিয়ে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর নেক বান্দারা অন্বেষণ করে কীভাবে আল্লাহ পাকের নৈকট্য অর্জন করা যায়।

পবিত্র রমজান বড়ই কল্যাণমন্ডিত মাস, দোয়ার মাস। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে রোজা পালন করে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত:১৮৫)।

প্রিয় নবী (সা) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজান মাসে রোজা পালন করবে, তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ ‘যে ব্যক্তি ইমানের সহিত সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে রাত জেগে ইবাদত করবে, তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ ‘যে ব্যক্তি ইমানসহ সওয়াবের উদ্দেশ্যে কদরের রাতে ইবাদত করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, খণ্ড:১, হাদিস: ৩৭, ৩৬ ও ৩৪)।

কানাডার বিভিন্ন প্রদেশের ন্যায় অন্টারিওর টোরোন্টোতেও ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্য ও যথাযত উদ্দীপনায় বাঙালি কমিউনিটি ও বাঙালিদের বাহিরে সকল মুসলিম কমিউনিটিতে মাহে রমজানের প্রস্তুতি ও সংযম সাধনার প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি সম্পন্নের দৃশ্য চোখে পড়েছে।
ভিক্টোরিয়া পার্ক ও সেন্টক্লিয়ার এর সন্নিকটে মাসজীদুল আবেদীন, ডানফোর্থ এভিনিউ ও ডানফোর্থ রোডের সন্নিকটের বায়তুল মোকাররম, ভিক্টোরিয়াপার্ক এভিনিউ ও ডানফোর্থ এভিনিউ সন্নিকটের বায়তুল আমান জামে মসজিদ, ডানফোর্থ ইসলামিক সেন্টার, মদিনা মসজিদ ও ডান্ডাস-কক্সওয়েলের অতি সন্নিকটে রহডস-এর ফেইথ জামে মসজিদ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে রমজানের চাঁদ দেখা যাওয়ার সংবাদের পর প্রথম রাতের তারাবীহ নামাজে প্রচুর সংখ্যক মুসল্লিদের সমাগম ঘটেছে প্রতিটি মসজিদে। মুসুল্লিরা একে অপরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন। মাসব্যাপী রোজা রাখার সময়সূচি সংবলিত রমজানের ক্যালেন্ডারও দেখা গেছে অনেকের হাতে। মসজিদে মসজিদে সদকা/ডোনেশন সংগ্রহের নানান পদ্ধতিও গ্রহণ করেছেন মসজিদ কর্তৃপক্ষ। প্রতিসন্ধ্যায় মুসল্লিদের ইফতার করানোর জন্য প্রতিটি মসজিদের গ্রহণ করা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।

টরোন্টোর স্থানীয় বড় বড় স্টোর ও বিভিন্ন দেশীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও রমজানকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে ক্রেতাদের সহজেই আকৃষ্ট করতে বড় করে মাহে রমজান সংবলিত পোস্টার ও মাহে রমজানের কেলেন্ডার প্রকাশ করা হয়েছে ।

গত দুই বছর কোভিড এর কারণে গৃহবন্দি আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে মসজিদের রূপ ভিন্ন আকার ধারণ করেছিল। দূরত্ব বজায় রাখা আর সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধ মানতে গিয়ে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছিল ধর্মীয় রীতিনীতি। কিন্তু এ বছর তার পুনরাবৃত্তি আর হচ্ছে না। এ বছর মুসুল্লিরা সবাই মসজিদে বসে একত্রে ইফতারি করবেন এজন্য আগে থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বন্ধু-বান্ধবদের সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছেন। প্রত্যেক মসজিদ কমিটি ইফতারির জন্য অর্থ সংগ্রহ ও ইফতার ডোনার অনুসন্ধান করে চলেছে।

প্রবাস জীবনের যান্ত্রিক দিনগুলোতে ইফতার আর তারাবি নামাজ শেষে টোরোন্টোবাসী বাঙালিরা আবার মিলিত হবে একে অপরের সঙ্গে। পুরো পরিবেশ পরিণত হবে এক পবিত্র ধর্মীয় আমেজে।

উল্ল্যেখ্য যে, রমজান এমনই এক বরকতময় মাস, যার আগমনে পুলকিত হয়ে স্বয়ং রাসূল সা. সাহাবায়ে কিরামকে মুবারকবাদ দিয়ে সুসংবাদ প্রদান করে বলেছেন- “তোমাদের সামনে রমজানের পবিত্র মাস আগমন করেছে, যে মাসে আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর রোজা ফরজ করেছেন।” (সহীহ মুসলিম)

তাই এ পবিত্র মাসে ইবাদত-বন্দেগি তথা সাহরি, ইফতার, তারাবি,পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত,ইতিকাফ, তাহাজ্জুদ, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দুআ-ইস্তিগফার, ফিতরা, দান-সদকা ইত্যাদি আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য বাঞ্ছনীয়।

পবিত্র রমজান মুসলমানদের কাছে একটি মহিমান্বিত মাস। রোজা পালনের মাস রমজান। পবিত্র কোরআন নাযিল ও রোজার কারণে রমজান এ মহিমা অর্জন করেছে। প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানই অধীর আগ্রহে এ মাসটির জন্য অপেক্ষা করেন। সম্মানিত মাসের মর্যাদামণ্ডিত রমজানকে বলা হয় আত্মশুদ্ধির মাস। এক মাসব্যাপী রোজা পালনের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা আত্মশুদ্ধির এ সাধনায় নিয়োজিত হন। রোজাদাররা বিশ^জগতের প্রভু আল্লাহর অতি প্রিয়।
অল্প দু-একটি দেশ ছাড়া বিশ্বের সর্বত্রই আজ কম-বেশি সংখ্যায় ইসলাম অনুসারীদের বসবাস রয়েছে। বলা দরকার, আধুনিক পৃথিবী ক্রমেই সংযোগ ও সম্পর্কের পথ হেঁটে বিশ্বগ্রামের রূপ নিচ্ছে। এ বিশ্বগ্রামের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে ইসলাম, মুসলমান, কোরআন ও ইসলামী সংস্কৃতি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি বিশ্বমানুষের জীবন ও কর্মে যেমন অনিবার্য প্রভাব ফেলছে; ইসলাম ও কোরআনও তেমনি ক্রমশ ব্যাপক সংখ্যক মানুষের চিন্তা-চেতনা ও ধর্মবোধকে প্রভাবিত করছে। এ প্রভাব এতটাই প্রবল যে, অত্যন্ত প্রতিক‚ল পরিস্থিতিও মুসলমানদের নামাজ আদায় ও রোজা পালন থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারে না। বিশ্বের এমনও স্থান রয়েছে যেখানে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কোনো দ্বিধা না করেই ২২ ঘণ্টা পর্যন্তও রোজা পালন করেন।

রমজান মাসে মুসলমানদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এ সময় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের দিকে যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক মনোযোগী হন। আমাদের দেশে রমযানে প্রতি ওয়াক্তের নামাজেই মসজিদে মুসল্লিদের উপস্থিতি বেড়ে যায়। রাতে তারাবির নামাজ পড়ার সময় মসজিদগুলো পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেক জায়গায় প্রতি জুমার নামাজে মসজিদে স্থান সংকুলান না হওয়ায় মুসল্লিদের জামাত পার্শ্ববর্তী রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এ থেকে রমযানের প্রতি মুসলমানদের সম্মান আর গুরুত্বারোপের প্রমাণ মেলে। রমজান মাসে বিশেষ করে মুমিন মুসলমানরা আল্লাহর ইবাদতে সর্বোচ্চ সাধ্য অনুযায়ী নিজেদের নিয়োজিত করেন। প্রকৃতপক্ষে রমজান মাসের আবহটি পুরোপুরিই প্রভুর কাছে বান্দার আত্মসমর্পণের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের। এ সময় আত্মশুদ্ধির আকাক্সক্ষায় নিবেদিত মুমিন বান্দার অস্তিত্বে জাগতিক স্বার্থ ও বিষয় চিন্তা একেবারেই গৌণ হয়ে যায়। বান্দার অন্তরের নিভৃতে তখন একটি ইচ্ছাই শুধু সার্বক্ষণিক নিবেদন হয়ে ধ্বনিত হয়- তা হচ্ছে ইবাদত ও ইবাদত, মহান প্রভুর সন্তুষ্টি।

আমাদের সবার উচিত হবে, রমজানের কল্যাণ থেকে পুরোপুরি ফায়দা হাসিল করা, রমজানের কল্যাণসমূহ দ্বারা নিজেদের সুশোভিত করা। যেন এ রমজানে কোরআন তেলাওয়াতের গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠে আমাদের চারপাশ। যেন রমজানের শিক্ষায় আলোকিত হয় সমগ্র বিশ্ব।

পবিত্র মাহে রমজানের শিক্ষা হোক আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির। পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন আমাদের মাহে রমজানের রোজার ফজিলত, তাঁর অপার করুণা ও রহমত সম্পর্কে উপলব্ধি, সঠিকভাবে রোজা পালন, ইবাদত-বন্দেগি, আদল-ইহসান, দান-খয়রাতের মাধ্যমে মাগফিরাত প্রাপ্তি এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি লাভের তাওফিক দান করেন।