আতোয়ার রহমান : জুলাই মাসের গুমোট গরম। মাঝে মাঝে মৃদু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। সারা টরন্টো নগরী হরেক রকমের গাছগাছালিতে ডুবে আছে। গাছে গাছে ফুল আর পাতার ছড়াছড়ি। প্রকৃতির হাসি যেন চারদিকে উপচে পড়ছে। শেষ বিকেলের আলো আকাশে তার শেষ রঙ মেখে যাচ্ছে, ম্যাপল গাছের ডালে ঝাঁক বেঁধে থাকা পাখির দল থেমে থেমে ডাকছে। তারও অনেক উঁচুতে গোল হয়ে ধীরে চক্কর দিচ্ছে একদল সী-গাল। সেদিকে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বৃদ্ধা। রানা যখন তার স্কারবরোর মিডল্যান্ড এভিনিউ এর বাড়ির ড্রাইভওয়ে থেকে গাড়ি বের করছে, তখন তার বয়ঃবৃদ্ধা প্রতিবেশির বিষাদে ছোঁয়া চোখে মুখ দেখে তারও মন খারাপ হয়ে গেলো। সে এখানে বাড়ি কেনার পর গত দশ বছরে তার প্রতিবেশী এই মহিলাকে কখনো এতো মলিন ও বিষণ্ণ মনে বসে থাকতে দেখেনি। আতি বৃদ্ধা হলেও তাকে সবসময়য় হাসিখুশিই দেখেছে ।

সে গাড়ি থেকে নেমে বৃদ্ধার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো- আপনার কি হয়েছে? মনখারাপ করে বসে আছেন কেন?
খানিক চুপ থেকে বৃদ্ধা বলল- আমার কুকুরটা হারিয়ে গেছে। গতকাল সকাল থেকে আমি ওটাকে খুঁজে পাচ্ছি না।
বৃদ্ধার পোষা কুকুর ‘চার্লি’কে রানাও খুব ভালবাসে। কুকুরটি হারানোর কথা শুনে রানারও মন খারাপ হয়ে গেলো।
পুলিশ কে জানিয়েছেন? আনিম্যাল শেল্টারে খোঁজ নিয়েছেন? -রানা বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ, সব করেছি, কিন্তু ওর খোঁজ পাইনি। তুমি একটু খুঁজে দেখোতো, ওকে পাও কি না।
ও যে কেন বাসা থেকে বের হয়ে গেল আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এই গরমে ও যে কত কষ্ট পাচ্ছে? ও হয়তো, অনাহারে আছে, হয়তো ডাস্টবিনের পচাবাসি খাবার খাচ্ছে। ওর চিন্তায় আমিও যে কিছু খেতে পাচ্ছি না। তবে ওর দেখা পেলে ওকে চেইজ করো না। আমাকে ফোন দিও, আমি গাড়িতে করে গিয়ে ওকে নিয়ে আসবো।

আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো ওটাকে খুঁজে বের করার জন্য। কারন চার্লি শুধু তোমারই পোষা কুকুর ছিল না, ওটা আমারও খুব প্রিয় ছিল। আমাকে দেখলেই সে আমার কাছে চলে আসতো, লেজ নাড়িয়ে চেঁচামেচি করে আনন্দ প্রকাশ করতো।
আচ্ছা, রানা তুমি এক কাজ করো। আমার কাছে চার্লির ছবি আছে। তুমি তা কপি করে রাস্তার মোড়ে লাগিয়ে দাও।

রানা ছবিটা নিয়ে তার ঘরে গিয়ে বেশ কিছু কপি করে কয়েকটা হারানো বিজ্ঞপ্তি লিখে নিকটস্থ মিডল্যান্ড ও কিংস্টন চৌ-রাস্তায় ও আশেপাশে বেশ কিছু রাস্তার মোড়ে বিদ্যুতের খুঁটিতে সেটে দিল, যাতে তা সহজেই পথচারিদের চোখে পড়ে। বিজ্ঞপ্তিতে বৃদ্ধার ফোন নাম্বার দিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ করা হয়েছে। এভাবে অনেক সময় হারানো কুকুর ফেরত পাওয়া যায়। পথচারিদের নজরে পড়লে মালিক কে ফোন দেয়। আবার রানার মনে অন্য এক শঙ্কা দানা বাঁধে। আজকাল অনেকে পথে ঘোরা কুকুর দেখলে ফুসলিয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কুকুরের ব্রিড করে। পরে তা ভাল দামে বিক্রি করে। আবার বৃদ্ধার কুকুরটি যেহেতু দামি ‘জার্মান শেফার্ড’ প্রজাতির, তাই এদের খপ্পরে পড়লে ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে।

কুকুরটির মতো বৃদ্ধার স্বামীও একদিন হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার পর এই বাড়িতে গত কুড়ি বছর ধরে তিনি একাই বসবাস করে আসছেন। বৃদ্ধার বয়স আশি ছুঁইছুঁই। দুই পুত্র সন্তান তার সঙ্গে থাকে না,তারা অন্য শহরে থাকে। কদাচিৎ এসে দেখা করে যান। সকাল সন্ধ্যা তিনি বাড়ির বারান্দায় একটা ইজি চেয়ারে বসে থাকেন আর প্রতিবেশি ও পথচারিদের সাথে কুশল ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। রাস্তার প্রথম বাড়িটি তার হওয়ায় প্রতিদিন অনেকের সঙ্গেই তার কুশল বিনিময় হয়। এতে তার একাকিত্বের বেদনা কিছুটা হলেও লাঘব হয়। নিত্যসঙ্গী হিসেবে একটি কুকুর ও একটি বিড়াল তার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। সর্বশেষ এই কুরটিও তার একজন নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছিল। সন্তান সন্ততি সঙ্গে নেই, একা থাকেন বাড়িতে- তাই কি সব মমতা উজাড় করে দিয়েছেন এই পোষা পশুগুলোকে?

কুকুরটি হারিয়ে যাওয়ায় শুধু বৃদ্ধাই খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়নি, বৃদ্ধার পোষা বিড়ালটিও কিছু খাচ্ছে না। কুকুরটি শুধু বৃদ্ধারই প্রিয় ছিল না, বিড়ালটিও তাকে খুব ভালোবাসতো। আবার কুকুরটিও বিড়ালটিকে খুব আদর করতো। প্রসঙ্গত রানা শুনেছে, বৃদ্ধা অনেকদিন আগে তাঁর এক কন্যাকে হারিয়েছেন। তাই রানার মনে হয় একাকীত্ব, ব্যক্তিগত বিচ্ছেদ ব্যথা না থাকলেও উনি মানুষী উত্তাপের অভাব বোধ করেন আর তাই সবটুকু স্নেহ ঢেলে দেন এই সব পোষ্যপ্রাণীদের।

আর যখনই একটি কুকুর হারানোর কথা রানার কানে আসে, তখনই তারর হৃদয় কুকুর এবং তার যত্ন নেওয়া মানুষের কাছে যায়। এর আগে শীতের সময়ে তার আর এক প্রতিবেশীর কুকুর হারিয়েছিল। সেবারও রানা পুরো স্কারবরো এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছিল কুকুরটিকে পাওয়ার আশায়। সে সময় সে অফিস থেকে দু’দিনের জন্য বিনা বেতনে ছুটীও নিয়েছিল। এ নিয়ে তার সুপারভাইজারের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝিও হয়েছিল। এবারেও সে দু’দিনের জন্য ছুটি নিয়েছে।

সমস্যা খুব গভীর। তার সমাধানও কিছু মিলছে না। আকাশপাতাল ভাবতে ভাভতে রানা তার বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে অস্থির ভাবে পায়চারি করছিল। কুকুরটির খোঁজখবর না পাওয়া গেলে বৃদ্ধার পরিণতির কথা ভাবছিলেন। পরদিন সকালে রানা বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা করতে গেল। বৃদ্ধা রানাকে দেখে লাঠিতে ভর করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
রানা, কুকুরটির কোন খোঁজখবর পেলে?

না এখনো পাইনি, আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গত দুদিন ধরে স্কারবরোর প্রায় সব জায়গায় খুঁজেছি। কিন্তু ও কোথাও আমার নজরে পড়েনি। আমিও অবাক এই ভেবে যে কুকুরটা গেল কোথায়? যাক। চিন্তা করবেন না। আমি প্রয়োজনে আরো দুদিন ছুটি নেবো, তবু এটাকে খুঁজে বের করবো।
না, তা করো না, এতে তোমার জব নিয়ে সমস্যা হতে পারে। শুনেছি, গত শীতে মিঃ স্মীথের কুকুর হারিয়ে গেলে তখনো তুমি এক সপ্তাহের ছুটী নিয়ে কুকুরটি খুঁজেছিলে। নিজের খাওয়া দাওয়া ঘুম ভুলে গিয়ে কুকুরটিকে খুঁজে বেড়িয়েছো। অনেকে তো নিজের কুকুর হারিয়ে গেলেও এত কষ্ট স্বিকার করে খোঁজাখুঁজি করে না। ‘বাহ! কুকুরের প্রতি তোমার এই মমতা—এই ভালোবাসা সত্যিই প্রশংসনীয়।’ কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কুকুরের প্রতি তোমার এত দরদ কেন?

‘আমি যে আজ বেঁচে আছি এর জন্য কয়েকটা কুকুরের কাছে আমি ঋণী। ওরা আমার জীবন বাঁচিয়েছে।’
এ কথা শুনে বৃদ্ধা খুব বিস্মিত হল।
‘জি ম্যাডাম। বাংলাদেশের ঢাকায় জন্মের পর কোনো এক কারণে আমার জন্মদাত্রী আমাকে রাতের আঁধারে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে গিয়েছিল। সকালে কয়েকটা কুকুর সেই ডাস্টবিন ঘিরে ভীষণ চিৎকার করতে থাকে। সেখান দিয়ে অফিসে যাচ্ছিলেন এক ভদ্র লোক। তিনি আমাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দেন। আমাকে তাঁর সন্তানের মতো লালন পালন করে বড় করেন। ভালো স্কুল কলেজে লেখাপড়া করিয়ে আমাকে উচ্চ শিক্ষিত করেন। তাঁর কাছে আমি যেমন ঋণী, পথ কুকুরদের কাছেও আমি ঋণী। আমি যতদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকব ততদিন কুকুরদের ভালো বাসবো, সেবা করবো।’
আচ্ছা, রানা বলোতো, আমার চার্লিকে এত আদরযতেœ লালনপালন করা সত্বেও ও এভাবে পালিয়ে গেল কেন?

আমার মনে হয় যেহেতু আপনি কুকুরটিকে নিয়ে পার্কে গিয়ে যথেষ্ট হাঁটাহাঁটি করাতে পারতেন না, তাই হয়তো সেটি এই বদ্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে ঘর থেকে পালিয়েছে। কুকুর যতই পোষা হোক, তার স্বভাবই বন্য, হাঁটাহাঁটি ও দৌড়াদৌড়ি করা। এখানে থেকে এ জন্মের মত নেচেকুঁদে ছুটে বেড়ানো কাকে বলে ওর আর জানা হয়নি।
ঠিকই অনুমান করেছো। লিলি বেশ কিছুদিন ধরে খ্যাপাটে হয়ে উঠেছিল। যাকে তাকে কামড়াতে যেত। ও হয়তো বদ্ধ পরিবেশে হাঁপিয়ে উঠেছিল।
আমার মনে হয় কুকুরটা আর ফিরে আসবে না। কুকুরটার প্রতি আপনার ভাবাবেগ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। নতুন একটা কুকুর কিনে নিন, রানা বৃদ্ধাকে বলল।

তুমি এসব কি বলো? চার্লি হারিয়ে গেছে, কিন্তু সে স্বপ্নে আমার কাছে আসে ঠিকই, কখনো তার অভিমান নিয়ে, কখনো তার হাসি নিয়ে। বলোতো, চার্লি কেন এসে ঘুমের ভেতর অকস্মাৎ দেখা দিয়ে যায়?
রানা বুঝতে পারে কুকুরের শোকে বৃদ্ধা ধীরে ধীরে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধাকে শান্তনা দেওয়ার স্বরে রানা বলে,
হারানো প্রিয় কুকুরের জন্য শোক প্রকাশ করতে হবে, কিন্তু তাই বলে এভাবে ভেঙে পড়া যাবে না।

শোকে বড়ো অশ্রুসিক্ত হয়ে বৃদ্ধা বললেন,
না তুমি বুঝবে না। আজ থেকে বিশ বছর আগে আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর যখন আমি ক্রমশ একাকিত্বের চোরাশ্রোতে নিমজ্জিত হচ্ছিলাম, তখন তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কয়েক বছর পরে ছোট্ট চার্লিকে কিনে নিয়ে আসি। তিলে তিলে সে আমাকে তার নিত্য সঙ্গী করে তুলে। আমার স্বামীর অনুপস্থিতি সে আমাকে ভুলিয়ে দেয়। আমার স্বামীর মতো সেও খ্যাপাটে স্বভাবের ছিল। কী আশ্চর্য! আমার স্বামী একদিন ভোরবেলা শেষ যে বিছানা থেকে পালিয়েছে, চার্লি ও সেই একই বিছানা থেকে ভোরবেলায় খোলা দরজা দিয়ে পালিয়েছে। ওকে ছাড়া এবার আমি কিভাবে বাঁচবো, বলো? আমার স্বামী হারিয়ে যাওয়ার পর চার্লিই ছিল আসলে আমার বেঁচে থাকার রসদ। এবার মনে হয় আমি আর বাঁচবো না।

বৃদ্ধার এমন মানসিক অবস্থায় শান্তনা দেওয়ার মতো কোন ভাষা সে খুঁজে পেল না। মাথা নিচু করে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে চড়ে অন্যমনস্ক ভাবে গাড়িটি স্টার্ট দিল। তার বাসা গলির একেবারে শেষ মাথায়। ফাঁকা রাস্তা। বাসার কাছে এসে জোরে ব্রেক কষে দাড়াল। সন্ধ্যার আবছায়া আলোতে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে শত শত কুকুর তার বাসার সামনে গিজগিজ করছে। তাদের সরু চোখের ধুসর চাহনি ছুঁড়ে দিয়েছে রানার দিকে। একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল সে। ঠাওর করতে পারছিল না, ঠিক কোথায় আছে! মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে গেলে যেমন হয়! কোথায় আছেন বুঝতে পারেন না! ঠিক তেমনই।

লেখক : কবি ও গল্পকার।