ফরিদ আহমেদ : ‘অবরোধ বাসিনী’ বেগম রোকেয়ার সর্বশেষ গ্রন্থ। তিনি মারা যান ১৯৩২ সালে। এর ঠিক এক বছর আগে ১৯৩১ সালে গ্রন্থ আকারে বের হয় ‘অবরোধবাসিনী’। এই গ্রন্থে তিনি টুকরো টুকরো কাহিনির মাধ্যমে সেই সময়ে বাঙালি নারীদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া অবরোধপ্রথার নেতিবাচকতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে সর্বমোট সাতচল্লিশটা কাহিনিকে লিপিবদ্ধ করেছেন। এর অনেকগুলো হয়তো তাঁর শোনা কাহিনি, কিছু আছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা। এগুলোর মাধ্যমে তিনি নারীদের চরম দুরবস্থাকে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন।

তিনি এই গ্রন্থের ভূমিকাতে লিখেছেন, ‘আমরা বহুকাল হইতে অবরোধের থাকিয়া থাকিয়া অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি। সুতরাং অবরোধের বিরুদ্ধে বলিবার আমাদের- বিশেষতঃ আমার কিছুই নাই। মেছোণীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, “পচা মাছের দুর্গন্ধ ভাল না মন্দ?” – সে কি উত্তর দিবে?’

অবরোধের বিরুদ্ধে কিছু বলার নেই বলেও তিনি এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। কারণ, ভারতের নারীদের অবরোধ শুধু পুরুষদের সামনেই করতে হতো না। মেয়েমানুষের সামনেও তাদের অবরোধপ্রথা মেনে চলতে হতো। তাঁর ভাষাতে, ‘অবিবাহিত বালিকাদিগকে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া এবং বাড়ীর চাকরাণী ব্যতীত অপর কোন স্ত্রীলোক দেখিতে পায় না।’
এ বিষয়ে তিনি নিজের জীবন থেকেও উদাহরণ দিয়েছেন। তাঁদের বাড়ির আঙিনায় কাবুলি এক স্ত্রীলোক উপস্থিত হলে, তাঁরা ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির ভিতরে। কপাট বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘কেহ বাঘ ভালুকের ভয়েও বোধ হয় অমন করিয়া কপাট বন্ধ করে না’।

তিনি যে সাতচল্লিশটা কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, সেগুলোর সবগুলোর পরিণতি এমন নিরীহ ছিলো না। অনেকগুলোতে এমন সব কাহিনি তিনি বলেছেন যেগুলো হাস্যরসে ভরপুর। কেউ হয়তো ট্রেনের বগিতে অন্য কোনো পুরুষ আসার শব্দ শুনে সিটের নীচে লুকিয়েছে, কেউ বেগানা মরদ কণ্ঠ শুনবে বলে, চোর দেখেও চুপ করে থেকেছে। অবরোধের কারণে শুধু হাস্যকর পরিস্থিতি বা দুরবস্থা না, অনেক সময় জীবন সংশয়ও ঘটতো নারীদের। ঘরে আগুন লাগলে, শুধুমাত্র অবরোধের কারণে, অন্য মানুষের সামনে আসতে হবে, এই ভয়ে নারীরা ঘর থেকেও বের হতো না। কেউ পাল্কির মধ্যে চুপচাপ বসে থাকতো চরম পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে। জীবন সংশয়ের একটা কাহিনি রোকেয়া উল্লেখ করেছেন তাঁর দুর সম্পর্কের এক মামি শাশুড়ির উদাহরণ দিয়ে। তাঁর এই মামানী ট্রেনে ভ্রমণ করছিলেন। কিউল স্টেশনে ট্রেন বদল করা লাগে। তিনি এক ট্রেন থেকে নেমে আরেক ট্রেনে ওঠার সময়ে বোরকাতে জড়িয়ে ট্রেন ও প্লাটফর্মের মাঝখানে পড়ে গেলেন। কুলিরা তাঁকে তুলতে গেলেও, তাঁর সাথে থাকা চাকরাণী চিৎকার করে তাদের ধরতে নিষেধ করলো। সে একাই টানাটানি করে তাঁর মনিবকে তুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুতেই তুলতে পারলো না। তারপরেও সে অন্য কারো সাহায্য নিলো না। আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ট্রেন ছেড়ে দিলো। ট্রেনের সংঘর্ষে ভদ্রমহিলার দেহ পিষে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো।

‘অবরোধবাসিনী’-তে সাতচল্লিশটা কাহিনির সংযোজন করা হলেও, এটা বেশ খর্বাকৃতির একটা বই। মাত্র ২৭-২৮ পৃষ্ঠার একটা বই। আগেই উল্লেখ করেছি যে এই কাহিনিগুলো টুকরো টুকরো কাহিনি। এই বইটার সাহিত্য মূল্য তেমন নেই। সাহিত্য মান বিচারে খুবই দুর্বল ধরনের লেখা। কিন্তু, এর প্রভাব রয়েছে ভিন্ন জায়গাতে। এই টুকরো টুকরো কাহিনির মধ্যে দিয়ে বেগম রোকেয়া সেই সময়ের সমাজের একটা ভয়াবহ চিত্র এঁকেছেন। সাহিত্যিক আব্দুল করিম লিখেছেন, ‘তাঁর অবরোধ-বাসিনী গ্রন্থে ৪৭টি অবরোধ-সম্পর্কিত দুর্ঘটনার উপাদেয় কাহিনী আছে – অতুলনীয় শ্লেষ ও লিপিকুশলতার সঙ্গে তিনি সেগুলি বর্ণনা করিয়াছেন।’

একটা সমাজের অর্ধেক অংশকে কেমনভাবে অবরোধের আড়ালে রেখে পশুর মতো জীবন পালন করতে বাধ্য করা হতো, সেটা তিনি তুলে ধরেছেন। অবোধ পশুরও তবু কিছু সুবিধা থাকে। তার উপরে অত্যাচার কিংবা নির্যাতন হলে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করার স্বাধীনতাটুকু তাঁর আছে। কিন্তু, ভারতবর্ষের নারীদের সেই সুযোগটাও ছিলো না। চরম অত্যাচারিত হয়ে, চরম দুরবস্থায় পতিত হয়েও, তাদের থেকে যেতে হতো নিঃশব্দ। কণ্ঠস্বর নিঃসৃত হওয়াকে ধরা হতো চরম অন্যায় হিসাবে। এমন নিঃশব্দে মার খাওয়ার উদাহরণ পৃথিবীতে বিরল।
রোকেয়া শুধু অবরোধ নিয়েই এমন শক্তিশালী একটা বই লেখেননি, তিনি সুলতানার স্বপ্নের মতোও দুঃসাহসী এক ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস লিখেছেন। সেখানে তিনি নারীদের মুক্ত করেছেন, অবরুদ্ধ করেছেন পুরুষদের। এই রকম একজন সাহসী নারীকে স্যালুট জানাতে দ্বিধা থাকার কথা না। কিন্তু, সমস্যা ঘটেছে অন্য জায়গায়।

যে রোকেয়া ‘অবরোধবাসিনী’ লিখে অবরোধের ফলে মেয়েদের কী ধরনের দুরবস্থা এবং দুর্দশার মধ্যে পতিত হতে হচ্ছে, সেটাকে চিত্রিত করেছেন, সেই একই রোকেয়া আবার ‘বোরকা’ নামের প্রবন্ধ লিখে বোরকার গুণগান করেছেন। তিনি সেই প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘রেলওয়ে প্লাটফরমে দাঁড়াইয়া কোন সম্ভ্রান্ত মহিলাই ইচ্ছা করেন না যে, তাঁহার প্রতি দর্শকবৃন্দ আকৃষ্ট হয়। সুতরাং ঐরূপ কুৎসিত জীব সাজিয়া দর্শকের ঘৃণা উদ্রেক করিলে কোন ক্ষতি নাই। … রেলওয়ে ভ্রমণকালে সাধারণের দৃষ্টি (public gaze) হইতে রক্ষা পাইবার জন্য ঘোমটা কিংবা বোরকার দরকার হয়।’

‘অবরোধবাসিনী’-তে এই রোকেয়াই নিজের মামি শাশুড়ির করুণ মৃত্যুর কথা বলেছেন। সেই ভদ্রমহিলাও ভ্রমণকালে সাধারণের দৃষ্টি এড়াতেই বোরকা পরেছিলেন। আর সেটা করতে গিয়ে নিজের প্রাণই হারিয়েছিলেন তিনি।

তিনি নিজেও বোরকা পরতেন। এটা নিয়ে হয়তো কেউ কেউ তাঁকে কথা শুনিয়েছে। ফলে, তিনি এই প্রবন্ধে বেশ গোস্বা করে লিখেছেন, ‘তাঁহারা প্রায়ই আমাকে বোরকা ছাড়িতে বলেন। বলি, উন্নতি জিনিসটা কি? তাহা কি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয় তবে বুঝিবে যে জেলেনী, চামারনী, কি ডুমুনী প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা উন্নতি লাভ করিয়াছে।’

বোরকার বাইরে উন্নতি থাকে না, এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী একজন যখন ‘অবরোধবাসিনী’ লেখে তখন তাঁর স্ববিরোধিতা দেখে অবাক হওয়া লাগে। অবাক হওয়া লাগে এই ভেবে যে তিনি আসলে কোনটাকে বিশ্বাস করেন।

তিনি অবশ্য অন্যায় পর্দা আর আবশ্যকীয় পর্দা নামের দু’টো অদ্ভুত পার্থক্য করেছিলেন। বোরকা প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের অবরোধ-প্রথাটা বেশী কঠোর হইয়া পড়িয়াছে। …. ওই সকল কৃত্রিম পর্দা কম (moderate) করিতে হইবে। ….. আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। … বোরকার আকৃতি অত্যন্ত মোটা (coarse) হইয়া থাকে। ইহাকে কিছু সুদর্শন করিতে হইবে।’ এর অর্থ হচ্ছে, মোটা এবং কুৎসিত পর্দাতে তাঁর আপত্তি আছে, কিন্তু, এটাকে পাতলা এবং সুদর্শন করে দিলে, সেটাকে তিনি আবশ্যকীয় বলে মনে করেন।

অবোধ নিয়ে রোকেয়ার এই স্ববিরোধিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে হুমায়ুন আজাদ তাঁর নারী গ্রন্থে লিখেছেন, “তিনি অবরোধকে সুদর্শন করার প্রস্তাব করেছেন, চেয়েছেন মসৃণ অবরোধ; কিন্তু অবরোধ হচ্ছে অবরোধ, তা কোনো মসৃণতা জানে না। ‘বোরকা’ রচনাটিতে বিস্ময়কর-ভাবে রোকেয়ার উপরে চেপে আছে আরব পিতৃতন্ত্র, এবং তিনি বিচ্যুত হয়েছেন নিজের স্বভাব থেকে।’

রোকেয়ার এই স্ববিরোধিতা এবং বিচ্যুতি শুধু অবরোধের ক্ষেত্রেই ঘটেনি। তিনি তাঁর সারাজীবন ধরে স্ববিরোধিতা কথাবার্তা বলে গিয়েছেন। তিনি ধর্মগ্রন্থকে পুরুষ রচিত বলেছেন, আবার ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মকর্ম পালন করেছেন অতি নিষ্ঠার সাথে। তিনি বালিকাদের কোরান শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষার যা কিছু আছে, সব কোরানে পাওয়া যায় সেকথা বলেছেন। ধর্মহীন পুরুষদের তিনি বিকৃত-মস্তিষ্ক বলে মনে করতেন। শিক্ষিত নারীদের মাধ্যমে এইসব পুরুষদের তিনি বানাতে চেয়েছেন পাক্কা মুসুল্লি। আদর্শ মুসলিম বিদ্যালয় গড়ে নারীদের আদর্শ মুসলিম নারীতে গঠন করার ইচ্ছা পোষণ করেছেন তিনি। আর তাঁদের মিলনে জন্ম দিতে চেয়েছেন সেইসব সন্তান-সন্ততিদের যারা হবে হযরত ওমর ফারুক আর হযরত ফাতেমা জোহরার মতোই পুণ্যবান, ধার্মিক।
যে রোকেয়া ‘সুলতানার স্বপ্ন’, বা ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসের মাধ্যমে নারী মুক্তি চেয়েছেন, সেই রোকেয়াই আবার ‘সুগৃহিনী’ প্রবন্ধ লিখে তাদের সুগৃহিনী হবার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন, সেটা হবার পথ বাতলে দিয়েছেন।

রোকেয়ার এই স্ববিরোধিতাকে জেনে এবং বুঝেই তাঁর অবরোধবাসিনীকে পড়া উচিত আমাদের। বিচ্ছিন্নভাবে পড়লে, লেখকের জীবনের নিজস্ব স্ববিরোধিতাকে উপেক্ষা করতে পারলে, এই গ্রন্থটা আপনাকে সেই সময়কার সমাজচিত্র সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা দেবে। একটা সময়ে পুরুষতন্ত্র কীভাবে নারীকে অন্তঃপুরে বন্দি করে রেখেছিলো নিজের সুবিধার জন্য, সেই চিত্রটা আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে। এর জন্য একটা আন্তরিক ধন্যবাদ বেগম রোকেয়া পেতেই পারেন।