মনীষ পাল : কানাডার অভিবাসনের বড়ো অংশ আসে পশ্চিম ইউরোপ থেকে, বিশেষ করে গ্রেট ব্রিটেন থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর টানা দু দশক কানাডার পক্ষপাত দেখতে পাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের প্রতি কিন্তু ষাটের দশকে বদলে যায় হিসেব-নিকেশ। অভিবাসন নীতিতে সূচিত হয় বিরাট পরিবর্তন। এবার নতুন নীতিতে অভিবাসী নির্বাচনে জোড় দেয়া হয় শিক্ষা এবং কাজের অভিজ্ঞতায়। যদিও পারিবারিক অভিবাসন, শরণার্থীদের থিতু করা বরাবরের মতোই অভিবাসন নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ থেকে যায়।

১৯৬৭-এর অভিবাসন আইনে সর্বজনীন পয়েন্ট ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়Ñ জন্ম, গোত্র নির্বিশেষে সম্ভাব্য অভিবাসী নির্বাচনে শুধু দক্ষতার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। অতীতের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, শুধু জন্মস্থান বা উৎস বিচারে কানাডার খুব একটা লাভ হয়নি, ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত কানাডা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায় প্রায় ষাট হাজার এরও বেশি লোক যেখানে কানাডায় আসে মাত্র তেত্রিশ হাজার। সেই সময় পেশাজীবী, কারিগরি বা ব্যবসায়ী উদ্যোক্তার মতো দক্ষ অভিবাসী কানাডা যত না আকৃষ্ট করে, তারো চেয়ে প্রায় দ্বিগুনের মতো দেশ থেকে বেরিয়ে যায়।

১৯৬৭ সালের অভিবাসন নীতি পরিবর্তনের এটাই মূল কারণ। কানাডা বুঝতে পারে, উন্নত বিশ্বে দক্ষ শ্রম আকৃষ্ট করবার যে প্রতিযোগিতা চলছে, তাতে নীতির বড়োসরো পরিবর্তন না আনলেই নয়। তারা ভাবে, অভিবাসনের উল্টো যাত্রা থামাতে হলে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেয়া দরকার, অভিবাসী নির্বাচনে মানব পুঁজির উপর নির্ভরতা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় হতে পারে না। ইতিবাচক পরিবর্তিত নীতি তাদের অভিবাসনে স্বাভাবিকভাবেই সুফল এনে দেয়। পরের আঠারো বছরে তারা দেখে, সেই সময় যতোজন কানাডা থেকে আমেরিকায় যায়, তারো চেয়ে ষোলো হাজারেরও বেশি উল্টোযাত্রায় কানাডায় অভিবাসী হয়।

এবার সাতষট্টির পর অভিবাসন আইনে বড়ো ধরণের পরিবর্তন আসে ১৯৭৮ সালে। অর্থনৈতিক ও পারিবারিক অবদানের মাপকাঠি তো আগেই আইনে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এবার এগুলোর সাথে নতুন করে যুক্ত হয় মানবিক সহানুভূতির কারণে অভিবাসন। কানাডার ইতিহাসে এটি এই প্রথম। যারা কোনোভাবেই অভিবাসী হবার যোগ্যতা রাখে না, তারা এই আইনের অধীনে অনুমতির চেষ্টা করতে পারে। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়; সেসবের মধ্যে কানাডার স্থায়ী অভিবাসী কারো সাথে পারিবারিক বন্ধন বা সম্পৃক্ততার উপর জোর দেয়া হয়। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট কোনো শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিতের পাশাপাশি আবেদন অগ্রাহ্যের কারণে শিশুর উপর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় কিনা, সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হয়।

১৯৮৫ সাল নাগাদ প্রায় এক লক্ষ শরণার্থী ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া থেকে কানাডায় আশ্রয় নেয়
সৌজন্যে : কানাডিয়ান এনসাইক্লোপিডিয়া

অন্যদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কানাডার অভিবাসনের পুরোটাই যদিও ইউরোপ থেকে আসা, কিন্তু সাতষট্টির পর ইউরোপীয় অভিবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। একটা হিসেব থেকে এ ব্যাপারটি সহজেই আঁচ করা যায়। প্রাক সাতষট্টিতে ইউরোপীয় অভিবাসীর অনুপাত যেখানে ছাপ্পান্ন শতাংশ, আটষট্টির পরের বিশ বছরে অর্থাৎ ১৯৮৮ পর্যন্ত সেটা নেমে আসে আটত্রিশ শতাংশে। ঠিক একই সময়ে ব্রিটিশ অঞ্চল থেকেও অভিবাসীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে নীচে নেমে আসে। সাতষট্টির আগে যেটা ছিল আটাশ শতাংশ, সাতষট্টির পরে সেটা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। সন্দেহ নেই, ষাটের দশকের শেষ প্রান্তে অভিবাসন নীতির সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ইউরোপের বাইরেও পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে যোগ্য অভিবাসী নির্বাচনে সক্ষমতা নিয়ে আসে।

সত্তরের দশক থেকে দৃশ্যমান সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি চোখে পড়বার মতো, যদিও ঐতিহাসিকভাবে কানাডা, বিশেষ করে পশ্চিম কানাডা তার শিল্পায়নে সেই শুরু থেকেই প্রাচ্যের শ্রমের উপর নির্ভর করে আসছে। দশকের পর দশক কেটে গেছে, কিন্তু প্রাচ্যের অভিবাসীরা দৃশ্যমান সংখ্যালঘুর স্বীকৃতি পায় মাত্র ১৯৮৪ সালে। ১৯৮৬ সালে তাদেরকে জাত বা বর্ণের নিরিখে কর্মসংস্থান আইনে সংখ্যালঘু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। সেই বছরের শুমারিতে প্রাচ্যের অনেক দেশ থেকে আসা অভিবাসীকে এই সংজ্ঞার আওতায় আনা হয়; তার মধ্যে কালো, ভারতীয়, চীনা, কোরীয়, জাপানি, দক্ষিণ পূর্ব এশীয়, ফিলিপিনো থেকে শুরু করে পশ্চিম এশীয়, আরব, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তবে এ যাত্রায় অজানা কারণে আর্জেন্টিনা আর চিলি থেকে আসা অভিবাসীরা বাদ পড়ে যায়।

১৯৮৬-তে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু যেখানে ছিলো ছয় শতাংশের সামান্য বেশি, মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় সেটা বেড়ে দাঁড়ায় নয় শতাংশে আর এক দশকের মাথায় সেটা দাঁড়ায় এগারো শতাংশ, যেটা এক দশক আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন। সত্তর এবং নব্বই এর মধ্যে মাত্র দুদশকে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে অভূতপূর্ব মাত্রায়। ১৯৮৬-তে যেখানে সেই সংখ্যা মাত্র ষোলো লক্ষ, মাত্র এক দশকের ব্যবধানে ১৯৯৬ তে এসে সেটি দাঁড়ায় একেবারে দ্বিগুন, মানে বত্রিশ লক্ষ। তখন কানাডায় সংখ্যালঘুদের মিশ্রণটা অনেকটা এরকম – ১৯৯৬ সালের একটা হিসেবে বত্রিশ লক্ষ সংখ্যালঘুর মধ্যে সাতাশ শতাংশ চীনা, একুশ শতাংশ দক্ষিণ এশীয় আর আঠারো শতাংশ কালো বর্ণের। তাই সত্তরের দশকের অভিবাসন কানাডার পুরো জনমিতিতে বর্ধিষ্ণু সংখ্যালঘুদের কথা মনে করিয়ে দেয়। এটি সম্ভব হতো না যদি অভিবাসী নির্বাচনে জাতপাতের বালাই তখনো থেকে যেতো। এই জাতপাতের বিচার বন্ধ হওয়াতে এশিয়া, আফ্রিকা বা গতানুগতিকতার বাইরে অন্য অনেক দেশ থেকে কানাডার এই ভূখণ্ডে অভিবাসন সহজ হয়ে যায়।

সে দুদশকে অভিবাসনের ধরণ থেকে একটা মজার চিত্র উঠে আসে – সংখ্যালঘু অভিবাসীদের অধিকাংশই কানাডার বাইরে থেকে আসা, তখনো প্রথম প্রজন্ম মাত্র, ততোদিনে ইউরোপীয়দের দ্বিতীয় প্রজন্ম জন্ম নিতে শুরু করে এই কানাডাতেই। বলা বাহুল্য, অতীতের অনুক‚ল অভিবাসন নীতির কারণে ইউরোপীয়রা এই দেশে সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসে।

সত্তর আর নব্বই এর মাঝামাঝি অভিবাসনের সংখ্যায় উঠানামা ছিলো; তবুও সর্বোপরি, বিশ শতক গুটিয়ে আসবার সাথে সাথে কানাডার সামগ্রিক জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে এ দুদশকের অবদান রয়েছে। শেষ দুদশকের জনসংখ্যার আনুপাতিক বৃদ্ধি শুরুর দু দুদশককে ছাড়িয়ে যায়। এ পর্যায়ে কানাডায় সংখ্যার দিক দিয়ে অভিবাসীদের অগ্রযাত্রা সত্তরের দশক থেকে ক্রমবর্ধমান অভিবাসনের ফলশ্রুতি বই কি।

বিশ শতকের শেষ দশকে অভিবাসীদের সংখ্যানুপাত সতেরো শতাংশে এসে দাঁড়ায় যা আগের পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মানবিক অভিবাসনের অন্তর্ভুক্তিও ইউরোপের বাইরের দেশগুলো থেকে শরণার্থীদের আসার সুযোগ করে দেয়। তাই বিশ শতকের শেষের দশকগুলোতে অভিবাসনে আসে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য যা আগে কখনো ওভাবে দেখা যায়নি। সময়ের সাথে সাথে পশ্চিম গোলার্ধ বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা থেকে আসা মানুষের সংখ্যা কমেছে, বেড়েছে পূর্ব গোলার্ধ থেকে মূলত এশিয়া, আফ্রিকা থেকে আসা মানুষের প্রবাহ।
মনীষ পাল – লেখক ও অভিবাসন উপদেষ্টা , টরন্টো