মনীষ পাল : ১৯৮৫ সালের ঘটনা। কানাডার সর্বোচ্চ আদালত থেকে দেয়া হয় এক যুগান্তকারি রায়। এই রায়ে বিচারপতিরা সংবিধানের আওতায় শরণার্থীদের অধিকার রক্ষার বিষয়ে ব্যাখ্যা করেন। বদলে যায় শরণার্থীদের নিয়ে আইনের খোল নলচে। সেই শিহরণ জাগানো রায় নিয়েই আজকের এই গল্প।

১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ছয়জন ভারতীয় শিখ এবং একজন গায়ানিজ কানাডায় শরণার্থী হিসেবে আবেদন করে। প্রত্যেকের যুক্তি ছিল, যদি তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়, তবে তাদের উপর নেমে আসবে অত্যাচারের খড়গ। কারণ হিসেবে তারা দেখায়, তাদের বর্ণ, ধর্ম বা রাজনৈতিক অতীত। কিন্তু কারো যুক্তি ধোপে ঠেকেনি। সেই সময়ে শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করতো এমন এক উপদেষ্টা কমিটির সুপারিশে সরকার সব কয়টি আবেদন নাকচ করে দেয়। পরে ইমিগ্রেশন আপিল বোর্ড ও সেই সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বোর্ড থেকে বলা হয়, আবেদনকারীদের কারো শরণার্থী হিসেবে আবেদনের যৌক্তিক কোনো ভিত্তি নেই, দেশে ফেরত পাঠালে তাদের উপর যে অত্যাচারের ভয়, সেটিই কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

এই সাতজনকে কেবল লিখিত আকারে তাদের যুক্তি উত্থাপন করতে দেয়া হয়। সেই সময়কার অভিবাসন নিয়মে শরণার্থী বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি এবং ইমিগ্রেশন আপিল বোর্ড গোপনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো। আবেদনকারীদের কাউকেই মৌখিক যুক্তি উপস্থাপনের বা পাল্টা যুক্তির সুযোগ দেয়া হতো না। শেষপর্যন্ত এই মামলাগুলো আদালতে গড়ায়। উচ্চতর আদালত থেকে একসময়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলাগুলো পথ খুঁজে পায়। সবগুলো মামলার আইনি বিষয় যেহেতু একই, সুপ্রিম কোর্ট সবগুলো মামলাকেই একটি মামলার আওতায় নিয়ে আসে আর এই মামলাটিই ‘সিং বনাম কানাডা’ হিসেবে ইতিহাসে পরিচিতি পায়।

এই মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের ছয়জন বিচারপতি পর্যালোচনা করেন এবং প্রত্যেকেই এর আপিল অনুমোদন করেন। তারা ইমিগ্রেশন আপিল বোর্ডকে এই বলে নির্দেশনা দেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে প্রত্যেক আবেদনকারী তাদের যুক্তি উপস্থাপনের জন্যে মৌখিক শুনানির পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে। কানাডার অধিকার আর মুক্তির সনদ (কানাডিয়ান চার্টার অফ রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডমস) সম্পর্কিত সুপ্রিম কোর্টের প্রথম দিককার রায়গুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। দেশটির বিচারব্যবস্থা ভবিষ্যতে কানাডিয়ান চার্টার অফ রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডমস কিভাবে ব্যাখ্যা করবে, এই মামলার সিদ্ধান্ত তার জন্য অনেকখানি গুরুত্ত¡ বহন করে।

ছয়জন বিচারপতির সবাই যদিও আপিল অনুমোদন করেন, কিন্তু তারা ভিন্ন ভিন্ন কারণ দেখিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছান। তাদের মধ্যে তিনজন যুক্তি তুলে ধরে বলেন, সনদের মৌলিক ন্যায়বিচারের মূলনীতি কানাডায় ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের অধিকার প্রদান করে এবং এই অধিকার পোর্ট অফ এন্ট্রি বা প্রবেশপথেও সমানভাবে প্রযোজ্য। তারা বলেন, প্রত্যেকে মানে আক্ষরিক অর্থে প্রত্যেকেই, শুধু কানাডার নাগরিক বা স্থায়ী বাসিন্দা নয়, কানাডার অন্তর্গত ভূখণ্ডের সবাই এই সনদের আওতায় পড়ে। আবেদনকারীরা সবাই নিপীড়নের ভয়ের কথা বলেছে। তাই বিচারপতিদের মতে, আবেদনকারীকে মৌখিক শুনানি থেকে বঞ্চিত করে অভিবাসন ব্যবস্থা সনদের অধীনে তাদের মৌলিক ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করেছে। অন্য তিন বিচারপতি চার্টার বা সনদের ব্যাপারে নীরব থেকেছে। তারা বরং ১৯৬০ সালের অধিকার বা বিল অফ রাইটস এর বিষয়টি তুলে ধরেন। তারা বলেন, ১৯৬০ সালের আইন শরণার্থী আবেদনকারীর মৌখিক শুনানির অধিকার নিশ্চিত করে।

শরণার্থী – প্রতীকী ছবি

রায়ের ঠিক চার বছর পর, কানাডার সরকার শরণার্থী পর্যালোচনা ব্যবস্থা ঢেলে সাজায়। সরকার একেবারে নতুন করে গঠন করে আজকের বহুল পরিচিত ইমিগ্রেশন এবং রেফিউজি বোর্ড। এই আধা বিচারিক বোর্ড সেই থেকে শরণার্থী আবেদনের মৌখিক শুনানি পরিচালনা করে থাকে। এই রায় যদিও শরণার্থী আইনের খোল নলচে পাল্টে দিয়েছে, কিন্তু এই রায় ঘিরে বিতর্ক রয়েই গেছে। বিচারপতিদের ভাগ্যে জোটে জুডিশিয়াল এক্টিভিজম এর অপবাদ। বিশেষ করে বিচারপতি বের্থা উইলসন এর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি প্রকাশ্যে প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়ে সামাজিক প্রভাব বিবেচনায় রায় দিতেন। একসময়ের লিবারেল সরকারের মন্ত্রী বিশিষ্ট সমালোচক জন মেলানি এই রায়ের কট্টর সমালোচনা করে বলেন, বিদেশিদের কানাডার অধিকার সনদের আওতায় নিয়ে আসা একটা মস্ত ভুল। তিনি এবং অন্য সমালোচকেরা মনে করেন, পরবতী সময়ের বিচারপতিরা এই ধরণের মামলায় হয়তো সম্পূর্ণ ভিন্ন রায় দিয়ে থাকতেন।

আরেকদল সমালোচক বলেন, এই রায় অভিবাসন ব্যবস্থায় অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই রায় অযৌক্তিকভাবে যারা আশ্রয় দাবি করেন, তাদেরকে ফেরত পাঠানো কঠিন করে তুলেছে। তবুও আইন বিশারদেরা বলছেন, এই রায় আশ্রয় প্রার্থীদের কানাডায় অনির্দিষ্ট কাল থাকার অধিকার দেবার কথা বলেনি, আশ্রয়প্রাথীদের ন্যায্য শুনানির অধিকার এর কথায় শুধু এই রায়ে বলা আছে। তাদের মতে, এই রায়ের কোথাও শুনানির পর অযোগ্য প্রমাণিত হলে কানাডা থেকে কাউকে বিতাড়নের ব্যাপারে সরকারকে কোনো বাধা দেয়া হয়নি।

এই রায় হয় ১৯৮৫ সালের ৪ এপ্রিল আর প্রতি বছর কানাডিয়ান কাউন্সিল ফর রেফিউজিস নামের একটি সংগঠন এই দিনটি শরণার্থী অধিকার দিবস হিসেবে বেশ ঘটা করে পালন করে থাকে। বারবারা জ্যাকম্যান নামের এক বিখ্যাত অভিবাসন আইনজীবী এই মামলায় আবেদনকারীদের পক্ষে লড়েন। তিনি বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্ত শরণার্থী আবেদনে একটা ন্যায্য এবং নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া বাতলে দিয়েছে, এই রায় না হলে আজো বন্ধ দরোজার পেছনে কতিপয় আমলা কানাডায় আশ্রয় প্রার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণ করতেন। তিনি বলেন, এই রায়টি গঠনমূলক। এই রায় একটি বার্তা পৌঁছে দেয় – চার্টার অফ রাইটস এন্ড ফ্রিডম একটি অন্তভুক্তিমূলক দলিল যেটি আমাদের মাঝে আগন্তুকদেরও সমানভাবে আলিঙ্গন করে, নিশ্চিত করে আগন্তুকদের ন্যায্য বিচার প্রাপ্তি।

মনীষ পাল – লেখক ও অভিবাসন উপদেষ্টা, টরন্টো