ফরিদুর রহমান : উইলি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। দরজা খুলে দিয়ে তার প্রথম কথা, ‘আমি ভেবেছি তোমরা নিশ্চয়ই রাস্তা হারিয়ে ফেলেছো। এতো দেরি হবার তো কথা নয়।’ বললাম, ‘রাস্তা নয় ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবে তোমাকে ফোনে চেষ্টা করেও পাইনি।’ উইলি বললো, ‘পাবলিক বুথ থেকে করা তোমার কলটা রিসিভ করতে পারিনি। পরে দেখে বুঝতে পেরেছিলাম তুমি কল করেছো। আমার বাইরে যাবার কথা ছিল, কিন্তু তোমাদের অপেক্ষায় থেকে প্রোগ্রাম বাতিল করে দিয়েছি।’

লম্বা চওড়া দশাসই চেহারা, মুণ্ডিত মস্তক এবং হাতে কানে গলায় নানা অলঙ্কারে সজ্জিত উইলিকে দেখে বড় মাপের মাস্তান মনে হলেও হোস্ট হিসাবে শুরুতেই খুব আন্তরিক মনে হলো। সে দুই হাতে দুটি ভারি স্যুটকেস অবলীলায় তুলে ভেতরে রেখে এসে আরো গোটা দুই ব্যাগসহ আমাদের ঘরে নিয়ে চললো। সবকিছু গোছানো টিপটপ। বাথরুম এবং কিচেন দেখিয়ে দিয়ে আমাদের কাছে থেকে বিদায় নেবার আগে বললো, ইচ্ছে করলে তোমরা রান্না করে খেতে পারো, বাইরে থেকে খাবার এনে গরম করে খেতে পারো অথবা খাবার ব্যাপারটা বাইরে থেকেই সেরে আসতে পারো। কাছে পিঠে দুই একটা রেস্টুরেন্টের খবরও সে জানিয়ে দিল।

ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা আটটা অর্থাত জার্মানিতে সূর্যাস্ত না হলেও বাংলাদেশে রাত বারোটা বেজে গেছে। বারোটা বেজেছে আমাদেরও । খাবার অনুসন্ধানের জন্য বাইরে যাবার মতো অবস্থা নেই। রাজ্যের ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। কখন কী অবস্থায় বিছানায় পড়েছি এবং ঘুমের ভেতরে তলিয়ে গেছি মনে নেই, ঘুম ভাঙলো সকাল সাড়ে সাতটায়। অর্থাত একরাতের ঘুমে ঢাকা মিউনিখের সময়ের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়ে প্রতিদিন সকালে জেগে ওঠার মতো প্রায় সঠিক সময়েই ঘুম থেকে উঠেছি।

সকাল দশটায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা থাকলেও আমাদের উপস্থিত হবার কথা অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে। সাড়ে আটটা থেকেই শুরু হয়ে যাবে রেজিস্ট্রেশন এবং অনুষ্ঠান সূচি,বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও পার্টির আমন্ত্রণপত্র, পরিচয় পত্রসহ ফেস্টিভ্যাল কিট ইত্যাদি বিতরণ। তারপরেই উত্সব এলাকা ঘুরে দেখাবার ব্যবস্থা থাকে। বিশেষ করে নবাগতদের জন্যে মূল প্রদর্শনী হল, স্টুডিও, তিনটি সেমিনার রুম, সাইবার ক্যাফে, ভিডিও কপিবার এবং কফিশপসহ পুরো বায়েরিসার রুন্ডফুংক ভবনে একটা চক্কর দিয়ে মূল মিলনায়তনে শুরু হয় উত্সব।

প্রিজনেসের পর্দায় অশ্বারোহী তাসমিনা

আমরা উইলির নির্দেশনা অনুসারে মিনিট পাঁচেক হেঁটে লিওনার্দো স্টপেজ থেকে কুড়ি নম্বর ট্রামে উঠে পড়লাম। আগের যাত্রায় একাধিকবার চলতি ট্রামেই টিকেট কিনে যাতায়াত করেছি। এবারেও ট্রমে উঠে টিকেট ভেন্ডিং মেশিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বুঝলাম কোথাও একটা ভুল হয়েছে। এই মেশিনে টিকেট শুধু ভ্যালিডেট করা যায়। ওয়ানম্যান ম্যান অপারেশন বা ওএমএস বাস বা ট্রামে উঠবার আগেই স্টপেজে টিকেট কিনে উঠতে হয় অথবা ড্রাইভারের কাছে থেকে নির্ধারিত কয়েন দিয়ে টিকেট কিনে মেশিনে এ্যাক্টিভেট করে নিতে হয়। মেশিনে টিকেট কেনার পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতেই দুটো স্টপেজ পার হয়ে গেছে। অতএব তৃতীয় স্টপেজে এসে ট্রাম থামতেই নেমে পড়লাম। আমাদের নেমে যাবার কথা কারস্টাড প্লাজ, এখান থেকে তিন চার মিনিট পায়ে হাঁটার পথ। বিনা টিকেটের যাত্রী হয়ে তিনস্টপেজ পরে নেমে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যদিও ট্রামে বাসে টিকেট চেকিং সচারচর দেখা যায় না, তারপরেও বিনা টিকেটে ধরা পড়াটা শুধু পঞ্চাশ ইউরো জরিমানা নয় রীতিমতো অসম্মানজনক।

এরপরের পথটুকু আমার চেনা। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম বি আর, মিউনিখের বেতার ভবন। রেজিস্ট্রেশন শুরু হয়ে গেছে আগেই। ভেতরের লবিতে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। চেনা অচেনা সাদা কালো বাদামী চেহারর নানা দেশের প্রতিনিধি প্রিজনেসের ব্যাগ কাঁধে এবং পরিচয়পত্র গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঘটনাস্থল ইউরোপে হবার ফলে সাদা চেহারার মানুষের সংখ্যা বেশি। তবে অন্যান্যরাও নেহায়েত কম নয়। সকলেরই এক পরিচয়, প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে অডিও ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার সাথে যুক্ত। মেইলে পাঠানো অংশগ্রহণকারীর তালিকায় বিটিভির দুজনসহ বাংলাদেশের অন্তত দশজনের নাম দেখেছিলাম। সকলেই হয়তো শেষ পর্যন্ত আসতে পারেনি বা পারবেন না। তবে সকাল সকালই রেজিস্ট্রেশন ডেস্কে একজনকে পাওয়া গেল তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সহকারি প্রযোজক বলে পরিচয় দিলেন। তবে রেজিস্ট্রেশনের সকাল ছাড়া আর কখনো কোনোদিন তাঁকে উত্সব চত্বরে দেখা যায়নি।

ঠিক দশটায় পুরো এলাকা জুড়ে উদ্বোধনী ইনসিগনিয়া বাজতে শুরু করলো। যিনি যেখানে ছিলেন প্রত্যেকেই ছুটলের এক নম্বর স্টুডিও বিশাল হল ঘরে। খুব বেশি আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। একদল শিশু কিশোর হাওয়া ভরা বিশাল বেলুনের মতো একটা পৃথিবী গড়িয়ে এনে মঞ্চে ছেড়ে দিল। তারই সূত্র ধরে প্রিজনেস সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নির্মাতাদের কয়েকজন তাঁদের অতীতের অভিজ্ঞতা, শিশুদের চলচ্চিত্র বা টেলিভিশন অনুষ্ঠানের ভবিষ্যত এবং প্রিজনেসের ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে খুবই সংক্ষেপে বক্তব্য শেষ করলেন। সব শেষে ছিল ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর মায়া গটজের সুস্বাগতম! এখানে মঞ্চে আসর জমিয়ে বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। মাননীয়দের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ বিশেষণে বিভুষিত করে লম্বা চওয়া বক্তব্য দেবার কোনো ব্যবস্থা নেই। এরা এতো অল্প কথা সব কথা বলে ফেলে কেমন করে সেটাও আমাদের শিখতে হবে। কথামালার ফাঁকে শিশুদের কিছু পরিবেশনা ছিল। বিশেষ করে ছোট্ট একটি মেয়ের বেহালায় ওয়েস্টার্ন ক্যাসিকের সুর মনে রাখার মতো।

এগারোটায় জাপানের এনএইচকের ছবি ‘টেক টেক’ (Take Tech) দিয়ে শুরু হলো প্রথম দিনের নন-ফিকশন প্রদর্শনী। বিকেলের অবিশেনে দ্বিতীয় ছবি আমাদের ‘অশ্বারোহী তাসমিনা।’ আজকের মতো মাঝের আলোচনা অধিবেশন এবং দুপুরের প্রদর্শনী বাদ দিতে পারলে ভালো হয়। আর তা না হলে ছবি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। বেলা একটায় লাঞ্চব্রেকের সাথে সাথেই ঘরে ফেরার জন্যে বেরিয়ে পড়লাম। এবারে আর বাসের টিকেট নিয়ে সমস্যায় পড়তে চাই না। কাজেই বাসস্ট্যন্ড থেকেই তিনদিনের গ্রুপ টিকেট কিনে ফেললাম। মেশিনে আমার টিকেট কেনার প্রাথমিক কসরত দেখে এক মধ্যবয়েসী জার্মান সজ্জন ‘লেট মি হেল্প ইউ’ বলে এগিয়ে এলেন এবং মুহূর্তে ২৭ ইউরো দিয়ে মেশিন থেকে টিকেট বের করে হাতে দিয়ে দিলেন। উত্সব থেকে ঘরে এবং ঘর থেকে উত্সব তিনদিন অবাধ যাতায়াতের টিকেট পকেটে ফেলে ট্রামে উঠে পড়লাম।

দর্শকদের একাংশ

লিওনার্দো স্টপেজে নেমে সেই দম পেদ্রো মহোদয়ের সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতেই মনে হলো ঘরে ফিরে আবার তো সেই লাঞ্চের সন্ধানে বেরোতে হবে। তারচেয়ে কোথাও বসে পিত্জা-পাস্তা কিছু খেয়ে নিলেই চলে আর খেতে ইচ্ছে না করলে সাথে করে নিয়ে নেয়া যেতে পারে। আমাদের ঠিক উল্টো দিকেই চোখে পড়লো পালেরমো পিত্জা! পথের ওপারে ছোট্ট ফাস্টফুডের রেস্তোরায় পিত্জার সাইনবোর্ড দেয়া থাকলেও ঢুকে দেখা গেল ইতালিয়ান পিত্জা পাস্তা, কিংবা জার্মান সসেজ বা পমেস বার্গারের চেয়ে এখানে তুরস্কের রন্ধনশালার কর্তৃত্ব বেশি। কাজেই ডোনার কাবাব, লামাকুন, কোফতে, দুরুম এবং বাকালাভার ছড়াছড়ি।
বুঝলাম নামে সুইডেন এবং ইতালির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে আসলে ব্যবসা করছে তুরস্ক! তাতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই, বরং এখানে অন্তত নিষিদ্ধ মাংসের কোনো ব্যাপার নেই ভেবে আমার সহযাত্রী স্বস্তি প্রকাশ করলেন। শশ্রুমণ্ডিড টার্কিশ তরুণ খাদ্য তালিকা এগিয়ে দিয়ে সবিনয়ে জানতে চাইলেন আমরা কী টেবিলে বসবো না টেক-এ্যাওয়ে? আমরা টেবিলে বসলাম ঠিকই তবে খাবার বললাম টেক-এ্যাওয়ে। খুব বেশি জটিল এবং অপরিচিত খাদ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষা না চালিয়ে সোজাসুজি দুটি দুরুম অর্ডার দিয়ে টেবিলে বসে এক হাস্য্জ্বোল বৃদ্ধার ঘরময় ঘুরে ঘুরে পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং ছেলেটির দক্ষ হাতে খাবার তৈরির কাজ দেখতে দেখতেই প্রস্তুত হয়ে গেলো আমাদের টার্কিশ লাঞ্চ। তরুণ তুর্কি বেশ যতেœর সাথে এ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মুড়ে পলি ব্যাগ হাতে ধরিয়ে দিলে আমরা বিল মিটিয়ে ঘরের পথ ধরলাম।

পলিব্যাগের ওজন দেখে আগেই মনে হয়েছিল, দুটি দুরুম দুজনে মিলে এক বেলায় তো দূরের কথা দু বেলায় সাবাড় করাও কঠিন হবে। বাংলায় দুরুমের অর্থ করলে দাঁড়ায় মোড়ক। তুরস্কের জনপ্রিয় স্ট্রিটফুড এখন ইওরোপের বিভিন্ন দেশে এমন কি খোদ ইস্তাম্বুলের অভিজাত রেস্তোরাতেও পাওয়া যায়। ময়দার একটি পাতলা রুটি দিয়ে মোড়ানো থাকে চিকেন বিফ অথবা মাটনের গ্রিল করা মাংস, সাথে টমেটো, পেঁয়াজ, পার্সলে পাতা ছাড়াও ইচ্ছেমতো এবং রুচি অনুসারে সবজি, মেয়োনিজ ও নানা ধরনের সস। একটি দুরুম উইলির রেফ্রিজারেটরে ঢুকিয়ে দিয়ে অন্যটি এ্যালুমিনিয়াম ফয়েলসহ কেটে দুজনে লাঞ্চ সেরে বোধহয় খানিকটা ঘুমিয়েও নিয়েছিলাম।

বিকেলের অধিবেশন সোয়া পাঁচটায় শুরু হবে চিলির একটি দশ মিনিটের ছবি দিয়ে। আমরা একটু আগেই পৌঁছাতে চাই বলে চারটার দিকে তৈরি হয়ে বেরোতে যাবার সময় সকালে কেনা ট্রামের টিকেট খুঁজে পেলাম না। পকেটে, টেবিলে, প্রিজনেসের ব্যাগে, অনুষ্ঠান সূচি এবং বেশ কয়েকটি ফোল্ডারের ফাঁকে, না কোথাও নেই। ট্রাম থেকে নেমে ঘরে ফেরার পথে সেই পিত্জার দোকান ছাড়া আর কোথাও যাত্রা বিরতি দিইনি, তাহলে কি ওখানে ফেলেছি! শেষ চেষ্টা হিসাবে ট্রাম স্টপেজের পথে আবার ঢুকলাম সেই পালেরমো পিত্জায়। টার্কিশ ছেলেটি আমাদের সমস্যার কথা শুনে প্রথমে কাউন্টারের আশেপাশে খুঁজে দেখলেন, তারপরে বললেন ‘তোমরা যাবার পরে টেবিল কিন করেছে আমার মা। তাকে একটু জিজ্ঞেস করে দেখি। সে ভেতরে চলে যাবার পরে আমরা আশা এবং আশঙ্কা নিয়ে বসে আছি। তিন ঘণ্টা আগে ফেলে যাওয়া কোনো কাগজের টুকরো কী আর এতোক্ষণ আমাদের জন্যে কেউ জমিয়ে রেখেছে! বেশ কিছুক্ষণ পরে সামান্য কোঁচকানো টিকেটটা আমার হাতে দিয়ে বললো, ‘সম্ভবত এটাই তোমার টিকেট। মা কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছিল, আর কিছুক্ষণ পরে এলে আর পেতে না।’ আমরা মাতা পুত্র দুজনের উদ্দেশ্যে যতোটা সম্ভব থ্যাংকইউ, ধন্যবাদ, শুকরিয়া, ডাঙ্কে ইত্যাদি বিতরণ করে বেরিয়ে এলাম।

ইনসিগনিয়া বাজতে শুরু করার সাথে সাথে সকলেই ব্যস্ত হয়ে প্রজেকশন হলের দিকে ছুটতে থাকে। বিকেলের অধিবেশনে আমাদের ব্যস্ততা ছিল আর সকলের চেয়ে বেশি। আমাদের উপস্থিতিতে বিদেশের মাটিতে এই প্রথমবারের মতো দেখানো হবে অশ্বারোহী। ছবির প্রজেকশন কোয়ালিটি নিয়ে আমার একটু চিন্তা ছিল। কিন্তু প্রথম ছবি চিলির সুনি: আইজ টু দ্য ফিউচার শেষ হবার পরে ঠিক পাঁচটা পঁচিশ মিনিটে পর্দায় ভেসে উঠলো নন-ফিকশন: ১৫ তাসমিনা দ্য হর্সগার্ল! শুরু হবার পরে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলাম বিশাল পর্দা জুড়ে যা দেখছি আমাদের তৈরি অশ্বারোহীর চেয়ে তার ছবি অনেকগুণ ঝকঝকে রংয়ের কোনো বিকৃতি নেই এবং সামান্যতম শব্দও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। শুধুমাত্র প্রক্ষেপণের পেশাদারিত্বের কারণে একটি সাধারণ নির্মাণও কতোটা আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা যায় প্রিজনেসে না এলে কখনোই সে অভিজ্ঞতা হতো না।

রেজিস্ট্রেশন ডেস্কের স্বেচ্ছাসেবীরা

ছবি শেষে দীর্ঘ করতালির মধ্যে বাংলাদেশি কারো করতালি শব্দ শোনা যায়নি। বিকেলে বিআর ভবনে ঢোকার পরেই রেজিস্ট্রেশন ডেস্কের সদাহাস্যময়ী ছোটখাটো মেয়েটি জানিয়েছিল বাংলাদেশের আরো দুজন প্রতিনিধি রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেছেন। নাম দেখে বুঝেছি এদের একজন আমার পূর্ব পরিচিত। ভেবেছিলাম ভালোই হলো, অন্তত দু তিনজন দেশি ভাই বোনকে প্রদর্শনীতে পাওয়া যাবে। কিন্তু এদের একজনও শুধু আমাদের ছবির সময় নয় নয়, কোনো প্রদর্শনীতেই উপস্থিত ছিলেন না। এরা জার্মান ভিসা পাবার জন্যে ফেস্টিভ্যালের আমন্ত্রণ ব্যবহার করেন এবং দিন কয়েক বার্লিন বা ফ্রাঙ্কফুটে আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবের বাড়িতে থেকে ঘোরাঘুরি করে দেশে ফিরে যান। কেউ কেউ মিউনিখ এয়ার পোর্টে নেমেই হাওয়া হয়ে যান, আর কখনো দেশেই ফেরেন না।

‘অশ্বারোহী তাসমিনা’র পরপরই শুরু হলো আর একটি চমত্কার প্রামাণ্যচিত্র নেদারল্যান্ডসের কুনুমি: দ্য নেটিভ থান্ডার। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডাচ হলেও ছবিটি নিজের জাতিসত্ত¡ার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ব্রাজিলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির এক কিশোরের কাহিনি। এগারো থেকে পনের বছর বয়েসীদের নন-ফিকশন ক্যাটাগরিতে কিশোরীদের বয়ঃসন্ধি সম্পর্কিত নরওয়েরর একটি ডকুমেন্টারি ছিল দিনের শেষ ছবি। আমাদের অর্থাত এশিয়ার রক্ষণশীল দর্শকদের জন্য এই খোলামেলা প্রামাণ্যচিত্রটি দেখা বেশ অস্বস্তির কারণ হলেও শেষ পর্যন্ত বসেই থাকতে হলো।

রাত আটটায় উদ্বোধনী দিনের রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান। প্রিজনেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা সাদামাটা হলেও রাতের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানটি কিন্তু বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। রেসিডেন্স নামের যে প্রাসাদের মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে সেটি শুধু তার সুবিশাল ভবন, সংলগ্ন উদ্যান, কারুকার্যখচিত দেয়াল, দরজা-জানালা এবং অলিন্দ ও খিলানের সৌন্দর্য্যরে জন্য নয়। জার্মানির এবং প্রকৃত পক্ষে ইওরোপের ইতিহাসের কয়েকশ বছরের উত্থান পতনের সাথে জড়িয়ে আছে এই প্রাসাদের নাম। এখানে অভিনীত হয়েছে জার্মানির রাজনৈতিক নাটকের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য!

প্রাসাদের নির্মাণ যজ্ঞের সূচনা করেছিলেন রাজা তৃতীয় স্টিফেন ১৩৮৫ খ্রিস্টাব্দে। ব্যাভারিয়ার রাজন্যবর্গের যথোপোযুক্ত বাসভবন হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছিল বলেই এর নাম রেসিডেন্স! শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সম্প্রসারণ ঘটেছে এই প্রাসাদের, যুক্ত হয়েছে নতুন ভবন, প্রমোদ-উদ্যান, জলাধার, ক্রীড়াক্ষেত্রে, রত্নভাণ্ডার এবং সংগ্রহশালা। ব্যাভারিয়ার শেষ রাজা তৃতীয় লুডউইগের রাজত্বকালে প্রাসাদের মাথার উপরে আচ্ছাদনযুক্ত এলাকার বিস্তৃতি দাঁড়িয়েছিল ২৩০০০ বর্গ মিটারে। বিদ্যুত সংযোগ, কেন্দ্রীয় তাপ সরবরাহ, এলিভেটর স্থাপন এবং আধুনিক পয়ো নিস্কাষণ ব্যবস্থাসহ স্বচ্ছন্দ জীবন যাপনের নানা আয়োজন রাজা মশাই ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু বেচারার কপাল খারাপ। চার বছরের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নাস্তানাবুদ হয়ে ইওরোপের অনেক দেশেই যখন রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে সেই সময়েই যুদ্ধে পরাজিত রাজা ১৯১৮ সালের নভেম্বরে সিংহাসন চ্যুত হয়ে রেসিডেন্স ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের অগাস্টে ওয়েমার রিপাবলিক নামে জার্মানি সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগে প্রবেশ করলে পরের বছর এই রাজকীয় প্রাসাদ মিউজিয়াম হিসাবে সর্ব সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

জাদুঘর হিসাবে দর্শনার্থীদের জন্য সকাল-সন্ধ্যাই শুধু উন্মুক্ত নয়, এখন রাজকীয় কনসার্ট হলে অয়োজিত হয় বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজনও হয়ে থাকেএ খানে। সে সব অনুষ্ঠানে আম জনতার অংশগ্রহণও নিয়মিত ব্যাপার, আর আমাদের প্রিজনেজ ইন্টারন্যাশনাল তো রাষ্ট্রীয় নয়, রীতিমতো আন্তর্জাতিক! অতএব আমাদের জন্যেও রেসিডেন্সের দুয়ার খোলা। ফেস্টিভ্যাল ভ্যেনু বায়েরিসার রুন্ডফুংক অর্থাত ব্যাভারিয়ান বেতার থেকে রেসিডেন্স ট্যাক্সিতে গেলে সাড়ে তিন কিলোমিটারের কিছু বেশি আর পায়ে হেঁটে গেলে দুই কিলোমিটারের কম। আরো কয়েকজন সঙ্গীসহ আমরা হাঁটতে শুরু করলাম রেসিডেন্সের উদ্দেশ্যে। রাজা মহারাজাদের বসবাস অনেক আগে উঠে গেলেও প্রাসাদের নামটা এখনও রেসিডেন্সই রয়ে গেছে। (চলবে)