মণিজিঞ্জির সান্যাল : নতুন প্রজন্ম কি প্রেমের অনুভূতি সত্যিই বোঝে,
বিশেষ করে এই শরৎ ঋতুতে?
ছোটবেলায় ডায়েরি লিখতাম। শুধু আমি কেন অনেকেই লিখত। আর সেই ডায়েরিকে গুপ্তধনের মতো লুকিয়ে রাখা হত। হয়তো কিছুই তেমন থাকত না তবুও মনে হতো কিছু জিনিস একান্ত গোপন থাকাই ভাল ।

এখন ডিজিটাল যুগ, গোপন শব্দটি হাস্যকর। সবাই ঝকঝকে স্মার্ট। মাঝে মাঝেই ফেসবুককে আমার ডায়েরি মনে হয়। সবাই এখানে তাদের সুখ-দুঃখের কথা লেখে, মৃত্যুর কথা লেখে, বিরহের কথা লেখে, যন্ত্রণার কথা লেখে, কিন্তু এই ডায়েরি লুকিয়ে রাখার নয়; এই ডায়েরি প্রকাশ্যে নিজেকে তুলে ধরার।

আগে প্রেম মানে ছিল দুরু দুরু ব্যাপার; কেউ দেখে ফেলল না তো? বিশেষ করে এই শরৎ ঋতুতে? জানি অনেকেই বলবে প্রেমের জন্যে কোনো ঋতুর প্রয়োজন নেই। থাকবেই বা কি করে?

এই যে শরৎ কাল – শিউলি, পদ্মফুল, কাশফুল, নীল আকাশ। এইসময়টা ছোটবেলার কথা মনে পড়ে, বিশেষ করে কিশোরী বেলার কথা। পুজো মন্ডপে দুরু দুরু বুকে যাওয়া। কেউ দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কি? কিম্বা কে যেন মিটিমিটি হাসল। আহা সারা শরীরে কি একটা শিহরণ জেগে উঠত! বন্ধুদের মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু হলো “এই তোকে দেখছে, ঠিক তোর প্রেমে পড়েছে।”

মোটামুটি বিশ্বকর্মা পুজোর দিন থেকেই শুরু হয়ে যেত একরকম পুজোর প্রস্তুতি। বাবার সাথে ছোটবেলায় কতো পুজো দেখা আর বাবার অফিসে কতো খিচুড়ি খাওয়া। একটা প্ল্যাস্টিকের মধ্যে অনেকে আবার কত ফল, মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে দিত। সে যে কি আন্তরিকতা বলে বোঝানো যাবে না। এসব ঘটনা একদম শৈশবের হলেও সবকিছু ঝকঝকে কাচের মতোই পরিস্কার।

বিশ্বকর্মা পুজোর দিনকে ঘিরেই শুরু হয়ে যেত আমাদের উৎসবের সূচনা। ধীরে ধীরে শুরু হতো পুজোর জামাকাপড় কেনা। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিনদিনের জন্যে তিনটে জামা হতেই হবে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার অষ্টমী পুজোর জন্যে সবচেয়ে সেরা জামাটা আলাদা করে রাখা থাকত। আর পুজো মানেই ছোটবেলায় বাটার জুতো। কতোদিন আগে থেকে জুতোর বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো প্রতিটি খবরের কাগজে। মনে হয় প্রতিটি বাঙালি সবার প্রথমে জুতো কিনত, আর এই দিয়েই শুরু হতো পুজো শপিং।

দেখতে দেখতে কখন যে মহালয়ার দিনটি এসে হাজির হত। আর মহালয়া মানেই তো শুরু হয়ে যেত বই,খাতা, পেনের সঙ্গে টাটা। আমাদের স্কুল যদিও ষষ্ঠীর দিন চারটে পিরিয়ড হয়ে ছুটি হতো। তবে মহালয়ার দিন থেকে আমরা ছোটরা বাড়ির সামনের পুজোর প্যান্ডেলে হৈচৈ, খেলাধূলো, বিশেষ করে লুকোচুরি খেলা শুরু করে দিতাম পুরো মন্ডপকে ঘিরে। সে যে কি উন্মাদনা বলে বোঝানো যাবে না। তার মধ্যে প্রকৃতিও তখন নররূপা। আকাশে বাতাসে দূর দূরান্তে তখন শুধু খুশির আবেশ। মানুষের মধ্যে তখন কোনো দুঃখ নেই, মলিনতা নেই, নেই কোনো গ্লানি, বিচ্ছেদ। আমাদের পাড়াতে সব ধর্ম, সব বর্ণ মিলে মিশে এক হয়ে যেতএই বিশেষ উৎসবের দিনে। ভালোবাসার বন্ধনে একে অপরকে জড়িয়ে থাকতাম প্রতিনিয়ত।

সকাল থেকে শিউলি ফুলের সুবাস মনকে ভাসিয়ে দিত কোথায়!
ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় প্যান্ডেলের সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকতাম কখন ঠাকুর আসবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকির আওয়াজে গমগম করে উঠত চারপাশের পরিবেশ। ট্রাকে করে ঠাকুর আসত। সাজানো হত মন্ডপ, কিভাবে ঘুরে ঘুরে খুব ধীরে ঠাকুরকে মন্ডপে রাখা হত। সেই কি আনন্দের মুহূর্ত তখন আমাদের মনের মধ্যে।
ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম, শৈশব ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছি কখন কৈশোরে। সেই সময়ের উন্মাদনা আবার আর একরকম।

সপ্তমীর দিন থেকে শুরু হতো সেই উত্তেজনা। পরদিন আরো উচাটন, অষ্টমী বলে কথা! পরিবারের বড়দের সাথে অঞ্জলি দিতে গিয়ে নীরব চাওনি। বন্ধুরা পাশাপাশি তবুও …
আহা ছেলেরা গোল হয়ে বসে কি ভাব নিচ্ছে! তখন তো মোবাইল ফোনের দিন ছিল না। ছেলে বা মেয়েরা এতো খোলাখুলি মেলামেশাও করত না। তখন প্রেম মানেই হয় খুব খারাপ কিছু, বা প্রেম মানে তেমন সাহসী একটা কিছু। একটি মেয়ের সাথে একটা ছেলের নির্জনে কথা বলা মানেই ব্যস চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত সেই খবর। এমনকি বাড়িতে যদি পৌঁছে যেত সেই কথা, তাহলে আর রক্ষা নেই। মেয়েটির ঘর থেকে বের হওয়া সবার আগে বন্ধ হয়ে যেত।

কিন্তু এই পুজোকে উপলক্ষ করেই তখন দিনের বেলা একটু কাছাকাছি পুজো মন্ডপে বন্ধুদের সাথে বসে গল্প করা, আড্ডা মারা হত। তবে ছেলেদের মতো করে মেয়েরা সেই সুযোগ পেত কম। এই স্মার্ট ফোনের যুগে এসে সবাই খুব তাড়াতাড়ি স্মার্ট হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু তাদের মধ্যে নেই সেই দুরু দুরু বুকে ছেলেদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া। কেউ তাকালো নাকি! কেউ কি মিটিমিটি হাসছে? কিম্বা সেই বিশেষ চেয়ে থাকা, যা দেখে সারা শরীরে, মনে পুলক জেগে উঠত। পুজোর সেই দিনগুলোতে প্রেমের ছোঁয়ায় ভরে থাকত মন, তার জন্যে প্রেম না করেও একই অনুভূতি। কারোর একপলক চোখে চোখ পড়লেই তার রেশ ছেয়ে থাকত পরের পুজো অবধি কিম্বা …

আমাদের কিশোরীবেলার পুজোর দিনগুলো কখনো জীবন থেকে তাই ¤øান হয়ে যাইনি, যাবেও না।

অষ্টমীর দুপুরে ভোগের প্রসাদ আনতে গিয়ে আর এক দৃশ্য। একটু দূরে ছেলেরা বসে আছে নানান স্টাইলে। সেকি রোমান্টিক ব্যাপার স্যাপার। কেউ ধবধবে সাদা পোশাকে নিজেকে মাতিয়ে দিয়েছে, কেউ পায়ের ওপর পা রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে, কেউ ঢাকের তালে পায়ের স্টেপ ফেলছে। সেই স্টেপ দেখার জন্যে আরো একটু ধীরে ধীরে ভোগের প্রসাদ নেবার ইচ্ছে প্রকাশ। তারপরেই বন্ধুদের ঠেলাতে আড়চোখে সেই নাচ দেখে নিয়ে লজ্জায় মাথা নত করে কতোক্ষণে বাড়ি ফেরা যায়।

তারপর সন্ধ্যা হলেই বড়দের সাথে ঠাকুর দেখতে যাওয়া। সবচেয়ে ভাল ড্রেসটা অষ্টমীতেই পরতে হবে। তখন নিজের পাড়ার পুজো ছেড়ে আরো দূরে দূরে পুজো দেখতে যাওয়ার আনন্দ, কত কিছু খাওয়া দাওয়া, ভিড় ঠেলে পুজো দেখা। কখনো হাই হিল শখ করে কিনে, সেই জুতো পরে ঠাকুর দেখে ফেরার পথে হাতে জুতো নিয়ে বাড়ি ফেরা। হাসিতে, কথায়, গল্পে রাতটাও যেন হেসে উঠত আমাদের সঙ্গে, রাত যে এত সুন্দর আগে তা জানাই ছিল না। পুরো পৃথিবী যেন কলকল করছে আমাদের উৎসবে। রাত জাগা পাখির মতো আমরা সারা পথ হেঁটে বেড়াতাম। গভীর রাতে এত হৈচৈ ! এত আনন্দ! রাতের তারারাও আমাদের মুগ্ধ চোখে দেখত। চাঁদও হেঁটে বেড়াত আমাদের সঙ্গে।

ঠিক তার পরদিন নবমী, মনের মধ্যে তখন থেকেই শুরু হয়ে যেত বিষাদের ঘনঘটা। সব আনন্দ, সব আয়োজনের সমাপ্তি পর্ব যেন সেইদিন। দিনের বেলায় বন্ধুরা মিলে পাড়ার পুজোর মন্ডপে পুজো দেখা। ঢাকের তালে কি অসাধারণ নাচছে। অদ্ভুত ভাবে ঢাকটা বাজাচ্ছে ঢাকি, কেমন টেনে টেনে। আমাদের এক বন্ধুর দাদাকে দেখতাম কি সুন্দর স্টেপ ফেলছে। যেমন সুন্দর দেখতে, তেমন সুন্দর নাচছে।

চারদিকে ধূপের গন্ধ। নাচের মধ্যেও কি মিষ্টি করে হাসছে। আর সন্ধ্যায় আমাদের পালা। আরতি প্রতিযোগিতা। প্রতিবার ধুনুচি নাচে আমার ফার্স্ট প্রাইজ কেউ আটকাতে পারেনি কোনোদিন।

দেখতে দেখতে চলে আসত দশমী অর্থাৎ বিজয়া। চোখ জলে ভরে উঠত আমাদের। সব আনন্দ এক নিমেষে শেষ। দুপুরে বড়দের সাথে ঠাকুরকে বই ছোঁয়াতে হবে। মিষ্টি খাওয়াতে হবে ।

চারদিকে তখনো চলছে শেষ আনন্দের ছোঁয়া। মায়েরা সবাই সবাইকে সিদুঁর পরাচ্ছে, একটা কাচের বড় প্লেটে মিষ্টি, সন্দেশ। সবাই সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছে। আমরা ঠাকুরের পায়ে বই ছুঁইয়ে বলতাম, যেন এবছর খুব ভাল রেজাল্ট হয়।

রাতে বড়দের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠাকুর বিসর্জন দেখা। সবাই কি সুন্দর নাচছে। পাড়ার মোড়ে ছোট বড় সবাই দাঁড়য়ে থাকতাম। একের পর এক ঠাকুর ট্রাকে করে আমাদের পাশ দিয়ে যেত সেই মহানন্দা নদীর উদ্দেশ্যে। ঢাকের তালে নাচতে নাচতে যেত সবাই, সারা মুখে গায়ে তাদের আবির। মনটা বিষন্ন হয়ে যেত, খুব কান্না পেত পুজো শেষ হয়ে গেল বলে। আজ এটুকু লিখতে লিখতেই আমার চোখে জল কেন!!!!

হে নতুন প্রজন্ম; হে নতুন ডিজিটাল যুগ, তোমরা আনন্দ, দুঃখ, মন খারাপ, ভাললাগা, মন্দলাগা কিছুই অনুভব করতে পারলে না। প্রেম কি, প্রেমের অনুভূতি কি কিছুই বুঝলে না।
তোমরা একটু ধীরে চলো, প্রেমকে উপভোগ করো, এক নিমেষে মেরে ফেলো না ; তাহলে কৈশোরের স্মৃতি একদিন তোমরা খুঁজেও পাবে না …

মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথা সাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ