সাজ্জাদ আলী : কান্দা উঁচু একখানা কাঁসার থালায় তিনি খেতে বসেছেন। পাশে রাখা জল ভরা গ্লাসটিও কাঁসার। মাদুরের ওপরে দুপায়ে সন্নিভরে বসা। জাবড়িয়ে বসা তাঁর অভ্যাস না। মস্ত থালায় অল্প দুটি ভাত! পাঁচ পদের তরকারি সামনে থাকলেও মাত্র একটি পদই তিনি খাবেন (বড়জোর দুটি)। খাবারটা কিন্তু মেজকাকীকেই দিতে হবে, অন্য কেউ দিলে হবে না। সেদিন কদু তরকারী দিয়ে শোল মাছ রাঁধা হয়েছে। বিশাল সিলভারের ডিস ভর্তি সেই ঝোলের ওপরে সর পড়ে আছে। ২৫/৩০ জন লোকে তা খাবে। তবে সবার আগে ওই ডিস থেকে নিজ হাতে তিনি একটুখানি তরকারি তুলে নেবেন। এটাই বাড়ির রেওয়াজ।

সবদিনই তিনি একা খেতে বসেন। মানে, বাড়ির আর কারো তাঁর সাথে খেতে বসার সাহস হয় না। তিনি যে বদ-মেজাজী, তা কিন্তু মোটেই না। তবে ভীষণ রাশভারী। তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়ানো বা পাশঘেঁষে বসার ঝুঁকি কেউ নিতে চায় না। মাথায় ঘোমটা টেনে মেজকাকী স্ট্যান্ডবাই আছেন, তার ভাইজানের কী লাগে না লাগে! থালার দিকে চেয়ে এক মনে খাচ্ছেন তিনি। খাবার ঘরে শালকাঠের তৈরি হাতলওয়ালা একখানা বেঞ্চি পাতা। হেলান দিয়ে দাদী বসেছেন সেই বেঞ্চিতে। তাঁর বড় ছেলে রাতে কি খেলো না খেলো, সেটা তাঁর নিজের চোখে দেখা চাই।

এতক্ষণ বলছিলাম, এক রাতে আব্বার খাওয়ার সময়ের চিত্রপট। আমি তখন খুবই ছোটো। পরনে প্যান্ট না থাকলেও কিছু যায় আসে না। বয়সটা সেই রকমের। বেয়েছেয়ে বেঞ্চিতে উঠে দাদীর কোলে বসছি, আবার লাফ দিয়ে নেমে পড়ছি। খানিক বাদে আবার উঠছি। কোলে বসে দাদীকে ফিসফিসিয়ে বললাম, সেই কথাডা আব্বারে জিজ্ঞেস করেন?

দাদী ফিসফিসানির ধার ধারলেন না। স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন, তোর বাপরে তুই ক, আমি কতি যাবো ক্যা!

কথাটা আব্বার কানে গেল। ক্ষণিকের জন্য গালের ভাত চিবানো বন্ধ রেখে তিনি দাদীর দিকে চাইলেন। আমি লজ্জায় দাদীর কাঁধে মুখ লুকালাম। কিন্তু ভয় পাইনি একটুও। কারণ আমি তো দাদীর কোলে। আমাকে আঁচড় কাটার সাধ্যি এ তল্লাটে কারোরই নেই। তিনি আবার খাওয়ায় মন দিলেন। মেঝকাকী আমার দিকে চেয়ে ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে কথা না বলার ইঙ্গিত করলেন। পাছে তার ভাইজানের খাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটে! কিন্তু আমার তো বারণ শুনলে চলে না। ও কথাটার জবাব তো আমার জানা চাই। এবার দাদীর গলা জড়িয়ে ধরে, কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা গলায় বললাম, আপনার আল্লার কিরা লাগে দাদী, আব্বারে জিজ্ঞেস করেন।

স্নেহভরে দাদী বললেন, তোর কতা তুই নিজির মুখি ক। ভয় নাই তোর, আমি আছি তো। তুই ক’।
আব্বা বললেন, তুই কি কিছু বলবি বাবা? আয়, আমার কাছে এসে বস, কী লাগবে তোর?

ওরে বাপরে, এ কোন পরিস্থিতিতে পড়লাম। ভেবেছিলাম কথাটা দাদী জিজ্ঞাসা করে জবাবটা জেনে দেবেন। এখন তো দেখছি আমারই বলা লাগে! অনেক হয়েছে, আমার আর ওই জবাব জেনে কাজ নেই। দাদীকে জড়িয়ে ধরে তাঁর আঁচলে মুখ ঢেকে ফেললাম।
আব্বা দাদীর দিকে চেয়ে বললেন, ও মা, ওর কি কবার চায়? কোনোদিন তো আমি খাওয়ার সময় ওরে এখানে দেহি না। আইজ আইছে যে?
দাদী বললেন, তুই নাকি ওরে কইছিস যে ও “খারাপ ছাত্রও না”!

আব্বা চেয়ে আছেন দাদীর দিকে। কখন, কী কারণে কথাটা বলে থাকবেন, তাই যেন মনে করার চেষ্টা করছেন। খানিক বাদে বললেন, এমন কথা কইছিলাম নাকি? কবে মা? মনে নাই তো!
ওই যে ওর পরীক্ষার আগের রাইতে, ও কলের গান বাজাইয়া গান শুনতি ছেলো। সেই সমায় রাগ কইরা কইছিলি তুই, অনুযোগের সুরে দাদী বললেন।

মৃদু হেসে আব্বা বললেন, ও আচ্ছা সেই কথা। তা ও এখন কী জানতে চায় মা?
দাদী বললেন, ও ভাল ছাত্র না, সে কথায় আমাগে আপত্তি নাই। কিন্তু ও “খারাপ ছাত্রও না”, এই কথাডা তুই কোন আক্কেলে কইলি? আমারে এট্টু বুঝাইয়া ক’তো?

এই তো চাই। দাদী এবার আমার হয়ে কথা বলছেন। ছেলের ওপরে খানিকটা চটেও গেছেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে অভিমানি মুখখানা আব্বার দিক থেকে ঘুরিয়ে নিলেন। আব্বা যেন খানিকটা বেকায়দায় পড়লেন! ততক্ষণে তাঁর খাওয়া শেষ। উঠে দাঁড়িয়ে লুঙ্গির কোচায় হাত মুছতে মুছতে দাদীর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালেন। আমার কোঁকড়ানো চুলে হাত বোলাতে বোলাতে পরম মমতায় বললেন,
বাবা, যারা ভাল ছাত্র তারা সারা বছরই পড়াশুনা করে। যারা খারাপ ছাত্র, তারা পরীক্ষার আগের রাতে পড়ে। আর তুই কী করিস? সারা বছর পড়াতো দূরের কথা, পরীক্ষার আগের রাতেও বই নিয়ে বসিস না। সেজন্যই কথাটি বলেছিলাম।
আজ আমার আব্বার মৃত্যুদিন। খুব মনে পড়ছে তাঁকে..! সেই ৮০ সালের পর থেকে কেউ আর কোনোদিন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নি!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডার নির্বাহী)