কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

তিন.
বাবা যখন বিভিন্ন দেশের নেতাদের সাথে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বা বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে কথা বলতেন, সেগুলো আমার মাথায় ঢুকার মত বয়স তখনও আমার হয়নি। তবে তখনই বৈদিশিক সম্পর্ক বিষয়ে আমার কাছে প্রায় পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল এক রাষ্ট্রের সাথে আরেক রাষ্ট্রের সুসম্পর্ক বজায় রাখা খুবই জরুরী। বাবা যখন ঐ দুটি বিষয় নিয়ে তাঁর প্রতিপক্ষের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতেন তখন লক্ষ্য করতাম তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য তাঁর প্রতিপক্ষ তাঁকে এক ধরনের সমীহ করতেন।

অন্যান্য দেশের নেতাদের সাথে আমার বাবার এমন আলোচনার পরিবেশ দেখার সুযোগ যখন কিছুটা পেতাম তখন সেই বাল্য বয়সেই এক অন্য ধরনের আনন্দে মনটা ভরে উঠতো। মাঝে মধ্যে দু’পক্ষের এই আলোচনার পরিবেশ এমন এক পর্যায়ে যেত যে মনে হতো তাঁরা একে অপরের পরম বন্ধু আর দু’জন মিলে সুন্দর কিছু গড়তে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে এ মুহূর্তে রোনাল্ড রেগানের কথা মনে পড়চ্ছে।

তিনি যখন বাবার সাথে ২৪ সাসেক্স এর বাসায় দুপুরের খাবার খেতে এসেছিলেন তখন আমি কেবল নয় বছরে পা দিয়েছি। দিন শুরু হবার পর থেকেই বুঝা যাচ্ছিল বিশেষ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কারণ ২৪ সাসেক্সের গোটা এলাকা জুড়ে আরসিএমপি (রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ) অফিসাররা দশ ফুট অন্তর অন্তর দাঁড়িয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন জুড়ে এমন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আমি আর কখনও দেখি নি।

যখন সেই বিখ্যাত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ২৪ সাসেক্সের বাসভবনে আসলেন, আমার বাবা তাঁর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং আমাদের তিন ভাইকে রোদ পোহানোর ঘরে আমাদের মত সময় কাটাতে বললেন। আমরা যখন সোফায় বসেছিলাম তখন রোনাল্ড রেগান আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে হাসলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন তাঁর কাছ থেকে আমি কবিতা শুনতে চাই কিনা। প্রেসিডেন্টের এমন প্রস্তাবে আমার সাথে সাথে বাবাও উৎসাহের সাথে মাথা ঝুকালেন। বাবা কবিতা ভালোবাসতেন এবং প্রায়ই রাচিন এর ‘ফেদ্রা’ এবং সেক্সপীয়ার এর ‘দ্য টেমপেষ্ট’ থেকে বিভিন্ন লাইন আমাদের মুখস্থ করতে দিতেন। কিন্তু কবিতা বিষয়ে রেগানের পছন্দ ছিল একটু আলাদা। ক্ল্যাসিকাল কোনো লাইন আবৃত্তি করার পরিবর্তে তিনি রবার্ট সার্ভিস এর ‘দ্য শুটিং অব ড্যান ম্যাকগ্রিউ’ থেকে আবৃত্তি শুরু করলেন। ‘একদল দুষ্ট বালক ম্যালামুট স্যালুনে বসে গলা ফাটিয়ে গান গাচ্ছে’ – সেই লাইনগুলো তিনি আমাদের শোনাতে লাগলেন।

আমি মুগ্ধ হয়ে কাউবয় অভিনেতা-প্রেসিডেন্ট এর আবৃত্তি শুনছিলাম। আমার বাবাও নয় বছরের এক বালক আর কাউবয় অভিনেতা-প্রেসিডেণ্ট রোনাল্ড রেগানের এর কাছ থেকে এমন একটা ভিন্ন পরিবেশ পেয়ে মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট এর সেই আবৃত্তি আমার কবিতার জগতে এক বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। আমি সেদিনই সেই কবিতাটা মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। তারপর ঐ ধরনের বেশ কিছু ন্যারেটিভ কবিতা আমি মুখস্থ করা শুরু করলাম যেগুলো সাধারণত আমার বাবা আমাকে শেখাতেন না। আমার এখনো মনে আছে ‘দ্য ক্রিমেসন অব স্যাম ম্যাকগী’ এবং আলফ্রেড নোয়ী’র ‘দ্য হাইওয়ে ম্যান’ আমাকে বেশ আলোড়িত করেছিল।
এ রকমই আরো সময় ছিল যেগুলো এখনও আমার স্মৃতিতে উজ্জল হয়ে আছে। এখানে আমি বলতে পারি সরকারী বোয়িং ৭০৭ প্লেনে যখন বিদেশে যাবার সুযোগ হতো সেই সময়গুলোর কথা। প্লেনের সামনের দিকটায় বড় আকারের আটটি সিট থাকতো, মুখোমুখি চারটি করে। সিটগুলোর পেছনে দুটো লম্বা বেঞ্চ থাকতো। সাধারণত অনেকক্ষণের ভ্রমণ হলে বাবা এবং আমি সেই বেঞ্চ দুটোতে ঘুমিয়ে নিতাম। প্লেনের এই অংশের সাথে অন্য অংশের মাঝখানে একটা দেয়াল থাকতো। দেয়ালের ওপারের অংশে থাকতো অন্যান্য কর্মচারী, নিরাপত্তাকর্মী ও সাংবাদিকরা। মাঝেমধ্যেই আমি পেছনের দিকে গিয়ে যাদেরকে চিনতাম তাদের সাথে কথা বলতাম। কারণ বাবা প্লেনে সবসময় কাজে ব্যস্ত থাকতেন আর খেলা করার জন্য আমার সাথে অন্য কোন ভাই থাকতো না । এই কথা বলাটা গল্পের পর্যায়ে যেত এবং এতে আমি খুবই মজা পেলেও ওখানে বেশীক্ষণ থাকতে পারতাম না। এই না থাকতে পারার আসল কারণ ছিল সিগারেটের ধোঁয়া। তখন প্লেনে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল না, এমনকি সরকারী প্লেনেও না। মাঝেমধ্যে সিগারেটের ধোঁয়া শীতের কুয়াশার মত এমনভাবে ওই জায়গাটা ছেয়ে ফেলতো যে আমি একটু বেশীক্ষণ থাকলেই খুক খুক করে কাশতে শুরু করতাম।

বাবার সাথে আমার এই সব ভ্রমণের সবচেয়ে মূল্যবান দিকটি ছিল কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাবা কিভাবে নিতেন সেটা কাছ থেকে দেখা। বাবার সাথে যেসব সফরসংগীরা থাকতেন বাবা কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তাদের কথা শুনতেন, তাদেরকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন, এমনকি কোনো কোনো সময় তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করতেন। অন্যদের সবার কথা না শোনা পর্যন্ত সাধারণত তিনি তাঁর চিন্তা ও মত জানাতেন না। ফলে বাবার সিদ্ধান্ত নেয়া মানে ছিল একটা প্রক্রিয়া যাতে প্রতিফলিত হতো অসংখ্যজনের কন্ঠস্বর। বাবা যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় কয়েক সপ্তাহ বা মাস পার করে দিতেন। সেই ৭০৭ বোয়িং প্লেনগুলোতে বাবার সিদ্ধান্ত নেবার যে প্রক্রিয়া আমি কাছ থেকে দেখেছি তা আমার জীবনে এক বিশেষ প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে আমার নেতৃত্বের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আমি অন্যদের মতকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়ে থাকি।

আমি এমন সব দিন এবং ঘটনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বেড় উঠেছি যেগুলো সব সময় আমার মানস গঠনে গুরুতপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু যে বিষয়টা সব সময় আমার স্মৃতিতে ঘুরপাক খায় তা হচ্ছে, আমাদের পাঁচ জনের সেই সুন্দর পরিবার আর আমাদের প্রতি আমাদের বাবা-মা’র যত্নশীলতা ও ভালোবাসা ।

১৯৮১ সালের ১৮ই জুলাই অটোয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান (বামে) ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ইলিয়ট ট্রুডো।

বাবার অনেক ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন এক অন্যরকম বাবা যিনি নিজের হাতে তাঁর সন্তানদের যতœ নিতেন এবং সন্তানদের মাঝে অনাবিল আনন্দ খুঁজে পেতেন। আমরা যখন একেবারে পিচ্চি তখন রাতে তিনি নিজের হাতে আমাদের সব কাজ করতেন। যখন আমরা একটু বড় হচ্ছি তখন তিনি নিজের হাতে আমাদের সাইকেল মেরামত করে দিতেন বা ক্রিসমাসের দিন আমাদের খেলনাগুলো সাজিয়ে দিতেন। রাতে আমাদের বিছানার পাশে বসে তিনি আমাদের ফরাসী উপকথা, পলিফেমাস ও তার গুহা বা হেলেন অব ট্রয়ের গল্প বলতেন। আর দিনে তিনি সব ধরনের শারীরিক খেলাধূলার সাথে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন, যদিও ফুটবল ও হকির প্রতি তিনি খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তিনি আমাদের নৌকা চালানো, পাহাড়ে উঠা, বন্দুক বা তীর ছোঁড়া, সাঁতার কাটা আর স্কি করা শেখাতেন। হ্যারিংটন লেকে আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের খেলাধূলায় কমপক্ষে চার ঘন্টা কাটাতাম। ঠান্ডা, গরম, শুকনো বা বৃষ্টি – কোনো দিনই এর ব্যতিক্রম ঘটতো না। বাবা প্রায়ই বলতেন, বাজে আবহাওয়া বলে কিছু নেই, খারাপ কিছু থাকলে সেটা হচ্ছে, বাজে পোশাক।
বাবা ও মা দু’জনেই খুব ভালো স্কি করতেন। বাবা এবড়ো-থেবড়ো পাহাড়েও ভালো স্কি করতে পারতেন। তাঁর বিশেষ স্টাইল আর কঠিন সাহসী উদ্দীপনায় তিনি অন্য সবাইকে নিমিষেই পিছনে ফেলে যে কোনো পথে সামনে এগিয়ে যেতেন। সত্তরে পা দেবার পরও আমাদের সাথে তিনি তালে তাল মিলিয়ে চমৎকারভাবে স্কি করতে পারতেন।

স্কি আর নৌকা বাইচ ছাড়াও তিনি বলরুমে চমৎকার নাচতে পারতেন এবং প্রায়ই ক্ল্যাসিকাল মিউজিক বা ধ্রুপদী সাহিত্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন। এগুলোর প্রতি তাঁর প্রবল যে প্রেম তা তিনি মাঝে মধ্যেই আমাদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতেন। তাঁর চরিত্রের এই সব বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদেরকে একই সাথে যেমন ইতিহাস, ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্ব বা দর্শনের গূঢ় বিষয় জানতে অনুপ্রাণিত করতো, ঠিক তেমনি উদ্বুদ্ধ করতো কিভাবে স্কি’তে কঠিন মোড় নিতে হয় বা নাব্য নদীতে কিভাবে নির্ভয়ে ডিঙ্গি নৌকা চালাতে হয়।

আমাদের তিন ভাইকেই ছোটবেলায় জুডো শিখতে হয়েছে। আমার বয়স যখন চার বা পাঁচ বছর তখনই বাবা নিজে আমাকে বক্সিং শেখাতেন। পরবর্তীতে বক্সিং এর প্রতি আমি বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে পড়ি এবং সত্যি কথা বলতে কি, বক্সিং রিং’য়ে থাকতে আমার ভালোই লাগতো।

আমাদের মা কিন্তু একটু অন্য দিকে আমাদের দক্ষ করতেন চাইতেন। যখন আমার কেবল ছয় বছর বয়স তখন তিনি আমাকে ব্যালে ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
ছোটবেলা থেকেই সংস্কৃতির যে কোনো ভাল দিক শেখার গভীর আগ্রহ আমার ছিল, কিন্তু প্রায় ষোল জন মেয়ের মধ্যে আমরা দু’এক জন ছেলে ব্যালে শিখবো, এ বিষয়টা আমার বালক মনের অহংবোধে বাধছিল। যদিও আমার মা এবং আমার ব্যালে শিক্ষক আমাকে ব্যালের টাইট পোষাক পরার পরিবর্তে সাধারণ প্যাণ্ট পরে ব্যালে ক্লাস করার অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু আমার জন্য সেটা যথেষ্ট ছিল না। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে জোর করে ব্যালে ক্লাসে ঢুকানো আমার মোটেই ভালো লাগতো না।
অবশেষে একদিন এই অপছন্দের বিষয়টা থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। সেদিন একটা ঘটনা ঘটেছিল। ব্যালে ক্লাসে আমি যাবো না, কিন্তু মা আমাকে জোর করে নিয়ে যাবেন। মা এক সময় এক রকম জোর করেই আমাকে ঘর থেকে বের করছিলেন, ২৪ সাসেক্সের দরজা দিয়ে যখন আমাকে বের করা হচ্ছিল, তখন আমি দুই হাত দিয়ে দরজাটা ধরে পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করে দিয়েছিলাম। আমার এই অবস্থা দেখে রেলিং রঙ করা এক মিস্ত্রী মায়ের দিকে এগিয়ে এসে বিনয়ের সাথে বলেছিলেন, লেডি, ও যখন চাচ্ছেই না, তখন ব্যালে ক্লাস থেকে কিছুদিনের জন্য তাকে একটু মুক্তি দিন। সেই রঙ মিস্ত্রীর কথায় কাজ হয়েছিল। সেই দিন আমি মায়ের সাথে ব্যালে ক্লাসে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেটাই ছিল আমার শেষ যাওয়া।

যদিও আমাদের বাবা ও মা দু’জন মিলে খুবই সুন্দরভাবে আমাদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছেন, কিন্তু তাঁদের নিজেদের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল না। দু’জনের মধ্যে অনেক সময় সামান্য কোনো বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হতো, আর অনেক সময় এই কথা কাটাকাটি’টা ঝগড়ার পর্যায়ে চলে যেত। এই ঝগড়া থেকে তাঁরা কেউ বের হতে পারেন নি, ফলে আমার যখন তের বছর বয়স তখন তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।

তবে আমার মা সব সময়ই স্বীকার করেন, বাবা হিসেবে আমার বাবা ছিলেন অনন্য, তাঁর কোনো তুলনা হয় না। যিনি সবসময় যেভাবেই হোক তাঁর সন্তানদের সাথে সময় কাটানোর জন্য সময় বের করে নিতেন। সত্যি কথা বলতে কি তিনি ছিলেন একজন খুবই আধুনিক পিতা যিনি তাঁর সন্তানদের বেড়ে উঠার প্রতিটি পদক্ষেপ খুব কাছ থেকে দেখতেন আর এই দেখায় এক মহা আনন্দ পেতেন। সেই সাথে আগামী দিনের জন্য তাঁর সন্তানরা কিভাবে সত্যিকারভাবে নিজেদের মতো যোগ্য হয়ে উঠতে পারে, সে ধরনের কাজ করার জন্য তিনি পাগল হয়ে থাকতেন।

মাঝে মাঝে তাঁর এই সন্তান প্রেমের পাগলামী তাঁর ভারিক্কীচালের সহকর্মীদের হতবাক করে দিতো। আমি যখন একেবারে শিশু তখন বাবা হঠাৎ করেই অফিস থেকে বাসায় চলে আসতেন এবং কোট না খুলেই এক রকম দৌড়ে ওপরতলায় যেখানে আমাকে শুইয়ে রাখা হতো সেখানে ছুটে যেতেন। মাঝে মধ্যে আমার প্রতি এই প্রেমের পাগলামী এমন এক পর্যায়ে পৌছতো যে তাঁর মন্ত্রীসভার কোনো এক মিটিং করার জন্য সকলকে ২৪ সাসেক্সের বাসভবনে মধ্যাহ্ন ভোজের দাওয়াত করতেন। আসল বিষয় ছিল আমাকে কাছে পাওয়া। এমন এক মিটিং এ টেবিলের মাঝখানে বেবী সিটে আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। সেই সময়কার বাবার মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী জন টার্নার আমাকে ঐ অবস্থায় দেখে বাবাকে বলেছিলেন, ‘পিয়েরে, দুশ্চিন্তা করো না, বাচ্চা একটু বড় হলে তুমি যে আনন্দ পাবে তা কহতব্য না।’ পরবর্তীতে বাবা যখন এই গল্পগুলো করতেন তখন তিনি জন এর সেই কথার সত্যতা খুঁজে পেতেন। একটা শিশু ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে আর অবাক হয়ে সে তার আশপাশের জগতের সাথে নিজেকে পরিচিত করছে, এই দেখার যে আনন্দ তা বাবা আমাদের দেখে পেতেন। অন্য রকম এক অপার আনন্দ ছিল এগুলো তাঁর কাছে। সত্যি কথা বলতে কি, এর চেয়ে চরম কোনো আনন্দই বাবার কাছে ছিল না। সেজন্য আমাদের জীবনের প্রথম শব্দ শেখা থেকে শুরু করে প্রথম পা ফেলা আর অন্য যত আনন্দের কাজ, সব কিছুর সাথেই তিনি জড়িয়ে আছেন। আমার জীবনে বাবাকে নিয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যত স্মৃতি আছে তার সবকিছুই সুন্দর আর স্বচ্ছ ভালোবাসার। সত্যি বলতে কি, শিশুকালে তিনিই ছিলেন আমার আসল চালক যিনি পরম প্রেমের সাথে আমাকে জীবনপথের সঠিক গন্তব্যে এগুতে শিখিয়েছিলেন।