সাজ্জাদ আলী : সে রাতে বাম হাতের কব্জির ব্যথায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। তখনও বালিশে মাথা, চোখ বুজে আছি। ঘুমের ঘোর কাটেনি। ওই ঘোরের মধ্যেই বুঝতে পারছি ব্যথার ধরণটি অন্য রকম। কেমন যেন চিনচিনে। এমনটা আগে কখনও হয়নি। ওই আধো ঘুমে থেকেই ভাবছি কি করা যায়, কি করা যায়? এমন কিছু হলে তো আম্মাকেই তা বলি। বহুকালের অভ্যাস মতো কখন যেন মাথার কাছে রাখা ফোনটিতে হাত চলে গেল। অটো ডায়াল চেপে দিলাম আম্মার ফোনের নম্বরে। ওপাশে ফোন বেজেই চলেছে। আম্মা ফোন ধরছেন না। অনেকগুলো রিং বেজে ফোনের সংযোগ কেটে গেলো। কী ব্যাপার? এমনটা তো কখনও হয় না! আমি আবারও ডায়াল করতে গেলাম। ঠিক তখন আমার ঘুম টুটলো, ঘোর কাটলো। উঠে বসলাম বিছানায়।

আম্মা আমার ঘনিষ্ট বন্ধু, বলতে গেলে এই জগৎসংসারে একমাত্র বন্ধু। আমাদের বয়সের ব্যবধানও খুব বেশি না, এই সাড়ে চৌদ্দ বা পনেরো বছর হবে। শিশু কালে নিশ্চয়ই তাঁর কোলে চড়েছি। শৈশবে তাঁর আঙ্গুল ধরে হাঁটা শিখেছি। কৈশোরে তিনি আমাকে তাঁর চোখ রাঙানির মধ্যে রেখেছেন। যৌবনে তাঁর আদেশগুলো শিরোধার্য মেনেছি। জীবনের সংকটে, আনন্দে, চড়াই বা উৎরাইতে তার আঁচল ছাড়িনি। যে কোনো সমস্যা, তা হোক ছোট, মাঝারি বা বড়, তিনিই তো সবদিন সামলে দিয়েছেন। আমাকে তো কখনও কিছু নিয়ে ভাবতে হয়নি। অথচ আজ আমার ফোন ধরছেন না। আমি তবে কার কাছে ব্যথার কথাটা বলবো? ডাক্তার হয়তো ব্যথা সারিয়ে তুলবে। অন্য স্বজনরা আমাকে সান্তনা-কথা বলবে। কিন্তু আম্মা ছাড়া আর কেউ তো আমার ব্যথায় কাতরাবে না!

তা প্রায় দুই যুগ আগের কথা, আমি তখন নিউইয়র্কে থাকি। কৈ মাছ খেতে গিয়ে গলায় কাঁটা বিঁধলো। সাথে সাথেই আমার অগতির গতি আম্মাকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, একটুও ভাবিস না, এক্ষুণি তোর কাঁটা বাইর হয়ে যাবে। তুই মুড়ির বোয়েমটা কাছে নিয়া আয়। গাল ভইরা মুড়ি নিয়া আধা চাবাইয়া গিলা ফেল। আর ফোনের লাইন কাটিস না। তোর চাবানোর শব্দ শুনতি শুনতি আমি দোয়া পড়তিছি।

ওরে বাপরে, দোয়ার কি দুর্দান্ত ফজিলত! তিন গাল মুড়ি গিলতেই গলার কাঁটা পেটে নেমে গেলো। সেই থেকে মাছ খাওয়ার সময়ে আমি আর কাঁটা নিয়ে ভাবি না। কিন্তু এখন যে তিনি আমার ফোন ধরছেন না, তবে কি এ জীবনে আমি আর নিশ্চিন্তে মাছ খেতে পারবো না?

তা মাস দুয়েক হয়ে গেল, আম্মা আমার ফোন ধরছেন না। কিন্তু তাই বলে তো তাঁকে ফোন করাটা থামছে না। আসলে আমি তো ইচ্ছা করে ফোন করি না। জীবনের প্রতিদিনকার ঠোকাঠুকিগুলো তাঁকে বলাটা আমার অভ্যাস। কিছু একটা ঘটলেই অবচেতনে আঙ্গুলের ছোঁয়ায় তাঁর নম্বরটি ডায়ল হয়ে যায়। ওই অভ্যাসটি তো মজ্জায় ঢুকে আছে। অন্য সবার তো কথা বলার কত মানুষ থাকে। কিন্তু আমার তো আর কেউ নেই। আমার কথাগুলো কান খাড়া করে শুনবেন, তারপরে হয় সায় দেবেন নয়তো বারণ করবেন। এমন মানুষ তো আমার একজনই।

এই তো ক’দিন আগে গান শুনতে শুনতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। গানে এতটাই মগ্ন ছিলাম যে গাড়ির স্পীড খেয়াল করিনি। তবে আমি খেয়াল না করলেও পুলিশ করেছে। অহেতুক সাইরেন বাজিয়ে, লাল-নীল রঙের বাতি জ্বালিয়ে আমাকে থামালো। তারপর নিজের গাড়ি থেকে নেমে এসে বললো, কেন আপনাকে থামিয়েছি জানেন?
বললাম, মনে তো হচ্ছে অকারণেই। তো আপনিই বলুন, কেন আমার চলায় বিঘ্ন ঘটালেন?

স্পীড চেকার মেশিনটি আমার চোখের সামনে ধরে বললো, ৫০ কিলোমিটার জোনে আপনি ৬২ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ড্রাইভিং লাইসেন্সটি দিন তো। আর গড়িতেই অপেক্ষা করুন। আমি আমার গাড়িতে বসে টিকিট লিখে আবার ফিরে আসছি।

এই পুলিশ বেটি এখন আমার নামে মামলা লিখবে। অন্তত তিন’শ ডলার জরিমানা গুনতে হবে। আর আমার ড্রাইভিং রেকর্ডে লালকালির একটা মোটা দাগ পড়বে। এই পচা ব্যাপারটায় খুবই মন খারাপ হলো। এই ঘটনাটা আম্মাকে বলবো বলে ফোন করলাম। ঠিক ইচ্ছা করে নয়, অবচেতন মনেই অভ্যাস মতো ফোনটা করে ফেলেছি। আজও আম্মা ফোন ধরছেন না। দুই একটা রিং বাজার পরেই আমার হুঁশ ফিরলো। লাইনটি কেটে দিয়ে মামলার কাগজ বুঝে নেবার জন্য চুপচাপ বসে রইলাম। কী আর করবো? এ সব ঝামেলা শোনার তো আর আমার কোনো লোক নেই!

কঁচুর মুখি দিয়ে পাবদা মাছের মাখোমাখো ঝোল আমার বেজায় পছন্দের তরকারি। দেশে যাবো, এটা জানতে পারলেই আম্মা মুখি কিনতে নিজে বাজারে যাবেন। তাঁর বাঁধা তরকারিওয়ালকে দিয়ে রংপুর থেকে কঁচুর মুখি আনাবেন। সেখানকার মুখি নাকি দেশ সেরা। এরপরে তা রেঁধে আগে নিজে খাবেন। মুখিতে গাল ধরে কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখবেন। মুখি যদি পরীক্ষায় পাশ করে তো সাথে সাথে আমাকে ফোন করবেন। গদগদ হয়ে বলবেন, জানিস, এইবারের কঁচুর মুখিগুলো একেবারে ডাঁসা ডাঁসা। ক্ষেত থেকে কেবলি উঠানো। হালকা একটা মিস্টি স্বাদ আছে। এ কথা শুনে আমার তো জিভে জল! দেশে যাবার দিন প্লেনে চড়ে বসার ঠিক আগে আমি ফোন করে বলি, আম্মা, কাল দুপুরে এসে পৌঁছাবো। পাবদা আর মুখি তরকারির ঝোল দিয়ে ভাত খাবো কিন্তু।

আমি আবার যখন দেশে যাবো, এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করলে আম্মা যদি ফোন না ধরেন! তবে আমার মুখি তরকারি খাওয়ার কী হবে?
বিয়ের বয়স পেরিয়ে যায়, তবুও আমার ছেলেটা একটা মেয়ে জোটাতে পারে না। আবার আমরা জুটিয়ে দেবো, তাও সে মানবে না। এ নিয়ে মহা বিপাকে আছি। দুএকটা মেয়ের সাথে সে চা-কফি খেয়েছে বটে, কিন্তু তাদের বর্ণ-গোত্র আমার পছন্দ নয় বলে ছেলেকে ধমকে দিয়েছি। মাস দুয়েক আগে হঠাৎ অসময়ে আম্মার ফোন এলো। অসময়ে মানে আমার দুপুর গড়িয়েছে, কিন্তু আম্মার তো তখন গভীর রাত! তিনি তো রাত জাগেন না। বললাম, আম্মা, আপনি এত রাত অব্দি জেগে আছেন যে?

এই তো তোর সাথে কথা কইয়াই ঘুমাতে যাবো। শোন, তোর ছেলে এরপরে যারে পছন্দ করবি, তার সাথেই ওর বিয়া ঠিক করবি। আর সাথে সাথেই আমারে ফোন কইরা সেইডা জানাবি। খবরদার, এর যেনো কোনো নড়চড় না হয়। তোর মনে আছে তো, তোরা পছন্দের বিয়ায় আমি বাধা দিছিলাম না?
জ্বি আম্মা, মনে আছে। আচ্ছা, তাই করবো। আপনি এখন ঘুমান।
আমি বড়ই চিন্তায় পড়েছি, যেদিন আমার ছেলেটার বিয়ের খবর দিতে আম্মাকে ফোন করবো, সেদিনও যদি তিনি ফোন না ধরেন! যদি তাঁর ঘুম না ভাঙ্গে?
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডার প্রধান নির্বার্হী)